তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_৯
#Nishat_Jahan_Raat ( ছদ্মনাম)
–“রূপা। তোমার গাঁ এতো গরম হয়ে আছে কেনো?”
আমি গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে উনাকে নিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি আর বলছি,,
–“তেমন কিছু না হিমু। হালকা জ্বর হয়েছে।”
–“এই অসময়ে জ্বর? কিভাবে হলো?”
মিথ্যে কথা তেমন বলতে পারি না আমি। তবে নিজের দুর্বলতা আড়াল করতে আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম,,,
–“কাল বাড়ি যাওয়ার পথে খুব জোরে বৃষ্টি নেমেছিলো। অটো পাচ্ছিলাম না। তাই না চাইতে ও বৃষ্টিতে ভিজতে হলো।”
উনি হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে আমার কপালে আলতো হাতে স্পর্শ করে হাতটা তাড়াতাড়ি আমার কপাল থেকে সরিয়ে বলল,,
–“ইসস জ্বরে তো গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। এই জ্বর নিয়ে তুমি হসপিটালে এলে কেনো? বাড়িতে রেস্ট নিতে পারতে।”
প্রচন্ড অবাক হয়ে আমি উনার দিকে তাকালাম। উনার চোখ দুটোতে উদ্বিগ্নতার ছাপ দেখা যাচ্ছে। লোকটা এই প্রথম আমাকে নিয়ে খুব ভাবছে। হঠাৎ আমাকে নিয়ে উনার এমন অহেতুক ভাবনা চিন্তা গুলো আমাকে ও ভীষণ ভাবাচ্ছে! উনার থেকে চোখ নামিয়ে আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম,,
–“আমি না এলে তো আপনার প্রোপার্লি যত্ন হবে না হিমু। আর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ও নাবিলার কাছে ফিরে যেতে পারবেন না।”
উনি কিছু না বলেই সামনে কদম বাড়ানো শুরু করল। হয়তো এই নিয়ে উনি কোনো কথা বাড়াতে চাইছেন না। আমি ও চুপ হয়ে ধীর পায়ে হেঁটে উনাকে নিয়ে বেডে বসিয়ে দিলাম। চোখ বুজে উনি বেডের কার্ণিশে হেলান দিয়ে চাঁপা এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,
–“তোমাকে খুব জ্বালাচ্ছি আমি৷ তাই না রূপা?”
–“না হিমু। জ্বালাচ্ছি তো আমি আপনাকে। আজ আমার জন্যই নাবিলার সাথে আপনার এতো দূরত্ব!”
উনি কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার বলল,,
–“আসলে আমরা কেউই কাউকে জ্বালাচ্ছি না রূপা। নিয়তিই আমাদের এমন এক্টা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিলো। না চাইতে ও আমি তোমার সাথে অনেক রুড বিহেভ করেছি। যা করা হয়তো আমার একদম ঠিক হয় নি৷”
চোখ খুলে উনি এবার বেশ অনুতপ্ত চাহনীতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,
–“এতো দিন তোমার সাথে আমি যা যা করেছি তার জন্য আমি সত্যিই খুব অনুতপ্ত রূপা। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।”
হালকা হেসে পানির এক্টা বোতল আমি হিমুর মুখের কাছে ধরে বললাম,,
–“পানিটা খেয়ে নিন হিমু৷ যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর ভাববেন না। ভাবলেই যতোদিন যাবে অনুতপ্ততা বাড়তে থাকবে। আমি চাই আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। নাবিলার কাছে ফিরে যান। নাবিলাকে নিয়ে সুস্থ, সুন্দর এক্টা স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করুন। মেয়েটা যতোদিনই বাঁচে পৃথিবীর সমস্ত সুখ তাকে উজাড় করে দিন।”
হিমু চোখ খুলে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে মৃদ্যু হেসে আমার দিকে তাকালো। আমি ও জোর পূর্বক হাসি টেনে উনার দিকে তাকালাম। উনার পানি খাওয়া শেষে আমি বোতলটা ডেস্কের উপর রেখে উনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,
–“হিমু আপনি রেস্ট নিন। আমি হসপিটালের স্টল থেকে খাবার নিয়ে আসছি।”
কেবিন থেকে বের হতেই হিমু পেছন থেকে আমাকে জোরে ডেকে বলল,,
–“রূপা আসার সময় তোমার জন্য মেডিসিন নিয়ে এসো। নাশতা করে তোমাকে ও মেডিসিন নিতে হবে।”
পিছু ফিরে আমি একবার উনার দিকে তাকালাম। উনি এতক্ষনে আমার থেকে চোখ সরিয়ে বেডের কার্ণিশে হেলান দিয়ে বেশ ভাবুক ভঙ্গিতে চোখ খুলে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। উনার থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। উনার এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেয়ার গুলো আমাকে খুব মায়ায় জড়িয়ে দিচ্ছে। এক্টা সময় উনাকে ছেড়ে থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো শ্বাস নেওয়া ও তখন দায় হয়ে পড়বে। কেনো উনি আমায় এতোটা মায়ার জড়িয়ে ফেলছে তার ঠিকঠাক উত্তর হয়তো উনার ও জানা নেই! তবে খালি চোখে যা দেখতে পারছি, মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই উনি আমার এতোটা যত্ন নিচ্ছে!
কিছুক্ষনের মধ্যে আমি খাবার আর ঔষধ নিয়ে কেবিনে ঢুকলাম। হিমু চোখ বুজে মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছে। আমি উনাকে ডেকে কিছু খাবার আর মেডিসিন খাইয়ে দিলাম। সাথে আমি ও অল্প পরিমানে খাবার খেয়ে জ্বরের ঔষধ গুলো খেয়ে নিলাম। তারপর উনার সাথে নানা ধরনের কথা বার্তায় সময় পাড় করতে লাগলাম। এই সময়গুলো হয়তো আর চাইলে ও ফিরে আসবে না। ভবিষ্যতে এই সময় গুলোকে মনে করে যেনো নিজেকে সামান্য হলে ও সুখী ভাবতে পারি তার যোগানেই লেগে পড়লাম!
এভাবে কেটে গেলো প্রায় তিন দিন। এই তিন দিনে আমার জ্বরটা নেমে গেছে। প্রতি বেলা হিমুর চাঁপে জোর করে আমাকে মেডিসিন নিতে হয়েছে। আর হিমুকে ও আমার চাঁপে ফলমূল, দুধ, ডিম খেতে হয়েছে। কোনো না কোনোভাবে দুজনই দুজনের কাছে বাধ্য ছিলাম। তিন দিনে হিমুর সাথে জমিয়ে বেশ আড্ডা হয়েছে। দুজন দুজনকে কিছুটা হলে ও বুঝতে পেরেছি। উনার সাথে সাথে নাবিলাকে ও আমার এক্টু এক্টু করে চেনা হয়ে গেছে৷ কারণ, এই দুই দিনে সারাক্ষন নাবিলার উনি শুধু কথাই বলেছে!
আজ হসপিটাল থেকে হিমুর রিলিজ নেওয়ার দিন। মা, বাবা আর আমি মিলে হিমুকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেলো। হিমুকে খাইয়ে দাইয়ে, মেডিসিন দিয়ে আমি সোফায় শুয়ে পড়লাম। চোখ
বুজে শুধু শুয়ে আছি আমি। কিছুতেই যেনো চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। মাথায় অনেক ধরনের দুঃশ্চিন্তা ঘুড়ছে। আস্তে ধীরে হয়তো হিমুর সাথে আমার ডিভোর্সের লগ্ন ঘনিয়ে এসেছে। আমার হাতে হয়তো বেশি সময় ও নেই। সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই হিমুকে ডিভোর্স দিতে হবে। ঐদিকে, নাবিলার সময় ও এক্টু এক্টু করে ফুরিয়ে আসছে। কতোদিন বাঁচবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
হিমুর দিকে তাকাতে দেখলাম উনি ও আমার মতো চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করছে৷ চোখের পাঁপড়ী গুলো উনার বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ এর মাঝেই হিমু হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল,,
–“রূপা। ঘুম আসছে না আমার। কি করি বলো তো?”
–“ঘুম তো আমারো আসছে না হিমু।”
–“নাবিলা পাশে থাকলে হয়তো ঘুমরা নিজে থেকেই আমার চোখে ধরা দিতো। জানো, এই মুহূর্তে আমি নাবিলাকে ভয়ঙ্করভাবে মিস করছি।”
কিছু বললাম না আমি। শুধু কান খোলে উনার কথা গুলো শুনছিলাম৷ ইদানিং ধৈর্য্য টা এক্টু বেশিই আমার মধ্যে কাজ করছে। নাবিলাকে নিয়ে কোনো রকম হিংসা প্রবণতা কাজ করছে না। এক প্রকার সয়ে গেছে সব। আমার মৌণতা দেখে হিমু আবার বলল,,
–“কি হলো রূপা? কথা বলছ না কেনো? ঘুমিয়ে পড়েছ?”
–“না হিমু। ঘুমোই নি। আপনি বলুন।”
উনি হঠাৎ চোখ খুলে আমার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে বলল,,
–“রূপা তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসো নি?”
আমি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে হিমুর দিকে তাকালাম। হিমু কিছুটা আমতা আমতা করে বলল,,,
–“না মানে, বিয়ের আগে কখনো কাউকে ভালোবাসো নি?”
চোখ বুজে সোজা হয়ে শুয়ে আমি লম্বা এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,,,
–“এসব কথা থাক না হিমু। হয়তো রূপাদের কপালে কখনো ভালোবাসা জুটে না!”
চুপ হয়ে গেলেন উনি। আর এক্টা কথা ও বললেন না। চোখের পাতা গুলো এক্টু এক্টু করে ভিজে আসছে আমার। কারো থেকে সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা টা যেনো বিশাল অসুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিয়ের আগে ও সত্যিকারের ভালোবাসা পেলাম না আমি। না পেলাম বিয়ের পরে। এই পৃথিবীতে তো রোজই কতো শতো রঙ্গিন ভালোবাসার বীজ বোনা হয়। শুধু আমার বেলা ই কেনো ভালোবাসার বীজগুলো এক টুকরো আবেগ হয়ে ধরা দেয় না?
কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। হিমুর দিকে আর একবার ও ঘুড়ে দেখলাম না। হয়তো উনি ও আমার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ভাঙ্গল আমার পরের দিন সকাল আটটায়। হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে আমি চোখ কচলাতে কচলাতে প্রথমেই হিমুর দিকে তাকালাম। নাক টেনে ঘুমুচ্ছে উনি। চোখ আর ঠোঁট বরাবর উনার সেলফোনটা পড়ে আছে। হয়তো রাত জেগে ফোন টিপেছে উনি। আর ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফোনটা যে নাকের মধ্যে পড়ে আছে নিশ্বাস নিতে কি উনার কোনো রকম অসুবিধা হচ্ছে না? না মানে দম আটকে আসছে না?
উনার কাছে এগিয়ে এসে আমি উনার মুখ থেকে ফোনটা তুলে নিলাম। ফোনের স্ক্রীনটা অন করতেই নাবিলা আর হিমুর হাসৌজ্জ্বল এক্টা ছবি আমার চোখে পড়ল। অমনি আমি ফোনটা তাড়াহুড়ো করে হিমুর বালিশের পাশে রেখে দিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে এলাম। না চাইতে ও আমার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। এই মুহূর্তে নাবিলাকে আমার একদম সহ্য হচ্ছে না। খুব হিংসে হচ্ছে। হিমুকে ও গলা ফাঁটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,,
–“আমি আপনাকে ভালোবাসি হিমু। এই পাঁচ মাসে আমি আপনাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে নাবিলার কাছে যাবেন না। আমি যে বড্ড একা হয়ে যাবো। সারা জীবনের জন্য সর্বশান্ত হয়ে যাবো। একটা বারের জন্য আমার মনকে বুঝার চেষ্টা করুন। আমার অনুভূতি গুলোকে এক্টু প্রাধান্য দিতে শিখুন। এক্টু হলে ও আমার ভালোবাসাটাকে বোঝার চেষ্টা করুন।”
এই চার দেয়ালের মাঝে কেউ আমার বুক ফাঁটা আর্তনাদ শুনতে পাবে না। শুধু ইটের তৈরী ইমারত গুলো আমার বুক চিৎকারের সাক্ষ্য হয়ে থাকব, হয়তো আমার কষ্ট দেখে তাদের অস্তিত্ব ও হয়তো নাড়া চাড়া দিয়ে উঠবে! কিছুক্ষন পর কান্না থামিয়ে ফ্রেশ হয়ে আমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলাম। কিচেন রুমে গিয়ে সকালের নাশতা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম৷ শ্বাশুড়ী মা ও আমাকে হেল্প করছিলো৷ প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যে নাশতা বানিয়ে আমি প্লেইটে করে নাশতা নিয়ে আমাদের রুমে চলে এলাম। হিমু এখনো ঘুমুচ্ছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সকাল নয়টা বাজছে। নাশতার প্লেইট টা ডেস্কের উপর রেখে আমি হিমুকে ডাকতে শুরু করলাম। ডাকাডাকির এক পর্যায়ে হিমু পিটপিট চোখে আমার দিকে তাকালো আর বড় এক্টা হামি তুলে বলল,,,
–“এতো সকাল ডেকে দিলে কেনো? আমার ঘুম এখনো ফুরোয় নি।”
–“এতো সকাল কোথায় হিমু। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখুন কয়টা বাজছে।”
হিমু আধখোলা চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,,
–“মাএ তো নয়টা বাজে রূপা। আর এক্টু ঘুমিয়ে নেই।”
আমি চোখ লাল করে বেশ রেগে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,
–“আর ঘুমোতে হবে না আপনাকে। উঠুন বলছি। উঠে খেয়ে দেয়ে, মেডিসিন নিয়ে এক্টু হাঁটার চেষ্টা করুন। তাছাড়া আজ আপনাকে গাঁ মুছে দিতে হবে। অনেক কাজ পড়ে আছে আমার।”
উনি হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা হা করে বলল,,
–“বাহ্ বাহ্ তোমার রাগ ও আছে রূপা? কই আগে তো কখনো দেখি নি!”
–“আগে দেখানোর প্রযোজন পড়ে নি তাই দেখেন নি।’
–“আচ্ছা রেগে গেলে তুমি কি কি করো?”
–“লোকজনদের ধরে পেটাই।”.
উনি হঠাৎ শুকনো ঢোক গিলে অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,
–“তার মানে রেগে গেলে তুমি আমাকে ও পেটাবে?”
উনার ইনোসেন্ট ফেইস দেখে আমার খুব হাসি পেয়ে গেলো। হাসতে হাসতে আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,
–“রেগে গেলে আমি কাউকেই ছাড় দেই না হিমু। আপনি ও ছাড় পাবেন না।”
হিমু এক ধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা উদাসীন হয়ে আচমকাই বলে উঠল,,
–“সবসময় এভাবে হাসি খুশি থাকবে রূপা। হাসলে তোমাকে খুব বেশি সুন্দর দেখায়।”
#চলবে,,,,?