বাসন্তী
পর্ব-০২
লিমু
-” আমাদের স্বভাবটাই এমন বুঝেছিস,নিজের সবকিছুই নিজের কাছে খুব স্পেশাল আর অন্যের গুলো ঠুনকো।
ভুল করেও মানুষ উঁচু গলায় কথা বলে কি করে ভেবে পায় না।
-” আরে পুষ্প ছেলেটা তো তোকে সরি বলেছিল, তুই মনে হয় ওভার রিএক্ট করে ফেলেছিস। বেচারার শখের গিটারটা এভাবে ছিড়ে ফেলা বোধহয় ঠিক হয় নি।
-” তোর কি তার জন্য খুব মায়া হচ্ছে,তাহলে যা তার গিটারটা রিপেয়ার করে দিয়ে আয়।
-” আরে আমি বলতে চাইলাম যে ফুল তো সহজেই কিনতে পাওয়া যাবে,কিন্তুু বেচারার গিটারটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস। এখন আজকে যদি তার কোথাও কনসার্ট থাকে তাহলে কি করবে?
-” পুষ্প অগ্নি চোখে তাকালো তন্নীর দিকে,” তুই কি ঐ ভ্যা ভ্যা ওয়ালা ব্যান্ড শিল্পীর ফ্যান নাকি,এতো তার পক্ষ নিয়ে কথা বলছিস যে?
-” যেটা সত্যি সেটা বললাম,ফ্যান হতে হবে কেন। তুই একটু বেশিই করে ফেলেছিস,তুই নিজে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ।
-” মাফ করেন খালাম্মা,আমার ভুল হয়ে গেছে। গিটারের তারটা কেটে ভুল করে ফেলেছি,আস্ত গিটারটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলা উচিত ছিল।
-” তন্নী ইয়া বড় বড় চোখ করে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে রইলো,এই মেয়ের মাথা ঠিক নেই। নাট,বল্টু সব ঢিলা হয়ে গেছে এইমুহুর্তে,তাই তন্নি আর কথা বাড়ালো না।
-” কিন্তুু পুষ্প বলে চলেছে,জিনিস ক্ষুদ্র হোক আর বড় সবার কাছেই নিজের জিনিসটা পছন্দের হয়,এইটা ঐ বড়লোকরা বুঝতে চায় না। মনে করে তাদের জিনিসটা দামী, তার মানে ঐটার গুরুত্ব বেশী। আরে দাম দিয়ে যদি সব নির্ধারণ করা হতো,তাহলে তো হতোই।
-” অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য জিনিসগুলোই দামহীন।”
-” মাফ করেন আফা,আপনার সাথে তর্কে লাগা মানে নিজের দুর্গতি ডেকে আনা। কারন আপনি হলেন একজন চ্যাম্পিয়ন, তাও আবার ডিবেটে। তাই অধমের গোস্তাকি মাফ করবেন,ক্ষমা করেন রানী সাহেবা।
-” পুষ্প তন্নীর মাথায় একটা দিতে চাইলো,কিন্তুু তন্নী সরে গেল।
তারপর পুষ্প তন্নীকে বললো,” ড্রামাকুইন এসব ড্রামা রেখে আমার জন্য বেলীফুলের গাজরার ব্যবস্থা কর। ইস আমার খোঁপাটার বারোটা বাজিয়ে দিল ঐ ত্রিপলি।
-” তন্নী হো হো করে হেসে দিল পুষ্পর কথা শুনে। তারপর বললো,”তুই কি ঐ বেচারার এই নামটা পার্মানেন্টলি দিয়ে দিলি নাকি?
আমিতো তখন ফান করে বলেছিলাম,কারন ‘থ্রিপল পি’ নামটা কেমন অদ্ভুত না।
-” পুষ্প বললো,” ঐসব ত্রিপলি মার্কা ব্যান্ড শিল্পীরা এসব ওয়ের্ড নামই দেই, কারো ভালো লাগলে লাগুক, না লাগলে নাই।
স্টেজে উঠে লাফাবে, আর লাউড মিউজিক, গান তো শুনাই যায় না। আই জাস্ট হেট দিস টাইপ সং।
-” তখনি তন্নী বলে উঠলো,” আপনার তো সূফী, দার্শনিক, ভাটিয়ালি এসব গান ভালো লাগে,তাই এগুলো ভালো লাগবেনা। এগুলো হলো মডার্ণ মিউজিক,আর আপনি হলেন বর্তমান যুগের হলেও চিন্তাভাবনা,পছন্দ প্রাগৈতিহাসিক যুগের।
-” পুষ্প চোখ গরম করে তন্নীর দিকে তাকাতেই তন্নী অন্যদিকে পালালো। পুষ্প চিৎকার করে বললো,”আমার জন্য ফুল নিয়ে আয় যেখান থেকে পারিস। দরকার হলে কারো খোঁপা থেকে চুরি করে আনবি,ঐ ত্রিপলির হয়ে কথা বলার শাস্তি এইটা।
-” এটা বলে পুষ্প কমনরুমের দিকে গেল,কলেজ ক্যাম্পাস প্রচুর মানুষ। বেশ ভালোভাবেই ডেকোরেশন করা হয়েছে,মোটামুটি বড় করেই কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। বাইরে থেকে বেশ কয়েকজন সিংগার আসবে,শুধু কলেজের ছেলেমেয়েদের দিয়ে তো কনসার্ট জমে না আজকাল।
-” কমনরুমে গিয়ে খোঁপাটা ঠিক করছিল,তখনি তন্নী মোটামুটি দৌড়িয়ে আসলো ওর দিকে। তন্নীর ওয়েট একটু বেশী হাইটের তুলনায়,তাই বেচারীর দৌড় দিতেও বেশ কষ্ট পেতে হয়। আর মোটা মানুষরা সাধারনত অল্পতেই হাপিয়ে যায়।
-” পুষ্পর সামনে এসে হাঁপাতে লাগলো,তন্নীর হাতে বেলীফুলের গাজরা।
-” পুষ্প জিজ্ঞেস করলো কোথা থেকে এনেছিস,তাও এতো তাড়াতাড়ি।
-” ডাকাতি করে এনেছি।”
-” পুষ্প যেন একটুও অবাক হলো না,মানে তন্নী ডাকাতি করতেই পারে। ওর পূর্বপুরুষরা বোধহয় চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিল। পুষ্প তন্নীকে বললো,”তা আজকের কাহিনীটা বলে ফেল শুনি।
-” তন্নী বেঞ্চীর উপর পা দুলিয়ে বসে কাহিনী বর্ণনা করতে লাগলো। সে ওদের ক্লাসের যে ঢংগী স্টাইলিস্ট মেয়েটা আছে তাকে গিয়ে বললো,” তোমার খোঁপায় এই বেলীফুল একদম মানায় নি,একদম বাজে লাগছে দেখতে।
-” তখন মেয়েটা বললো,”সত্যি বাজে লাগছে? আমি পড়তে চাইনি,কিন্তুু আমার বিএফ বললো বেলীফুলের গাজরাতে নাকি সুন্দর লাগে।
-” তখন তন্নী বললো,” আরে তোমাকে বোকা বানিয়েছে,যেন বেশী সুন্দর না লাগে তাহলে তো অন্য ছেলেরা তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
-” তন্নীর তীর মনে হয় ঠিক নিশানায় গিয়ে লেগেছে,কারন সুপ্রিয়া রাগে ফুসছে।
-” সুপ্রিয়া কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে,মানুষের ভাত খাওয়া যেমন ডেইলি রুটিন, ঠিক তেমনি সুপ্রিয়া ডেইলি একটা না একটা প্রপোজ পাবেই,এটা তার ডেইলি রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। অথচ তার বয়ফ্রেন্ড আছে এবং সে বুয়েটে পড়ে। তবুও ছেলেরে ওর পিছনে লাইন মারেই,মাঝে মাঝে তো জুনিয়র পোলাপান ও ক্রাশ খেয়ে প্রপোজ করে বসে।
-” তন্নীর কথা শুনে সুপ্রিয়া রাগে গাজরাটা ছিড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল। তখন তন্নী তাড়াতাড়ি করে বললো,” আরে ছিড়তে হবে না আমাকে দিয়ে দাও। আর এই
কাঠগোলাপ গুলো তোমার খোঁপায় পড়িয়ে দিচ্ছি। আরে বর্তমানে তো কাঠগোলাপের ট্রেন্ড চলছে,আর তুমি এত সুন্দরী একটা মেয়ে কিনা ঐ শাবানার যুগের বেলীফুল পড়বে,দ্যাটস নট ফেয়ার।
সুপ্রিয়া তন্নীর টুপটা বেশ ভালোভাবেই গিললো,অতঃপর তন্নী বেলীফুল নিয়েই আসলো পুষ্পর জন্য।
এই কাহিনী শুনে পুষ্প হাসবে না কি করবে বুঝতে পারলনা,এই মেয়ে মারাত্নক ডেঞ্জারাস।
-” তন্নী পুষ্পর খোঁপায় গাজরাটা পরিয়ে দিল। পুষ্প আসলে একটা কবিতা আবৃত্তি করবে,তাই শাড়ীর সাথে খোঁপা আর বেলীফুলের গাজরা পরেছে। কারন কবিতা আবৃত্তি করতে নিশ্চয় কোন ঝাক্কাস সাজ দেয়ার দরকার নেই,বরং দিলে সেটা বেমানান লাগবে।
একেকটা বিষয়ের সাথে ড্রেসআপটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
-” ফাংশন শরু হওয়ার আধাঘন্টা পর পুষ্পর নাম মাইকে ঘোষণা করা হলো।
পুষ্প যখন স্টেজে যাবে তখন পাশে একজনকে দেখে ওর চোখ কপালে,এ এখানে কি করছে?
-” গিটার রিপেয়ার করে দেয়ার জন্য টাকা চাইতে এসেছে নাকি!”
-” এসব ভাবতে ভাবতে পুষ্প স্টেজে উঠলো। পুষ্প সুফিয়া কামালের সেই বিখ্যাত বসন্ত বন্দনার কবিতাটা আবৃত্তি করলো,”তাহারেই পড়ে মনে।”
-” যখন শেষ লাইনটা বলছিল,”তাহারেই পড়ে মনে,ভুলিতে পারি না কোনমতে।”
তখন মাথা বামদিকে ঘুরিয়ে দেখে কেউ একধ্যানে ওর দিকে তাকিয়ে আছে,যেটা পুষ্পর কাছে অসস্থিকর লাগছিল।
-” স্টেজ থেকে নেমে চলে যাচ্ছিল,তখন প্রণয় সামনে এসে দাঁড়ায়।
-” হঠাৎ সামনে আসায় পুষ্প একটু ভয় পেয়ে পিছনে সরে গেল। তারপর বললো,”দেখুন আপনার গিটার ঠিক করে দেয়ার টাকা আমার কাছে নেই। আর আমি ইচ্ছে করে ছিড়িনি,আপনাকে এটা বুঝাতে ছিড়ে ছিলাম যে, সবার কাছেই নিজের তুচ্ছ জিনিসটাও স্পেশাল হতে পারে।
-” প্রণয় পুষ্পর কথা শুনে মিটি মিটি হাসছিল,হায় সে ভেবেছে গিটার ঠিক করে দেয়ার জন্য টাকা চাইতে এসেছি।
-” স্বনামধন্য শিল্পপতি রওনক মেহবুব এর ছেলে একটা গিটার ঠিক করার জন্য টাকা চাইতে আসবে,জোকস অফ দ্যা ইয়ার।
অবশ্য ঐ মেয়ে যদিও আমাকে চিনেনা,তাই ভাবতেই পারে।
কারো ভাবনাতে বাঁধা দেয়ার সাধ্য তো কারো নেই।
-” পুষ্পকে অবাক করে দিয়ে প্রণয় বললো,” ইউর ভয়েস ইজ সো সুইট।”
কবিতা আবৃত্তি আমার কোনকালেই ভালো লাগে না। কোন প্রোগ্রামে যখন কবিতা আবৃত্তি করা হতো,তখন আমার মনে হতো প্রোগ্রামটাই বোরিং হয়ে গেছে।
কিন্তুু অনেস্টলি স্পিকিং,আপনার কন্ঠটা অসাধারন, এককথায় অসাধারন।
কবিতা আবৃত্তিও যে মানুষ এত আগ্রহ নিয়ে শুনে সেটা আপনার আবৃত্তি না শুনলে বুঝতে পারতাম না। যখন আবৃত্তি করছিলেন,তখন পুরো পরিবেশটা একদম শান্ত ছিল। একটা সুনসান নীরবতার মাঝে শুধু একটা মেয়ের কন্ঠস্বর বেশে আসছে,বিষয়টা চমৎকার।
-” পুষ্প একটু অবাক চোখে তাকালো,এত প্রশংসা করছে কোন মতলব আছে নাকি। পুষ্প সহজে কাউকে বিশ্বাস করে না,অনেক ভেবেচিন্তে গবেষণা করে তারপর বিশ্বাস করবে।
তাই প্রণয়কে ছোট্র করে ধন্যবাদ দিয়ে কেটে পড়লো।
-” আর প্রণয় হা করে তাকিয়ে রইলো,আর বললো জাস্ট থ্যাংক ইউ!
তারপর নিজেই নিজেকে বললো,তাহলে কি একটা অপরিচিত মেয়ের থেকে আপনি আই লাভ ইউ আশা করেছিলেন প্রণয় মেহবুব। এইটা বাংলাদেশ, আমেরিকা না।
-” ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে যখন আসছিল,তখন প্রণয় শুনতে পেল কেউ একজন বলছে,” আরে এসব ব্যান্ড শিল্পীরা তো স্টেজে পাগলের মতো কতক্ষণ লাফাবে,ড্রামটাকে মনে হবে ফাটিয়ে ফেলছে, আর গিটারটা নিয়ে যুদ্ধ করবে।
-” একটা হাসির আওয়াজ আসলো ঐ রুম থেকে,প্রণয় দরজার ফাঁক দিয়ে একটু লুকিয়ে দেখলো। হুম ভয়েসটা শুনে যেটা মনে করেছিল সেটাই,ঐ মায়াচন্ডী।
-” তা ব্যান্ড শিল্পীদের প্রতি এতো নেগেটিভ মনোভাব কেন?
এটা ভেবে ভেবে প্রণয় স্টেজের দিকে গেল। ওর গ্রুপ এসে গেছে,ওরা অন্য একটা জায়গায় কনসার্টে গিয়েছিল প্রণয় সেখানে যায় নি। কারন ওর গ্রুপে আরো দুজন বেশ ভালোই গান গায়,পূরব আর
পরাগ। আর ওদের তিনজনের নামের প্রথম অক্ষর নিয়েই ওদের ব্যান্ড এর নাম দিয়েছে’থ্রিপল পি।”
-” আর তিনজন বেশ ভালো ফ্রেন্ড ও। তিনজন-ই আমেরিকা থেকে মিউজিক এর উপর পড়াশুনা করেছে। তারপর সেখান থেকেই দেশে এসে একটা ব্যান্ড দল গঠনের প্লেন করলো,এবং তাদের প্রথম এলবাম মার্কেটে বেশ সাড়া ফেলেছে। যদিও গান গেয়ে টাকা ইনকামের কোন প্রয়োজন নেই প্রণয়ের কিন্তুু ঐ যে প্যাশন। এই প্যাশন জিনিসটা এমন যে যার মাথায় যে বিষয়টা ঘুরবে সে সেটা করবেই একসময় না একসময়। আর নিজের মনের কথা শুনলে আত্বতৃপ্তি পাওয়া যায়,প্রশান্তি অনুভূত হয়। যেটা আমরা সহজে বুঝিনা, বা বুঝলেও বাস্তবতার কাছে হেরে গিয়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলি।
-” আর আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পরিবারের মানুষগুলো বুঝেনা সন্তান কি চায়। জোর করে নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়। আর যেটা থ্রি ইডিয়ট মুভিতে কারিনা কাপুর ভাইরাসকে(তার বাবা) বলেছিল তার ভাই সুইসাইড করেনি,তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কারন তার কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার চেয়ে সুইসাইড করা সহজ মনে হয়েছিল।
আমরাও আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার শুরুতেই ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ারের ভূত চাপিয়ে দেয়। যেন দেশে সবাই শুধু ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ারই হবে। আমাদের এ মানসিকতা কি কখনো বদলাবে না!
-” প্রণয় এর গান সবার শেষে ছিল,যখন প্রণয়ের নাম উপস্থাপক এনাউন্সমেন্ট করলো,তখন মানুষের মধ্যে অন্যরকম উৎসাহ দেখা গেল। কারন ইয়াং জেনারেশন এসব গানই বেশি পছন্দ করে,সিংগারও লাফায়, সাথে তারাও লাফায়।
যেটা পুষ্পর একদম ভালো লাগে না,তাই তন্নীকে টানছিল বাসায় চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তুু তন্নী যাবে না,সে ত্রিপলির গান লাইভ শোনার চান্স মিস করতে চায় না।
-” অতঃপর তন্নীকে রেখেই পুষ্প চলে যাচ্ছিল,হঠাৎ মাইকে গানের প্রথম লিরিকটা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।
#চলবে…..