প্রহর শেষে

পর্ব:১৬
বাবার পাশে বসে ওয়াসিয়াত ইতস্তত করছে।যে কথাটা সে বলতে এসেছে এখন আর কোনো ভাবেই সেটা মুখে আসছে না।
আহসানউল্লাহ সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন -‘কিছু বলবে? ‘

ওয়াসিয়াত অন্যমনস্ক ছিল।নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো। মাথা নিচু করে নরম স্বরে বলল,’হ্যাঁ বাবা ।’
কিছুটা থেমে বলল, ‘বাবা, আসলে…আমার এখন ঢাকা যাওয়া টা খুব প্রয়োজন। ‘
কথাটা বলতে পেরে ওয়াসিয়াত হাফ ছেড়ে বাঁচল।

কিন্তু আহসানউল্লাহ সাহেব কিছু বললেন না, কি যেন ভাবতে লাগলেন। কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়লো।খানিক পর মৌনতা ভেঙে তিনি বললেন, ‘যাওয়া টা কি খুবই জরুরি?’

ওয়াসিয়াত মাথা নিচু করে চাপা স্বরে বলল,’হ্যাঁ।’

আহসানউল্লাহ সাহেব আর কিছু জানতে চাইলেন না।হতাশাগ্রস্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে যাও।’

-‘কিন্তু বাবা , মা……?’

-‘ওসব আমি সামলে নেব।তোমার মা অতন্ত্য নির্বোধ মহিলা। তাকে যা কিছু একটা বুঝিয়ে দিলেই হবে।সেসব তুমি ভেবো না। তুমি যাচ্ছো কখন ?’

কথা গুলো যে আহসানউল্লাহ সাহেব তীব্র অভিমান নিয়ে বলেছেন তা বুঝতে ওয়াসিয়াতের দেরি হলো না। সে বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি যাওয়া সম্ভব । দেখি,আজ রাতেও চলে যেতে পারি।’

আহসানউল্লাহ সাহেব নিরব থেকে শুধু মাথা নাড়লেন।
ওয়াসিয়াত উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পা এগিয়ে আবার ফিরে এল। আহসানউল্লাহ সাহেবের পাশে দাঁড়ালো।তিনি সাহেব আগের মতই স্থির বসে রইলেন। পকেটে হাত রেখে দৃষ্টি অবনত করে ওয়াসিয়াত নিজে থেকেই বলল,’মাস দেড়েক আগে একটা কর্পোরেট হাউজে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম।তারপর আর খোঁজ খবর নিই নি,ওখান থেকে কিছুদিন আগে কল এসেছিল।ওরা আমাকে ডেকেছে ।’

-‘তুমি যেতে পার।আমার কিছু বলার নেই। ‘

ওয়াসিয়াত ব্যাস্ত হয়ে বলল,’বাবা, আমি খুব জলদিই ফিরে আসব।দু একটা দিনের ব্যাপার মাত্র।তারপর নাহয় ফিরে এসে মাকে আমি বুঝিয়ে বলবো। ‘

-‘সাবধানে যেও।পৌঁছে খবর জানিও।’

ওয়াসিয়াতের বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল।সে আঢ় চোখে একবার বাবার দিকে তাকিয়ে ফের যাওয়ার জন্য ব্যাস্ত হতেই আহসানউল্লাহ বললেন, ‘দেখো, তোমার মা যেন টের না পায়।’
ওয়াসিয়াত মাথা নাড়লো।

সেই রাতে হাড় কাঁপানো শীতের মাঝে চুপিসারে সবার অলক্ষ্যে ওয়াসিয়াত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।গায়ে ধূসর বর্ণের চাদর জড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আহসানউল্লাহ সাহেব ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন।আর থেমে থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। জীবন তাকে অবসর দিচ্ছে না, মূহুর্তের জন্যও না।এখন তার নাতি-নাতনিদের নিয়ে খেলার বয়স।অথচ পরিবারের ভাঙন রোধ করতে গিয়েই তাকে বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যাবসা টারও ভরাডুবি চলছে।তবুও এত কিছুর পর তিনি ছেলের যাওয়া রোধ করেন নি ।কারন ছেলে বড় হয়েছে, সে যদি এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। তাকে আটকানোর কোন মানে হয় না।

জোহরা খানম দোতলার বারান্দায় বসে আছেন।অবসন্ন দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছেন।
যদিও তিনি কোন বিষবৃক্ষ রোপন করেন নি, তবুও তার সারা শরীর আর সমস্ত সংসার জুড়ে বিষবৃক্ষের অসংখ্য শাখা প্রশাখা বিস্তৃত হতে হতে আজ এ সংসারই বিপন্ন প্রায়!
সেদিন সকাল থেকেই তিনি যখন ওয়াসিয়াতের দেখা পাচ্ছিলেন না অশুভ শংকায় শংকিত হয়ে ভয়ে তিনি জমে গেলেন।এসব দেখে আহসানউল্লাহ সাহেব জানতে চাইলেন কি হয়েছে।নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করা মাত্র আহসানউল্লাহ কঠিন গলায় জানালেন ওয়াসিয়াত ঢাকা চলে গেছে। এ নিয়ে যেন কোনরকম হৈচৈ করা না হয়।
ছেলে চলে গেছে শুনে জোহরা খানমের মুখটা ব্যাথায় একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেল।তিনি বিমর্ষ নয়নে তাকিয়ে রইলেন। তার ঠিক দু’দিন পর ওয়াসিয়াত ফিরে এলো। জোহরা খানম প্রশান্তির একটা নিশ্বাসও ফেলতে পারলেন না তার আগেই ওয়াসিয়াত জানালো তার চাকরি হয়েছে।
প্রগাঢ় কষ্ট বুকে চেপে রেখে তিনি ছেলেকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
তাছাড়া মাকে রাজি করানো ওয়াসিয়াতের জন্য কঠিন ছিল না। আধঘন্টা পা ধরে বসে থাকা আর মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খাওয়াই মাকে রাজি করানোর জন্য যথেষ্ট।

এবার জোহরা খানম সন্তান হারানোর প্রবল যন্ত্রণা ধীরে ধীরে প্রগাঢ় ভাবে অনুভব করতে লাগলেন।ওয়াসিয়াত যতদিন ছিল একাকিত্ব তাকে গ্রাস করতে পারে নি।সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সবসময় ওয়াসিয়াত পাশে পাশেই থাকতো । ফলাফল কখনোই নিঃসঙ্গ বোধ হয়নি।ওয়াসিয়াত চলে যাওয়া মাত্র মৃত সন্তানের জন্য তার হাহাকার প্রবল থেকে প্রবলতর হলো। নিদারুণ যন্ত্রণায় তিনি দগ্ধ হতে লাগলেন।

দিনগুলো খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছে।মাতৃত্তে মেয়েদের নানারকম পরিবর্তন হয়। গুনগুনেরও পরিবর্তন এসেছে , চোখে পরার মতই এসেছে। তার শারীরিক অস্বাভাবিকতা গুলো আজকাল নজরে আসছে। চলাফেরায় এসেছে স্বাভাবিক মন্থরতা। সে যখন দোতালার বারান্দায় বসে রোদ মাখে পাশের বারান্দা থেকে জোহড়া খানম অবাক চোখে তাকে দেখেন।কি সুন্দর হয়েছে মুখটা!
গাল দুটো রোদ পরে কেমন লাল হয়ে আছে,ভীষণ ঝিলিক দিচ্ছে ।ভ্রু জোড়া আরও কালো হয়েছে।ঘন পল্লবিত চোখে সে যখন সূর্যের পানে চায়,জোহরা খানম তখন তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না। বুকে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভুত হয়।এই সুন্দর ফুলের মতো মেয়ের জীবনে এতো দুঃখ কেন?

তখন পড়ন্ত বিকেল।গুনগুন বিছানায় শুয়ে আছে। আজ তার শরীর ভালো নেই। বারবার সে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। সেলিনার আসার কথা।গুনগুনের ইদ্দতের চার মাস দশদিন এখনো শেষ হয়নি।তাই ওবাড়ি সে যেতে পাড়ছে না। সেকথা ভেবেই বিকেলের এই সময়টায় সেলিনা রোজ আসেন। গুনগুনের সাথে তার বিশেষ কথাবার্তা হয় না।তবুও তিনি ঘন্টা দেড়েক বসে থাকেন। এটা ওটা জিজ্ঞেস করেন।অবশেষে উঠে ধীরে ধীরে জোহরার ঘরের দিকে চলে যান।
গুনগুন অনেকটা বিরক্ত। এখনো ওষুধ খাওয়া হয়নি।ডক্টর বলেছে ওষুধ খেতে হবে ভরপেটে।অথচ সকালের পর থেকে কিছুই পেটে পরে নি। বিছানা থেকে উঠে অদূরে থাকা ফ্রিজ থেকে খাবার নিয়ে খেতেও তার মন চাইছে না।
আবার ওষুধ না খাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি হচ্ছে না, শুধু মনে হচ্ছে কি একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি রয়ে গেছে।
হঠাৎ করে ভাবনা বাদ দিয়ে গুনগুন নির্নিমেষ চোখে ঘরের বাম কোণের ছোট ফ্রিজটার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে আবার সেই পুরনো অসুখ টা মাথাচাড়া নিয়ে উঠতে লাগলো। হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হল,নিশ্বাস ঘন হয়ে এলো, চোখের কোলাজে জল জমলো।

এই ছোট ফ্রিজটা ইরশাদ সেদিনই কিনে এনেছিল যেদিন সে জানতে পেরেছিল নিজের সন্তানের কথা।বাড়ি ফিরে বহুক্ষণ সে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিল। তার কান্না দেখে গুনগুনের সে কি হাসি।ইরশাদ বলেছিল,’অত হেসো না গুন,পড়ে কিন্তু কাঁদতে হবে। ‘(সবাই তাকে আদর করে গুনি ডাকলেও ইরশাদ সবসময় গুন ডাকত।এই নামটাই নাকি তার ভালো লাগত।)
ইরশাদ একদম ঠিক বলেছিল। গুনগুনকে পড়ে ঠিক কাঁদতে হয়েছে। এতো বেশি কাঁদতে হয়েছে যতটা সে পুরো জীবনে কাঁদে নি।

-‘ কিরে গুনগুন…..।’সেলিনা কথা শেষ করতে পারলেন না হঠাৎ ঘরে এসে তিনি চমকে গেলেন। গুনগুন বিছানায় শুয়ে কি যেন বিরবির করছে, সেই সঙ্গে তার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ে যাচ্ছে। সে বাচ্চা মেয়েদের মতো হিচকি তুলে কাঁদছে। সেলিনা দ্রুত মেয়ের পাশে গিয়ে বসলেন। মাথায় হাত রেখে বারকয়েক নাম ধরে ডাকলেন কিন্তু গুনগুন সাড়া দিল না।যেন সে শুনতেই পায় নি।সেলিনা নিরবে মেয়ের কথা গুলো বোঝার চেষ্টা করলেন।-

কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না
শুকনো ধুলো যত
কে জানিত আসবে তুমি গো অনাহূতের
মতো।।

এই একটুখানি কথার মাঝে কি ভীষণ গভীর ব্যাথা লুকানো! কি সন্তপ্ত, নির্বিন্ন আর বেদনাতুর মন নিয়েই মেয়েটা বেঁচে আছে। ভেবে সেলিনা মনে মনে আর্তনাদ করে উঠলেন।মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তার মনে হতে লাগলো ধীরে ধীরে সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না।

দীর্ঘ সাত মাস পর গুনগুন তাদের ছোট বাড়িটাতে পা রাখলো।এর আগে কখনোই এতো বেশিদিন সে বাড়ি থেকে দূরে থাকে নি।কে জানত শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি জড়ানো এই বাড়িটার সাথেও একদিন তার এতো দূরত্ব তৈরি হবে!

এবাড়ি এসে সে যেন আরও মৌন হয়ে গেল। সেই ছোট সাদামাটা ঘরটাই যেন তার সব হয়ে উঠল। সারাক্ষণ সে বড় গরাদ দেয়া বিশাল জানালাটা ঘেঁষে বসে থাকে, যদিও পুরো পৃথিবীটা দেখার জন্য আদতে জানালাটা খুব ছোট।তবুও সে অর্হনিশি এই জানালার ধারেই বসে থাকে। সেলিনা কেবল দূর থেকে দাঁড়িয়ে মেয়ের নিঃশোষিত হওয়ার দৃশ্য দেখেন।

বিকেলে সেলিনা নামাজ শেষ করে মেয়েকে দেখতে ঘরে এলেন। ঘরে কোথাও কেউ নেই। সেলিনা ভীত হয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলেন। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। আজকাল সামান্য কারণেই এমন হচ্ছে ।
গুনগুন কে পাওয়া গেল ছাদে । সেলিনা কঠিন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। ছাদে রেলিং নেই।তাই মেয়েকে ছাদে আসতে তিনি বারণ করেছিলেন। অথচ মায়ের কথা অমান্য করে সে পিচ্ছিল ছাদে এসে বসে আছে।সেলিনা দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেলেন।আজ তিনি মেয়েকে কিছু কঠিন কথা শোনাবেন।
কিছু বলার আগেই গুনগুনের মুখের দিকে তার নজর পরল।গুনগুন শ্রান্ত, অসহায় দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে।সেলিনা বিষ্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলেন।কি সুন্দর হয়েছে গুনগুন। চোখ ফেরানো যায় না এমন। গায়ের রঙ আরও উজ্জ্বল হয়েছে, কাঁচা চন্দনের মতো। চোখ দুটো ঘন কালো, যেন দীঘির গভীর জল,গাল দুটো ভরাট হয়েছে। চিবুকের তিলটা আরও কালো দেখাচ্ছে।

চলবে……….।
অদ্রিজা আহসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here