বাসন্তী
পর্ব-০৫
লিমু

-” আজকের দিনটাতে পুষ্প কোনদিনই বাইরে বের হয় না। কেন জানি ওর ভালো লাগে না। বেশ কয়েকবছর ধরে পহেলা ফাল্গুনের পরের দিনই থাকে চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি, আর এই দিনটা পুষ্প ঘরে বসেই কাটায়। বিশেষ মানুষ নেই বলে না,কেন যেন নির্দিষ্ট একটা দিনকে ভালোবাসার দিন হিসেবে ভাবতে ভালো লাগে না পুষ্পর। ভালোবাসা সেতো হবে ক্ষণে ক্ষণে,মনে মনে। একজনের হৃদয়ের অনুভুতি আরেকজনের সাথে ধাক্কা খাবে,অনুভূতি অনুভূতিতে ভাব হবে, তবেই না ভালোবাসা। লোকে শুধু শুধু ঘটা করে একটা দিনের সীমাবদ্ধতায় বেঁধে ফেলে তাকে,অথচ ভালোবাসা হলো বাঁধনহারা পাখি। যে পাখি যত মুক্তভাবে উড়বে,ততই ভালোবাসা বাড়বে। ভালোবাসার কোন সংজ্ঞা নেই,কোন মানে নেই,কোন যুক্তি নেই। ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা।
যে ভালোবাসার জন্য যুগ যুগ অপেক্ষা করতেও আনন্দ,তবুও সেই শুভ্র ভালোবাসাই আসুক জীবনে।

-” কোন কথা হবে না,কোন স্পর্শ হবে না তবু দুজন পাশাপাশি থাকলেই মনে হবে আর কিছু চাওয়ার নেই জীবনে। দুজনের চোখ কথা বলবে,হৃদয়ে হৃদয়ে কথা হবে। একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের শব্দটা শুনেও বুঝে যাবে সে কেমন আছে,কি ভাবছে,কি চাইছে। যদি একজন আরেকজনের চোখের ভাষাই না পড়তে পারে,তাহলে সে ভালোবাসার গভীরতা কোথায়। আর ভালোবাসা তো আর এমনি এমনি গভীর হয়ে যায় না।

-“অনেক ত্যাগ,ধৈর্য,সহিষ্ণুতা, নির্ভরতা,দায়িত্ববোধ,শ্রদ্ধাবোধ,বিশ্বাস,আর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসায় ভালোবাসাকে গভীর করে তোলে। আজকাল মানুষের মধ্যে এসব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর,তুচ্ছ কারনেও সম্পর্ক ভেংগে যাচ্ছে।
পুষ্প একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আনমনে এসব ভাবতে।

 

-” কলি পরীক্ষায় চলে গেছে,কবির স্কুলে।
হঠাৎ পুষ্পর মাথায় একটা প্লান আসলো,আজকে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে গেলে কেমন হয়। বিশেষ মানুষকে নিয়েই ঘুরতে হবে এমন কোন মানে নেই,আর পরিবারের চেয়ে বিশেষ মানুষ আর কেউ হতে পারে না। সবসময় পরিবার প্রথম, তারপর বাকীসব।

-” যেই বলা সেই করা,পুষ্প ওর মাকে বললো রেডি হতে, কলিকে আনতে যাবে সেন্টার থেকে। তারপর কবিরকে নিয়ে সবাই ঘুরতে যাবে পার্কে। আজকে বৃহস্পতিবার, তাই স্কুল হাফ ডে। আর কলির পরীক্ষা শেষ একটায়। অতঃপর পুষ্প শাওয়ার নিয়ে একটা নীল শাড়ি পড়লো,সাথে নীল কাচের চুড়ি। ঠোটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক,আর চুল খোঁপাই করলো।লম্বা চুলে আসলে ছোট চুলের মতো এতো ডিজাইন করা যায় না,তাই খোঁপাটাই বেস্ট। আর শাড়ির সাথে খোঁপাটাই মানায়।

-” খোঁপার একপাশে একটা কৃত্রিম গোলাপ গুজে দিল। গোলাপটা গুজতে গিয়ে কালকের ঘটনা মনে পড়ে গেল,সাথে সাথেই পুষ্প চোখ বন্ধ করে ফেললো।
একদম ঐ ত্রিপলির কথা মাথায় আনতে চায় না পুষ্প, বেটা অসভ্য।

-” সিংগার হয়েছে দেখে ভেবেছে একটু বাজালেই মেয়ে পটে যাবে,নিজের মতো সবাইকে হ্যাংলা মনে করে।

-” আর আজকে সকালে যে কাজটা করলো,চূড়ান্ত অসভ্যতামি। কোন রিএক্ট করিনি কারন আমার বাসার সামনে ছিল,আশেপাশে সবাই আমার পরিচিত।
না হলে এমন কাজ করার জবাবটা একটু দিয়ে দিতাম।
-” আমি আফরা পুষ্প,নামটা শুনে কোমল মনে হলেও মোটেও আমি তেমন নয়। যারা আমাকে ভালো করে চিনে, তারা জানে আমি কেমন। আমার সাথে কোন হ্যাংকি প্যাংকি করলে, তার উত্তর বেশ ভালো ভাবেই দিতে জানি। এটা বলে পুষ্প ডানহাতের তর্জনী আংগুল দিয়ে নাকের ডগার নিচে টান দিল। এটা ওর একটা অভ্যাস।

.
-” সবাই মিলে ঘুরাঘুরি করে যখন বাসায় ফিরছিল,তখন ঘটলো এক বিপত্তি।
একটা গাড়ি প্রায় ওদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিল,অল্পের জন্য বেঁচে গেল।
গাড়িটা তাড়াতাড়ি কোনক্রমে ব্রেক কষলো,না হলে বড় দুর্গটনা ঘটে যেত আজকে। পুষ্প রাগে ঐ গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল,যদিও পুষ্পর মা মানা করছিল।

-” পুষ্প গাড়ির কাছে যেতেই একটা ছেলে নেমে আসে,ছেলেটার চোখ কেমন লাল লাল। দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র নেশা করে এসেছে। এদের সাহস বলিহারি,ড্রাংক অবস্থায় গাড়ি চালাতে বের হয়ে পড়ে। বাপের আছে হয়তো অঢেল টাকা,এসব ছাইপাশ গিলে নষ্ট করে।

-” ছেলেটা বোধহয় কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তুু সে কিছু বলার আগেই পুষ্প তাকে কষিয়ে একটা চড় মারলো। ইতিমধ্যেই সেখানে চারপাশে মানুষজন জমা হয়ে গেছে,যার কারনে ছেলেটার মুখ রাগে লাল হয়ে গেলেও কিছু বলতে পারছেনা। কারন এখানে কিছু বললেই পাবলিকের খেলানি খেতে হবে,যেহেতু দোষটা তার।
ছেলেটার বয়স খুব বেশি নয়,পুষ্পর বয়সী বা দুই এক বছরের বড় হতে পারে।
পুষ্প ছেলেটাকে একগাদা কথা শুনিয়ে দিল,ছেলেটা ঠোট কামড়ে রেখে কথাগুলো হজম করছিল।

-” পুষ্প একটা সিএনজি ডেকে সবাইকে নিয়ে উঠে চলে গেল। ছেলেটা ঐখানেই কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল,হয়তো খুব অপমানবোধ লাগছে তাই। তবুও যদি এদের অভ্যাস বদলায়,কিন্তুু এদের তো গন্ডারের চামড়া। সহজে কোন কথায় ইফেক্ট পড়ে না এদের।
.

-” রাতে খাওয়ার পর পুষ্প একটা বই হাতে নিল পড়ার জন্য। মুহম্মদ জাফর ইকবালের” আমি তপু” বইটা। বইটা পড়লে কষ্ট হয় আবার একইসাথে অনেক ভালো লাগে। প্রিয়াংকা ক্যারেক্টারটা অসাধারন, তপুর লাইফটাই বদলে দিল হঠাৎ এসে।

-” জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাসগুলো বরাবরই অসাধারন। টুকুনজিল,লিটু বৃত্তান্ত,বুবুনের বাবা আর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘ আমার বন্ধু রাশেদ।

-” রাশেদ কে যখন রাজাকাররা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বলে,তখনও সে জয় বাংলা বলে। কারন চোখ বেঁধে যখন তাকে নিয়ে যায় নে জানতো তার মৃত্যু নিশ্চিত। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্তও সে দেশপ্রেম থেকে একচুল নড়ে নি। রাশেদের মৃত্যুর দৃশ্যটা চোখে ভাসলেই পুষ্পর কান্না চলে আসে। এইটার মুভিটাও দেখেছে পুষ্প।

-” পুষ্প এসব ভাবছিল আর কলি টেবিলে পড়ছিল। হঠাৎ জানালা দিয়ে কি যেন একটা ঢুকলো,যেটা দেখে পুষ্প ভয় পেয়ে গেল। তবে কলি একটুও ভয় পেল না,কারন সে সাইন্সের স্টুডেন্ট। আর যে জিনিসটা ভেতরে এসেছে সেটা ছিল একটা ছোট ড্রোন রোবট। পুষ্প চুপচাপ বিছানায় বসেছিল,কলি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

-” কলি দাঁড়াতেই একটা ছেলে ওর দিকে হাত নাড়াতে গিয়ে আবার থেমে গেল। কলি বোধহয় বুঝে গেল ছেলেটা কে,পুষ্পকে প্রশ্ন করলো,” আচ্ছা বু ত্রিপলি কতটুকু লম্বা?
-” ছয়ফুটের কম হবে না। কিন্তুু হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস কেন?
-” ওয়েট বলছি।
-” কলির যা বুঝার বুঝে গেল,তাই তাড়াতাড়ি করে ড্রোনটার সাথে কি আছে সেটা দেখার জন্য হাতে নিল। তেমন কিছুই নেই একদম ছোট্র একটা টেডি যেটার বুকে লাল লাভ সাইনের মধ্যে লিখা ‘আই লাভ ইউ।”

-” এবার কলির কাছে সবটা স্পষ্ট হয়ে গেল। আর একটা চিরকুট,কলি চিরকুট আর টেডি টা পুষ্পর হাতে দিল। আর নিজে এমন একটা কাজ করলো যেটা জানতে পারলে পুষ্প ওর কান আর আস্ত রাখবে না। কলি ওর ফোন নাম্বারটা লিখে ড্রোনটার সাথে বেঁধে দিল,ঐটা নিচে যেতেই কলি প্রণয়ের হাসিমাখা মুখটা দেখতে পেল। লাইটের হালকা আলোতে সেই হাস্যজ্ব্যল মুখটা দেখেই কলি ফিদা হয়ে গেল। দেখতে ফর্সা নয় তবে ছেলেদেরকে এই গায়ের রংটাতেই বেস্ট লাগে। কলির ধারণা ছেলেরা বেশি ফর্সা হলে প্লাস্টিকের মত লাগে। তবে প্রণয়কে দেখে যে কোন মেয়ের হার্টবিট মিস হওয়ার কথা আর তার বোনকে দেখো!
এটা বলে কলি পুষ্পর দিকে তাকিয়ে আফসোস করলো। এই মেয়েটা এমন কেন,একদম রসকসহীন বেগুন।

-” তারপর মনে মনে বললো,সরি বু আগেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি। তবে এমন একটা ডার্ক চকোলেট ছেলেকে দুলাভাই বানানোর জন্য যদি হাজার বার তোর হাতের কানমলা খেতে হয়,তবুও সেটা মঞ্জুর।
এমন কাউকে তোর বর হিসেবে পাওয়ার জন্য হাজার বার তোর বিরুদ্ধে যেতে প্রস্তুত এই বান্দা। এইটা বলে কলি পুষ্পর দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টুমি হাসি দিল, যেটার মানে পুষ্প কিছুই বুঝলনা।
কলি জানালা লাগিয়ে দিল, তার আগে প্রণয়কে বাই জানালো। প্রণয়ও হাত নাড়ালো,আর ভাবলো ইনি মনে হচ্ছে আমার দলে নাম লিখাবেন।

ঐদিকে কলি পুষ্পর কাছে গিয়ে দেখে পুষ্প চিটিটা খুলেও দেখেনি,এই মেয়ের দ্বারা কিছু হবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে দেখছি,অবশ্য তার আগে ঐ ত্রিপলিকে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে,তারপর বাকী কাজ।

তারপর পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বললো,বু যদি ঐ ডার্ক চকোলেট ভালো স্বভাবের হয়, তাহলে তোর মনে যদি তার জন্য কাপন না ধরাতে পারি তবে আমি ‘আরহা কলি না,নাম বদলে দিবো।

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here