#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৬
#আসেফা_ফেরদৌস
বাসার কেউ অবশ্য ফয়সাল মল্লিকার সম্পর্কের স্থবিরতাটা টের পায়নি। এমনকি মুকুলও না। সবার সামনে ওরা দুজন ভীষণ হাসিখুশি, স্বাভাবিক, বাড়ির পরিবেশটা থমথমে, অস্বস্তিকর করার ইচ্ছে নেই আসলে।
ফয়সাল অতিথিদের আতিথেয়তায় কোনো ত্রুটি রাখেনি। তাছাড়া, যতক্ষণ বাড়ি থেকেছে সবার সঙ্গে মিলেমিশে থেকেছে, খেলাধুলা, হাসিঠাট্টা করছে। শুধু পার্থক্যটা হলো,আগে ও সারাক্ষণ মল্লিকাকে পাশে চাইত অথচ এই দুদিনে মেয়েটাকে সে বিরক্ত করতে চায়নি। নিজের মতো থাকতে দিয়েছে, এক কথায় স্পেস দিয়েছে। হয়ত ফয়সাল বুঝতে পেরেছে, প্রথমে কুয়াকাটা যাবার প্ল্যান ক্যানসেল হওয়া, এরপর পারিবারিক আয়োজনে যেতে না পারা দুইয়ে মিলে মল্লিকার মনটা ভালো নেই। কিন্তু এর পেছনে অন্তরও যে একটা কারণ তা অবশ্য ছেলেটার জানা নেই। তবে মনের অবস্থা যেমনই থাকুক এবং ফয়সাল কিছু না বললেও পরিবারের সদস্যদের প্রতি দায়িত্বে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেনি মল্লিকা।
এবং আজ সারাদিন ভেবে ভেবে মেয়েটার মনে হয়েছে, যেই আক্ষেপ করে কোনো লাভ নেই সেজন্য অযথা মন খারাপ করে কী হবে! কিছু অতীত হয়ত বেদনাতেই সুন্দর, তাই অতীতের বেদনা পুষে ক্ষত বিক্ষত হয়ে মিষ্টি বর্তমানকে তিক্ত করার মধ্যে কোনো প্রাপ্তি নেই। আসলে এবার ফয়সাল এবং ওর পরিবারের অনুষ্ঠানাদি একসাথে পড়ে যাওয়াতেই ঝামেলাটা বেধেছে, নইলে তো যাওয়াই যেত। ফয়সালের ভালোমন্দ যাই লাগুক মল্লিকার শখে সে কখনো বাধ সাধে না। তাছাড়া ফয়সাল যে মল্লিকাকে ভীষণ ভালোবাসে এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই ভালোবাসার দাবি থেকেই হয়ত ওর আবদারটা একটু বেশি। সে সবসময় চায় ওর সকল হাসি আনন্দে মল্লিকা মধ্যমনি হয়ে থাকুক। জীবনের সম্পর্কে একটু তো ছাড় দিতেই হয়, এবং ফয়সাল, মল্লিকা স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় পরস্পরকে সেই ছাড়টা দিয়েই থাকে।
কিন্তু এবার বোধহয় হিসেব নিকেশে একটু এদিক সেদিক হয়ে গিয়েছে, অযথা কষ্ট পেয়েছে দুজনেই। নাহলে ফয়সালের মতো উচ্ছল প্রাণবন্ত হাসিখুশি একটা ছেলে হঠাৎ এমন চুপচাপ হয়ে যাবে কেন! এটা তো মেনে নেয়া যায় না। যে মানুষটা এতবছর পরও মল্লিকার আগেপিছে ঘুরতে পছন্দ করে, ওকে আগলে রাখতে চায়, সে এভাবে হঠাৎ করে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে মল্লিকা, তার উপর আজ সকালে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। মুকুল মিনির খেলনাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ড্রইং রুমের মেঝেতে, প্রায়ই এমন করে মুকুল, এ ব্যাপারে বহুবার বারণ করেও লাভ খুব একটা হয়নি। ফয়সাল অবশ্য এসবে অভ্যস্থ কখনো পাশ কাটিয়ে কখনো লাফ দিয়ে জায়গাগুলো পেরোয় সে, অথচ আজ হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচেছে। মল্লিকা এবং শামীম কাছাকাছি না থাকলে আরো মারাত্মক কিছু হতে পারত। পায়ের একটা আঙ্গুল কেটেছে একটু, এমনটা মল্লিকার সঙ্গে ঘটলে মুকুলকে শাস্তি পেতে হতো, কিন্তু ফয়সাল ভুলেও চিৎকার চেঁচামেচি করেনি। শুধু ছেলেকে বলল, এভাবে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখো না মুকুল, আজ বাবা ব্যথা পেয়েছি কাল অন্য কেউ পেতে পারে। সমস্যা হবে তখন!
আজ সারাদিনেও দৃশ্যটা ভুলতে পারেনি মল্লিকা, ভীষণ মায়া লেগেছে, সেজন্যই ফয়সালের পছন্দের তিন রকম নাশতা তৈরি হয়েছে আজ বাসায়। মল্লিকা নিজে বানিয়েছে। ফয়সালের কিনে আনা হলুদ শাড়িগুলো থেকে একটা বের করে রেখেছে, আজ সন্ধ্যার আড্ডায় এটাই পরার ইচ্ছে। নিজের আত্মীয়স্বজনের সাথে তো হৈচৈ করা গেল না, তবে আর যে কটা দিন অতিথিরা আছেন এ বাড়িতেই চরম হৈচৈ হবে। এরপর নিশ্চয় ফয়সাল আর রাগ করে থাকতে পারবে না। নিজের মনটা একটু ভালো হতেই ছেলেটার পরিবর্তন চোখে পড়েছে, এবং এই রাগটা মল্লিকাকে স্বস্তি দেয়নি!
সে যাইহোক, মেয়েটা মোবাইল টান দিয়ে মেসেজ লিখল, পায়ের অবস্থা কেমন এখন?
কখন আসছ?
জলদি বাসায় এসো প্লিজ! ঝড় টড় হবে মনে হয়, ভালো লাগছে না আমার!
মেসেজগুলো সিন হলো ঠিকই। কিন্তু উত্তর পাওয়া গেল না! মল্লিকা অপেক্ষা করে আছে। না, উত্তর নেই।
ও ভাবছে, সোজা সরল মানুষকে নিয়ে এই এক সমস্যা, রাগ করবে না, করবে না, কিন্তু হঠাৎ একবার করে বসলে সেই মান ভাঙানো কঠিন! আপনমনে বলল, আরে আশ্চর্য, মুকুলকে একটা থাপ্পড় মেরেছি বলে এত কষ্ট পাওয়ার কী আছে! ছেলের জন্য এত টান আর আমার জন্য কোনো টান নেই? আমি যে কাল থেকে ওর পেছন পেছন ঘুরে মরছি,কত কষ্ট পাচ্ছি, সেটা যেন কিছু না!
সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ, ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই, টিভিতে খরব চলছে। সন্ধ্যার নাশতা দেয়া হয়েছে, অথচ এখনো আসেনি ফয়সাল। আবহাওয়াও একদম থমথমে, যেকোনো মুহূর্তে ঝড় আসবে। গুড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়ে আকাশ একটু পাতলা হয়েছিল কিন্তু আবার যেন ঝড়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে।
রীতিমতো ভয় লাগছে মল্লিকার, এ কদিন তো ছেলেটা সন্ধ্যার সাথে সাথে বাড়ি ফিরেছে, তাহলে আজ এত দেরি কেন? ফয়সালের নিজের ব্যবসা সে তার ইচ্ছেমতো অফিস থেকে বেরুতে পারে, বাড়িতে মেহমান আছে বলে কটা দিন তাড়াতাড়িই ফিরেছে আজ দেরি হলে ও নিশ্চয় জানিয়ে দিত, কিছু যখন বলেনি তবে এত সময় লাগছে কেন?
এরমধ্যে কয়েকবার ফোন ট্রাই করেছে মল্লিকা, কিন্তু মোবাইল বন্ধ ও বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে রীতিমতো, এমন সময় বাবলূকে দেখতে পেল। বাবলু এ পাড়ারই ছেলে, সারাদিন বাইরে বাইরে ঘোরে। কাছাকাছির মধ্যেই বাসা ওদের।
বাড়ির গেটের সামনে এসে থামল বাবলু, হাতে অনেক জিনিসপত্র, উপরে তাকিয়ে মল্লিকাকে চোখে পড়তেই বলল, ভাবি, দরজা খোলেন, আমি উপরে আসতেছি!
চাবি লাগবে না?
না ভাবি গেইট খোলা।
মল্লিকা হুড়োহুড়ি করে এসে দরজা খুলেছে
মিসেস রেবা বললেন, ফয়সাল ফিরেছে বউমা?
না মা, বাবলু এসেছে অনেক কিছু নিয়ে, বুঝলাম না!
জিনিসপত্রগুলো নিয়ে তিনতলা উঠতে সময় লেগেছে বাবলুর। বাজার সদাই, নাশতা আরও অনেককিছু, ব্যাগগুলো এগিয়ে দিতে দিতে ও বলল, ভাবি, এগুলো ভাইয়া পাঠাইছে, আর এই যে নেন মোবাইল, চার্জ করে রাখতে বলছে, উনি নাকি চার্জার খুঁজে পাইতেছে না। ভাইয়ার সাথে রাস্তায় দেখা হইছিল, বলসে জিনিসগুলো বাসায় পৌঁছায়ে দিতে, উনি একটু তৌফিক ভাইয়ের বাসায় যাইতেছে, ফিরতে ফিরতে রাত হবে বলল। মোবাইলে চার্জ ছিল না বলে ফোন করতে পারে নাই!
মল্লিকা বলতে গেলে আকাশ থেকে পড়ল। ও ফয়সালকে মেসেজে বারবার বলে দিয়েছে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে। তাহলে বাড়ি না ফিরে ও তৌফিকের ওখানে গেল কেন!
রাত পৌনে দশটা, ঝড় থেমেছে প্রায় একঘন্টা পেরিয়ে আরও কিছুক্ষণ, অথচ এখনো ফেরেনি ফয়সাল। মেয়েটা বারান্দায় আসছে যাচ্ছে, ঝড় থামার আগেই তৌফিকদের বাসায় ফোন করেছিল মল্লিকা, ফয়সালের সঙ্গে কথা হয়েছে। ও কয়েকবার বলেছে,ঝড় থামলেই বেরিয়ে যেতে।
ফয়সাল তো রাজি হলো, বলল, আচ্ছা আসব। অথচ এখনো কেন আসেনি!
একটু আগেই আবার কথা হয়েছে তৌফিকের সঙ্গে, বলল, ছেলেটা ঝড় থামার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে গিয়েছে। তৌফিকের নতুন বাসাও বেশি দূরে নয় তাহলে বাড়ি ফিরতে এতক্ষণ লাগে কেন?
অস্থির হয়ে ঘর বারান্দা, বারান্দা ঘর পায়চারি করছে মেয়েটা। ওর অস্থিরতা দেখে বাড়ির সবাইও দুশ্চিন্তায় পড়েছে। একপর্যায়ে হানিফ সাহেব বললেন, বউমা, প্লিজ তুমি একটু শান্ত হও, ফয়সাল হয়ত কোথাও আটকে গিয়েছে, চলে আসবে এক্ষুনি! তুমি বড়ো বেশি দুশ্চিন্তা করছ!
হ্যাঁ ভাবি বেশি টেনশন নিও না তো! দেখবে ভাইয়া ভালোই আছে। বলল ফাইজা।
মিসেস রেবা তো সেই কখন থেকে মল্লিকার পেছন পেছন আছেন। ও ভাঙা গলায় বলল, দেখুন না বাবা, ঝড় থেমেছে এতক্ষণ, এখনো ফয়সাল আসেনি! সেই কখন তৌফিক ভাইয়ের বাসা থেকে বেরিয়েছে, এতক্ষণ লাগবে কেন! উনাদের বাসা তো কাছেই। তাছাড়া আকাশের অবস্থা খারাপ দেখেই আমি ওকে বাড়ি ফিরতে বলেছিলাম, অথচ এমন ঝড় হয়ে থেমে গেল এখনো এসে পৌঁছায়নি!,আজ বন্ধুর বাড়িতে না গেলে কী হতো? সে জানে আমি ঝড়ের সময় বাইরে থাকলে ভয় পাই, তারপরও!
মামা বললেন, মামনি, তুমি মাথাটা একটু ঠান্ডা রাখো ভয় পেয়ে তো কোনোকিছুর সমাধান করা যায় না। নিজেকে একটু শান্ত করো প্লিজ! তোমাকে এমন অস্থির করতে দেখে তো মুকুলও ভয় পেয়ে যাচ্ছে!
আমি যে শান্ত থাকতে পারছি না মামা! দ্যাখেননি আজ সকালে কেমন একটা ঘটনা ঘটেছে! অল্পের জন্য মারাত্মক কিছু হয়নি। এখন এমন ঝড়বৃষ্টি, এরমধ্যে ও এসে বাসায় পৌঁছাচ্ছে না, মোবাইলটাও বাসায়! বলতে গিয়ে মেয়েটা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
মিসেস রেবা এসে ধরলেন মল্লিকাকে। বললেন, না, না, বউমা কাঁদে না,দেখো, আল্লাহর রহমতে কিচ্ছু হবে না ফয়সালের।
মা আমি একটু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, এখানে ভালো লাগছে না!
মল্লিকা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে আট মিনিট, ফাইজাও আছে সঙ্গে, এমন সময় আবার বাবলুকে চোখে পড়ল। হয়ত কোথাও বেরিয়েছিল এখন বাড়ি ফিরছে।
মল্লিকা অস্থির, একটু চেঁচিয়েই জানতে চাইল,আ্যই বাবলু, তোমার ভাইয়াকে দেখেছ?
জি ভাবি, ফয়সাল ভাইয়া তো, মিন্টু ভাইয়ের দোকানে বসে গল্প করতেছে!
চেহারায় স্পষ্ট বিষ্ময় মল্লিকার,মাথা কাজ করছে না! ও উত্তর না দিয়েই ঘরে ফিরল। ফাইজা এসেছে পেছন পেছন।
ধপ করে এসে সোফায় বসে পড়েছে মেয়েটা। চেহারা রাগে লাল, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে সমানে।
কী ব্যাপার বউমা? হানিফ সাহেব যেন একটু ভয় পেয়ে গিয়েছেন।
কথা বলার মতো অবস্থায় নেই মল্লিকা, ফাইজা বলল, ছোটো ভাইয়া নাকি মিন্টু ভাইয়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে!
বাবা এবং ছোটো মামা বিস্মিত হয়ে তাকালেন পরস্পরের দিকে। চটে গিয়েছেন মিসেস রেবাও, ঝাঁজের সঙ্গে বললেন, আশ্চর্য! ছেলেটার কি কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই?
একটু চুপ থেকে হানিফ সাহেব বললেন, শামীম বের হও তো, ফয়সালকে গিয়ে নিয়ে এসো।
হাসছে শামীম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে যাবার আগে মল্লিকার উদ্দেশ্যে বলল, ভাববেন না ভাবি, আমি যাচ্ছি, ছোটো ভাইয়াকে সাথে করে নিয়েই বাড়ি ফিরব!
শামীম বেরিয়েছে প্রায় পঁচিশ মিনিট, অথচ মল্লিকার মনে হচ্ছে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। পেরিয়ে যাওয়া প্রতিটা মুহূর্তের সঙ্গে ছটফটানি বেড়ে চলেছে ওর। একপর্যায়ে আর থাকতে না পেরে ফোন করল শামীমকে।
দু একটা রিং হবার পর ফোনটা ধরে শামীম বলল, জি ভাবি, আমরা পৌঁছে গেছি প্রায়!
কেমন যেন অনুভূত হচ্ছে মল্লিকা বলে বোঝাতে পারবে না। ফোন রেখে সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যাচ্ছিল
মিসেস রেবা বললেন, আরে, আরে, বউমা কোথায় যাচ্ছ? বাইরে আবার বৃষ্টি!
শামীম বলল ওরা পৌঁছে গেছে মা, তাই আমিও রেরুচ্ছি।
ওরা তো চলেই এসেছে এখন আর গিয়ে কী হবে! মল্লিকা শোনো,শোনো!
না লাভ হলো না, ছাতা সঙ্গে নিয়ে মেয়েটা বেরিয়ে গিয়েছে।
চলবে