মাতোয়ারা
পর্ব_১৩

শুধু ইরিনের মায়ায় এবং ওর হয়রানি কমাতে আমিও নোট করতে বসলাম। আমি মেঝেতে বসতেই ইরিন বড়সড় একটা চিৎকার দিলো।
—মাই গড… ইউনিভার্সিটির তুখোড় ছাত্রনেতা আমার সাথে মেঝেতে বসেছে। ভাবা যায়? হে বাংলার ইতিহাস, এই মুহূর্তকেও তোমার সিলেবাসে শামিলললল করে নাও.. বাংলার নেতা, ছাত্রদের বস, ইউনিভার্সিটির বড় ভাইইই… নায়ক শ্রেয়ায়ায়ান চৌধুরী মেঝেতে বসে বই ঘাঁটছে। এই ঘটনা বাংলার আকাশে বাতাস ছড়িয়ে..
—স্টপ ইট ইরিন। আমি আমার জন্য বসিনি, তোমাকে সাহায্য করতে বসেছি। আমার বই ঘেঁটে নিজের পড়া নষ্ট করছো। পরে বলবে আমার জন্য তোমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।

ইরিন গান ধরলো,
আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি….
আবার দেখি নাই রে…..

সেই রাতেই আমি প্রথম জানতে পারলাম আমার সাবজেক্টে অনেক ভালো ভালো সাহিত্যের বই আছে এবং সেগুলো লিখেছেন সব নামীদামী সাহিত্যিকেরা।
আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম,
—হবে না ইরিন। সত্যিকারের স্টুডেন্ট আমি কখনোই হতে পারবো না।
—একজন নিষ্ঠুর খুনী ডাকাত লোক বিশিষ্ট আউলিয়া হতে পারলে আপনি সামান্য রাজনীতি করা ছেলে পড়াশোনা কেন পারবেন না? আপনি আরো ভালো পারবেন।
—কোন খুনি?
—কেন? নিজামুদ্দিন আউলিয়ার ঘটনা জানেন না? একশোটা খুন করার পরও তিনি একজন নামী সূফী সাধক হয়েছিলেন ।
—তুমি এত এত ঘটনা মনে রাখো কি করে ইরিন?
—ইচ্ছে করে রাখতে হয় না। মনে থেকে যায় জনাব। এদিকে তাঁকান হু আমার দিকে…. গুড এবার গালে হাত দিয়ে ভাবুন।
—গালে হাত দিয়ে ভাবতে হবে?
—দেখুন সব কাজের জন্য একটা ভালো ফিজিক্যাল পজিশান অনেক গুরুত্বপূর্ণ।এই যে, গালে হাত রাখলে ভাবনাটা ভালো হয়। রাখুন, রাখুন গালে হাত রাখুন।
আমি বাধ্য হয়ে গালে হাত রাখলাম। ভাবাভাবি মুড এলো না, তবে গালে হাত রেখে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টে আর ঢলঢলে মেরুন টিশার্ট পরনে ইরিনকে দেখতে বেশ লাগছিলো আমার।
—আপনি আগে আপনার সবগুলো বিষয় সম্পর্কে ভাবুন। কোন সাবজেক্ট দিয়ে শুরু করবেন ঠিক করুন। তারপর একটা শুভ দিনক্ষণ দেখে আপনার হাতে খড়ি হবে। আমি আপনার জন্য নতুন খাতা কলমও এনে রেখেছি।
বলেই ইরিন মেঝেতে চিত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো।
—তুমি ঘুমিয়ে যাচ্ছো?
—হুঁ।
—তাহলে নোটটা কে করবে?
—আমিই করবো। আপনি আগে আপনার টপিকগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে নিন।
ইরিন চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়েই থাকলো। আমি উদ্দেশ্যহীন ভাবে এই বই, সেই বই ঘাঁটতে থাকলাম।
ঘুমের মাঝেই ইরিন আমাকে ডাকলো।
—শুনছেন? একটা কথা ছিলো?
—তুমি জেগে কথা বলছো না ঘুমিয়ে?
—অর্ধেক জেগে, অর্ধেক ঘুমিয়ে। এই যে দেখুন আমার এক চোখ খোলা, অন্য চোখ বন্ধ।
ইরিন সত্যিসত্যিই এক চোখ বন্ধ করে আছে।
—বলবো?
—বলো…
—আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ইয়ারলি এসকারশানে সবাই কক্সবাজার যাচ্ছে। তিনহাজার টাকা করে চাঁদা.. দুদিন, তিনরাতের ট্যূর! এসি বাসে করে যাওয়া আসা। সস্তা না?
—তুমি যাচ্ছো নাকি?
—আরে যাওয়ার জন্যই জিজ্ঞেস করছি? চাঁদাটা কি বেশি না ঠিক আছে? যদি সস্তা হয়, তবে যাবো। বলুন না, চাঁদাটা ঠিক আমার পোষাবে তো?
আমি জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলাম।
—আপনি আগে কক্সবাজার যান নি? কি হলো যাননি? ভাড়ার ব্যাপারে কোনো আইডিয়া আছে?
ইরিন শোয়া থেকে উঠে বসলো।
—এতগুলো টাকার ব্যাপার। হুট করে তো আর দিয়ে দেয়া যায় না? পরে যদি দেখা যায় লস হলো। আচ্ছা চিটাগাং থেকে কক্সবাজারের ভাড়া কত?
—আমি জানি না ইরিন।
আমার মাথায় তখন অন্যরকম জেদ। ইরিন এসকারশানে কেনো যেতে চাইছে?
—আপনি কখনো কক্সবাজারই দেখেননি? এটা কোনো কথা হলো? আপনার মা বললো আপনি আটটা দেশে বেড়াতে গিয়েছেন। অথচ নিজের দেশের সেরা বীচটাই স্কিপ করে গেলেন? মানুষ আসলে নিজের দেশের সৌন্দর্য্যের গুরুত্বই দেয় না। এই জন্যই তো রবীন্দ্রনাথ আপনার জন্য লিখে গেছেন,
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া… একটি ধানের শীষের উপর.. একটি শিশির বিন্দু…
—আমি কক্সবাজার গিয়েছি ইরিন। সবসময় ফ্লাইটে গেছি। বাসের রুটটা তাই জানি না। তবে তিনহাজার টাকা এতটাও বেশি নয়। ওখানে থাকাসহ এই টাকাটা বরং সস্তা।
—তাহলে কি আমি নাম দেবো? বলছেন তো?
—হু। দিতে পারো।
—ইশ্। আমার কি যে ভালো লাগছে জানেন? বাবার কাছে থাকলে একদম যেতে দিতো না। বাবা কোথ্থাও যেতে দেয় না। ইন্টারমিডিয়েটে আমাদের কলেজ থেকে সবাই সিলেটে রাতারগুল গেলো। কিন্তু বাবার কেলানিতে আমার যাওয়া হলো না। মেট্রিকে অবশ্য যেতে দিয়েছিলেন। তবে সেটা গার্লস স্কুল বলে। এরপর থেকে কলেজের কোনো পিকনিক, ইয়ারলি পিকনিকেও আমার যাওয়া হয়নি। এই যে এখন কক্সবাজার শুনলেও ঘাইঘাই করতো। প্যানপ্যান… ওসব ট্রিপে যাওয়া ঠিক না। ছেলেমেয়েরা অবাধে মিশে। হেন না তেন না… অঘটন ঘটবে.. অথচ আপনি? আপনি কত ভালো…
আমি মনে মনে বললাম, ইরিন আমারও তোমাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না একদম। কিন্তু তোমায় বারণ করি এই অধিকার কই আমার?
মুখে বললাম,
—তুমি চাইলে আমরা ফ্লাইটে যেতে পারি ইরিন। ইচ্ছেমত বেড়াতে পারি.. যতদিন খুশি থাকতে পারি।
—হুহহহম ফ্লাইট। আপনার তো আছেই শুধু টাকা খরচের চিন্তা। বাবার পেয়েছিলেন তো…! গায়ে লাগে না তাই! আমি বাবা সবার সাথেই যাবো। হইহই করবো। তাছাড়া আপনার সাথে কক্সবাজার গিয়ে আমি কি মজা করবো? আপনি তো আগেই দেখে ফেলেছেন। তাহলে আমি কিন্তু যাচ্ছি ফাইনাল। ট্রিপ টু কক্সবাজার…

ইরিন তক্ষুনি তার বান্ধবীকে ফোন করলো। মহা খুশিতে কক্সবাজার যাবার ফিরিস্তি দিতে থাকল। আমি খুব বিস্মিত হচ্ছিলাম ইরিনকে দেখে। একটা মেয়ে, সে কখনোই আমার কাছে কিছু চায় না, ইনফ্যাক্ট কারো কাছেই না। আমাদের এত বিলাসবহুল বাড়ি। অথচ সে কত সাধারণ থাকছে। নিজের মতই সস্তা জামাকাপড় কিনছে। জুতা সেলাই করে পরছে। কোনো গয়নাগাটি নেই, বাড়তি চাওয়া নেই। সারাদিন ফ্রক পরে পাখির মতো বাড়িময় ঘুরছে। কখনো সখনো বাগানের গাছে নিরানি দিচ্ছে, কখনো বা ছাদ পরিষ্কার করছে। কখনো একা একা টিভি দেখে লাফাচ্ছে। কখনোবা সিনেমার গানের সাথে গলা মেলাচ্ছে। এখন আবার কক্সবাজার যাই যাই করে আনন্দে টালমাটাল হচ্ছে।
আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমাদের বিবাহিত জীবন কোনদিকে যাচ্ছিলো। শুধু মনে হচ্ছিল আমার ভেতরে অন্য একটা আমি, আমাকে ইরিনের জন্য খুব তাড়া দিচ্ছিলো। বারবার করে জানিয়ে দিচ্ছিলো ইরিনকে আঁকড়ে ধরতে। আচ্ছা, ইরিন কি চায়? ও এই জীবনটা চায় তো? নাকি অন্য কিছু?

ইরিন ফোন রেখে এসে আমার মুখের উপর ঝুঁকে তাঁকালো।
—জানেন, কক্সবাজার থেকে আমরা সেন্টমার্টিনও যাবো। উফ্ আমার তো ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। দেখুন।
—কবে যাচ্ছো?
—সাত তারিখে। আর মাত্র তেইশ দিন বাকি। তেইশ তেইশ তেইশ….
ইরিন গান ধরলো,
“ওই ঝিনুকফোটা সাগর বেলায় আমার ইচ্ছে করে…
আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের ভেলায় তোমার হাতটি ধরে…”

আমার দৃষ্টি তখন অন্য জায়গায়। ইরিনের ঝুঁকে থাকা বুকের ভাজে। সবুজ ব্রায়ের ভেতর থেকে ফিনকি দিয়ে বেরুনো আগুন ঝলকানি। আমি পুড়ে যাচ্ছিলাম শাঁ শাঁ করে। আর ইরিন? সে নয়? সে তো শুধু মুক্ত পাখির মত কথা বলতেই থাকলো। সেইরাতে আমার মনে হলো, ইরিন এসকারশানে যাওয়ার কথা না বলে যদি আমাকে দুটো চড়ও মারতো তাতেও আমি কিছু মনে করতাম না। কিন্তু ইরিনের কক্সবাজার যাবার আনন্দ আমার কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না। বারবার ধারালো পাথর হয়ে বুকে বসে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল, সমুদ্র দেখতে আমাকে ছেড়ে কেনো? আমিও থাকবো। সেই প্রথম কক্সবাজারের উপর আমার খুব রাগ হলো। ভূমিকম্পে কক্সবাজার ধ্বংস হয়ে যাক। আমি সেই প্রার্থনাও করলাম। নিজেকে এত দূর্বল মনে হচ্ছিলো যে বলে বুঝানো যাবে না।

ইরিনের যাওয়া নিয়ে আমি এতটাই আপসেট হয়ে পড়লাম যে, ওদের ডিপার্টমেন্টের স্যারকে পর্যন্ত ফোন করে বললাম ওর বিশেষ খেয়াল রাখতে। মন যেনো তাও স্বস্তি পাচ্ছিলো না। এর মধ্যে আমার সাঙ্গপাঙ্গরাও উড়ো খবর দিলো।, ইরিনের ডিপার্টমেন্টের নাফিস
নামে কোন একটা ছেলে ইরিনকে খুব কনসার্ন দেখায়। মাঝে মাঝে ইরিনকে তাঁর সাথে গল্প করতে দেখা যায়! ক্যান্টিনেও একসাথে খেতে দেখা গেছে।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ছেলেটার বায়োডাটা কালেক্ট করলাম। এক ব্যাংক কর্মকর্তার ছেলে। রাজশাহীতে বাড়ি। পড়াশোনার সূত্রেই ঢাকায় এসেছে। এভারেজ দেখতে, এভারেজ সবকিছু। এই ছেলের ইরিন বিষয়ে কেন এত আগ্রহ? ইরিনই বা এই ছেলেকে পাত্তা দিচ্ছে কেন?

চলবে…

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here