#মেঘের_আড়ালে_মেঘ”২”
#জেরিন_আক্তার_নিপা
ইরফান কোনো ভাবেই আয়ামকে ওই মেয়ের কাছ থেকে নিয়ে আসতে পারছিল না। আয়াম বারবার ওর কাছে ছুটে যেতে চাইছিল। ইরফান ছেলেকে বুঝাতেই পারছিল না, এটা ওর মা না। ওর মা এই দুনিয়াতে নেই। ওই মেয়েটা ওর মা’র মতনই দেখতে অন্য একটা মেয়ে। গাড়িতে উঠেও আয়াম মাম্মী মাম্মী বলে কাঁদছিল। ইরফানকে বলছিল,
“তুমি পঁচা পাপা। তুমি মাম্মীকে রেখে চলে যাচ্ছ। মাম্মীকে নিয়ে চল পাপা। মাম্মী ছাড়া আমি বাড়ি যাব না।”
কথাগুলো বলতে বলতে ফোপাচ্ছিল আয়াম। তখন নিজের কাছেই নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিল ইরফানের। শেষে কোনভাবেই আয়ামকে শান্ত করতে না পেরে ধমক দিয়েছিল সে। ধমক শুনে আয়াম চুপ হয়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তখনও তার কান্না থামছিল না। হামনা মারা যাবার পর এই প্রথম ছেলের সাথে শক্ত গলায় কথা বলেছে সে।
ইরফান আয়ামকে বাসায় ওর বাবার কাছে রেখে আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাবা অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে,
“ইরফান, আয়াম কাঁদছে কেন? কি হয়েছে ওর। কোথায় যাচ্ছিস তুই এখন? মাত্রই তো ফিরেছিস। এই ইরফান!”
বাবার কোন কথার উত্তর দেয়নি সে। পেছন থেকে বাবার অনেক ডাক শুনেও দাঁড়ায়নি ইরফান। সে ড্রাইভ করে হামনার কবরের কাছে চলে এলো। এতক্ষণে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝুম বৃষ্টি। আশেপাশে কোন লোকজন নেই। ইরফান গাড়ি থেকে নামার পরেই বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা ওর গায়ে পড়ে ওকে ভিজিয়ে দিল। হামনার কবরের সামনে এসে দাঁড়াল ইরফান। কিছুক্ষণ এক নজরে কবরের দিকে তাকিয়ে, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর হঠাৎ শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে ফেলে কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
“তোমার ছেলেকে আজ আমি ধমক দিয়েছি, হামনা। তোমার কথা আমি রাখতে পারিনি। আমি ওর পাশে থাকতেও আয়ামের চোখে পানি এসেছে। আমি ভালো বাবা হতে পারিনি।”
.
.
তখন মেহরীন বৃষ্টিতে ভিজেই বাসায় চলে এসেছে। কিছুই ভালো লাগছিল না তার। নিজের উপর রাগ হচ্ছিল নাকি অন্য কারণে অস্থির লাগছিল সেটাও বুঝতে পারছিল না। ভেজা কাপড় পাল্টে সে অনন্তকে কল দেয়। আজকের ঘটনা অনন্তকে জানানো দরকার। একবার কল রিং হয়ে কেটে যাবার পর, আরেকবার কল করতে গিয়ে মেহরীন থেমে গেল। তার হঠাৎ মনে হতে লাগল, অনন্ত উল্টো তাকেই ভুল বুঝবে। পুরো কথা শুনবে না সে। ফোন ছুঁড়ে রেখে কপাল চেপে ধরে বিছানার এক কোনায় বসে পড়ল সে। ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবছে মেহরীন।
“আমরা তো একে অপরকে ভালোবাসি। তুমি নিজে আমাকে প্রপোজ করেছিলে। তিনমাস পর আমি রাজি হয়েছিলাম। তাহলে এখন আমার উপর তোমার এত অবহেলা কেন? তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে আমি ভীষণ ভুল করেছি। তুমি আমাকে ভালোবাসো,তাহলে বিয়েতে তোমার এত আপত্তি কেন?”
চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল মেহরীন। অনন্ত আগে এমন ছিল না। হঠাৎ করে যেন সে পরিবর্তন হয়ে গেছে। মেহরীন এই অনন্তকে চিনতে পারে না। তাকে যেই অনন্ত ভালোবাসতো, সেই আগের অনন্ত যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এখনকার অনন্তর সাথে সাত মাস আগের অনন্তর কোন মিল নেই। দু’জন যেন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। অথচ এই অনন্তই সাত মাস আগে ওর জন্য পাগল ছিল। তার পাগলামি দেখে মেহরীন মাঝে মাঝে ভয় পেত। চোখ বন্ধ করতে হঠাৎ সকালের সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। ওই লোকটা তার চোখে, মুখে, গালে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছিল। কেঁপে উঠলো মেহরীন। তাড়াহুড়ো করে চোখ খুলে উঠে দাঁড়াল। সকালের কথা মনে পড়তেই মনের মাঝে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। লোকটাকে চেনে না, জানে না, আগে কখনও দেখেনি, ওই লোক তাকে কিস করেছে। অথচ সেই সময় তার মোটেও খারাপ লাগেনি। লোকটার ছোঁয়ায় বিন্দুমাত্র অপবিত্রতা ছিল না। বরং ভালোবাসার ছোঁয়া স্পষ্ট ছিল। কাঁদো কাঁদো মুখে মেহরীন বলল,
“অনন্ত, বাইরের একটা লোক তোমার মেহুকে কিস করেছে। সে খবর রাখো তুমি? তুমি আমার সাথে থাকলে এসব কিছুই হত না। আগে তুমি প্রতিদিন নাচের ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করতে। আমার দেরি হয়ে গেলে তুমি অপেক্ষা করতে। কখনও বিরক্ত হতে না। কিন্তু এখন তুমি নাচের ক্লাসে যাওইনা। আমার নাচ শেখানো নাকি এখন তোমার কাছে বিরক্ত লাগে।”
মেহরীন অনন্তর কথা ভাবতে চেয়েও পারছে না। ঘুরে ফিরে তার মনে বারবার ইরফানের খেয়ালই এসে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই সে ইরফানের মুখ দেখতে পাচ্ছে।
———————————
“আমি আজ অন্য একটা মেয়েকে তুমি ভেবে ভুল করেছি। তুমি ভেবে ওই মেয়েকে আমি কিস করেছি! কী করে পারলাম আমি! তোমাকে অন্য একটা মেয়ের সাথে গুলিয়ে ফেললাম! এটাই আমার ভালোবাসা! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও হামনা। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। ওই মেয়ে যতই তোমার মতন দেখতে হোক ওর প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। বিশ্বাস করো তুমি। পরের বার ওই মেয়ে আমার সামনে আসলে আমি ওর দিকে তাকিয়েও দেখব না। আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা তুমি। এই ইরফানের জীবনে হামনা ছাড়া আর কারো জায়গা নেই। আমার পুরোটা জুড়ে শুধুই তুমি। আমার অস্তিত্ব তুমি। তোমাকে আমি কখনও ভুলতে পারব না। তোমাকে আমি ভুলতে চাইওনা। আমি নিজেকে ভুলে যেতে রাজি আছি। তবুও তোমাকে ভুলতে চাই না। তুমি এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আমার মাঝে তুমি আছো। যতদিন আমার অস্তিত্ব থাকবে ততদিন আমার মাঝে তুমি বেঁচে থাকবে।”
এক ঘন্টার উপরে হবে হামনার কবরের পাশে বসে আছে সে। অন্য একটা মেয়েকে হামনা ভাবার ভুলটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ইরফান। তার নিজের কাছে অপরাধী লাগছে। বেশ কিছু সময় পর আয়ামের কথা মনে হলে বাড়ির পথ ধরল সে। বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় গিয়েছিল বাপ ব্যাটা। ওকে ওই অবস্থায় রেখেই চলে এসেছে সে। বাবাকেও কিছু বলে আসেনি। নিশ্চয়ই আয়াম এখন দাদুভাইয়ের একটা কথাও শুনবে না। ছেলেটার না ঠান্ডা লেগে যায়। চিন্তিত ইরফান ফুল স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছে।
ইরফান বাসায় এসে দেখে বাবা আয়ামকে চেঞ্জ করিয়ে দিয়েছে। তবে আয়াম এখনও মাম্মী মাম্মীই করে যাচ্ছে। বাবা আয়ামকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে সোফায় বসে আছে। আর বারবার জিজ্ঞেস করছে।
“দাদুভাই, কোথায় তোমার মাম্মী? কার কথা বলছো তুমি। ও দাদুভাই, বলো না। কোথায় তোমার মাম্মী।”
ইরফান ওদের দিকে এগিয়ে গেল। ওকে ভেজা শরীরে দেখে বাবা বললেন,
“তুই আবার কোথায় বেরিয়েছিলি? কোত্থেকে এরকম ভিজে এসেছিস? তখন আমাকে না বলে চলে গেলি। আয়াম কাঁদছে কেন? আর মাম্মীর কথা কী বলছে! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“আয়াম কিছু খেয়েছে বাবা?”
“না। কাপড় পাল্টে দিয়েছি অনেক কষ্টে। কিন্তু কিছু খাওয়াতে পারিনি। আমি তো ওর কান্নাই থামাতে পারছি না। এতক্ষণ ধরে কত ভাবেই তো চেষ্টা করে দেখলাম। ইরফান, আয়াম ওর মা’র কথা কী বলছে? তুই কিছু বুঝতে পারছিস।”
ইরফান বাবার কথা এবারও এড়িয়ে গেল। সে আয়ামকে দেখে বলল,
“ধন্যবাদ বাবা। আমি ওকে খাইয়ে দেব তুমি টেনশন করো না।
আয়াম, আয় তো ব্যাটা। আজ পাপা তোকে ঘুরতে নিয়ে যাবে। অনেকগুলো আইসক্রিম খেতে দিবে। চকলেট খেয়ে দাঁতে পোকা হলেও বকা দিবে না। টয়ও কিনে দেবে।”
বাবা ইরফানের কাণ্ড কিছুই বুঝতে পারছে সে। ইরফান তো খুলে কিছু বলছেও না। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“তুই বলছিস টেনশন করো না। আয়াম আমার চোখের সামনে কাঁদছে, ওকে কিছুতেই থামাতে পারছি না। ও বারবার হামনার নাম নিচ্ছে। কী হয়েছে তুই আমাকে কিচ্ছু বলছিস না। আর বলছিস, বাবা তুমি টেনশন করো না। তোকে বলে টেনশন করব আমি, হ্যাঁ? এসেই কোথায় বেরিয়েছিলি তুই? এমন কাক ভেজা হয়ে কোত্থেকে ফিরলি? বল আমাকে। তুই নিজে বাপ হয়েছিস বলে, নিজের বাপ থেকে বড় হয়ে যাসনি। মনে রাখিস, আমি এখনও তোর বাবা। তুই যেমন আয়ামকে শাসন করতে পারিস, ওর ভালো মন্দ নিয়ে চিন্তা করিস। তেমন আমিও। তুই আমার থেকে এভাবে কথা লুকাতে পারিস না।”
ইরফান ঘাড় কাত করে মৃদু হাসল। হঠাৎ হঠাৎ বাবার ছেলেমানুষি রাগ দেখে ওর বড্ড হাসি পায়। মানুষটাকে তার কাছে আয়ামের মতই মনে হয়। আয়াম যেমন মাঝে মাঝে বিনা কারণে জেদ ধরে, বাবাও ঠিক একই ভাবে কোন কারণ ছাড়াই জেদ ধরে। যেমন এখন ধরছে। ইরফান তার ছেলে আর বাবার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায় না। দু’জনই বাচ্চা।
“ভুলিনি। তুমি এখনও আমার বাবা। আমাকে শাসন করার সম্পূর্ণ অধিকার তোমার আছে। নিজের ছেলের জন্য একশো বার টেনশন করতে পারো তুমি। আমি তোমাকে টেনশন করতে না করে অপরাধ করে ফেলেছি। এজন্য যা শাস্তি দিবে তা-ই মাথা পেতে নেব। কিন্তু টেনশন করে প্রেশার বাড়িয়ে ফেললে তখন কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে ছুটোছুটি করব না।”
ইরফান আয়ামকে নিয়ে যেতে নিলে বাবা পেছন থেকে বলে উঠলেন,
“এসব বলে আমার কাছ থেকে আসল কথা লুকোচ্ছিস তুই। তোর নিজেকে ভীষণ চালাক মনে করার কোন কারণ নেই। আয়াম হামনার কথা কী বলছে আমাকে বল তুই। তুই কোথায় থেকে হামনাকে নিয়ে আসিস নি? আয়াম ওর মা’কে কোথায় দেখেছে?”
ইরফান, আয়াম কি সত্যিই হামনাকে দেখেছে?”
ইরফান যেন বাবার কথাগুলো শুনতেই পায়নি। এমন ভান করে আয়ামকে নিয়ে রুমের দিকে চলে গেল। ছেলের এমন আচরণ দেখে বাবা রাগে ফেটে পড়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন।
“এখন আর আমার কথার জবাব দিবে কেন? নিজে বাপ হয়ে গেছে না! এখন তো সে আমার থেকেও বড় হয়ে গেছে। নিজের ছেলের উপর ঠিকই হুকুম চালাতে পারবে সে। অথচ নিজে আমার হুকুম মানবে না। আমি তো ওর বাবা না।”
ইরফান চেঞ্জ করে আয়ামের জন্য খাবার হাতে নিয়ে রুমে ঢুকল। আয়ামের সামনে এসে বসে বলল,
“আমার ব্যাটার এখনও মন খারাপ নাকি? অমন গাল ফুলিয়ে রেখেছে কেন আয়াম?”
আয়াম অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইরফান বুঝতে পারছে, আজ আয়ামকে বোঝানো সহজ হবে না।
“আয়াম, আমার খিদে পেয়েছে বাবা। তোমার খিদে পায়নি? আমাকে আজ খাইয়ে দিবে না তুমি?”
“তুমি পঁচা। আমি তোমার সাথে কথা বলব না। তুমি আমার মাম্মীকে নিয়ে আসোনি। তুমি মাম্মীকে রেখে চলে এসেছ কেন পাপা?”
ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই অবুঝ ছেলেকে কীভাবে বুঝাবে সে!
“ওটা তোমার মাম্মী না, আয়াম।”
“না। ওটাই আমার মাম্মী। মিথ্যা বলছো তুমি। আমি মাম্মীকে চিনি। ওটাই আমার মাম্মী।”
আয়াম দৌড়ে উঠে গেল। ড্রয়ার থেকে ছবির অ্যালবাম বের করে এনে বলল,
“দেখো, এটাই আমার মাম্মী। মাম্মীর ছবি দেখেছি আমি। মাম্মীকে তুমি চেনো না। তুমি পঁচা। আমি মাম্মীকে চিনি। ওটাই আমার মাম্মী।”
ইরফান হামনার ছবির দিকে তাকাল। হামনার হাসি হাসি মুখটা দেখে বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল। এই ছবিটা তোলার সময় ইরফান কল্পনাও করেনি, সামনের বছরই হামনা তার সাথে থাকবে না।
চলবে___
আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।