#ভাগ্যবতী
#লাবিবা_তানহা_এলিজা
#পর্ব_৭

১১.
পূরবীকে নিচ তলার একটি রুম দেওয়া হয়েছে। রুমটা ছোট তবে একজন থাকার জন্য পারফেক্ট। একটা খাট পাতা রয়েছে পূর্বপাশে। তার পাশেই একটা কাবার্ড রয়েছে তারপাশে একটা ড্রেসিং টেবিল। দক্ষিনে একটা জানালাও আছে। পূরবী বাড়তি কোন দরজা দেখতে পেলো না। বাথরুম কি এই রুমের সাথে এডজাস্ট নেই? প্রশ্নটা পূরবীর মাথায় ঘুরপাক খায়। জমিলাকে করবেনা করবেনা বলে জিজ্ঞাসাই করে বসে ” খালা! এইরুমে বাথরুম নাই? ”
” না খালা। ড্রয়িং রুমের সাথে কমন বাথরুমে যাইতে হবো আপনারে। ”
” ওহ। ”
” কোন সমস্যা নাই। আমি আর আপনে শুধু যাইবো। আমি পরিষ্কার করে রাখি সবসময়। অপরিষ্কার এই বাড়িতে নট অ্যালাও । ছোটসাহেব এক্কেবারে সহ্য করতে পারে না। প্রথম দিন আমি কিচেনে একটু ময়লা করছিলাম। পরিষ্কার করতে ভূলে গেছিলাম। ধরা পড়লো ছোট সাহেবের চোখে। সে কি রাগ। ধমক দিয়ে তখনি সাফসাফ জানায়ে দিছে অপরিষ্কার এই বাড়িতে নট অ্যালাও।”
জমিলার কথা বলার ধরন দেখে পূরবী মুচকি হাসে।বড্ড ঢং করে হাত পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলে জমিলা। বয়স হবে চল্লিশ -পঁয়তাল্লিশ। এখনো থ্রি পিচ পরে। পূরবী বলে,
” ডাক্তার তো তাই আর কি। ”
” জানি গো জানি। আপনি কাপড় খান ছাড়েন তো। আপনার খাবার দিতেছি। ছোট সাহেব ও খাইবো। দেড়ি হয়তাছে আমার। পরে আবার ধমক খাইতে হবো। ”

জমিলা চলে যায়। পূরবী তাকিয়ে থাকে। ধমক খাবে? কে দিবে? মি. ডাক্তার? বয়সে এতো বড় মানুষটাকেও ধমক দেয়? যেরকম রাগ আজ দেখা গেলো সেই মতে খালাকে ধমক দেওয়া বড় কিছু নয়।
গহনাগুলো খুলতে খুব জামেলা পোহাতে হলো পূরবীকে। কানের ফুটো মূহুর্তেই লাল হয়ে যায়। অতিরিক্ত টানাটানির ফলে এই অবস্থা। এমন ভাবে কচি লেগেছিলো যে খুলাই যাচ্ছিলো না। গহনা আর টাকাগুলো কাবার্ডে রেখে দেয়।জামা কাপড় গুলোও বের করে সাজিয়ে রাখে। একটা থ্রি পিচ বের করে কমন বাথরুমটি খুঁজে বের করে। বাথরুমটি মোটামুটি বড়। লো কমট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাফ ইউজের জন্য বানানো হয়েছে। পূরবী সাওয়ার ছেড়ে গোসল করে দেয়। সমস্যা হলো শরীরের ক্ষত গুলো নিয়ে। পানির ছোয়া পেয়ে যেনো জলে যাচ্ছে। বের হতেই চোখ পড়ে সিড়ির দিকে। মোচড়ানো বাকা সিড়ি উপরের দিকে চলে গেছে। এরকম সিড়ি আজ প্রথম দেখলো পূরবী। একটু এগিয়ে যেতেই দেখে পেছনদিকে বড় একটা ডাইনিং। তার পাশেই কিচেন। পুরো বাড়ি চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকে পূরবী। বেশ দামী দামী ফার্নিচারে সাজানো গোছানো একটি বাড়ি। বাড়িটি দুতলা ।আসার সময় বাইরে থেকে দেখা হয়েছে। অনেক সুন্দর ডিজাইন বাড়িটির আর বেশ বড়। হটাৎ পায়ের শব্দ পেয়ে উপরের দিকে তাকায়। সাদকে দেখতে পায়। একহাতে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে। পরনে লাল-খয়েরি টি শার্ট আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট হাটুর একটু নিচ অব্দি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাওয়ার নিয়েছে। অনেক ফ্রেশ লাগছে। পূরবী আর এক মূহুর্তো দাঁড়ায় না। দৌড়ে রুমে চলে আসে। দরজার কাছে আসতেই হোঁচট খেয়ে ব্যথার আঙুলে আবার ব্যথা পায়। ” ও মাগো ” বলে পা ধরে বসে পড়ে।
পূরবীর দৌড়ে আসা নজর এড়ায়নি সাদের। চিৎকার শুনে এদিকেই আসে। পূরবীকে পা ধরে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করে, ” কি হয়েছে? আবার ব্যথা পেয়েছো? ”
পূরবী মাথা তুলে তাকায় সাদের দিকে। মাথার দেয়া ওড়নাটা টুপ করে পড়ে যায় । পূরবীর ভেজা চুল গুলো মুখে লেগে আছে। সাথে টলমল করছে দু চোখে পানি। রাতে যে জলভরা চোখ দেখে মায়া হবার জন্য আজ পূরবী এখানে সেই জলভরা চোখদুটো দিনের আলোতে আবার দেখছে সাদ। প্রচন্ড রাগ হয় সাদের। পূরবীকে একটানে দাড় করিয়ে বলে, ” বজ্জাত মেয়ে তুমিতো হাটতেই পারো না আবার দৌড়াতে গিয়েছিলে কেনো? ভাল্লুক এসে তাড়া করেছিলো তোমাকে? ”
মমতা সেখানে চলে আসে। ” কি হয়েছে ” জিজ্ঞাসা করতেই পূরবীর চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পায়ে ব্যথা পাবার কথা জমিলা বললে মমতা পূরবীকে ধরে ডাইনিং এ এনে চেয়ার টেনে বসায়। জমিলাকে এইড বক্স আনতে বলে। জমিলা এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। সাদের ধমকা ধমকি দেখে আর কিছু বলার সাহস পায়নি। মমতা যত্ন নিয়ে পূরবীর পায়ে ঔষধ লাগিয়ে দেয়। একটুও ব্যথা লাগেনা পায়ে।
” আপনিও কি ডাক্তার? ” পূরবীর প্রশ্নে পূরবীর দিকে একবার তাকায় মমতা।
” না। আমি ডাক্তারের মা। ”

টেবিলে ভাত দেওয়া হয়েছে। পূরবী খেতে পারছেনা। গলায় আটকে যাচ্ছে। একটু পর পর সামনের দিকে তাকাচ্ছে। পূরবীর সোজাসুজি বসেছে সাদ। পাশে মমতা। সাদ একটু পর পর চোখ তুলে দেখে যাচ্ছে পূরবী খেতে পাচ্ছে না। কিন্তু কোন কথা বলছে না। পূরবী দেখছে সাদ কীভাবে খাচ্ছে। ফ্রক দিয়ে একের পর এক চিকেন ফ্রাই আর সালাদ খেয়ে যাচ্ছে । মমতা পূরবীর দিকে পানি এগিয়ে দেয়। পূরবি এবার এক লোকমা মুখে দেয় আর পানি দিয়ে গিলে খায়। মমতা জিজ্ঞাসা করে, ” ভালো নাম কি তোমার? ”
” নওশীন আনবার পূরবী। ”
” সুন্দর নাম। আমার পছন্দের। আমার পরিচিত এক পিচ্চির নাম রেখেছিলাম নওশীন আনবার। বাসা কোথায় তোমার? ”
” তুলসীপুর। ”
” বাবার নাম ?”
” পলাশ খাঁ। ”
” হুম। কিসে পড়ো? ”
” ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। ”
” নূরার কেমন বোন হও তুমি? ”
চমকে তাকায় সাদ। পূরবীও সাদের দিকে তাকায়। সাদ মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে।
” আ.. আমি? ”
” হ্যাঁ তুমি। তোতলাচ্ছ কেনো? ”
” কাজিন। দূরসম্পর্কের কাজিন। ” কথা বলতেই গলা কাপছিলো পূরবীর। এতোক্ষণ কি সুন্দর উত্তর দিচ্ছিলো। সিরিয়াস উত্তরেই গলা কাঁপতে হলো তার।মেয়েটা সুন্দর করে মিথ্যাটাও বলতে পারে না। সাদ মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।কিছু বললোনা দেখে হাপ ছেড়ে বাচে।

সাদ চলে যেতেই মমতা পূরবীর দিকে ঘুরে বসে। শক্ত গলায় বলে, ” মিথ্যা কথা বলতে পারো না তো বলো কেনো? ”
” আমি.. ”
” তুমি নূরার কাজিন নও। নূরার কাজিন হলে নূরা তোমাকে সাদের সাথে পাঠাতো না। সাদ নূরার ফ্রেন্ড তোমার নয়। সাদ ছেলে মানুষ। এমন সুন্দরী বোনকে কখনোই একা ছাড়তো না তার বাসায় থাকতে দেয়া তো দূরের কথা। নিজের লোকেদের প্রতি নূরা কেমন পসেসিভ তা আমি ভালো করেই জানি। ও নিজের বাসায় না রাখতে পারুক ঢাকা শহরে তার মেয়ে ফ্রেন্ড আর রিলেটিভসের অভাব নেই। আমাকে সত্য করে বলো কে তুমি? সাদের সাথে কি সম্পর্ক তোমার? ”
পূরবী চুপ থাকে। এমন ভাবে জেরা করায় পূরবীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। মমতা ধমকে বলে,
” কি হলো চুপ করে আছো কেনো? বলো আমার ছেলের সাথে কি সম্পর্ক? ”
” আআমি চিনিনা। ”
” চিনিনা মানে? চিনোনা অথচ তার সাথে তার বাড়িতে চলে এলে? ”
জমিলা বলে, ” মেয়েটারে কাদা. .”
মমতা হাত উঠিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।
” কি হলো কথা বলছো না কেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। বিয়ের আসর ছেড়ে একটা মেয়ে এমনি এমনি পালাবেনা যদি বয়ফ্রেন্ড না থাকে। আমাকে বোকা ভেবো না তুমি। ”
পূরবী এবার কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত ঘটনা বলে দেয়। মমতা, জমিলা শুনে স্তব্ধ ।এতো কষ্ট আছে মেয়েটা! সাদ যদি না বাচাতো কি হতো মেয়েটার? ছেলের জন্য গর্বে বুক ফুলে উঠে মমতার। ঠিক শিক্ষা দিয়ে বড় করেছে ছেলেকে। কিন্তু এবার নূরার সাথে বোঝাপড়া আছে। এরকম দাহা মিথ্যা কিভাবে বললো সে মমতা শেখের সাথে ? হুট করেই পূরবী মমতার পা ধরে বসে।
” আমাকে বের করে দিবেন না প্লিজ। আমি বড্ড অসহায়। নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাকে দয়া করে একটু আশ্রয় দিন। এই অচেনা শহরে আমার কেউ নেই। কিছুই চিনিনা। আমাকে একটু আশ্রয় দিন। আপনারা বড়লোক। একটু দয়া করুন। ” বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। পূরবীর কান্না দেখে মমতা বুক ভরে শ্বাস ছাড়ে। জমিলাকে ইশারা করতেই জমিলা পূরবীকে নিয়ে চলে যায়। মমতা উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। কি মনে করে ঘুরে একবার সাদের রুমের দিকে আসে। দরজাটা লক করা দেখে আবার ফিরে আসে। মমতা সিদ্ধান্ত নেয় পূরবীকে এখানেই রাখবে। বাইরের জগত কতটা ভয়ংকর তা মেয়েটা একদিনেই অনেক টা টের পেয়ে গেছে। এবার একটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চোখের জল ফেলছে। ঐরকম ফুলের টুকরাকে অবহেলায় ফেলে দিতে পারে না মমতা। মেয়েটার জান মাল সম্মান রক্ষা করার জন্য হলেও আশ্রয় দেওয়া উচিত।

১২.
পূরবী কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে দুপুরেই। সন্ধ্যা হতে যাচ্ছে তবুও উঠার নাম নেই। জমিলা একটু পর পর পূরবীকে এসে দেখে যায়। তার জন্মে হাতে গোনা এরকম সুন্দরী মেয়ে দেখেছে সে। একদম ফুলের মতো। মেয়েটার কপালটা খারাপ বলে আফসোস করতে থাকে জমিলা। তবে মেয়েটা ভাগ্যবতী তা না হলে কি এইখানে আসতে পারে? একবার যখন এসে গেছে একটা না একটা ব্যবস্থা করবেনই বড় মেডাম। এই মেয়েটার মতো সেও তো একদিন চাল চুলোহীন ছিলো। ভাগ্যক্রমে এই বাড়ির সন্ধ্যান পেয়েছে। মাথার উপর ছাদ পেয়েছে। বারো বছর থেকে এবাড়িতে আছে। শেষ নিঃশ্বাসটাও বোধহয় এ বাড়িতেই ত্যাগ করবে। জমিলা পূরবীর ঘুমন্ত মূখের উপর হাত রাখে।
” মাশাল্লাহ। আল্লাহ এই মেয়েটা ছোট সাহেবের বউ হইলে কি এমন হইতো? ছোট সাহেবের পাশে কি সুন্দর মানায়! যখন একসাথে দরজার সামনে দাড়াইয়া আছিলো কি সুন্দর লাগতাছিলো দুইজনরে.. ”

পূরবী গালে কারো স্পর্শ পেয়ে জেগে উঠে। জমিলাকে দেখতে পেয়ে হুড়মুড় করে বসে। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর মমতা শেখের কথা মনে পড়ে। মূহুর্তেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
” খালা। কি বললেন উনি? আমাকে এখনি চলে যেতে বলেছে? আমি কোথায় যাবো খালা? আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই। ” পূরবীকে উত্তেজিত হতে দেখে জমিলা পূরবীর কাধে হাত রেখে বলে, ” শান্ত হও। বড় মেডাম কিছুই বলেনাই। উনি তো আর নিজের রুম থেকে বেরই হয়নাই। ”
তবুও স্বস্তি পায় না পূরবী। জমিলা পূরবীর পাশে বসে বলে,
” সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাও উঠো নাই। শরীর দুর্বল লাগে মা? ”
পূরবী উপর নীচ মাথা নাড়ায়।
” ঠিক হয়ে যাবো ” বলে জমিলা উঠে চলে যায়। পূরবী শান্তি পাচ্ছে না। বিছানা গুছিয়ে উঠে ওযূ করে আসে। নিজের একটি উড়না বিছিয়ে নামাজে বসে পড়ে। সিজদায় গিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চায়। বিপদে একমাত্র আল্লাহর শরণার্থী হয়। আল্লাহই পারে একমাত্র সাহায্য করতে কোন না কোন উসিলায় ।

চলবে,

আপনার পরিচিতো পাঠক কে উপন্যাস টি পড়ার জন্য ইনভাইট করুন। উপন্যাস টি লেখা শেষ হবার পর পর ই
ডিলিট করা হবে। পরে পড়বেন বলে যারা বসে আছেন এমন বোকামো করবেন না। অনুগ্ৰহ করে কেউ কপি করবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here