#মেঘের_আড়ালে_মেঘ”১৩”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ইরফান ঘুমিয়ে আছে। মেহরীন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ওকে ডাকতে লাগল।

“এইযে শুনছেন? উঠুন না প্লিজ। মিস্টার ইরফান, শুনছেন আপনি? ”

ঘুমঘুম চোখে ইরফান মেহরীনের দিকে তাকাল। মেয়েটাকে এত উত্তেজিত লাগছে কেন? কিছু হয়েছে কি?

“কিছু হয়েছে? ডাকছেন কেন?”

“আঙ্কেল দরজা খুলছেন না। কতক্ষণ ধরে ডেকে এলাম। কোন সাড়াশব্দই নেই।”

গত রাতের ঝগড়ার কথা মনে পড়ল ইরফানের। বাবা হয়তো তার উপর রাগ করে আজ ঘর থেকে বের হচ্ছে না।

“ঘুমিয়ে আছে হয়তো।”

“এত বেলা অবধি ঘুমাবে! আঙ্কেল তো কোনদিনও এত ঘুমায় না৷ প্রতিদিন আমি উনাকে সকালে চা দিই। আজ চা নিয়ে ডাকাডাকি করে এলাম। দরজা খুললো না। ভেতর থেকে আমার ডাকের সাড়াও দিল না।”

“আপনি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছেন। বাবা মাঝে মাঝেই এমন করে। আমার উপর কোনকিছু নিয়ে রাগ করলেই এমন করে।”

“না। তবুও আমার কেমন লাগছে। আপনি একটু উঠুন না। আঙ্কেলকে দরজা খুলতে বলুন।”

বাধ্য হয়ে ইরফানকে উঠতে হলো। মেয়েটা তার থেকে বেশি তার বাবার জন্য টেনশন করে নাকি? যতসব আদিখ্যেতা। ইরফান বাবার ঘরের দরজায় গিয়ে অনেকক্ষণ ডাকল। কিন্তু ভেতর থেকে বাবার কোন শব্দ আসছে না। এবার ইরফানেরও ভয় হতে লাগল। বাবা ঠিক আছে তো?

“বাবা! ও বাবা! বাবা দরজা খোলো। বাইরে এসে রাগারাগি করো। তবুও ঘরে বন্দী হয়ে বসে থেকো না।”

“আঙ্কেল তো কোন সাড়াশব্দ করছে না।”

“আপনি একটু শান্ত হোন। বাবা এক্ষুনি দরজা খুলে দিবে।”

প্রায় ত্রিশ মিনিট ডাকার পরও যখন বাবা দরজা খুললেন না। তখন ইরফান আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না। সে চিৎকার করে বাবাকে ডাকছে। মেহরীন অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। সে কাঁদছে আর বলছে,

“আমার মনে হচ্ছে আঙ্কেলের কিছু হয়েছে। আপনি জলদি দরজা খোলার ব্যবস্থা করুন না।”

ইরফান শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। এক সময় দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম হলে। ইরফানের হাত পা কাঁপছে। সারা শরীর বেয়ে ঘাম পড়ছে। বাবা নিশ্চয়ই ঠিক নেই। নইলে এতকিছু করার পরও বাবা রাগ করে ঘরে বসে থাকতে পারত না। দরজা ভেঙে ফেলার পর ইরফান প্রথম ঘরে ঢুকে বিছানায় বাবার দিকে নজর গেল। বাবা শুয়ে আছেন। গভীর ঘুমে তলিয়ে আছেন যেন। কাঁপা গলায় ইরফান বাবাকে ডাকল।

“বাবা! ও বাবা! ঘুমোচ্ছ তুমি? বাবা ওঠো না এবার।”

ইরফান বাবার পাশে গিয়ে বসল। বাবার মুখের দিকে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে বাবার হাত ধরল। বাবার হাত বরফের মত ঠান্ডা। যেন সারারাত ফ্রিজে ছিল। ইরফানের হাত কাঁপছে। সে বাবার নাকের কাছে হাত এনে শ্বাস চলছে নাকি তা দেখার চেষ্টা করল। না, বাবার শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে না। তবে কি বাবা…

“বাবা!”

লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসল ইরফান। তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। আজকের স্বপ্নের মত ভয়ঙ্কর স্বপ্ন সে কখনও দেখেনি। বাবাকে সে কতটা ভালোবাসে তা শুধু সে-ই জানে। এইচএসসি পরীক্ষার পর তার মা মারা যায়। সেই তখন থেকে বাবাই কাছে সামলিয়েছে। তার কথা ভেবেই দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। বাবাকে কখনও জেনেবুঝে কষ্ট দিতে চায়নি সে। কিন্তু বাবা যা চাইছে তা করা ইরফানের পক্ষে অসম্ভব। হামনাকে সে কখনও ভুলতে পারবে না। বাবার কথা মনে হতেই ইরফান লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। বাবার ঘরের দিকে দৌড়াতে লাগল সে। মেহরীন ইরফানের ঘরেই আসছিল। ইরফান তার সাথে ধাক্কা খেয়েও দাঁড়াল না। ছুটতেই থাকল। মেহরীন ভ্রু কুঁচকে ইরফানের দিকে চেয়ে বলল,

“লোকটা পাগল হয়ে গেল নাকি? এভাবে ছুটছে কেন হ্যাঁ! ”

বাঁ হাতে কাঁধ ডলছে সে।

“ইশ! কাঁধটা ভেঙেই ফেলেছে। হাতি লোক একটা।”

ইরফান বাবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে জোরে জোরে দম নিচ্ছে। দৌড়ে এসে হাঁপাচ্ছে সে। বাবা ইরফানের দিকে তাকিয়েও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ইরফান কোমল গলায় ডাকল,

“বাবা!”

বাবা কথা বললেন না। টেবিলের উপর থেকে একটা বই হাতে নিলেন। ইরফান ভেতরে ঢুকে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“বাবা তুমি ঠিক আছো?”

ইরফানের গলায় এমন কিছু ছিল বাবা এবার আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারলেন না। হালকা বিরক্ত মুখে ইরফানের দিকে ফিরল। বলল,

“ঠিক থাকব না কেন? আমার আবার কী হবে?”

“কিছু না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরফান মনে মনে বলল,

“থ্যাংক গড, তুমি ঠিক আছো বাবা। আমি তোমাকে হারাতে পারব না। তুমি আমার জীবনে কতটা জুড়ে আছো আমি বুঝাতে পারব না।”

ইরফানকে ভালোমতো লক্ষ করে বাবা বললেন,

“ঘামছিস কেন তুই?”

“এমনি। গরম লাগছে।”

“হাঁপাচ্ছিস কেন?”

“ছুটে এসেছি তো।”

বাবা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,

“ছুটে এসেছিস কেন? হেঁটে আসতে মানা করেছে কেউ?”

ইরফান হুট করে সামনে এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বাবা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। এই ছেলের হঠাৎ হলোটা কী? কাল রাতে তো খুব ঝগড়া করছিল। এখন এত ভালোবাসা দেখাচ্ছে কেন।

“ইরফান! এই ইরফান! কী হয়েছে তোর?”

“বাবা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা। তোমাকে আমি কখনও কষ্ট দিতে চাই না। তবুও মাঝে মাঝে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা। আমি তোমার সব কথা শুনব। তুমি যা বলবে আমি তাই করব। তবুও তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। তুমিও চলে গেলে আমি বড্ড একা হয়ে যাব বাবা। তোমাকে হারানোর মত শক্তি আমার মাঝে আর নেই।”

ইরফান কাঁদছে। তার চোখের পানি বাবার পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাবা সেটা টের পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ইরফান কাঁদছে কেন? হামনা মারা যাবার পর ইরফানকে উনি কখনও কাঁদতে দেখেননি। হঠাৎ করে এই শক্ত ধাচেঁর ছেলেটা এমন ভেঙে পড়ল কেন?

“ইরফান৷ ও বাবা কাঁদছিস কেন তুই? আমার কিছু হয়নি তো বাবা। আমি তোর কাছেই আছি। তোকে ছেড়ে আমি কোথাও যাইনি। তুই এসব কেন বলছিস? গতরাতে তোর সাথে রাগ করেছি বলে তুই ভেবেছিস আমি তোকে একা ছেড়ে চলে যাব! এই চিনলি বাবাকে! তুই তো আমার সোনা ছেলে। তোকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব বল। বুড়ো বয়সে তুই-ই তো আমার লাঠি।”

ইরফান বুঝতে পারল বাবার সামনে তার অতটা ভেঙে পড়া উচিত হয়নি। সে মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। বাবাকে ছেড়ে চোখ মুছে হাসার চেষ্টা করে বলল,

“তুমি থাকো বাবা। আমি আয়ামকে দেখে আসি।”

কথাটা বলে ইরফান আর এক মিনিটও বাবার ঘরে দাঁড়াল না। সে চলে গেলে বাবা অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন,

“পাগল ছেলে আমার। আমাকে নিয়ে কত চিন্তা ওর।”
.
ইরফান জানে সে যতদিন বিয়ে করতে রাজি না হবে বাবা ততদিন তার পিছু ছাড়বে না। বিয়ে সে কখনও করবে না। তার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। সে মেহরীন মেয়েটার সাথে কথা বলবে।
এই ভেবে মেহরীনের সাথে কথা বলার জন্য ইরফান তার রুমে গেল।

“মিস মেহরীন আসব?”

দরজায় দাঁড়িয়ে কথাটা বললে মেহরীন তার দিকে ফিরে মনে মনে বলল,

“নিজের বাড়ি, নিজের ঘর আবার ভদ্রতা দেখাচ্ছে!”

মনের কথা মনে রেখে মেহরীন হেসে বলল,

“আসুন।”

ইরফান ভেতরে এসে ভাবছে কথাটা কীভাবে মেহরীনকে বলবে।

“কিছু বলবেন?”

“দেখুন বাবা আপনাকে কী বলেছে জানি না। কিন্তু আমি এখন বিয়ের জন্য তৈরি না। আমি কাউকেই বিয়ে করব না। বাবা যেহেতু চাইছে… তাই আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে।”

মেহরীন কপাল কুঁচকে ভাবছে এই পাগল লোক তাকে এসব বলছে কেন? নিজে বিয়ে করবে নাকি না করবে তা মেহরীনকে শুনিয়ে লাভ কী? মেহরীন কি তার বিয়ের ঘটকালি করবে? আজব!

“আমরা একটা চুক্তিতে আসতে পারি। যেমন ধরুন বিয়েটা মিথ্যা হবে। বাবা শুধু জানবে সত্যি সত্যি বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আমরা নিজেরা জানব এটা একটা ডিল। এই ডিলের জন্য আপনি যত টাকা চাইবেন আমি ততই দিতে রাজি। আর হ্যাঁ চুক্তিটা কিন্তু এক বছরের জন্য হবে। এক বছর পর আপনি মুক্ত। তখন চাইলে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে পারেন। কেউ আপনাকে আটকাবে না।”

মেহরীনের চোখ কপালে উঠে পড়েছে। সে হাঁ করে ইরফানের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। লোকটা পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। নইলে এসব উল্টাপাল্টা কথা বলছে কেন? সে কোন দুঃখে এই লোককে বিয়ে করতে যাবে। মেহরীন বিস্মিত গলায় বলল,

“বিয়ে!”

“হ্যাঁ।”

“কার বিয়ে? কে কাকে বিয়ে করছে? ”

মেহরীন এখনও ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি।

“আপনি এসব আমাকে বলছেন কেন?”

“বাবা তো আপনার সাথেই আমার বিয়ের কথা বলেছেন।”

“হ্যাঁ! কখন? আশ্চর্য, আমি আপনাকে বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে?”

“করবেন না?”

“না। কক্ষনো না৷ জীবনেও না। আপনাকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না।”

“তাহলে বাবাকে যে বললেন!”

“আল্লাহ! আপনার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। আমি আঙ্কেলকে বিয়ের কথা বলেছি! তাও আপনার সাথে, আমার! হাহ্, আপনি মনে হয় ঘুমের ঘোরে আছেন।”

“আপনি বলেননি! বাবা এমনি বলেছে? উনি আপনার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কোন আলাপ করেননি! ”

মেহরীন মনে করতে চেষ্টা করল। তার যতটুকু মনে আছে সে আঙ্কেলের সাথে বিয়ের ব্যাপারে তেমন কোন কথাই বলেনি।

“ওহ। এবার বুঝতে পারছি। আঙ্কেল জিজ্ঞেস করেছিল, আমার পছন্দের কেউ আছে কিনা। মানে বয়ফ্রেন্ড। আমি লজ্জায় আঙ্কেলকে বলতে পারিনি। আঙ্কেল হয়তো ভেবে নিয়েছে আমাকে আপনার সাথে বিয়ে দিবে। কারণ আমি হামনার মত দেখতে। তাই আপনাকে… এবার সব বুঝতে পারছি। মিস্টার ইরফান, আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে কখনও সম্ভব না। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। আর খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করব।”

ইরফান হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে বলল,

“এই কথাটা যদি বাবাকে বলতেন তাহলে এসব কিছুই হত না। আপনি জানেন না, বাবা এই কয়দিন বিয়ের জন্য আমাকে কত প্যারা দিয়েছে।”

“আঙ্কেলকে আমি বলতে পারিনি। সেটা আমারই ভুল। কিন্তু এবার আপনি আঙ্কেলকে বোঝান। আমাদের বিয়ে কোনদিনও সম্ভব না।”
.
.
তার ঠিক পরের দিন সকালে ইরফানের ফোনে আননোউন নম্বর থেকে কল আসে। সে অফিসের জন্য বের হচ্ছিল। কয়েকবার রিং হয়ে কেটে যাবার পর ইরফান নিজেই কল ব্যাক করল। তার পেশার খাতিরে তার কাছে প্রায়ই অচেনা নম্বর থেকে কল আসে। লিফট থেকে বের হতে হতে সে কথা বলছে,

“হ্যালো কে?”

ওপাশ থেকে শোনা গেল।

“আপনি এডভোকেট ইরফান আহমেদ?”

“হ্যাঁ। আপনি কে?”

“আমি যে-ই হই। আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার সাথে আমি দেখা করতে চাই।”

“আমার সাথে? ”

“জি। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। আজ দেখা করতে পারব?”

“ঠিক আছে। আমার অফিসে চলে আসুন। আমার অফিসের ঠিকানা জানেন তো?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ চিনি। আমি ঠিক সময়ে আসে পড়ব।”

ফোন রেখে অনন্ত ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসি দিল। মেহরীন কাল রাতে তাকে সবই বলেছে। অনন্তর রাগ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তার রাগ হয়নি। বরং মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। আজ সকাল সকালই সে লোকটার সাথে কথা বলে নিল। এখন বাকি কাজ দেখা হলে সেরে নিবে। টাকার খনি নিজে থেকে এসে ধরা দিতে চাইছে। এই সুযোগ কোন পাগলও হাত ছাড়া করবে না।

চলবে___

গল্প সম্পর্কিত সকল পোস্ট গ্রুপে করতে পারেন।
গ্রুপ লিংক
👇
https://www.facebook.com/groups/928548141001685/?ref=share

বিঃদ্রঃ আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য পেলে রাতে আরেক পর্ব আসতে পারে 👀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here