মাতোয়ারা
পর্ব_০৭

ইরিনের ইনজুরি আরেকটা বিশাল ইনজুরি ঘটিয়ে দিলো আমার মনে। আর সেটা ঘটালো রিয়া।
পুরো ইউনিভার্সিটিতে আমার বিরোধী দলেরগুলো যখন ইরিনের ব্যাপারটা নিয়ে তুলকালাম করছে।, ঠিক সেই মুহূর্তে আমি হয়তো একটু মানসিক ক্ষতিতে পড়েছিলাম। রিয়া সেই সুযোগটা নিলো। রটিয়ে দিলো, আমার চরিত্র খারাপ, আমার মেয়েদের সাথে বিছানায় যাবার দোষ আছে। অনেকদিন আগে আমি শুতে চেয়েছিলাম তার সাথে, হয়নি বলে তাকে মেরেছি আমি। রিয়া ভালো ছাত্রী ছিলো, আগেই বলেছিলাম। আর ইউনিভার্সিটির ভালো ছাত্রী কিছু বললে সেটা যে কতটা সত্য আর বিশ্বাস্য হয় সেরকম পরিস্থিতিতে না পড়লে আমি হয়তো বুঝতাম না। ইরিনকেও নাকি আমি বিয়ের কথা বলে ইউজ করেছি। নতুন মেয়ে, জুনিয়র মেয়ে; বিয়ের কথা ইউনিভার্সিটিতে বলে দেওয়ায় আমি তাঁকে টর্চার করেছি। হয়তো সেজন্যই সে ইনজুরড। ইনজুরির কথাটা আরো নোংরাভাবে রটে গেলো; শুধু পা ভাঙা নয়, ইরিনের হয়তো এবরশানও করিয়েছি আমি। আগেই বলেছি মারামারি করা তুখোড় ছাত্রনেতা আমি। পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছি কয়েকবার। সুতরাং আমার চরিত্রের বিষয়ে এই কথাগুলো বিশ্বাস করা সবার জন্য সহজ ব্যাপার ছিলো। দেখতে ভালো হওয়ায় অনেক মেয়ে আমার কাছে এসেছে। হয়তো সাড়া দেইনি আমি। সেই রাগ, ক্ষোভ মিলেমিশে ইরিনের ব্যাপারটায় ছোটখাটো যুদ্ধ বেঁধে গেলো ইউনিভার্সিটিতে।
ইরিনের বাবা বারবার আমার কাছে এর সমাধান চাইছিলেন। হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে ইরিনের বাসায় যাবার পর আমি ওকে দেখতে যাইনি আর। কিন্তু এর সপ্তাহখানেক পর ইরিন অামাকে ফোন করলো।
—আপনার সাথে জরুরি দরকার, এক্ষুনি একটু আসতে পারবেন।
ইরিনের গলা শুনেই মনে হলো, সে কাঁদছে।
আমি নিজেকে খুব শক্ত মনের মানুষ ভাবতাম। কিন্তু ইরিন বিষয়ক ঘটনা আমাকে খুব নেড়েচেড়ে দিচ্ছিলো। হয়তো তার কান্নাও আমাকে কাঁদিয়ে দিচ্ছিলো।

আমি তাৎক্ষণিক ওদের বাসায় গেলাম। এবং গিয়ে যা দেখলাম, তা আমার কল্পনারও বাইরে। আমাদের ইউনিভার্সিটির উল্লেখযোগ্য কিছু ছাত্র নেতা (যারা আমার বিরোধী) ইরিনের বাসায়। এন্ড দ্য মোস্ট শকিং থিং ওয়াজ, রিয়া ওয়াজ উইথ দেম।
—ব্যাপার কি?
ইরিন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—উনারা আমাকে নিয়ে একটা প্রেস কনফারেন্স করতে চান। আপনার সাথে আমার কি সম্পর্ক সেটা নিয়ে।
ভাবুক সারা পৃথিবী আমায় খারাপ। কিন্তু রিয়া কেন ভাববে? আমার একসময়ের ভালোবাসা মিশ্রিত প্রচন্ড আবেগ আমার জীবনে অভিশাপ হয়ে এলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না কোনটা আমার জন্য দুঃস্বপ্ন, ইরিন নাকি রিয়া?
ইরিনের বাবার অবস্থা তখন ব্যাখ্যার বাইরে। মেয়েকে পারলে তিনি টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে আমি পাথর হয়ে বললাম,
—ঠিক এক্ষুনি কি করলে সবটা সলভ হবে?
দলবেঁধে আলোচনা করে সমাধান এলো,
—এভাবে একটার পর একটা মেয়ে নিয়ে তো আমি খেলতে পারি না। সুতরাং প্রকাশ্যে ইরিন বিষয়ক ক্ষমা প্রার্থনা করে রিয়ার কাছে মাফ চাইতে হবে। এবং ইরিনের সাথে আমার অবৈধ সম্পর্কের বৈধতা দিতে বিয়ে করতে হবে।
আমি যেনো রিয়াকে সেই মুহূর্তে চিনতে পারছিলাম না। বিষয়টার মধ্যে রিয়া না থাকলে হয়তো খুনাখুনি হয়ে যেতো। কিন্তু আমার সবথেকে দূর্বলতার জায়গায় বিঁধেছিলো বলে, আমি ব্যাপারটায় সম্মত হলাম।
রিয়া এতে বিস্মিত হয়েছিলো। এত সহজে সবটা কেনো আমি মেনে নেবো?
ইরিন একাধারে কাঁদছিলো শুধু। বারবার করে বলছিলো,
—এত কলঙ্ক আমি বয়ে বেড়াতে পারবো না ভাইয়া। কিছুতেই না। আমি মরে যাবো। আমি এরকম কিছুই করিনি। ইউনিভার্সিটিতে আমার কেউ ছিলো না, ব্যাকিং পেতেি শুধু আমি আপনার নাম ব্যবহার করেছিলাম। ইভেন আপনাকে নিয়ে যখন আমি গসিপ তৈরি করি, তখন আমি সরাসরি আপনাকে দেখিওনি!
আমি মনে মনে বলছিলাম তখন, এতে তোমার কোনো দোষ নেই ইরিন। অনেকদিন আগে আমি ভুল করে কাউকে কঠিন ভালোবেসে ফেলার শোধ নিচ্ছে সে।
সেদিন সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটিতে ভাঙ্গা পা নিয়ে ইরিন আর আমার বিয়ে হয়ে গেলো।
রিয়ার মুখে তখন সার্থকতার হাসি। সে আমায় মেসেজ করলো, “আমায় জোর করে চুমু খেয়েছিলে বন্ধ ঘরে। আর আমি তোমার ইমেজ ধর্ষণ করলাম সবার সামনে”।
ইরিনের বাবা এতটাই মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন যে, তিনি ইরিনের গলা ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন সবার সামনে। অথচ আমি জানি, তাঁর মেয়ে আর আমার মাঝে তখন কি ব্যথা বয়ে যাচ্ছিলো। ইউনিভার্সিটি তখন রমরমা, ক্যারেক্টারলেস আমার একটা হিল্লে হলো। পিয়নের মেয়ে গলায় ঝুললো। এই দুঃখে আমার গর্জন কমবে, হুঙ্কার কমবে, নেতৃত্ব কমবে। কেউ কেউ তো আনন্দ মিছিলও বের করলো।
সেদিন সবার সামনে দিয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে গেট অবধি আমি ইরিনকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে বসালাম। আমার জেদ ছিলো, যেটা তোমরা আমায় ঘাড়ে বোঝা করতে চাঁপিয়ে দিলে সেটা যে আমি সহজেই বইতে পারি, তা আমি শ্রেয়ান চৌধুরী বুঝিয়ে দিতে চাইছিলাম মনেপ্রাণে।
ইরিনকে গাড়িতে বসিয়ে আমি ওর বাবাকে দু-হাত জোড় করে বললাম,
—আপনি যদি আমাদের এখানে, মানে কাছে এসে থাকেন আমি হয়তো ইরিনকে ভালো রাখতে পারবো। ও সত্যিই খুব কষ্ট পাচ্ছে, আপনার জন্য…
ইরিনের বাবা কিছু না বলে নিশ্চুপ চলে গেলেন।
আমি ড্রাইভিং সিটে বসতেই ইরিন অসার কণ্ঠে বললো,
—আমার জন্য সব কেমন শেষ হয়ে গেলো তাইনা, ভাইয়া? হয়তো পুরো জীবনটাই। আমি ঠিক মরে যাবো দেখবেন, ঠিক খুব তাড়াতাড়ি।
আমি মনে মনে বললাম, এবার তো তোমার চ্যালেঞ্জ বেঁচে থাকা। আমার সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে গেছে ইরিন। বাকী পুরোটা তুমি লড়বে, আমার জন্য।
বাড়িতে বউ নিয়ে এসেছি এতেই আমার মা খুশি ছিলেন। বিয়ে কিভাবে হলো, কেনো হলো এসবে তাঁর কিছুই আসে যায় না…৷
ইরিন হয়তো ব্যাপারগুলো নিতে পারছিলো না। রাতে শরীর খারাপ হয়ে গেলো খুব।
আমি বারান্দায় বসে সিগারেটে ডুবে ছিলাম সেদিন সারারাত। ভোররাত থেকে ইরিনের প্রচন্ড বমি শুরু হলো। আবার হসপিটালাইজড করতে হলো তাকে।
ইরিনের ইনজুরি হয়তো শারীরিক ছিলো। মেডিসিনে সাড়ানো সম্ভব ছিলো।
আর আমার মনের ইনজুরির কোনো মেডিসিন ছিলোনা। একদিকে রিয়ার তৈরি করে দেওয়া আমার অন্তরের ক্ষত, অন্যদিকে আমার কারণে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ইরিন। এদিকে আমার ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক ফিল্ডেরও খারাপ অবস্থা। সব মিলিয়ে আমার নতুন যুদ্ধ শুরু হলো।

আর আমার গল্পের শুরু এখান থেকেই…..

চলবে…

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here