বাসন্তী
পর্ব-২০
লিমু

_____ ” একদম নির্জীব,শান্ত, নিথর হয়ে ঘুমিয়ে আছে প্রণয়ের ফুলবাসন্তী। মেয়েটাকে এমন অবস্থায় দেখে,প্রণয়ের ভেতরটা বারবার হু হু করে কেঁদে উঠছে। কেন এমন হলো,কি দোষ ছিল এই মেয়েটার? ভালো মানুষগুলোই কেন কষ্ট পায় জীবনে?

_ ” পুষ্প কেমন যেন পাগলামী করছিলো সেন্স আসার পর। ওর চোখেমুখে কেমন একটা আতঙ্ক বিরাজ করছিলো,যেটা প্রণয় স্পষ্টত বুঝতে পারছিলো। কিন্তুু ঠিক কি কারনে পুষ্প এমন ভয় পাচ্ছিল, সেটা প্রণয় অণুধাবন করতে পারছিলনা। পুষ্প কি কাউকে দেখে ভয় পেয়েছিলো?

_ ” প্রণয় মনে মনে ভাবলো, কলির কাছে জিজ্ঞাস করতে হবে,ঐখানে কেউ ছিল কিনা। আর নয়তো হঠাৎ করে পুষ্পর এমন রিয়াক্ট করার কথা না।
এসব ভেবে ভেবে প্রণয় আবার পুষ্পর মুখের দিকে দৃষ্টি আরোপ করলো।
ইসস…মেয়েটার চেহারার কি হাল হয়েছে এ কদিনে। দেখলেই একরাশ কষ্ট ঘিরে ফেলে মনপ্রাণ দুটোই।

_ ” পুষ্প গভীর ঘুমে নিমঘ্ন,কারন ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তাই প্রণয় পুষ্পর পাশে বসতে পেরেছে। মেয়েটাকে একটু প্রাণভরে দেখতেও পারে না যে সে,শুধু দূর থেকে ছটফট করতে হয়। এতো কাছে সে,তবুও যেন শতক্রোশ দূরত্ব। এ দূরত্ব কবে মিটবে,কেউ জানেনা। কাছে পেয়েও, কাছে নেই সে। এক অদ্ভুত দেয়াল গড়ে রেখেছে
বিভেদ। যে বিভেদ প্রণয়ের পুষ্পকে তার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তুু মায়াচন্ডী কেন আমার থেকে নিজেকে লুকোতে চাইছে? সে কি আমাকে একটুও বুঝতে পারেনি এতোদিনে। হ্যা হয়তো কাউকে জানার জন্য তিনমাস খুব কম সময়,কিন্তুু কখনো কখনো যে বছরের পর বছর একসাথে থেকেও কেউ কাউকে জানতে পারে না। অনেক বছরের সম্পর্কেও যে বিচ্ছেদ ঘটে,আবার অল্পদিনের পরিচয়েও অনেকে দিব্যি একজীবন একসাথে পার করে দেয়। তাই ভাগ্যে কি আছে, সেটাতো কেউ জানেনা। তবে আমরা তাই পাই জীবনে,যা আমরা করি। ভালো করলে, ভালো পাবো। আর মন্দ করলে মন্দ। তবে হ্যা, ব্যাতিক্রম ও ঘটে,সেটা ভিন্ন বিষয়।

_ ” পুষ্পর একটা হাত প্রণয় ওর দু’হাতের মধ্যে নিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ করলো। একা একাই কথা বলতে লাগলো তার মায়াচন্ডীর সাথে।
আচ্ছা তুমি এতো অভিমানী কেন হুম? এই যে আমার সাথে কথা বলোনা,আমার সামনে আসতে চাওনা,আমার কি কষ্ট হয় না? তুমি বুঝোনা,আমার যে কষ্ট হয়?
একবার এ চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো তো,এচোখে শুধু ভালোবাসায় দেখতে পাবে। কোন শঠতা নেই সেখানে,জানো তো মানুষ মুখে মিথ্যা বললেও চোখ সত্যি বলে দেয়।

_ ” তুমি কি বুঝতে পারছোনা,নাকি বুঝতে চাইছোনা? কেন এমন করছো আমার সাথে? তুমি আগেও যেমন আমার বাসন্তী ছিলে,এখনও ঠিক তেমনই আছো। আর সবসময়ই আমার হৃদকুঠিরের ফুলবাসন্তী হয়ে থাকবে। আজ বুঝতে পারছি,কেন এতোদিনেও কোন মেয়ে আমার মনে দাগ কাটতে পারে নি। কারন কেউ যে মায়াচন্ডী ছিল না তোমার মতো। তুমি রুপবতী নও,তুমি মায়াবতীও নও। তবুও তুমি যেমন, তেমনই অনন্যসাধারণ। নিজেকে তুমি একটুও বদলাও নি,এই আধুনিকতার ভিড়ে। তুমি তোমার স্বকীয়তায় অটুট থেকেছো। আমি হয়তো এমন কারো অপেক্ষায় ছিলাম এই এতোদিন। কিন্তুু কি থেকে কি হয়ে গেল বলো।
থাক এসব বাদ,একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে আমরা এটা ভুলে যাবো। জানি তোমার জন্য এটা সহজ হবে না,কিন্তুু তোমার প্রণয় আছে না,সে তার প্রণয়ে জড়িয়ে সব ব্যাথা ভুলিয়ে দিবে। তুমি শুধু একটু সাহস করো,সমাজ কি বলবে তাতে কিছু যায় আসে না এই প্রণয় মেহবুবের। এই সমাজ পারে শুধু ভালো কিছুর সমালোচনা করতে। আর মন্দ কিছু ঘটলে মুখে কুলুপ এটে রাখতে। যারা মন্দের প্রতিবাদ করতে পারে না,ভালোর সমালোচনা করার কোন অধিকার নেই তাদের।

_ ” কলি প্রণয়কে ডাকতে ডাকতে রুমে আসছিলো,কিন্তুু প্রণয়কে এভাবে পুষ্পর হাত ধরে বসে থাকতে দেখে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। আর মনে মনে বলতে লাগলো, এই একসিডেন্টটা না ঘটলে আজ হয়তো শুধু একজন নয়, দুজন দুজনের হাত ধরে থাকতো। জীবন মাঝে মাঝে কেন এতো কঠিন সিচুয়েশনে নিয়ে ফেলে আমাদের। এমন সিচুয়েশন, যেটা থেকে চাইলেই সহজে বের হয়ে আসতে পারিনা আমরা। দাঁত কামড়ে কষ্ট,যন্ত্রনাটা সহ্য করতে হয়। কলির অজান্তেই ওর দু’চোখ বেয়ে অবাধ্য জলের ফোটাগুলো গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কলি দু’চোখ মুছে, ওদের দিকে তাকালো। আর মনে মনে দোয়া করলো আল্লাহর কাছে,যেন ওর বু দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। প্রণয় ভাইয়া যেন তার মায়াচন্ডী, তার বাসন্তীকে নিজের ভালোবাসার বাহুডরে আবদ্ধ করতে পারে। কলি মনেপ্রাণে এখন এটা চায়।

_ ” যে ভালোবাসা প্রণয়ের চোখে কলি দেখেছে ওর বুবুর জন্য,সে ভালোবাসা কখনো হেরে যেতে পারে না। একটা আটার-বিশ বছরের ছেলের ভালোবাসা আবেগ হতে পারে,তবে একজন আটাশ বছরের পুরুষের আবেগ থাকে না। সে হুটহাট কারো প্রেমে পড়বেনা। কিন্তু যাকে ভালোবাসবে, তাকে মন উজার করেই বাসবে। এতটুকু কলি জানে।

হঠাৎ প্রণয়ের ডাকে কলি চমকে তাকালো।
ঐখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”
_ ” নাহ,এমনি।

_ ” ভিতরে আসো। কলি পুষ্পর পাশে গিয়ে বসলো।

_ ” প্রণয় জিজ্ঞাস করলো,আচ্ছা কলি তোমার বু কি কাউকে দেখে ওমন রিয়াক্ট করেছিল?”

_ ” আমি ঠিক বলতে পারবোনা ভাইয়া। আমি যখন তাকাই,তখনতো কাউকে দেখতে পায় নি।

_ ” প্রণয় বললো, ওহহ। কিন্তুু আমার মনে হয় ও কোনকিছু দেখে বা কাউকে দেখে ভয় পেয়েছে। কিন্তুু যতদিন পুষ্প সুস্থ না হচ্ছে,স্বাভাবিক না হচ্ছে ততদিন তো কিছুই অনুমান করা যাচ্ছেনা।

_ ” তা তো ঠিকই ভাইয়া। বু যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে,তত তাড়াতাড়ি সবকিছু জানা যাবে। তার আগে যে আমাদের কিছুই করার নেই।

_ ” হুম,সেটাই। কলি তুমি কলেজে যাবে না? আজকে না তোমার ওরিয়েন্টেশান?

_ ” ভালো লাগছেনা ভাইয়া।”

_ ” আরে এসব বললে হবে নাকি। পড়াশুনা তো করতে হবে, তাইনা। তোমার বুর স্বপ্ন পূরন করতে হবে না?

_ ” কলি জোর করে মৃদু হাসতে গিয়েও কেঁদে দিলো।

_ ” এই বোকা মেয়ে, একদম কান্না বন্ধ। কান্না কোনকিছুর সমাধান নয়। আর তুমি না অনেক স্ট্রং গার্ল,তাহলে বোকার মত কাঁদছো কেন?

_ ” কলি কোন কথা বলতে পারছেনা কান্নার জন্য। আসলে আমরা বাহিরে যতই দেখায় না কেন শক্ত,ভিতরে ভিতরে ঠিকই সবার কষ্ট থাকে। কেউ সেটা প্রকাশ করে,কেউ করে না। কিন্তুু কখনো কখনো সেই চাপা কষ্ট বেরিয়েই যায়। যেমনটা এখন কলির হচ্ছে।

_ ” ফুলকলি, কান্না দ্রুত শেষ করো।
আমার ফুলকলিকে যে কান্না করতে দেখতে একদম ভালো লাগে না,তাকে যে হাসিখুশিতেই মানায়।

_ ” আর তারপর রেডি হয়ে কলেজে যাও। নতুন বন্ধু-বান্ধব হলে মন ফ্রেশ লাগবে।
বাসায় থাকো তো সারাদিন তাই আরো মন খারাপ থাকে। নিয়মিত কলেজে গেলে দেখবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।আর তোমার বুও দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

_ ” আর শোনো,একা যেতে পারবে,নাকি প্রিয়মকে বলবো আজকে তোমাকে দিয়ে আসতে?

_ ” নাহ,আমি একাই যেতে পারবো ভাইয়া।

_ ” নাহ,আজকে প্রথমদিন দিয়ে আসুক। পরে তুমি একাই যেও।

_ ” কলি আর কিছু বলতে পারলনা,কারন জানে প্রণয় আর ওর কোন কথা শুনবেনা। তাই ফ্রেশ হতে চলে গেল।

_ ” হঠাৎ পুষ্পর ঘুম ভেঙ্গে গেল। পুষ্পর হাতটা কেমন যেন ভারী লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে।

_ ” কিন্তুু কি সেটা পুষ্প অনুমান করতে পারছেনা। সোজা হয়ে শুয়ে ছিল পুষ্প,তাই একটু ঘাড়টা ডানদিকে ঘুরিয়ে যেটা দেখলো সেটার জন্য ও প্রস্তুত ছিল না। প্রণয় ওর হাত মুঠোয় রেখে বিছানার পাশেই ফ্লোরে বসে ছিল। বসে থেকেই হালকা ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়।

_ ” গত একটা মাস ধরে প্রণয় হয়তো দু’চোখ ঠিকমতো এক করতে পারে নি। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। গতকাল রাতও ঘুমায়নি,তাই হয়তো এখন এভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে।

_ ” পুষ্পর কান্না পাচ্ছে,ভীষণ কান্না পাচ্ছে প্রণয়কে এভাবে দেখে। পুষ্পর ভেতরটা নিঃশব্দে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে প্রণয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। ও তো চেয়েছিলো নিজেকে প্রণয়ের প্রণয়ে রাঙাতে,কিন্তুু ভাগ্য যে সবসময়ই বিড়ম্বনা করে ওর সাথে। পুষ্প জানে,এতোকিছুর পরও এই ছেলেটা ওকে ছেড়ে চলে যাবে না। কিন্তুু পুষ্প যে অসহায়,ও চাইনা ওর কারনে প্রণয়ের দিকে আঙুল তুলে কেউ কথা বলুক।

_ ” ভালোবাসার মানুষের রেসপেক্ট বজায় রাখাও যে,ভালোবাসার অন্যতম প্রধান শর্ত। আর পুষ্প চাইনা,ওর কারনে প্রণয় কথা শুনুক। ভালো না বাসতে গিয়েও, মনের অজান্তে অনেকটা বেশিই ভালোবেসে ফেলেছে পুষ্প। হয়তো অনেক বেশি স্বপ্নও সাজাতে শুরু করেছিল,কিন্তুু সেই স্বপ্ন কাঁচের টুকরোর মতোন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। আর ভাঙ্গা কাঁচ ধরত গেলে যে,হাত কাটার সম্ভাবনা প্রবল। তাই পুষ্প সেই ভাঙ্গা কাঁচে আর হাত দিতে চায় না। সে অনেক দূর চলে যাবে,যেন প্রণয়ের ভালোবাসা তার নাগাল না পাই। এটা ভেবেই পুষ্পর দু’চোখ অশ্রুতে ভারী হয়ে উঠলো। ও চাইছে কান্না না করতে,কিন্তুু আবেগ যে বড্ড অবাধ্য। সে কান্না হয়ে বের হয়ে আসবেই।

_ ” হঠাৎ পুষ্প বামকাত হয়ে শোয়ার জন্য ঘুরতে নিলে, প্রণয় হকচকিত হয়ে জেগে উঠে। ও বুঝতেই পারে নি কখন প্রলাপ বকতে বকতে পুষ্পর হাত মুঠোতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। পুষ্প কি ওকে দেখে ফেলেছে? দেখলে তো ওর রিয়াক্ট করার কথা,তাহলে মনে হয় দেখেনি। এটা ভেবে প্রণয় পুষ্পর হাতটা আস্তে করে ছেড়ে, একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লো।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here