মেঘের_আড়ালে_মেঘ”৬”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

হুমায়রা কট করে কল কেটে দিল। ওর বুক ধুকপুক করছে। হার্টবিট দ্রুত কাজ করছে। সে যে কথাটা বলার জন্য অনন্তকে কল করেছিল। সেই কথাটাই বলতে পারল না। আজ সে অনেক খুশি। তার দু’টা কারণ। এক, অনন্ত দুপুরে খেতে এসেছিল। দুই, অনেক দিন পর আয়াম আজ তার কাছে আছে। দুই হাতে মুখ ঢাকল হুমায়রা।

“হুমায়রা তুই একটা পাগল! এত কিসের ভয় তোর? না, না ভয় না। লজ্জা, এত কিসের লজ্জা তোর? ওর সাথে তোর এনগেজমেন্ট হয়েছে। দু’দিন বাদে লোকটার সাথে তোর বিয়ে হবে। এখনও এত লজ্জা পেলে চলবে, হ্যাঁ? ওর সামনে ঠিকমত দু’টা কথা বলতে পারিস না। হাত পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে যায় তোর। তুই সত্যিই একটা অপদার্থ। তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।”

হঠাৎ কাঁচা ঘুম ভেঙে দেওয়ায় অনন্তর মেজাজ বিগড়ে গেল। ফাজিল মেয়ে মাঝরাতে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?( ব্যঙ্গ করে বলল অনন্ত)
না, আমি এত রাতে ঘুমাব কেন? আমি তো রাতজাগা পাখি। আমি চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকব।”

অনন্তর মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। রেগে গেলেই ওর এমন হয়। এখন বাকি রাত সে আর ঘুমাতে পারবে না। একবার ঘুম ভেঙে গেলে ঘুমের ঔষধ খেলেও আর ঘুম হবে না। এই মেয়ে দুই দিন হলো না তার জীবনে এসেছে। এই একটু সময়েই জ্বালিয়ে খেল। মেহরীন এক বছর ধরে তার জীবনে আছে, কই সে তো কখনও অনন্তর প্যারার কারণ হয়নি। মেহরীন কখনও এমন মাঝরাতে তাকে কল দেয়নি। সে জানে অনন্ত কখন ঘুমায়, কখন খায়। অনন্ত কোন সময় কোন কাজটা করে মেহরীন সবই জানে।
অনন্ত ফোনে মেহরীনের নাম্বার বের করল। মেয়েটার কোন দোষ নেই। শুধু ছয়টা মাস ধরে বিয়ে বিয়ে করে তাকে পাগল করছে। এই বিয়ের ভূত ওর মাথায় কে ঢুকিয়েছে অনন্ত যদি তা জানত, তাহলে ওইটাকে আগে কাঁচা খেত।

“মেহরীনের মাথায় বিয়ের ভূত নিশ্চয়ই ওর চামচি রুমমেট-টাই ঢুকিয়েছে। নইলে মেহরীন কখনো আমাকে প্যারা দিত না। ও এমন মেয়েই না।”

আজ মেয়েটার জ্বর ছিল। তবুও সে মেহরীনকে ভীষণ জ্বালিয়েছে। যাওয়ার সময় মেয়েটার মন খারাপ ছিল। কল রিং হতেই মেহরীন রিসিভ করে ফেলল। যেন সে অনন্তর কলের অপেক্ষায় ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিল। অনন্ত বলল,

“এখনও ঘুমাসনি তুই?”

“না।”

“কেন?”

“ঘুম আসছিল না।”

“ঘুম আসে না কেন? রাত কয়টা বেজেছে দেখেছিস?”

“তুমিও তো ঘুমাওনি।”

অনন্ত বিব্রতবোধ করল। সে মেহরীনকে শাসন করতে গিয়ে নিজেই নিজের কথায় ফেঁসে গেছে।

“হ্যাঁ তো আমি ঘুমাইনি তাতে কী হয়েছে? আর তোকে কে বলেছে আমি ঘুমায়নি? তুই এসে দেখেছিস নাকি? আমি এতক্ষণ ঘুমিয়েই ছিলাম। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেলে তোর কথা মনে হলো।”

মাঝরাতে অনন্তর ঘুম ভেঙে গেলে সে মেহরীনের কথা মনে করে, এটাই ভেবেই মেহরীনের মনে সুখময় অনুভূতি হচ্ছে। অনন্ত কখনও মনের ভাব কারো সামনেই প্রকাশ করে না। ভালোবাসার কথা সে মরে গেলেও বলবে না। এই ছেলেটা এমন কেন?

“তোর জ্বর সেরেছে? ”

“হুম।”

“মিথ্যা বলছিস কেন? তোর কপাল তো এখনও গরম।”

মেহরীন নিঃশব্দে হাসল। অনন্ত তার কত কেয়ার করে! শুধু বিয়েটাই করতে রাজি হয়না।

“একটু একটু জ্বর আছে মনে হয়। ঘরে প্যারাসিটামল ছিল। আমি খেয়ে নিয়েছি। এখন ভালোই লাগছে।”

“আচ্ছা তাহলে ঘুমিয়ে পড়। রাত জাগা ভালো না। তোর সুন্দর চোখ দু’টো কালো হয়ে যাবে। ঘুম না হলে মুখে এই বড় বড় পিম্পল উঠবে। রাখি, শুয়ে পড় তুই।”

অনন্ত কল কেটে দিলে মেহরীন একা একাই হাসল। জীবনে সে কারো কাছেই বিশেষ কেউ ছিল না। বাবা মা’র ভালোবাসাও পায়নি সে। ছোট বেলায় মা মারা গেলে মাতাল বাবা তাকে অনাথাশ্রমে দিয়ে যায়। সাত বছর বয়স পর্যন্ত সে ওখানেই ছিল। তারপর সেই ফেরেশতার মত মানুষটা ওর জীবনে আসে। ওকে নিজের মেয়ে করে নিয়ে আসে। এই পরিবারে সে যে পালিত মেয়ে তা কখনও অনুভব করেনি। ভাইয়া শুধু তাকে সহ্য করতে পারত না। বাবা মা বেঁচে থাকতে ভাইয়া ওর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ না করলেও, বাবা মারা যাবার মাস দুই পরই ভাইয়া তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মা’ও তখন ভাইয়াকে আটকাতে পারেনি। মেহরীনের তখন তেমন অবস্থা ছিলনা যে, সে মা’কে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। বাবার শোকে আর ভাইয়ার এই জঘন্য রূপ দেখে মা’ও আর বেশিদিন পৃথিবীতে থাকলেন না। তিনিও বাবার কাছে চলে গেলেন। বাবা মা’কে হারিয়ে মেহরীন আবার এই পৃথিবীতে একা হয়ে গেল। তারপরই তার জীবনে এল অনন্ত। যে তাকে ভালোবেসেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেহরীন। অনন্ত ছাড়া তার আপন বলতে আর কেউ নেই। এই একটা মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে সে বেঁচে আছে। কিন্তু মানুষটা অদ্ভুত। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে নারাজ।
.
.
ঘড়িতে এখন রাত দু’টা বাজে। কোন একটা কারণে মেহরীনের ঘুম ভেঙে যায়। সে উঠে বসে। হঠাৎ এমন অস্থির লাগছে কেন তার? মেহরীন উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে খেল।
জ্বর ছেড়ে দেওয়ায় এমন ঘামছে সে?

“হঠাৎ বুকের ভেতর এমন লাগছে কেন আমার? যেন কোথাও আমার খুব আপন কারো কিছু হয়েছে। বুকের ব্যথাটা এত বাড়ছে কেন?”
.
দু’টা বাজলেও ইরফান এখনও ঘুমাতে পারেনি। এক ফোঁটা ঘুম নেই তার চোখে। আয়ামকে রেখে এসে কিছুই ভালো লাগছে না। ছেলেটা কি ঘুমিয়ে গেছে? নাকি এখনও জেগে আছে। আচ্ছা, আয়াম কি ওই মেয়েটার কথা এখনও মনে রেখেছে? নাকি হুমায়রাকে পেয়ে ওই মেয়েকে ভুলে গেছে? ভুলে গেলেই ইরফান বাঁচে। আয়াম যা জেদি ছেলে। কিছু নিয়ে একবার বায়না ধরলে, তা যতক্ষণ না পাবে ততক্ষণ কারো কথাই শুনবে না। ইরফান বুঝলো আজ রাতে আর সে ঘুমাতে পারবে না। ব্যালকনিতে গিয়ে সে ইজি চেয়ারে বসে মেঘে ঢাকা আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হয় আকাশের বুকের এই মেঘের আড়ালেও আরও মেঘ আছে।
.
আয়ামের কান্নার আওয়াজে হুমায়রার ঘুম ভেঙে গেল। হুড়মুড়িয়ে উঠে সে আয়ামের গায়ে হাত রাখল। ইশ! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।

“এত জ্বর কখন এলো! শোবার সময়ও তো ঠিকই ছিল ছেলেটা।”

হুমায়রা ফোনে সময় দেখল। দু’টা বাজে! আয়াম জ্বরের তীব্রতায় ঘুমের ঘোরে বিরবির করে কী যেন বলছে। হুমায়রা আয়ামের মুখের কাছে কান নিল।

“বাবু, আয়াম কী বলছো সোনা! ও বাবা কষ্ট হচ্ছে তোমার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে আয়াম। এখন কী করব আমি? এত রাতে দুলাভাইকে ডাকা ঠিক হবে?”

হুমায়রা আয়ামের মুখের কাছে কান নিলে শুনতে পেল আয়াম তার মা’কে ডাকছে। হুমায়রা কান্না চেপে বলল,

“তোমার মা নেই বাবা। তুমি মা’কে ডাকলেও মা আসবে না।”

হুমায়রার চোখ বেয়ে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। তার বোনের বড্ড আদরের সন্তান ছিল আয়াম। হামনা তার ছেলেকে এক সেকেন্ডের জন্য চোখের আড়াল করত না। আজ এই ছেলে মা’কে ডেকে কাঁদছে অথচ মা তার কাছে নেই।
হুরায়রা ইরফানকে কল করল। চেয়ারে বসেই চোখটা লেগে এসেছিল ইরফানের। রুমে ফোন বাজছে শুনে লাফিয়ে উঠে বসল। আয়ামের কিছু হয়নি তো? দৌড়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করল সে।
এপাশ থেকে হুমায়রা বলছে,

“দুলাভাই, আয়ামের ভীষণ জ্বর এসেছে। শোবার সময় জ্বর ছিল না। এখন কপালে ধরে দেখি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।”

ইরফান উত্তেজনায় কিছু বলতে পারছে না। ভীষণ কষ্টে ক’টা কথা মুখ দিয়ে বের করল সে।

“আমি আসছি। ততক্ষণ তুমি একটু আয়ামকে দেখো। আমি দশ মিনিটের মধ্যেই আসছি।”

“এত রাতে আসবেন…. হুমায়রা কথা শেষ করার আগেই ইরফান কল কেটে দিয়েছে। বাবা নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। সে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। রাত দু’টার সময় রাস্তায় একটা কাকপক্ষীও নেই। ইরফান রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে অন্ধকার রাস্তায় কার ড্রাইভ করে যাচ্ছে।
হুমায়রা কাপড় ভিজিয়ে এনে আয়ামের কপালে রাখল। আয়াম এখনও বিড়বিড় করে যাচ্ছে। তার কথাগুলো এবার কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে। আয়াম বলছে,

” মাম্মী, মাম্মী তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে মাম্মী? আমাকে আর পাপাকে একা রেখে তুমি কেন চলে গিয়েছিলে? আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি। পাপা তোমার জন্য অনেক কাঁদে মাম্মী। তুমি আমার সাথে চলো। পাপা, পাপা তুমি মাম্মীকেও বাসায় নিয়ে চলো। আমি একা যাব না পাপা। এটাই আমার মাম্মী। মাম্মী, ও মাম্মী…

হুমায়রার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। আয়ামের কথাগুলোর কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না সে। আয়াম কাকে মাম্মী ডাকছে? কাকে সাথে করে বাসায় নিয়ে আসার কথা বলছে? এতদিন পর হঠাৎ আয়ামের হামনার কথা মনে পড়লো কেন?
হুমায়রা দরজা খুলে দিতে ইরফান দৌড়ে ওর রুমে চলে এলো। হুমায়রা ওর পেছন পেছন এসেছে। আয়াম এখন আর প্রলাপ বকছে না। কপালে জলপট্টি দেওয়ায় কপাল গরম অনেকটা কমেছে। ইরফান আয়ামের কাছে ঝুঁকে বসে ওর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

“বাবা, এই ব্যাটা আয়াম। কষ্ট হচ্ছে ব্যাটা?”

হুমায়রা ইরফানের পেছন থেকে বলল,

“সরি দুলাভাই। আমি ওর খেয়াল রাখতে পারিনি। রাতেও জ্বর ছিল না। আমরা একসাথেই ঘুমিয়েছি। কীভাবে যেন কখন জ্বরটা…

ইরফান ওকে থামিয়ে বলল,

” তুমি সরি বলছো কেন? প্রকৃতির উপর কারো হাত থাকে? আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি হুমায়রা। তুমি একা বাসায় থাকতে পারবে? নইলে আমার সাথে চলো।”

“হুম। ওই অবস্থায় আয়ামকে আপনার সাথে পাঠিয়ে দিয়ে আমি বাসায় কিছুতেই থাকতে পারব না।”

হুমায়রা মেইন দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। ইরফান আয়ামকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে এসে বসেছে। হুমায়রা ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে বলল,

“আয়ামকে আমার কাছে দিন। ওকে কোলে নিয়ে গাড়ি চালাতে পারবেন না।”

ইরফান আয়ামকে হুমায়রার কাছে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুটা পথ আসার পর হুমায়রা কথাটা জিজ্ঞেস করল,

“দুলাভাই, আয়াম আপুর নাম নিচ্ছিল কেন? কোথাও থেকে আপুকেও সাথে করে বাসায় নিয়ে আসতে বলছিল। আরও বলছিল, এটাই আমার মাম্মী। মাম্মী তুমি আমাদের সাথে চলো। আরও কীসব যেন বলছি আয়াম।”

ইরফান উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

“এসব বলেছে আয়াম!”

“হুম। আমি তো ওর কথা কিছুই বুঝতে পারিনি।”

ইরফান যেটা চাচ্ছিল না সেটাই হতে যাচ্ছে। আয়াম ওই মেয়ের কথা ভুলেনি। ওই মেয়ে আয়ামের মাথায় বেশ ভালো করেই গেড়ে বসেছে।
কোন কুক্ষণে যে সকালে ওই মেয়েটার সাথে ওদের দেখা হয়েছিল! পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে ওই মেয়ে হামনার মতই কেন দেখতে হলো? কেন, কেন, কেন?
সারারাতে আয়ামের জ্বর একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে। ইরফান হুমায়রাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে আয়ামের কাছে এসে শুনতে চেষ্টা করল আয়াম কী বলছে। সকালের কথাগুলোই বলছে আয়াম।

“মাম্মীকে এনে দাও পাপা। মাম্মীকে নিয়ে চলো। মাম্মী তুমি আমাদের সাথে চলো৷ আমি মাম্মীকে ছাড়া যাব না।”

দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে কয়েকবার বিছানায় আঘাত করল ইরফান। ওই মেয়ের জন্য তার ছেলের আজ এই অবস্থা। মেয়েটা তাদের বাবা ছেলেকে ফ্রট বলেছে। এতটুকু বাচ্চা ওর সামনে কেঁদেছে, তাকে জড়িয়ে ধরে মা ডেকেছে। তবুও বাচ্চাটার অনুভূতি বুঝেনি যে মেয়ে, সে কখনও হামনা হতে পারে না। হামনার মত দেখতে হলেও হামনার গুণ পাওয়া অসম্ভব। হামনা একজনই ছিল, যে সবার খুশির কথা ভাবত।

চলবে___

সবার মন্তব্য প্রত্যাশা করছি🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here