প্রহর শেষে

পর্বঃ৭
অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও কেউ দরজা খুলছে না দেখে গুনগুন এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠল ।

নিচে এতো হইচই যে কথা বলাই দায়।তাই ফোন নিয়ে ইরশাদ ছাদে এসেছিল কথা বলতে। ফোনে কথা বলতে বলতেই সে ক্ষীণ একটা শব্দ শুনতে পেল। খুব দূর থেকে যেন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। সে সেদিকে পাত্তা দিচ্ছিলো না। এবার শব্দটা একটু জোড়ালো হওয়াতে ইরশাদের অসস্থি হলো। সে কান্নার উৎস খুঁজতে খুঁজতে চিলেকোঠার সামনে এসে কান পেতে দাড়াঁলো।ভেতর থেকেই শব্দটা আসছে।দরজায় ধাক্কা দিয়ে বুঝতে পারলো বাইরে থেকে লাগানো।

দরজায় মৃদু শব্দ হতেই গুনগুন ধরফর করে উঠে দাঁড়ালো। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই দরজাটা খুলে গেল। সে আর কিছু না ভেবে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলো।

গুনগুনকে বেরিয়ে আসতে দেখে ইরশাদ ভীষণ অবাক হয়ে বললো -“গুনগুন, তুমি এখানে কি করছো? আর বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ ছিল কেন ?”

-“জানি না।”বলে গুনগুন চোখ মুছলো।

সেদিকে তাকিয়ে ইরশাদ বুঝলো মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়েছে। ভয়ে রীতিমতো সে কাঁপছে।
সে বলল-” যাইহোক, তুমি এখন নিচে যাও। “একা এদিকে আর এসো না।”
গুনগুন নিরবে মাথা নেড়ে চলে এলো।

গুনগুন জোহরা খানমের ঘরে বিছানায় পা তুলে বসে আছে। ছাদ থেকে নেমে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে সে এখানে চলে এসেছে। এখানে বসেই সে ঠিক করেছে সন্ধ্যার ব্যাপার টা কাউকে জানাবে না। শুধু শুধু হুলুস্থুল পাকানোর কোন মানে নেই।তাই বলে ওয়াসিয়াত কে সে ছাড়বে না।তাকে সে আচ্ছা মজা দেখাবে। ভেবে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তার আগেই সেলিনা হক দরজায় এসে দাড়াঁলেন।তিনি রেগে আগুন হয়ে বললেন-“কিরে, কোথায় ছিলি তুই, সারাবাড়ি তোকে খুঁজে আমি হয়রান।”
মাকে দেখেই গুনগুন উঠে দাঁড়ালো। সেলিনা এগিয়ে এলেন।এসে মেয়েকে তিনি একটানা কিছুক্ষণ বকলেন।
সেদিন গুনগুন আর ওয়াসিয়াতের দেখা পেল না।

আকাশ ঘন নীল। সকালের রোদে চারদিক ঝলমলে। দরজায় কেউ অনবরত কড়া নেড়ে চলেছে।গুনগুন দৌড়ে এলো দরজা খুলতে।দরজা খুলতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

-“তোমার আসার সময় হয়েছে তাহলে, আমি তো ভাবলাম তুমি আর আসবেই না।”

কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে পরম মমতায় বোনের মাথায় হাত রেখে গুঞ্জন বললো -“সরি বাবু, একটু দেরি হয়ে গেল।এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে সবকিছু গুছিয়ে রওনা হতে হতে রাত হলো। আমি কি বেশি দেরি করে ফেলেছি? ”

গুনগুন ঠোঁট উল্টিয়ে বলল-“হুহ্,ঢং বাদ দিয়ে ভেতরে এসো। মা তোমার অপেক্ষায় বসে আছেন। ”

সেলিনা চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন।এভাবে বসে থাকতে তার ভালো লাগছিল। কারো পথ চেয়ে থাকতে সবসময়ই ভালো লাগে। তখন মন জুড়ে থাকে মিষ্টি একটা যন্ত্রণার অনুভূতি। ভালো খারাপের মাঝামাঝি সময়ে কারো অপেক্ষায় থাকা।
শাহাদাতের বিয়ে উপলক্ষে ছেলেটার আসার কথা। তারপর থেকেই তিনি ছেলের অপেক্ষায় দিন গুজরান করছেন।

হটাৎ করে তার কাঁধটা ভারি লাগলো, পেছন থেকে কেউ একজন জড়িয়ে ধরেছে।সেলিনা চোখ খুললেন না।তার নাকে এলো সেই চির পরিচিত গন্ধ। যে গন্ধের নাম গুঞ্জন।সেলিনার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো।

বহুবছর আগে গুঞ্জন যখন খুব ছোট ছিল তখন তিনি তাকে কারো কাছেই দিতেন না।সারাদিন ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতেন। আর শরীরের ঘ্রাণ নিতেন। তার এসব পাগলামি দেখে আহমেদ সাহেব রেগে গিয়ে বলতেন –

“কি যে করো তুমি সেলিনা, ছেলেটাকে একেবারে ঘর পোরা গরু বানাবে দেখছি। সিদুড়ে মেঘ দেখলেই যে ভয় পায়।”
সেসব শুনে সেলিনা তখন শুধু খিলখিল হাসতেন।

_________

মীর্জা বাড়ির সামনে সারিবদ্ধ ভাবে অনেক গুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে উৎসব মুখর পরিবেশ। জোহরা খানমের একটু মন খারাপ যেতে পারছেন না বলে। এতো দীর্ঘ পথ জার্নির ধকল সইতে পারবেন না তাই তিনি সেলিনাকেই সব দায়িত্ব দিয়ে পাঠাচ্ছেন।

বিয়ের কাজও মিটলো কোনো ঝামেলা ছাড়াই।
গাড়িতে ওটার পর পরই গুনগুনের মাথা ঘোরানো শুরু হওয়ায় সে সারাক্ষণ মা’র পাশে পাশেই ছিল। বউ নিয়ে এসে সকলে বিয়ে বাড়িতে এলেও সে থাকলো না।এতো হইচই এর মাঝে সে থাকতে পারে না। বাড়ি এসে সে বিছানায় পড়ে রইল।

বিয়ের ঝামেলা মেটার পর গুনগুন আর বেশ কিছুদিন ও-বাড়ি গেল না।বিয়ের ছুটোছুটিতে এমনিতেও পড়ালেখায় খুব গাফিলতি হয়েছে। এতো দিনের পড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে।গুনগুন আরেকটা কথাও ভাবলো। ও-বাড়িতে এখন বউ এসেছে,সে হয়তো তার এই ঘনঘন যাওয়া আসা পছন্দ নাও করতে পারে।কিন্তু এই অবস্থা অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হলো না।

এক সন্ধ্যায় জোহরা খানম ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বাড়ি এসে একপ্রকার জোর করেই তাকে নিয়ে গেলেন।
নতুন বউয়ের সঙ্গে কথা বলে গুনগুনের মন হালকা হলো। ভাবি হিসেবে প্রিয়া’ মেয়েটিকে তার ভারি পছন্দ হলো।কি সুন্দর তার হাসি। কিন্তু সে হাসে খুব কম।

জোহরা খানমের খানিক মন খারাপ। তিনি ভেবেছিলেন বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছে, এবার বোধহয় বাড়িটা প্রাণ ফিরে পাবে। কিন্তু তিনি একটু হতাশই হয়েছেন বলা যায় । প্রিয়া মেয়েটা ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের। তাদের যত্নআত্তি করে ঠিকই তবে প্রয়োজনের অধিক একটি কথাও সে বলে না।
সেজন্য প্রথম কিছুদিন তিনি খুব খুশি থাকলেও এবার গুনগুনের শূন্যতা অনুভব করতে লাগলেন।

তার মনে অভিপ্রায় হলো এ’কদিন তিনি গুনগুন কে একদমই মনে করেন নি,তাকে ডেকে পাঠান নি তাই বোধহয় সে রাগ করেছে।সেজন্য ই বোধহয় এ’বাড়ি আর আসছে না।
তাই তিনি নিজে গিয়ে তাকে নিয়ে এলেন।সকলে মিলে আবার আড্ডা জমে উঠলো।

কিছুক্ষণ পর ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে হাতে ফুটবল নিয়ে ওয়াসিয়াত বাড়ি ফিরলো।তার পড়নে কাদা মাখা জার্সি। আজ নাকি তার ফুটবল টুর্নামেন্ট ছিল।

এসব দেখে গুনগুনের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো। সে ভেবে পেল না এতো বড় ছেলে কীভাবে সারাদিন বাচ্চাদের মতো খেলা নিয়ে পরে থাকে।প্রিয় দল আর খেলোয়াড়দের নাম লিখে ঘরের দেয়াল ভর্তি করে রাখে।

রাত বেড়ে গেছে। গুনগুন বাড়ি ফেরার জন্য তাই তুই করছে।ফের একবার জোহরা কে বাড়ি ফেরার কথা বলতেই তিনি বললেন -“একটু বস মা।তোর যাওয়ার ব্যাবস্থা করছি।”
বলে তিনি নিচ থেকেই গলা উঁচিয়ে ডাকলেন-“ওয়াসিয়াত……। ”

মিনিট দশেক পর কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ওয়াসিয়াত সিঁড়ি দিয়ে নামলো। বলল-“দাও মা ,আমার খাবার দাও।খুব খিদে পেয়েছে। ”

জোহরা চশমা ঠিক করতে করতে বললেন-“দিচ্ছি, তার আগে গুনগুনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়।”

-“কি! আমি পারবো না ” বলে সে সোফায় হেলান দিয়ে বসে পরলো।

-“তাহলে আমিও তোর খাবার দিতে পারবো না। ”

ওয়াসিয়াত বিরক্ত হয়ে বললো -“কি আশ্চর্য! গুনগুন কি বাচ্চা নাকি যে একা যেতে পারবে না?”

জোহরা খানম রেগে বললেন -“তোর মাথায় কি কোন বুদ্ধি নেই? এই রাতের বেলা মেয়েটা একা একা যাবে?
তাড়াতাড়ি ওকে পৌঁছে দিয়ে আয়। আমি ভাত বাড়ছি।”

ওয়াসিয়াত একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে এলোমেলো ভাবে হেটে সামনে এগুলো।
সবার কাছে বিদায় নিয়ে গুনগুন তার পেছন পেছন হাটা শুরু করলো।

বাইরে নিস্তব্ধতায় ঘেরা সুন্দর একটা রাত। শুল্ক পক্ষ চলছে,জোৎস্নার আলোয় পথে তাদের ছায়া পরলো।

ওয়াসিয়াত পকেটে হাত রেখে আপন মনে গুন -গুন করতে করতে হাটছিল।এবার সে থেমে বললো -“কী ব্যাপার গুনবতী, তোমার তো আজকাল দেখাই পাওয়া যায় না। সব সময় কি দাওয়াত করে আনতে হবে নাকি?”

উত্তর না দিয়ে গুনগুন মুচকি হাসলো। জোৎস্নার আবছা আলোয় তার হাসি বোঝা গেল না। সে বললো -“এখন কি আর আগের পরিস্থিতি আছে বলো? তোমাদের বাড়িতে এখন বউ এসেছে। যখন তখন এভাবে তো আর আসা যায় না। ”
বলে সে মিটি মিটি হাসলো।

ওয়াসিয়াত কিছুটা আগে আগে হাটছিল।এবার সে হাটার গতি কমিয়ে গুনগুনের পাশাপাশি এসে হাটতে শুরু করলো।বললো -“বউ আসুক আর যেই আসুক তাতে তোমার আসতে কি অসুবিধে? ”
তারপর ধির কণ্ঠে বললো -“তোমার বাড়ি আমার বাড়ি সব তো একই কথা। তুমি সবসময়ই আসবে। ”

গুনগুন সন্দিগ্ধ হয়ে বললো-“কি!তোমার বাড়ি আমার বাড়ি সব এক মানে ?”তারপর হেসে বললো –
“তোমার বাড়ি আমার বাড়ি এক নাকি?
কখনোই না।”

ওয়াসিয়াত নিশ্চুপ হয়ে রইল। সে বুঝতে পারছে অতি সরল মনে সে যা বলেছে গুনগুন অত সরল মনে তা নেয় নি।

তখন গুনগুন আবার মন খারাপের সুরে বলল-“এখন তো তবুও আসতে পারছি কিন্তু তোমার বিয়ে হলে তো মনে হয় এ’বাড়িতে পা’ও ফেলা যাবে না। ”

ওয়াসিয়াত চট করে ঘুরে গুনগুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো -“কেন?”

গুনগুনের খুব মজা লাগছে।সে হাসি চেপে বলল-“ওমা, তখন তোমাদের বাড়িতে তিন-তিনটা বউ।ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। তারা কি আমাকে রোজ রোজ খাতির করবে নাকি?
তাছাড়া তখন তো তোমাদের বাড়িতে মেয়ের অভাব পুরনই হয়ে যাবে। তাহলে আমি গিয়ে কি করবো? ”

ওয়াসিয়াত কিছু একটা ভাবতে ভাবতে হাটতে লাগলো। তারপর আবার বললো -“শোনো, এমন টা কখনোই হবে না,তুমি আসবে। আর তোমাকে যারা বাড়িতে ঢুকতে দেবে না ও-বাড়িতে তাদেরও জায়গা হবে না।”

“কেন? “গুনগুনের জানতে খুব ইচ্ছে হলো। কিন্তু সে কিছুই বললো না, বাকিটা পথ একদম চুপ রইল। হাটতে হাটতে তারা বাড়ির কাছে চলে এলে ওয়াসিয়াত পকেটে দু’হাত পুরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শব্দ বলল-
” বাড়ি যাও। ” বলে সে পেছন ফিরে হাটা শুরু করলো।

গুনগুন দাঁড়িয়ে রইলো। তার ভালো লাগছে না। বুকে কেমন যেন ভীষণ অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু কেন?কিছুই তো হয়নি। সবকিছু তো ঠিক আগের মতোই আছে।
ওই যে জোৎস্নার আলো ঠিকরে পড়ছে, জোনাকিরা আলোর বৃত্তে খেলা করছে,কামিনীর সেই চিরচেনা গন্ধও তো পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে এতো কিসের কষ্ট?
এটা কি বেদনার সুর নাকি বিচ্ছেদের?

চলবে………………..

অদ্রিজা আহসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here