নিজের মৃত স্ত্রীকে সাত মাস পর চোখের সামনে জীবিত অবস্থায় দেখে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল ইরফানের। এটাও কি সম্ভব? সাত মাস আগে এক ঝুম বৃষ্টির দিনে যার কবরে মাটি দিয়েছে সে, আজ কীভাবে সেই মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! মৃত্যুর পর কি কেউ ফিরে আসতে পারে? সে কি ভুল দেখছে! আদৌও কি হামনার ফিরে আসা সম্ভব! সে তো মারা গেছে।
—————————————————

“মাম্মী! পাপা, মাম্মী। পাপা ওইযে মাম্মী।”

কথাগুলো বলেই আয়াম ইরফানের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে চলে গেল। ওর হাতের আইসক্রিমটা নিচে পড়ে গেছে। ইরফান আয়ামকে স্কুল থেকে নিতে এসেছে। ওরা আইসক্রিম শপে ঢোকার পরপরই হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। আইসক্রিম নিয়ে কোনরকমে বিল দিয়ে গাড়ির দিকে দৌড়ে আসছিল বাপ ব্যাটা। আর ঠিক তখনই আয়াম কাকে দেখে যেন কথাগুলো বলল। ইরফান ছেলের উপর বিরক্ত হল, এভাবে রোডের মাঝ দিয়ে দৌড়ায় কেউ? ভাগ্য ভালো রাস্তায় কোন গাড়ি নেই।
বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। এই হঠাৎ বৃষ্টিতে রাস্তার সবাই আশেপাশের দোকানের বারান্দায় আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছে। ইরফান ভিজে ভিজেই আয়ামের দিকে হাঁটতে লাগল। ছেলেটা মাঝে মাঝে যা কাণ্ড করে না। ইরফান ওকে কীভাবে বুঝাবে যে, ওর মাম্মী এখানে আসতে পারবে না।
.
মেহরীন নাচের ক্লাস শেষ করে বাসার দিকে রওনা দিয়েছিল মাত্র। তার রাস্তার বের হতে দেরি হয়নি সাথে সাথেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টি মেহরীনের ভীষণ প্রিয়। তাই বলে এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধালে চলবে না। আর এই মাঝ রাস্তায় এতগুলো লোকের সামনে বৃষ্টির মজা উপভোগ করতে পারবে না। তাই সে-ও বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য বাকি সবার মত দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু বড় বড় ফোঁটায় এত সুন্দর করে বৃষ্টি হচ্ছে যে,ভেজার লোভ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। মেহরীন দু’পা সামনে এগিয়ে এসে বৃষ্টিতে হাত মেলিয়ে দিল। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো হাতে স্পর্শ হতেই অন্যরকম এক ভালোলাগা মন ছুঁয়ে গেল। মেহরীন চোখ বুঁজে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি নিয়ে খেলা করছে। আর ঠিক তখনই রাস্তার ওপাশ থেকে চার/পাঁচ বছরের একটা ছেলে ভিজে ভিজে দৌঁড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল।

“মাম্মী! তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে মাম্মী? আমি, পাপা তোমাকে অনেক মিস করেছি। তুমি কেন গিয়েছ মাম্মী? তুমি জানো না, তোমাকে ছাড়া থাকতে পাপার, আমার, দাদুর সবার কষ্ট হয়। তুমি আমাদের ছেড়ে আর যাবে না। আমি তোমাকে যেতে দেব না।”

মেহরীন কিছুই বুঝতে পারছিল না। অবাক হয়ে সে শুধু ছেলেটার কথা শুনছিল। এই ছেলেকে সে চেনে না, জানে না, আগে কোনদিন দেখেওনি। তবুও এই ছেলে তাকে মাম্মী ডাকছে কেন! ছেলেটার ছোট্ট হাত দু’টো ওকে আঁকড়ে ধরে কাঁপছিল। মেহরীন ওকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারল না। সে বিস্ময় কাটিয়ে উঠে আশেপাশে দেখল। এই ছেলের বাবা, মা কোথায় আছে। এখনও ছেলেটা ওকে “মাম্মী” “মাম্মী” ডেকে যাচ্ছে। হঠাৎ করে ছেলেটার প্রতি ভীষণ মায়া লাগল ওর। সে ওর মাথায় হাত রেখে সস্নেহে বলল,

“দেখি বাবা, এদিকে তাকাও। আমার দিকে তাকা না একটু সোনা। কোথায় তোমার মাম্মী? ও বাবু, তাকাও আমার দিকে।”

মেহরীন হাঁটু গেড়ে আয়ামের সামনে বসেছে। ওর গালে হাত রেখে বলল,

” এইতো বাবা, লক্ষী সোনা। আমাকে বলো তোমার মাম্মী কোথায়?”

আয়াম দম নিতে নিতে বলল,

“তুমিই আমার মাম্মী।”

আয়ামের কথা শুনে মেহরীন হকচকিয়ে গেল। বলে কী এই ছেলে! সে ওর মাম্মী হবে কীকরে? তার তো এখনও বিয়েই হলো না। বিয়ে আগেই স্বামী ছাড়া এত বড় ছেলে এলো কোত্থেকে! মেহরীন হাসার চেষ্টা করে বলল,

“কী বলছিস বাবা! তোর এসব কথা শুনলে এই জীবনে আমার আর বিয়ে হবে না। এমনিতেই অনন্ত বিয়ের কথা শুনেই ক্ষেপে যায়। ছয় মাস ধরে বলেও ওকে রাজি করাতে পারছি না। আর তুই আমাকে মাম্মী ডাকছিস। এরকম করিস না, বাপ। নিজের আসল বাপ মা’র কোলে ফিরে যা মানিক আমার।”

শেষের কয়েকটা কথা সে নিজেকে বলে আবার রাস্তার দিকে দেখল। এর বাপ মা কোথায় রয়ে গেল।
এতক্ষণে ইরফান রাস্তা পেরিয়ে চলে এসেছে। আয়ামকে ডাকতে ডাকতে সামনের দিকে তাকিয়ে যা দেখেছে তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। হামনা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ামের সাথে কথা বলছে সে। কয়েক মুহূর্তের জন্য ইরফান ধমকে দাঁড়াল। হামনা! সে সত্যিই কি হামনাকে দেখছে! এটা কী করে সম্ভব? হামনা এখানে কীভাবে আসবে? আয়াম ভুল দেখেছে। সে নিজেও কি তাহলে ভুল দেখছে! এইতো হামনা তার চোখের সামনের আছে। এটা কীকরে মিথ্যা হতে পারে। ইরফান কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেল।

মেহরীন সামনের লোকটাকে দেখে বুঝল ইনিই নিশ্চয়ই এই ছেলের বাপ। চেহারা মিলে যাচ্ছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত হেসে বলল,

“ও আপনার ছেলে?”

ইরফান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অস্পষ্ট স্বরে ইরফান উচ্চারণ করল,

“হামনা!”

“ও মনে হয় আমাকে তার মা…

কথা শেষ করতে পারল না মেহরীন। তার আগেই লোকটা ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দুই হাতে ওর গাল চেপে ধরে পাগলের মত কপালে, চোখে, গালে চুমু দিয়ে যাচ্ছে। মেহরীন চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেল। লোকটা পাগল নাকি অন্য কিছু! হুট করে তাকে এভাবে চুমু খেয়ে যাচ্ছে কেন! মেহরীন সমস্ত শক্তি দিয়ে লোকটাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এই গন্ডার লোকের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। তার কান্না পাচ্ছে। এতক্ষণে আশেপাশের লোকজন উৎসুক নজরে ওদেরকে দেখছে। মেহরীন বুঝতে পারছে না তার এখন কী করা উচিত। কে এই লোক? তার সাথে এমন ব্যবহার করার কারণ কী? ধাক্কা দিয়ে মেহরীন ইরফানকে ছাড়িয়ে নিল। চিৎকার করে বলে উঠল,

“পাগল আপনি? আপনি কে হ্যাঁ? আপনার সাহস হলো কি করে আমাকে…

রাগে দুঃখে বাকি কথাগুলো বলতে পারল না মেহরীন। তার চোখে পানি চলে এসেছে। বাঁ হাতে গাল মুছতে মুছতে সে কেঁদেই ফেলল। তাদেরকে ঘিরে ছোট একটা ভীড় জমে গেছে। সবাই কেমন করে ওকে দেখছে। রাগে, লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার।

মেয়েটা ওকে ধাক্কা দেওয়ার পর টলে ওঠে ইরফানের মনে পড়ল, সাত মাস আগে এমনই বৃষ্টির দিনে নিজের হাতে হামনার কবরে মাটি দিয়েছে সে। হামনা মারা গেছে। সে আর এই পৃথিবীতে নেই। হামনা আর কখনও ওদের মাঝে ফিরে আসবে না। এই মেয়ে হামনার মত দেখতে হলেও হামনা না। নিজের উপর রাগ হলো ওর। সাথে সাথে নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিতও হলো।

ইরফান দূরে থেকে মেয়েটাকে হামনা ভেবে ভুল করছিল। কিন্তু কাছে এসে ওর কন্ঠ শুনে মনে হল, এটা হামনাই। নইলে একজনের ফেস, ভয়েস হুবহু আরেকজনের সাথে কীভাবে মিলবে! এটা নিশ্চয়ই কো-ইন্সিডেন্ট হতে পারে না। সাত মাস পর নিজের মৃত স্ত্রী হামনাকে চোখের সামনে দেখেছে সে। যাকে সে পৃথিবীর সবথেকে বেশি ভালোবাসে। সে জীবিত আছে বুঝতে পেরে, এই সময় কীভাবে সে নিজেকে সামলে রাখত?
মাথা নিচু করে অপরাধী গলায় ইরফান বলল,

” দুঃখিত। আসলে আমি আপনাকে…

সে কথা শেষ করার আগেই মেহরীন ঝাঁঝিয়ে উঠল,

“কিসের দুঃখিত! আপনার দুঃখ দেখে আমি কী করব এখন? যা করার আপনি তো এতগুলো লোকের সামনে করেই ফেলেছেন। এখন আপনার এক সরি কেন, বস্তা বস্তা সরি নিয়ে কি আমার ইজ্জত ফিরে পাবো? আপনি আর আপনার ছেলে কি পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছেন? আশ্চর্য! হঠাৎ করে এই ছেলে ‘মাম্মী’ ‘মাম্মী’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আর আপনি কী না কী ভেবে এই কাজটা করেছেন তা আপনিই জানেন। ঘরে বউ নেই আপনার? সে এসব জানতে পারলে আপনার সাথে কী করবে ভাবতে পারছেন! নাকি এই বাচ্চাটাকে ছেলে সাজিয়ে নিয়ে ধান্দায় নেমেছেন?”

রাগে গজগজ করে মেহরীন এতগুলো কথা বলে ফেলেছে। ইচ্ছে তো করছে ঠাটিয়ে লোকটার গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু সে যে, কারো গায়ে হাত তুলতে পারে না। কারো গায়ে হাত তুলার শিক্ষা সে পায়নি।

ইরফান লাল লাল চোখে মেয়েটার দিকে তাকাল। প্রচন্ড রাগ হলেও কিছু বলল না সে। সব দোষ তার। মেয়েটার কথা শোনা তার প্রাপ্য। মেয়েটা এখন তাকে চড় মারলেও তার কিছুই করার ছিল না। সে নিজে এত বড় ভুল করলো কীভাবে! হামনাকে অন্য একটা মেয়ের সাথে গুলিয়ে ফেলে, সে মেয়েটাকে কিস করে বসে আছে! এটাই তার ভালোবাসা! সে তার নিজের স্ত্রী আর অন্য একটা মেয়ের মধ্যে তফাত খুঁজে পেল না!
মেহরীনের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে আয়াম বলল,

“মাম্মী তুমি পাপাকে বকছো কেন? তুমি জানো পাপা তোমার জন্য কত কাঁদে। তুমি এক্ষুনি পাপাকে সরি বলো। নইলে আমি তোমার সাথে কথা বলব না। তুমি ব্যাড মাম্মী। তুমি পাপাকে বকেছ। তুমি ভালো না।”

মেহরীন নিজের জ্বালায় বাঁচে না। এখন আবার নতুন করে এই দুই বাপ ব্যাটার ফাঁদে পড়েছে। সে ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,

“ছাড় তো বাবা। আমি তোর মাম্মী টাম্মী না। আমি তো তোদেরকে আজই প্রথম দেখছি। আগে কোনোদিনও তোদের দেখিনি, আমি কীভাবে তোর মাম্মী হব?”

ইরফান আয়ামের হাত চেপে ধরে বলল,

“চল বাবা। বাড়ি যাবি।”

আয়াম বাধা দিয়ে বলল,

“না। মাম্মীকে না নিয়ে আমি যাব না। পাপা তুমি মাম্মীকে আমাদের সাথে যেতে বলো। মাম্মীকেও বাসায় নিয়ে চলো। প্লিজ পাপা, প্লিজ।”

মেহরীনের দিকে তাকিয়ে ইরফান চাপা গলায় বলল,

“এটা তোর মাম্মী না।”

“না। এটাই আমার মাম্মী। আমি মাম্মীকে চিনি। তুমি মিথ্যে বলছো পাপা। এটাই আমার মাম্মী।”

ইরফান যাবার আগে আর একবার মেহরীনকে সরি বলে গেল। আয়ামের হাত ধরে ওকে টানতে টানতে চলে গেল সে।
মেহরীন সব রাগ ভুলে গিয়ে আয়ামের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। এখনও ওকে মাম্মী মাম্মী বলে ডাকছে। ওকে ছাড়া যেতে চাইছে না। ওকেও সাথে নেবার জন্য বায়না করছে। ওরা রাস্তা পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখান থেকেও মেহরীন শুনতে পাচ্ছে ছেলেটা চিৎকার করে বলছে,

“মাম্মী, মাম্মী তোমাকে রেখে আমি যাব না। তুমিও আমার সাথে চল। তুমি পাপার সাথে রাগ করেছ কেন মাম্মী? মাম্মী…

আর শোনা যাচ্ছে না। আশেপাশের লোকজন এতক্ষণ বিনা টিকিকে ওদের দৃশ্য দেখা মজা নিচ্ছিল। ছেলেটাকে ওর বাবা নিয়ে চলে যাবার পর আস্তে আস্তে লোকগুলোও চলে যাচ্ছে। মেহরীন খেয়ালই করেনি এতক্ষণে বৃষ্টিও কমে গেছে। তবে পুরোপুরি থামেনি। এই ঝিরঝির বৃষ্টিতেই মেহরীন রাস্তায় নেমে গেল। হঠাৎ করে কিছুই ভালো লাগছে না তার। কেনই যেন কান্না পাচ্ছে। আর ওই ছেলেটার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। তাকে জড়িয়ে ধরে ছেলেটা কাঁপছিল। যাবার আগেও তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ছেলেটা কি তাকে নিজের মা ভাবছে? আচ্ছা তাকে যদি ছেলেটা ওর মা ভেবে থাকে, তাহলে ওই ছেলের আসল মা কোথায়? ওর আসল মায়ের চেহারা কি তার সাথে মিলে? নইলে কেন ওকে দেখে মাম্মী বলে ভুল করবে। ওই ছেলের মা বেঁচে আছে? নাকি মারা গেছে?
ছেলেটা ছোট, সে ভুল করেছে ঠিক আছে। কিন্তু ওই লোকটা? ওই লোকটা কেন হঠাৎ করে এমন কাজ করল। ওই লোকও কি তাকে নিজের স্ত্রী ভেবেছিল? লোকটা তো মনে হয় স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসে। সে-ও কেন একই ভুল করলো?
ইশশ, চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে ওর। এখন এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কোনভাবেই পাবে না সে। কিন্তু প্রশ্ন গুলোর উত্তর জানার ভীষণ ইচ্ছে করছে তার।

#মেঘের_আড়ালে_মেঘ”১”
#জেরিন_আক্তার_নিপা
চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here