#মেঘের_আড়ালে_মেঘ”৩”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ইরফান ভাবছে, দুটো মানুষের মধ্যে এতটা মিল কীভাবে থাকতে পারে! ওই মেয়ে হুবহু হামনার মত দেখতে! কীভাবে? আল্লাহ দু’জন মানুষের চেহারার মধ্যে এতটা মিল দিয়েছেন! তার মনে একটা ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল, ওই মেয়ে কি কোন ভাবে হামনার যমজ বোন?

“না। যমজ বোন কীকরে হবে? হামনার যমজ বোন থাকলে আমি জানতাম। হামনা একবার হলেও আমাকে ওর বোনের কথা জানাত। ও তো কোন কথাই আমার থেকে গোপন করেনি।
আচ্ছা, এমনটা কি সম্ভব। ওর যমজ বোন ছিল অথচ এই কথা ও নিজেও জানত না। উঁহু, যমজ বোন ছোট বেলায় হারিয়ে যায়, এমনটা মুভিতেই হয়। রিয়েল লাইফে না। হামনা, হুমায়রা দুই বোন। ওদের আর কোন ভাই বোন নেই।”

ইরফান ভেবে পাচ্ছে না, তাহলে ওই মেয়েটা কে? হামনার সাথে ওর এত মিল কীভাবে? কোথায় থাকে ওই মেয়ে? কী ওর পরিচয়?
ইরফান সমস্ত কল্পনা জল্পনা বাদ দিয়ে আয়ামের দিকে দেখল৷ ছেলেটা তার মা’কে ভীষণ ভালোবাসে। ইরফান আয়ামকে কথায় ভোলাতে চাইল।

“আয়াম, পাপার সাথে ঘুরতে যাবে তুমি?”

“না।”

“চকলেট, আইসক্রিম খাবে?”

“না।”

“কিছুই করবে না তুমি?”

“না।”

“আয়াম পিজ্জা খাবে, তাই না?”

“না।”

“তাহলে কী করবে আয়াম? আয়াম না খেয়ে থাকলে, আয়ামের পাপা কষ্ট পাবে না? আয়াম তো গুড বয়। সে কি পাপাকে কষ্ট পেতে দিবে?”

“তুমি মাম্মীকে এনে দাও। আমি মাম্মীর হাতে খাব। মাম্মীকে নিয়ে ঘুরতে যাব। মাম্মী আমাকে অনেকগুলো আইসক্রিম কিনে দিবে। ও পাপা, মাম্মীকে এনে দাও না। মাম্মীর জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হয়। মাম্মী আমাদের রেখে কোথায় গেছে, পাপা?”

ইরফান কিছুই বলতে পারল না। এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর তার তাকে থাকলেও, তার চার বছরের ছেলে কি উত্তর গুলো বুঝবে? এতটুকু ছেলের কাছে কি কথাগুলো বলা যায়! সে কি বুঝবে তার মা এই দুনিয়াতে নেই। মৃত্যু কী তা কি এই অবুঝ ছেলের মাথায় ঢুকবে?
ইরফান আয়ামকে খাওয়ানোর জন্য বলল,

“আচ্ছা, আগে তুমি খেয়ে নাও। তারপর তোমার মাম্মীকে এনে দেব।”

কথাটা শুনে আয়াম খুশি হয়ে গেল।

“সত্যি দিবে পাপা? তুমি মাম্মীকে এনে দিবে।”

“হুম।”

“প্রমিস বলো এনে দিবে।”

“প্রমিস করতে হবে?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, আয়াম আজ তার খালামনির কাছে নানু বাসায় যাবে? খালামনি কিন্তু আয়ামকে অনেক মিস করে।”

খালামনির কাছে যাওয়ার কথা শুনে আয়াম খুশি হয়ে গেল। সব রাগ ভুলে গিয়ে বলল,

“আমি আজ খালামনির কাছে থাকব পাপা।”

ইরফান কখনও ছেলেকে নিজের থেকে দূরে রাখতে রাজি না। আয়াম রাতে বাবার সাথে শুলেও ইরফান তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তবুও আজ ইরফান রাজি হয়ে গেল।

“আচ্ছা থাকবে। তাহলে এখন আগে খেয়ে নাও। বিকেলে আমরা নানুর বাসায় যাব।”

“ওকে পাপা। আই লাভ ইউ পাপা।”

.

অনন্ত মেহরীনের ফ্ল্যাটের নিচে দাঁড়িয়ে ওকে কল করল। মেহরীন গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল। তার জ্বর জ্বর লাগছে। এই বছরের প্রথম আজ বৃষ্টিতে ভিজেছে। আর এতেই জ্বর এসে গেল! ফোন রিং হলে মেহরীন উঠে বসল। নিশ্চয়ই অনন্ত কল করেছে। মেহরীনের রাগ হলো। সারাদিনে এই তার খোঁজ নেওয়ার সময় হলো! এত ব্যস্ত সে! কিসের এত ব্যস্ততা ওর, যে সকাল থেকে একবার ফোন দিয়ে ওর খোঁজ নিতে পারল না। অভিমান নিয়েই সে কল তুললো। ওপাশ থেকে অনন্ত বলল,

“কোথায় তুই? ফোন তুলতে এত দেরি হয়েছে কেন? এক্ষুনি নিচে আয়। আমি দাঁড়িয়ে আছি।”

মেহরীন গাল ফুলালো। সারাদিন একবার কল দেয়নি। আর এখন কল দিয়েই হুকুম ঝাড়ছে। কোথায় একটু নরম গলায় জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছো তুমি? সরি, আসলে আজ একটু ব্যস্ত ছিলাম। তাই তোমাকে কল দিতে পারিনি। মেহরীন থমথমে গলায় বলল,

“আমি আসতে পারব না। আমার জ্বর এসেছে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি।”

মেহরীনের জ্বর হয়েছে শুনে অনন্ত একটু যেন নরম হলো৷ মেয়েটা কেন নিজের খেয়াল রাখতে পারে না। নিজের প্রতি এতটা উদাসীন হলে কীভাবে হবে? অনন্ত মেহরীনের জন্য চিন্তা করছে এটা ওকে বুঝতে না দিয়ে আগের মতই ধমক দিয়ে বলল,

“নিশ্চয়ই আজ সকালে বৃষ্টিতে ভিজেছিস। বৃষ্টি দেখলে তো তোর মাথা ঠিক থাকে না। শুয়ে থাক তুই। আমি আসছি।”

অনন্ত আসছে শুনে মেহরীন খুশিতে নেচে উঠল। যাক বয়ফ্রেন্ডটা মানুষ হচ্ছে তাহলে। প্রেমিকার একটু হলেও কেয়ার করছে। কোন কুক্ষণে যে মেহরীন এই রসকষহীন মানুষটার প্রেমে পড়েছিল। প্রেমে পড়ারও কারণ ছিল তখন। তাকে নিয়ে অনন্ত করা পাগলামি গুলোই তাকে অনন্তর প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছিল। কিন্তু মেহরীন যদি তখন জানত, এত সব পাগলামি ও রাজি হবার পরে শুকিয়ে মরে ঝড়ে যাবে। তাহলে সে কখনও রাজি হতো না। এখন পর্যন্ত অনন্তকে নাকে দড়ি দিয়ে তার পেছনে ঘুরাত। ঝুলিয়ে রেখে লম্বুটাকে আরও লম্বা বানিয়ে ছাড়ত। হুহ্!
মেহরীন কাঁথা ছেড়ে তাড়াহুড়ো করে উঠে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
অনন্ত ডোরবেল চাপার আগে হাতের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে পকেটে রাখল।
সে ডোরবেলে হাত দেওয়ার আগেই মেহরীন দরজা খুলে দিল। সে চেহারায় রাগী ভাব রাখতে চাইলেও পারছে না। অনন্তকে দেখে হাসি এসেই যাচ্ছে। অনন্ত ভেতরে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,

“জ্বর নিয়ে তুই দরজা খুলতে উঠে এলি যে! তোর ওই চামচি রুমমেট কই?”

“বাড়িতে গেছে। দু’দিন পরে ফিরবে।”

“ওহ। তাহলে তুই একা আছিস?”

“হুম।”

“এই অসময়ে জ্বর বাঁধালি এখন তোর সেবাযত্ন করবে কে?”

মেহরীন মুখ কালো করে নিল। বিরবির করে বলল,

“ইশ! কত চিন্তা! যেন আমি এক্ষুনি তার ঘাড়ে চেপে বসতে যাচ্ছি। বলতে নিচ্ছি, আমার জ্বর হয়েছে তাই বয়ফ্রেন্ড হিসেবে আমার সেবা করা তোমার কর্তব্য। এই চিন্তায় তিনি কেমন অস্থির হয়ে আছেন।”

অনন্ত ওর শোবার ঘরে এসে বসল। মেহরীনকে পাশে বসতে ইঙ্গিত করল। মেহরীন বসলে অনন্ত হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওর কপাল ধরে জ্বর দেখল।

“বেশ ভালোই জ্বর বাঁধিয়েছিস। কমসে কম এক সপ্তাহ বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। হাসপাতালেও যেতে হতে পারে।”

মেহরীন মুখ বাঁকাল। বলল,

“হু তুমি তো এমবিবিএস ডাক্তার। কপালে হাত রেখেই সব অগ্রিম বলে দিতে পারছো। আমি জ্বর ইচ্ছে করে বাঁধাই নি। আর এই জ্বর কাল সকালেই চলে যাব।”

“এবার তো তুই অগ্রিম বলে এমবিবিএস এর উপরে যদি কিছু থাকলে সেটা হয়ে গেলি।”

মেহরীন হেসে ফেলল। অনন্ত নির্বিকার মুখে বলল,

“চা খাওয়াতে পারবি। চায়ের ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।”

মেহরীন মাঝপথে হাসি থামিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইল। এটা তার বয়ফ্রেন্ড! তার জ্বর জেনেও, কপালে হাত দিয়ে দেখেছেও। তবুও এই অবস্থায় তাকে চা খাওয়ানোর কথা বলছে! কোথায় কেয়ারিং বয়ফ্রেন্ডের মত বলবে, বাবু, ও জান, কলিজা পাখি তুমি শুয়ে থাকো। ওঠো না। তোমার কী খেতে ইচ্ছে করছে, আমাকে বলো। আমি নিজের হাতে বানিয়ে খাওয়াব। তা না করে পাষাণের মত বলছে, চা খাওয়াতে পারবি। এতই যখন চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে তাহলে আসার পথে খেয়ে এলেই তো পারতি। এখানে এসে আমাকে কামলা খাটানোর কী মানে? এমনিতে ঠান্ডায় নাক বন্ধ হয়ে আছে। শ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে।
মেহরীন অনাগ্রহে উঠে দাঁড়াল। বলল,

“বসো তুমি। আমি চা বানিয়ে আনছি।”

দরজার কাছে যেতে অনন্ত পেছন থেকে ডাকল।

“থাক, দাঁড়া। জ্বর শরীরে চা বানাতে বলেছি বলে তুই যদি আবার রান্নাঘরে গিয়ে অজ্ঞান হবার ভান করে কাব্দা খেয়ে পড়ে থাকিস, তখন তোকে নিয়ে টানাহ্যাচড়া আমাকেই করতে হবে। তার থেকে ভালো, আমি নিজেই নিজের জন্য চা করি গিয়ে। তোর কাছে এক চাপ চা খেতে চেয়ে, তোকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে নিজের পকেট থেকে বর্তুক দিতে পারব না।”

মেহরীন এবার রাগী চেহারায় অনন্তর দিকে তাকাল। এক্ষুনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বসবে যেন সে। অনন্ত তাকে না দেখার ভান করে, তাকে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মেহরীন রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

“কী কিপ্টার কিপ্টারে বাবা! অসুস্থ গার্লফ্রেন্ডের কথা চিন্তা না করে কিপ্টুসটা এই সময়েও টাকার চিন্তা করছে! নিজের পকেট বাঁচিয়ে চলতে পটু। একদিন তোমাকে বাগে পাই চাদু। ফতুর করে ছাড়ব দেখে নিও।”

বিরবির করতে করতে মেহরীনও অনন্তর পেছন পেছন রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগল।

“এই আমার কিচেন ওলটপালট করবে না একদম। দাঁড়াও আসছি আমি। চায়ের সরঞ্জাম কোথায় কী আছে খুঁজে পাবে না তুমি। আমি এসে দিচ্ছি।”
.
.
হামনা মারা যাবার পর এই নিয়ে দ্বিতীয় বার ইরফান তার শ্বশুরবাড়িতে এসেছে। আগে হামনার সাথে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আসত। কিন্তু হামনা চলে যাবার পর তার জীবনের সব নিয়ম এলোমেলো হয়ে গেছে। আগের মত কিছুই নেই। সাত মাসে মাত্র দু’বার এসেছে এখানে। নিশ্চয়ই হুমায়রা তার উপর ভীষণ রেগে আছে। আজও ইরফান আসত না। কিন্তু সকালের ওই ঘটনার পর আয়ামকে এখানে নিয়ে আসা জরুরি ছিল। হুমায়রার কাছে কিছু সময় থাকলে তবেই আয়াম ওই মেয়েটাকে ভুলে যাবে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিল ইরফান। হামনার সাথে আসার সময় গুলো অন্য রকম ছিল। এখন তাকে একা আসতে হচ্ছে। ভেতরে গিয়েই হামনার সাথে জড়ানো হাজারো স্মৃতি দেখতে পাবে সে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডোরবেল চাপল সে। আয়ামের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। আয়াম তার ডান হাতের আঙুল মুঠো করে ধরে রেখেছে। তাকে ভীষণ খুশি লাগছে। আয়ামও তাকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করল,

“খালামনি দরজা খুলছে না কেন? আজ কিন্তু আমি খালামনির কাছে থাকব, পাপ।”

ইরফান মাথা কাত করে সায় দিল। ঠিক তখনই কেউ দরজা খুলে দিল।
দরজা খুলে সামনে ইরফানকে দেখে হুমায়রা এক মুহূর্ত ধমকে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ইরফান হুমায়রার অবস্থা বুঝতে পেরে অপরাধী ভাবে হেসে চোখ নিচু করে নিল। কোন ভাবে হুমায়রা ইরফানের উপর থেকে চোখ সরিয়ে আয়ামের দিকে তাকাল। আয়াম এতক্ষণে “খালামনি” বলে চিৎকার করে হুমায়রার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হুমায়রাও আয়ামকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায়, পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

“বাবুসোনা, আমার কলিজাটা কেমন আছে? এতদিন পর খালামনির কথা মনে পড়ল, বাবা। খালামনি তোমার উপর ভীষণ রেগে আছে। ভীষণ।”

আয়ামকে সোজা করে হুমায়রা দুই হাতে ওর মুখ ধরে কপালে গাঢ় চুমু দিয়ে বলল,

“কত বড় হয়ে গেছে আমার বাবাইটা। কতদিন পর খালামনির কাছে এসেছে।”

আয়াম খালামনির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কপালে হাত ঘষতে ঘষতে বলল,

“খালামনি, তুমি এত জোরে পাপ্পি করো কেন? ভীষণ পঁচা তুমি। নানুভাই কোথায়?”

হুমায়রাকে ছেড়ে আয়াম নানুভাইকে ডাকতে ডাকতে ভেতরে চলে গেল। হুমায়রা ওর যাবার দিকে তাকিয়ে আহ্লাদি গলায় বলল,

“ওরে আমার পুঁচকি বাবাটা!”

ইরফান এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে খালা ভাগিনার ভালোবাসা দেখছিল। এবার সে বলল,

“ভেতরে যেতে বলবে? নাকি দরজা থেকেই বিদেয় করবে?”

হুমায়রা ইরফানের দিকে ফিরে মুখ গম্ভীর করে বলল,

“আসুন। বিনা দাওয়াতে আজ যেহেতু এতটা পথ কষ্ট করে আসতে পেরেছেন। তাহলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলাবলির অপেক্ষা করছেন কেন? ভেতরে গেলে আপনাকে কেউ আটকাবে না। এটাকে নিজের বাড়ি মনে করলে যদি পাপ হয়, তাহলে শ্বশুরবাড়ি ভেবেই যাওয়া আসা করতে পারেন।”

কথা ক’টা বলে হুমায়রা চলে গেলে ইরফান হেসে বলল,

“ওরেব্বাস! শ্যালিকা দেখি রেগে বোম হয়ে আছে। যেকোন সময় ফেটে পড়বে।”

চলবে…

দ্বিতীয় পর্ব
https://www.facebook.com/107175347372111/posts/512612703495038/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here