#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৭
#আসেফা_ফেরদৌস
প্রায় সাত আট মিনিটের মতো মুষলধারে বৃষ্টি হলেও এ মুহূর্ত জোর কমে এসেছে, টিপটিপ করে পড়ছে বলা যায়। মল্লিকা গেইট পেরিয়ে একটু দূর এগুতেই দেখতে পেল শামীম আর ফয়সাল কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। ফয়সালকে সম্ভবত খোঁড়াতে হচ্ছে একটু। তাছাড়া,সে ঠিক ছাতার মধ্যে নেই, সামান্য এদিক ওদিক হাঁটছে।
রাস্তায় মল্লিকাকে দেখতে পেয়ে ফয়সাল কিছুটা অবাক। বলল, এত রাতে তুমি বাইরে? শামীম তো গিয়েছেই আমাকে আনতে, তাহলে তুমি আবার এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
উত্তর এলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। বলা হলো, ওমা তুমি তো খোঁড়াচ্ছ! হাঁটতে বেশি অসুবিধা হচ্ছে? তো আরও আগে বললে না কেন, প্রয়োজনে তৌফিক ভাইয়ের বাসা থেকে শামীম গিয়ে নিয়ে আসত তোমাকে, সবচেয়ে বড়ো কথা এ অবস্থায় হেঁটে এসেছ কেন, একটা রিকশা নিতে পারলে না? আর এমন শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে তুমি এতক্ষণ বাইরে! শরীর বেশি খারাপ হয়ে গেলে কি হবে সে খেয়াল আছে? মল্লিকার কন্ঠে কিছুটা বিষ্ময়, কিছুটা চিৎকার, এবং খানিকটা কান্না!
শামীম আছে সাথেই, তাছাড়া, এলাকার রাস্তা সেজন্যই কথা বাড়াল না ফয়সাল, ও দৌড় দিয়ে গেটে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ব্যাস, ব্যাস বাকি চিৎকার চেঁচামেচি সব বাসায় গিয়ে, এসো ভেতরে!
সিঁড়ি ভেঙে ঘরের দরজায় ঢুকতেই ছেলেটা দেখতে পেল, বাবা, মা ছোটো মামা সবাই কটমট করে তাকিয়ে আছেন। ফয়সাল আগে ঢুকেছে, শামীম এবং মল্লিকা পেছন পেছন। ছেলেটা চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল।
হানিফ সাহেব বললেন, দাঁড়াও ফয়সাল!
ও দাঁড়াল।
এদিকে এসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে।
চুপচাপ পিছিয়ে এসে বাবার মুখোমুখি দাঁড়াল ছেলেটা।
বাবা প্রথমেই বললেন, তুমি দেখি খোঁড়াচ্ছ, পায়ে কি বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে?
না, না, তেমন মারাত্মক সমস্যা না! ফয়সালের গলায় খুব একটা জোর নেই।
হানিফ সাহেব তাকিয়ে আছেন। একপর্যায়ে বললেন, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
তৌফিকদের বাসায় গিয়েছিলাম, সেখান থেকে ফেরার পথে মিন্টু ভাইয়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়েছি বাবা।
কিছুক্ষণ? তৌফিকদের বাসা থেকে তুমি বেরিয়েছ পৌনে নয়টায়, তোমার বাড়ি আসতে বড়োজোর পনেরো মিনিট লাগার কথা অথচ এখন বাজছে পৌনে এগারোটা! এতটা সময় যে পেরিয়ে গেল, এ সময়টাকে বুঝি কিছুক্ষণ বলে?
উত্তর দিলো না ফয়সাল, চোখ নামিয়ে রেখেছে।
বাবা আবার বললেন, মল্লিকা তোমাকে ফোন করে বারবার বলে দিয়েছে ঝড়বৃষ্টি আসার আগেই বাড়ি ফিরতে, ঝড়বৃষ্টিকে সে ভয় পায় তুমি জানো, তাছাড়া, তোমার শরীর খারাপ, এরপরও তুমি তৌফিকদের বাসায় গিয়েছ, মিন্টুর দোকানে বসে আড্ডা দিয়েছ এ কেমন কথা! তোমাকে তো তৌফিকদের বাসায়ই ফোন করে বলা হয়েছে ঝড় থামলে বাড়ি ফিরতে, তুমি বেরিয়েও গিয়েছ অথচ বাসায় ফেরোনি, কেন?
এমনি! মিন্টু ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিতে ইচ্ছে হলো তাই বসলাম। তাছাড়া,আমি তো আর ছোট বাচ্চা না যে লোক পাঠিয়ে ডেকে আনতে হবে! বলেছিলামই তো আসছি।
হানিফ সাহেবের মেজাজটা চড়ে গেল। কিন্তু এমন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে যে কিনা নিজেই সন্তানের বাবা, তাকে ঘরভর্তি মানুষের সামনে ঠিক শাসন করা যায় না। তাই বাবা চুপ করে আছেন।
কিন্তু ছোটো মামা নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বিস্মিত কন্ঠে বললেন, এটা কী বললি তুই ফয়সাল, বয়স বাড়ার সাথে সাথে দায়িত্বজ্ঞান সব খুইয়ে বসছিস নাকি? আকাশের অবস্থা খারাপ, তোর সঙ্গে ফোন নেই, তার উপর সকালে এমন একটা ব্যথা পেয়েছিস! বউমা তোর চিন্তায় অস্থির, সেই কখন থেকে খাওয়া দাওয়া কাজকর্ম ছেড়ে ঘর বারান্দা, বারান্দা ঘর করছে, মুকুলটা কান্নাকাটি শুরু করেছে, মুকুল আর মল্লিকাকে সামলাতে গিয়ে বুবুও দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছে, আমরা দুশ্চিন্তা করছি, বারবার ফোন করে বলার পরও বাড়ি ফেরার নাম নেই তোর, কোথায় আছিস তাও জানি না, এ অবস্থায় শামীমকে না পাঠিয়ে আমাদের কী উচিত ছিল, খেয়েদেয়ে নিশ্চিন্তে হয়ে ঘুমিয়ে পড়া? মামার শেষ বাক্যে স্পষ্ট ধমক!
ঠিক এমন সময় মুকুল ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। ছেলেটা যে ভয় পেয়েছে বোঝা যায়, হয়ত একটু একটু কাঁদছেও।
ওকে কোলে তুলে নিলো ফয়সাল, শক্ত করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরেছে মুকল, সে সম্ভবত আশ্বাস চায়! একটু থেমে থেকে বলল, সকালবেলার ঘটনার জন্য তুমি কি আমার উপর রেগে আছ বাবা?
না না, সোনা! আমি কেন তোমার উপর রাগ করব, আমিও তোমার উপর রাগ করলে হবে? ভয় পেয়ো না মুকুল, বাবা ঠিক আছি, সত্যিই ঠিক আছি। আমি সরি, সো সরি, আর কখনো এমন হবে না!
সত্যি বলছ? কান্না জড়ানো কন্ঠ মুকুলের।
একদম সত্যি। বাবা তো ভিজে গিয়েছি, তোমাকেও ভিজিয়ে ফেললাম। নামিয়ে দিচ্ছি যাও, তুমি গিয়ে কাপড়টা বদলে নাও।
আচ্ছা!
মুকুল চলে যেতেই ফয়সাল বাবা এবং ছোটো মামার উদ্দেশ্যে বলল, সরি! আমি আসলে বুঝতে পারিনি তোমরা এতটা দুশ্চিন্তা করবে কিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, শরীরটা কেমন যেন করছে, আমার বোধহয় এ মুহূর্তে ঘরে যাওয়াই ভালো। সবাইকে আবার সরি! আমার বোকামির জন্য বেশ একটু ঝামেলাই হয়ে গেল!
ফয়সাল ঘুরতে না ঘুরতেই মা এসে দাঁড়ালেন সামনে, একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, তুই ঠিক আছিস তো বাবা?
হ্যাঁ মা! আমি ঠিক আছি, সত্যি বলছি ঠিক আছি। ভয়ের কিছু নেই! আচ্ছা আসছি। বলেই তাড়াহুড়ো করে নিজের ঘরে ঢুকে গেল ছেলেটা।
মা যেন নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। একই অবস্থা ফাইজারও।
মল্লিকা ঘরে এসে ঢুকল একটু পর, ফয়সাল ততক্ষণে কাপড় পাল্টে নিয়েছে।
রাগে পুরো চেহারা লাল হয়ে গেছে মেয়েটার। গম্ভীর গলায় বলল, এটা কী ছিল ফয়সাল?
বললাম তো সরি! আর কী করব? আচ্ছা যাও তোমাকে আরও একবার সরি, বাবা বলেছেন, মামা কথা শুনিয়েছেন, তুমি আর বাদ থাকবে কেন, ধমকাধমকিটা শেষ করে ফেলো তাড়াতাড়ি। বড্ড ঘুম পাচ্ছে!
ঘুম পাচ্ছে মানে? তুমি কি বাইরে থেকে খেয়ে ফিরেছ? মল্লিকা আবাক।
হ্যাঁ। তৌফিকদের বাসায় খেলাম, মিন্টু ভাই আবার খাওয়ালেন!
তুমি সত্যিই খেয়ে এসেছ?
হ্যাঁ, এতে এত অবাক হবার কী আছে? তৌফিক, মিন্টু ভাই এত করে ধরল, খাব না?
বিকেলে ফয়সালের প্রিয় মিষ্টি নিজ হাতে বানিয়েছে মল্লিকা, এই প্রথম ও ঘরে মিষ্টি বানিয়েছে। ফয়সাল ছিল না বলে সন্ধ্যার নাশতায় মিষ্টিটা দেয়া হয়নি। মল্লিকা ভেবেছিল রাতের খাবারের পর সবাই একসঙ্গে খাবে। তাছাড়া, রাতেও খাবারের ভালো আয়োজন! সবাই খিদে নিয়ে ছেলেটার জন্য বসে আছে। কিন্তু হিসেব যে সব উল্টা হয়ে গেল, পরপর দুবার খেয়ে তৃতীয়বারের মতো ফয়সাল নিশ্চয় এ বেলা আর খাবার টেবিলে বসবে না!
রাগ চেপে ও বলল, কী খেয়েছ মিন্টু ভাইয়ের দোকানে?
পাশের দোকানের পুরি আর মিন্টু ভাইয়ের দোকানের চা!
ঝড় থামার পর মিন্টু ভাইয়ের পাশের দোকানটা খুলেছিল?
হ্যাঁ খুলেছিল। এখনো খোলা। আশেপাশের অনেকেই দুই দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। গভীর রাত পর্যন্ত এই এলাকায় এমনটাই তো চলে!
তুমি তো বাইরের খাবার সহ্য করতে পারো না,খেয়ে প্রায়ই অসুস্থ হও, তারপরও খেয়েছ, কেন?
এমনিই! মনে চাইল তাই খেলাম। আমার মাঝে মাঝে একটু ছন্নছাড়া হতে ইচ্ছে করে এই আরকি! ফয়সালের কন্ঠটা ভাবলেশহীন।
রাগ করে তাকিয়ে আছে মল্লিকা, বলল, ফয়সাল, তুমি কি বুঝতে পারছ আজ সারাদিন এবং সন্ধ্যার পর আমি কী উঠিয়েছি, কতটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম? বিকেল থেকে এ পর্যন্ত দু গ্লাস পানি ছাড়া কিছুই খাইনি আমি, অথচ তুমি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছ, বন্ধুর বাসায় খেয়েদেয়ে মিন্টু ভাইয়ের দোকানে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছ! তুমি যে ঠিকমতো হাটতেও পারছ না সেটাও কি বুঝতে পারোনি?
হাঁটতে পারব না কেন, ঐ দুপুরে আবার একটু বেকায়দায় হোঁচট খেয়েছিলাম তো, তাই হয়ত পাটা সামান্য টনটন করছে। এর বেশি কিছু না। তাছাড়া, তৌফিকটা বাসা বদলে আমাদের এলাকায় এসেছে একটু খোঁজ খবর নিতে হয় না, ও আমার এত পুরানো বন্ধু! এসব নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করার কী আছে?
অন্য সময় হলে এমন কথার পর নির্ঘাত রেগে যেত মল্লিকা, কিন্তু আজ ব্যাপার উল্টো ঘটল। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থেকে মেয়েটা জানতে চাইল, তুমি দুপুরে আবার ব্যথা পেয়েছ? কীভাবে পেয়েছ, আশ্চর্য! একটু সচেতন হবে না, দেখি?
ফয়সাল পা দেখাল, খুব বেশি মারাত্মক মনে না হলেও পাটা কেটেছে আবার এবং গোড়ালি হালকা ফুলে আছে।
দ্যাখো কান্ড! এরকম অবস্থায় কেউ বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফেরে? ব্যান্ডেজ করোনি কেন, বরফ লাগাবে কে! ঘটনাটা কী তোমার? মল্লিকার কন্ঠে ঠিক ধমকের সুর নেই, তবে দুশ্চিন্তা স্পষ্ট।
ছেলেটা হাসল একটু, এরপর একদম স্বাভাবিক, হাসিখুশি গলায় বলল, না, আসলে দেখতে চাইছিলাম যে, আমি হারিয়ে যেতে চাইলে তোমার খোঁজার ইচ্ছে হয় কিনা!
মল্লিকা বিস্মিত! রেগে গিয়ে বলল, এটা বুঝি ঠাট্টা করার সময় ফয়সাল? সব বিষয় নিয়ে কি ঠাট্টা চলে? অসুস্থতায় খামখেয়ালি করলে কেমন খেসারত দিতে হতে পারে ভেবছ একবার! আচ্ছা তুমি কি মুকুলের বয়সী?
আমার মতো মানুষদের অবুঝ হবার জন্য বয়স ব্যাপার না, মনটাই যথেষ্ট আসলে! বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ফয়সাল।
না! তোমার সঙ্গে আমি সত্যিই পারব না! মাথাটাও যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে, কথা না বাড়িয়ে বোসো চুপচাপ, বরফ নিয়ে আসছি! ব্যান্ডেজও করতে হবে!
দুদিন পর।
ফয়সাল শুয়ে আছে চুপচাপ। অনেকদিন ঢোকা হয়নি এ ঘরে, একসময় এই রুমটা ফয়সাল আর ফাইজার পড়ার ঘর ছিল। শরীরটা ভালো নেই, তাই গত দুদিন অফিস করলেও আজ যাওয়া হয়নি। তাছাড়া, মল্লিকার বাড়াবাড়িতে ডাক্তার দেখাতে হয়েছে। এক্সরে প্লেট দেখে ডাক্তার বললেন, মারাত্মক কিছু না, তবে বিশ্রাম নিতে হবে। যতটা সম্ভব কম হাঁটাচলা করতে বলা হয়েছে। পা কেটে যাওয়ায় অবশ্য ইনজেকশন নিতে হয়েছে একটা। গত দুদিন তেমন পাত্তা না দিলেও,আজ শরীরটা খারাপই, তাছাড়া, তিনদিন ধরে মা, মল্লিকা, ফাইজা এমনকি মুকুল পর্যন্ত ভীষণ খেয়াল রাখছে।
চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে ফয়সাল। বিষন্ন লাগছে। চেঁচিয়ে আশপাশ এক করার ইচ্ছে আজ, বাড়িতে একদম ভালো লাগে না, জীবনের এতগুলো বসন্ত, এত উত্থান পতন পেরিয়ে এসে এমন অনুভূতি, এই চাপা হাহাকার কতটা যুক্তিযুক্ত আসলে!
ছেলেটা এসবই ভাবছিল, এমন সময় হালকা শব্দে চোখ মেলল। মল্লিকা ঘরে এসে ঢুকেছে।
চলবে