বাসন্তী
পর্ব-১৪
লিমু

——-“অবশেষে অনেক কষ্টে কলি পুষ্পকে রাজি করিয়ে ছাড়লো প্রণয়কে দেখতে যাওয়ার জন্য। অনেকভাবে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে তবে রাজি করাতে পারলো পুষ্পকে। পুষ্প একরকম না পেরে রাজি হলো,আচ্ছা মানবতার খাতিরে তো যাওয়াই যায়। পুষ্প রাজি হওয়ায় কলি পুষ্পকে জড়িয়ে ধরলো হুট করেই,পুষ্পর মাথায় এটাই ঢুকছে না কলি ওকে ঐখানে যাওয়ার জন্য এত কেন তেল মারছে। পুষ্প আর ভাবতে পারছেনা,ওর মাথা কাজ করছেনা।

-” কলি চলে গেল ফ্রেশ হতে,পুষ্প জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো চুপচাপ। প্রকৃতিতে এখন গ্রীষ্মকাল চলে,বসন্ত বিদায় নিয়েছে গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা পেয়ে। বাইরের আকাশটা হালকা মেঘে ঢাকা,মৃদু বাতাস বইছে। পুষ্প চোখ বন্ধ করে কালকের ঘটনাটার কথা মনে করলো। ও দেখেছিল প্রণয় চলে গেছে,তাই আনমনে জানালার কাছে দাঁড়িয়েই কি যেন ভাবছিল। ঠিক তখনি প্রণয় আবার ফিরে আসে এবং পুষ্পকে বাড়াবাড়ি রকমের লজ্জায় ফেলে দেয়। পুষ্প কল্পনাও করতে পারে নি,প্রণয় এমন একটা কাজ করতে পারে।

-” প্রণয় একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিল,আর পুষ্প মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনে হচ্ছে ও নড়াচড়া করতে ভুলে গেছে,অথবা নড়াচড়া করলেই ওকে কোন শাস্তি দেওয়া হবে। পুষ্পর এ অবস্থা দেখে প্রণয় কত কষ্ট করে যে হাসিটা চেপে রেখেছে, সেটা শুধু প্রণয়ই জানে। অবশ্য প্রণয় সম্পুর্ণ কাজটা ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে। কারন ওর কেন যেন মনে হচ্ছিল মায়াচন্ডী ওকে আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখছে। তাই ওর মনে হওয়াটাকে পরখ করতেই আবার ফিরে আসে,তবে অন্য গলি দিয়ে। কারন এইদিক দিয়ে আসলে তো ধরা পড়ে যেতো,তখনতো সব ভন্ডুল হয়ে যেতো। পুষ্পর এই ভয়ংকর সুন্দর অবস্থাটা দেখতে পেতো না।

-” ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চার কপি করতে গিয়ে ধরা পড়লে শিক্ষকের সামনে যেমন অবস্থা হয়,পুষ্পর অবস্থা তারচেয়েও সিরিয়াস। ও হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি,এভাবে ধরা খাবে।

-” কিন্তুু ওর স্বপ্ন, কল্পনা সব ভেংগে চূড়ে দিয়ে প্রণয় আরেকটা কাজ করে বসলো।
যেটার জন্য ও একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। পুষ্প জানালার পাশে প্রায় দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রণয় ওকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে দিয়ে ওর দিকে এগুতে লাগলো,পুষ্পর ভয়ে জান যায় অবস্থা। পুষ্প একেবারে দেয়ালের সাথে লেগে গেল,প্রণয় ওর দু’হাত দু’দিকে দিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালে ঐ গভীর নয়নপানে।

-” কিন্তুু সে তো নজর লুকানোর চেষ্টায়,একটুও তাকাচ্ছেনা প্রণয়ের দিকে। চোখ বন্ধ করছে,আবার একটু একটু খুলে দেখছে প্রণয়কে। প্রণয়ের খুব হাসি পেল এটা দেখে। পুষ্পর চোখের সামনে আসা চুলগুলো বামহাতে সরিয়ে দিল,পুষ্প ভয়ে একটু কেঁপে উঠলো। এবার চোখ মেলে তাকালো প্রণয়ের দিকে, কিন্তুু যেই প্রণয় ওর দিকে মুখ এগুচ্ছিল তখন একদম ভয়ে চোখ বন্ধ করে কাঁপতে লাগলো। মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে দিবে ভয়ে।

-” প্রণয় পুষ্পকে অবাক করে দিয়ে একদম ওর কানের কাছে গিয়ে বললো,” ভালোবাসি তোমাকে,তার মানে এটা নয় সুযোগের অপব্যবহার করবো। ভালোবাসা মানে বুঝোতো? ভালোবাসা হলো শুধুই ভালোবাসা,সেখানে মন্দবাসা বলতে কিছু থাকতে নেই। আর কাউকে ভালোবাসার আগে জরুরি তার বিশ্বাস অর্জন করা,আর তাকে সম্মান করা। এই দুটো জিনিস অনেক বেশি জরুরি ভালোবাসায়, অনেক বেশি। ওপাশের লোকটার প্রতি যদি তোমার বিশ্বাসই না থাকে,তার প্রতি সম্মানই না থাকে,তাহলে আর যাই হোক আমি অন্তত সেটাকে ভালোবাসা বলবোনা।

-” পুষ্পর মনে হয় দমবন্ধ হয়ে আসছিল,ওর চোখ থেকে একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। যেটা পড়ার আগেই প্রণয় হাতের মুঠোয় তুলে নিল।”

-” পুষ্প ধীরে ধীরে নিচে বসে পড়লো, ওর মুখে কোন কথা নেই,বোবা হয়ে গেছে।

-” প্রণয়ও হাটুতে ভর দিয়ে ফ্লোরে বসলো, পুষ্পর হাতটা ওর হাতে নিল। প্রণয় বেশ বুঝতে পারছে পুষ্প কাঁপছে, এমনি এতো সাহস। আর এখন একেবারে ভীত হরিণীর ন্যায় চুপসে গেছে। অবশ্য দেখতে বেশ লাগছে এই মুখটা।

-” প্রণয় পুষ্পর হাতটা ধরেই বললো,” ভালোবাসলে একটু তো রিস্ক নিতেই হয়,আমাকে বিশ্বাস করার রিস্কটা একটু নিয়েই দেখো। এত অবিশ্বাস দিয়ে তো জীবন চলে না। বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়েই তো জীবন। সবাই তো আর ঠকে না,আর সবাই ঠকায়ও না। জানো তো যে যেমন,তার সাথে তেমনই হয়। ভালোর সাথে ভালো,মন্দের সাথে মন্দ,এটাই সত্য। আর যদি কখনো ভালোর সাথে মন্দ হয়,তবে বুঝতে হবে উপরওয়ালা হয়তো তার পরীক্ষা নিচ্ছে। আর যে ভালো মানুষের সাথে প্রতারণা করে,প্রকৃতি থাকেও সহজে ছাড় দেয় না। সেও কোন একসময় নিজের কৃতকর্মের ফল অবশ্যই ভোগ করে,সেটা শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার।
প্রকৃতি কোন ঋণ রাখে না, সময়ে সুদসহ পুষিয়ে দেয়।

-” পুষ্প অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো প্রণয়ের দিকে,নাহ এই চোখে কোন মন্দ দেখতে পাচ্ছে না পুষ্প। যেটা দেখতে পাচ্ছে, সেটাই হয়তো শুধুই ভালোবাসা। যে ভালোবাসার জন্য মানুষ সারাজীবন হাহাকার করে, হন্য হয়ে খুঁজে সেই ভালোবাসা। যুগ যুগ প্রতীক্ষা করে এমন ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। কিন্তুু পুষ্প তো এ মায়ায় নিজেকে বন্দি করতে চায় না।

-” ভালোবাসায় যে সুখের চেয়ে দুঃখ বেশি।
আর দুঃখের দহনে পুড়তে যে সবাই পারে না,মাঝপথে হাত ছেড়ে দেয়,সেটাই ভয়।”

-” পুষ্পকে আরো অবাক করে দিয়ে প্রণয় বললো,আমি আমার জীবনের বাসন্তী কে কখনো দুঃখের দহনে পুড়াবো না,এই যে একবার শুধু ভরসা করে হাতে হাত রাখো। সেই হাত মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ধরে রাখার দায় আমার,শুধু আমার প্রতি বিশ্বাস রেখো সর্ববস্তায়। তাহলে যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক না, আমি সব মোকাবেলা করতে পারবো। তুমি শুধু ভরসা রেখো আমার ভালোবাসার প্রতি।

-” পুষ্প ঠাঁই বসে রইলো,ওর মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। যখন অনুভূতিরা কথা বলে,তখন বোধহয় মুখ ভাষা হারায়।
এই লোকটা কি পুষ্পর মন,চোখ সব পড়তে জানে নাকি! এটা ভেবে পুষ্প অবাক হলো।

★★★

-” পুষ্প শাড়ি পড়লো। কালোর মধ্যে লাল কম্বিনেশনের জামদানি শাড়ি। এটা গত ঈদে পুষ্প ওর মায়ের জন্য কিনেছিল।
হাতে কালো, লাল কাচের চুড়ি। চোখে কাজল, ঠোটে লিপস্টিক পরা পুষ্পর অতোটা পছন্দ না। পরলেও সবসময় হালকা কালার পরে,ডার্ক কালার পরতে ওর অসস্থি লাগে। চুল খোলা রাখলো আজকে কলির কথায়। পুষ্প এমন ভাব করছে যেন কলি মনে করে ওর যাওয়ার বেশি ইচ্ছে নেই। তাই কলি ওকে বিভিন্ন কথা দ্বারা খুঁচালেও,পুষ্প সেগুলো গায়ে লাগাচ্ছেনা।

-” এই যেমন কলি বললো, দেখো তুমি থাকে পছন্দ করো না, তাহলে তার সামনে যেতে তোমার কিসের এত হেজিটেশন?
আমরা সাধারনত তার সামনেই যেতে পারিনা, যার জন্য মনের কোণে বিশেষ অনুভুতি আছে।

-” এ কথা শুনে পুষ্প সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলো যাওয়ার জন্য। আর কলি মনে মনে বললো,যাক একটা প্লান অন্তত কাজে দিয়েছে।

-” কলি একটা লং গাউন পরলো,বেবি পিংক কালারের। চুড়ি,কানের দুল এসব পরা কলির কার্য নয়,এসবে এলার্জি তার। একদম সোজাসাপ্টা থাকতে ভালোবাসে।
হাতে জাস্ট একটা ব্রেসলেট পরলো গোলাপী পাথরের।

-” পুষ্পর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কলি। পুষ্প কি যেন ভাবছিল,এই মেয়ে কি যে এতো ভাবে কলি সেটাই ভেবে পায় না। কলি পুষ্পকে আয়নার সামনে দাঁড় করালো। অনেক্ষন পর্যবেক্ষণ করে বললো,জাস্ট কপালে একটা ছোট্র কালো টিপ থাকলে একদম পার্ফেক্ট লাগতো।

-“এটা শুনে পুষ্প বললো,জানিস না মুসলমানদের টিপ পরা নিষেধ। যদিও কজনেই বা মানে সেটা।”

-“কলি বললো,হুম সেটাই। আচ্ছা বাদ দাও,চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে। পরে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”

-” সন্ধ্যা হবে মানে? আমরা কি ঐখানে খেতে যাচ্ছি নাকি?”

-” নাহ। তবে একজায়গায় গেলে তো আর সাথে সাথে এসে পরা যায় না।

-” হুম

-” জ্বি,ম্যাডাম। এবার চলুন দয়া করে।

-” আচ্ছা কলি শোন না,চুলটা বেনী করে ফেলি। এভাবে চুল ছেড়ে বাইরে যেতে আমার ভালো লাগে না। আর খোলা চুলে বাইরে যাওয়া ঠিকও না।

-” বুঝছি বোন,আমারি ভুল হইছে। আপনি আপনার প্রাচীনকালের ঐ শাবনূর বেনীটাই করুন।”

-” পুষ্প আর কিছু না বলে হালকা ঢিলা করে বেনী করলো। বেনীটা ডানপাশে সামনে এনে রাখলো। মনে মনে বললো এবার ঠিক আছে।

★★★

-” বাসার কলিংবেল বাজতেই প্রণয় তড়িঘড়ি করে টি শার্ট খুঁজতে শুরু করলো। কারন মাত্রই শাওয়ার নিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। আগে গিয়ে চেক করলো কে এসেছে। ম্যাজিক আই এ চোখ রেখে পুষ্পকে দেখে প্রণয়ের মাথা মনে হয় বেশ কয়েকটা চক্কর দিল। এই মেয়ে আমাকে খুন করবে,তার রুপে নয়, মায়ায়।

একটা মানুষের চেহারায় কি করে এতোটা মায়া থাকতে পারে,সেটা প্রণয়ের জানা নেই।

-” প্রণয় দরজা খুলতে নিয়ে আবার বন্ধ করে দিল নিজের দিকে তাকিয়ে। তাড়াহুড়ো করে একটা টি-শার্ট পরে এসে দৌঁড়িয়ে দরজা খুললো।

-” কলি প্রণয়কে দেখেই একটা হাসি দিল। প্রণয়ও হালকা হাসলো কলির দিকে তাকিয়ে। কিন্তুু ওর চোখ তো পুষ্পতে স্থির হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোন মায়াপরী ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কালো জামদানিতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে পুষ্পকে। প্রণয়ের এ তাকানো দেখে পুষ্প পড়লো ভারী অসস্থিতে। পুষ্প চোখের সামনের চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজার জন্য হাত তুলতেই, চুড়ির রিনিকঝিনিক শব্দে প্রণয়ের ঘোর কাটলো।

কলিই প্রণয়কে বললো,আমরা কি ভেতরে আসতে পারি,না এখান থেকেই আপনাকে দেখে চলে যাবো?

-” প্রণয় ভীষন নার্ভাস হয়ে গেল এটা শুনে।
বললো, কি যে বলো ফুলকলি। প্রথমবার আমার বাসায় পদার্পণ, এভাবে চলে যাবে মানে? এসো, এসো ভিতরে এসো।

-” কলি হেসে ঢুকলো,পুষ্প প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো,” কেমন আছেন?

-” পুষ্পর ঠান্ডা গলায় প্রশ্নটা শুনে প্রণয় অবাক হলেও,সেটা সামলে নিয়ে বললো,” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।

-” তুমি?

-” জ্বি,ভালো।

-” কলি সোফায় গিয়ে বসে টিভি অন করে দিলো। এই মেয়ে এমনি,মনে হয় সে এই বাসায় আরো কতবার এসেছে। অন্তত ওর ভাব দেখে যে কেউ এটাই বলবে।”

-” পুষ্পও গিয়ে কলির পাশে বসলো। প্রণয় মাথা চুলকাতে চুলকাতে ওদের পাশের সোফায় বসলো।

-” হঠাৎ প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে কলি তার সেই বিখ্যাত রাক্ষসীর হাসিটা দিলো। মনে হচ্ছে বিল্ডিং ছেদ করে সেই হাসি শহরময় ছড়িয়ে পড়ছে। পুষ্প একটু রাগ নিয়ে তাকালো কলির দিকে,কিন্তুু কলির হাসি থামার নাম নেই। মনে হচ্ছে ও ভীষন মজার কিছু দেখে ফেলেছে। ঐদিকে প্রণয় ভীষণ অসস্থি বোধ করতে লাগলো।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here