স্বীকৃতি
পর্ব_৫
#Saji_Afroz
.
.
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এলো খুশি।
আরাম কেদারায় বসে গল্পের বই পড়ছে সে।
মাঝেমাঝে চোখ যাচ্ছে তার অনন্তদের বাড়ির উঠোনে। এখান থেকে সবই দেখা যায় বাড়ির ভেতরের অংশ ছাড়া। অনন্ত প্রতি সকালে ঘুম থেকে উঠে উঠোনে আসে। তবে হাটাহাটি করতে নয়। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করে করে সিগারেট খেতে। যদিও অনন্তের সিগারেটে এতো আসক্ত নয়। তবুও সকাল বেলায় না খেলে যেনো সারাদিন ভালোই কাটেনা তার।
তার এই অভ্যেস্যের কথা খুশি আর খুশবু ছাড়া কেউ জানেনা। কেননা কাক ডাকা ভোরে দুই বাড়ির কেউই ঘুম থেকে উঠে উঠোনের দিকে আসেনা।
খুশবু আর অনন্তের অভ্যেস এসব। খুশবু ছাদে হাটাহাটি করতো বই পড়তে পড়তে আর অনন্ত বাড়ির উঠোনে। খুশবুর কাছেই খুশি শুনেছিলো, অনন্তের এই অভ্যেসের কথা। সেই দিন থেকে খুশিও ভোরে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় আসে।
বই পড়ার নাম করে আড়চোখে অনন্তকে দেখে সে। আর আপনমনে বলে, সিগারেটের ধোঁয়া উড়ানোর সময়ও একটা ছেলেকে এতো ভালো লাগে কেনো?
.
অনন্তের অপেক্ষা করতে করতে হাজির হলো সে।
উঠোনে থাকা কাঠের চেয়ার গুলোর মাঝে একটিতে বসে, সিগারেটে আগুন ধরালো।
একটু পরেই খুশি খেয়াল করলো, বাড়ি থেকে বের হচ্ছে অনন্তের মা। একবার অনন্তকে ডাক দিতে চেয়েও দিলোনা খুশি। মায়ের কাছে সিগারেট খেতে ধরা পড়লে অনন্তের যে কি হাল হবে ভেবেই আনন্দ পাচ্ছে সে।
এদিকে অনন্ত তার মাকে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাতে থাকা সিগারেট টি পেছনে ছুড়ে ফেলে এগিয়ে গেলো মায়ের দিকে। বেশ দুরত্ব বজায় রেখেই অনন্ত বললো-
-এতো সকালে তুমি?
-দরজা খোলা দেখে আসলাম।
আমারো আজ ইচ্ছে হলো উঠোনে হাঁটতে।
-কিন্তু আমার যে ইচ্ছে করছে তোমার হাতের এক কাপ চা খেতে।
-ওমা তাই! আমি এখুনি করে দিচ্ছি।
.
মা যদি পাশে থাকতো নিশ্চয় গন্ধেভরা মুখের অবস্থায় বুঝে ফেলতো সে কি করছিলো! তাই কৌশলে এখান থেকে মাকে সরালো অনন্ত।
আগের জায়গায় এসে পকেট থেকে একটা চকোলেট বের করে মুখে দিয়ে, সেই চেয়ারটিতেই বসে পড়লো অনন্ত। পরক্ষণেই এক লাফে উঠে দৌড়াতে লাগলো সে।
অনন্তের এমন অবস্থা দেখে খুশি হাসতে হাসতে বারান্দায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো।
খুশির হাসির শব্দ শুনে তার বারান্দার সামনে এসে অনন্ত বললো-
কি বুঝে হাসছো তুমি?
-তুমি যে তখন তাড়াহুড়ো করে সিগারেট টা চেয়ারের উপরে ফেলেছিলে সেটা তুমি না দেখলেও আমি দেখেছি। এখনও না দেখেই বসে গেলে জলন্ত সিগারেটের উপরে। আন্টিকে বোকা বানানোর শাস্তি পেলে।
.
কথাটি বলেই হাসতে লাগলো খুশি।
অনন্ত রেগেমেগে বললো-
দিবো এখন কানের নিচে একটা। খুশবু থাকলে কখনো এমন করতো না। আমাকে ডেকে বলতো সিগারেট টা ওখানে আর মায়ের কাছ থেকেও বাঁচাতো আমাকে। কেউ বলবেনা তুমি খুশবুর বোন।
.
অনন্তের রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে ছলছল করে উঠলো খুশির দুচোখ। মুখটা ভার করে সে নিজের রুমে ঢুকে গেলো।
অনন্ত চেঁচিয়ে বললো-
লজ্জা থাকলে আমার সামনে আর আসবেনা তুমি।
.
.
.
আরহাম এসে আফসানার দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললো-
ছেলেটিকে আসতে বল। তার সাথে কথা বলি। যার তার হাতে তো আর বোন তুলে দিতে পারবোনা না।
.
ভাই এর কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে আফসানা বললো-
এখুনি বলছি।
.
একটু থেমে আফসানা আবার বললো-
কিন্তু মা বাবা?
-তাদের বোঝানোর দায়িত্ব আমার। তুই ছেলের মা অথবা বাবাকেও সাথে নিয়ে আসতে পারবি।
.
.
আরহাম রুম থেকে বেরুনোর পরে বেশ কয়েকবার তার ফোনটা বেজে উঠেছে।
আবারো বেজে উঠলে খুশবু বিরক্তি প্রকাশ করে নিজের মনে বললো-
নিজের ফোনটা সাথে নিয়ে যেতে পারেনি লোকটা?
.
সাইলেন্ট করার জন্য মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখলো তার মায়ের ফোন। তার মা আরহামের মোবাইলে কেনো ফোন দিচ্ছে?
.
খুশবু রিসিভ করে বললো-
হ্যালো?
.
খুশবুর গলার স্বর শুনে খালেদা শারমীন স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন-
ভালো আছিস?
-হু।
-আরহাম কে একটা কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি।
-উনি তো রুমে নেই এখন।
-তোকে এখানে নিয়ে আসার জন্য বলতে চাইছি।
-কেনো?
-কেনো মানে? বিয়ের পরে স্বামী নিয়ে মেয়েদের বাসায় দাওয়াত খেতে আসতে হয়। থাকতে হয় কিছুদিন।
-এসব কিছুই আমি করবোনা।
-কেনো?
-তোমাদের সব কথা শোনা সম্ভব নয় আমার।
.
দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে খালেদা শারমীন বললেন-
ছেলেটাকে কষ্ট দিস না। বড্ড ভালো ছেলে। সংসারে মন বসাতে চেষ্টা কর। সব ভুলে যাবি।
.
মায়ের কথাটি শুনে ঢুকতে কেঁদে উঠলো খুশবু।
ওদিক থেকে শান্তনা পেয়েও যেনো শান্ত হচ্ছেনা তার মন।
কাঁদতে কাঁদতেই সে বললো-
চিন্তা করোনা মা। তোমাদের সম্মানহানী হয় এমন কোনো কাজ আমি করবোনা। সংসারেও মন দেয়ার চেষ্টা করবো। শুধু একটু দোয়া করো আমার জন্য। আমি যেতে পারবোনা ও বাড়ি এখন। যেখানে এসেছি ওখানেই মনটা বসাতে চাই।
.
ফোনের লাইন কেটে বিছানায় বসে পড়লো খুশবু।
পেছন থেকে সবটা শুনে আরহামের চোখের কোণেও যেনো পানি চলে এলো।
ফারাজ নামক ছেলেটিকে কি অনেক বেশিই ভালোবাসে খুশবু?
আরহামের কষ্ট হচ্ছে আবার রাগও হচ্ছে। ভালোবাসবেই যদি তার জীবনে কেনো এসেছে সে? এতো সহজে নিজের ভালোবাসা কে ফেলে অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেললো!
রাগ হলেও খুশবুর কান্নামিশ্রিত মুখটি দেখে তাকে কিছুই বললোনা আরহাম। এখন আপাতত বোনের বিষয়টা নিয়েই মাথাটা ঘামাতে চায় সে।
.
.
.
ড্রয়িংরুমে মুখোমুখি বসে আছে বকুল জান্নাত ও সাদেকের মা।
আফসানা, সাদেক ও আরহামও রয়েছে।
বকুল জান্নাত বললেন-
মেয়ের খুশির জন্য আপনাদের ডাকিয়েছি।
.
সাদেকের মা বললো-
ছেলের খুশির জন্যই এসেছি।
-আমার কিন্তু এমন একটা ছেলেকে মেয়ে দেয়ার ইচ্ছে নেই। সাদেক এখনো ছোট বাচ্চা। আরো বড় হোক, কিছু করুক তারপর সব ভাবা যাবে। এখনো কথা দিতে পারছিনা।
-আমিও কথা নিতে আসিনাই। যদিও সাদেক আমার বড় ছেলে। তবে ওকে এখন বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে আমারো নেই। অনেক স্বপ্ন আমার। তবে ও বড় কিছু হলে আফসানা কেই কেনো বিয়ে করতে হবে! অন্য কোনো ভালো মেয়েকেই পারবে।
-আফসানা কি ভালো নয়?
-হয়তো ভালো। কিন্তু আমি বউ হিসেবে যেমন এক্সপেক্ট করেছি তেমনটাও নয়। আমার সাদেকের জন্য তো এখন থেকেই মেয়েরা লাইন ধরে আছে।
-আমার মেয়ের জন্যও আছে ছেলেরা।
-দেখে তো মনেহয় না। কি দেখে সাদেক ওকে পছন্দ করলো ভেবেই পাচ্ছিনা। নেহাত ওর খুশির জন্য এখানে আমার আসতে হয়েছে। নাহলে ওর জন্য অন্যরকম একটা ভবিষ্যৎ ভেবে রেখেছি আমি। ছেলেতো বুঝলোনা, এসব মেয়েরা কি কি করতে পারে। আমার তো মনেহয় আফসানা ওর বয়সেও বড় হবে। ওর জন্য আমার সাদেকের মতো কমবয়সী ছেলে আসলেই মানানসই নয়।
.
বোন সম্পর্কে এমন কথা শুনে আরহাম রাগে ফুসতে লাগলো।
পেছন থেকে আফসানার বাবা সাদেকের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন-
তোমার মা যে আফসানার সম্পর্কে এমন কথা বলছে, কিছু বলার নেই তোমার?
.
সাদেক কিছু বলার আগেই তার মা বলে উঠলেন-
বিয়েই এখনো হয়নি। আমার ছেলেকে আমার বিরুদ্ধেই উস্কাতে চায়ছেন? কেমন মানুষ আপনারা?
.
সাদেকের দিকে তাকিয়ে আফসানা গলার স্বর নিচু করে বললো-
সাদেক? আন্টিকে থামতে বলো। কি বলছেন এসব উনি? উনি আমার বাবা।
-বড়রা কথা বলছেন আমি কি বলবো!
.
এভাবে দুই দলের মাঝে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে সাদেকের মা বললেন-
এমন একটা পরিবারের মেয়ে আমার বউ হয়ে আসুক আমি চাইনা সাদেক। কয়েকমাসের ভালোবাসার জন্য তুই আমার কথার অমান্য করবি? সুখী হতে পারবি এভাবে? কদর পাবি এখানে? কখনো না। এখুনি চল আমার সাথে। ভেঙ্গে দে এই সম্পর্ক।
.
আফসানা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাদেকের দিকে।
সাদেকের নজর তা না এড়ালেও মনটা ঘামলোনা। কড়া গলায় বললো-
বাবা নেই আমার। মা আমার সব। সম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখেয়েছে মা আমাদের দুই ভাইকে। তোমার সাথে জড়ালে অসম্মান ছাড়া কিছুই পাবোনা। দুঃখিত আমি। আমাদের সম্পর্ক এইখানে শেষ।
.
.
.
খুশবুর বুকে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে আফসানা।
খুশবু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো-
এখন সব ভুলে ভাগ্য মেনে নেয়াটাই হবে তোমার জন্য মঙ্গলজনক।
.
খুশবুকে ছেড়ে আরহামের দিকে তাকিয়ে আফসানা বললো-
ফাহিম ভাইয়ার সাথেই বিয়ের ব্যবস্থা করো আমার।
.
কথাটি বলে আফসানা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
আরহামের দৃ্ষ্টি আটকে আছে খুশবুতে। তার চোখে মুখে হারানোর ভাবটা স্পষ্ট। তবে কি খুশবুর সাথেও আফসানার মতোই কিছু হয়েছে? নিশ্চয় তাই…. তাইতো সে সংসারে মন দিবে বলেছে তার মাকে।
খুশবু যদি সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে চায়, তার কি উচিত নয় তাকে সাহায্য করা?
অহেতুক অতীত টেনে এনে লাভ টা কি? এতে তিক্ততা ছাড়া কিইবা বাড়বে? ছেলেটি যদি সত্যিই খুশবুকে ভালোবাসতো, তাহলে নিশ্চয় তাকে ছবিটি পাঠাতো না।
হুম, আরহাম কোনো প্রশ্ন করবেনা খুশবুকে। আফসানার মতো খুশবুও ভুল মানুষকে বেছে নিয়েছিলো ।
আরহাম বুঝতে চায় তাকে। বিয়েটা যখন হয়েছেই একটা সুযোগ দিতে সমস্যা কি? বিয়ে তো আর খেলা না!
একজন ভালো মানুষের সাথে সর্বদা থাকলে একজন মন্দ মানুষও একদিন ভালো হয়, কথাটি সত্য। আর সেই ভালো মানুষটি যদি জীবনসঙ্গী হয়, তাহলে তো কথাই নেই! আরহাম ভালো মানুষ কিনা তার জানা নেই। তবে সব মানুষের মাঝেই ভালোমন্দ মিশ্রিত। কারো ভালো দিক বেশি, মন্দ দিক কম। আবার কারো ভালো দিক কম, মন্দ দিক বেশি। সেই হিসেবে আরহামের মতে তার ভালো দিকটা বেশি। সেই ভালো দিকটা দিয়ে কি সে খুশবুর সকল দুঃখ ঘুছিয়ে দিতে পারেনা? কঠোর স্বামী হবার কি খুব বেশি প্রয়োজন? মোটেও না। একটা সুযোগ দিতেই পারে সে খুশবুকে এই সংসারে মন দিতে। খুশবু কি পারবে সব ভুলে গিয়ে আরহাম কে মেনে নিতে?
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here