#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ১১
#আসেফা_ফেরদৌস
যাও, হাতমুখটা ভালো করে ধুয়ে কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নাও। প্রয়োজনে হালকাভাবে গোসলও করতে পারো, বেশ ঘেমে গিয়েছ। মোমবাতিটা নিয়ে যাও, তোমার তো আর আমার মতো সমস্যা নেই। তবে হ্যাঁ, বাথরুমে মোমবাতি নিয়ে ঢুকবে না। চেয়ার দিয়ে দরজার কাছে রেখো।
আচ্ছা!
ফয়সাল ফ্রেশ হয়ে কাপড় পাল্টে বাথরুম থেকে বেরুতেই কারেন্ট চলে এলো, মল্লিকা ডাইনিং রুমে টেবিল সাজাচ্ছে। বলল, নাশতা দিয়েছি, খেতে এসো।
চুপচাপ রুমে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল ফয়সাল, চেহারা বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে মেয়েটার।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে বাইরে। নাশতাও খুব সাধারণ, আলুপুরি, বিস্কুট, আর চা! কিন্তু তারপরও এমন আবহাওয়া, বৃষ্টির শব্দ, ঝিরিঝিরি বাতাস, দুজন প্রিয় মানুষ এবং হালকা নাশতা, ভেতরের মানসিক স্থবিরতাকে স্বাভাবিক করতে এটুকুই যেন যথেষ্ট।
ফয়সাল বলল, তোমার শরীর খারাপ?
হ্যাঁ একটু! মল্লিকা যেন জোর দিতে চায় না। ও কফিতে চুমুক দিচ্ছে চুপচাপ।
সবাইকে একসঙ্গে বাইরে পাঠাতে গেলে কেন, মুকুলকে রেখে দিতে।
না,মনটা চাইছিল না। তাছাড়া, আজ ছেলেটার টিচার আসবে না, ওরও যাওয়ার ভীষণ শখ, সেজন্যই আমি আর আটকালাম না! ঘরে বসে বসে কী হবে, বোরই তো হতো!
আমি যদি সময়মতো এসে পৌঁছাতে না পারতাম?
কী করার আছে, ভয় পেতাম বসে বসে!
কান্নাকাটি করতে না?
উত্তর নেই। মেয়েটা চোখ নামিয়ে নিয়েছে।
আচ্ছা, যখন দেখলেই আকাশের অবস্থা খারাপ একটা ফোন কি করা যেত না? আমি তো অপেক্ষা করছিলাম! ভেবেছিলাম, তুমি অবশ্যই স্মরণ করবে!
মল্লিকা চোখ তুলে তাকাল, ফয়সাল তো তাকিয়েই আছে। দুজনের মাঝে এখন যে নীরবতা সেখানে বোধহয় কোনো ভাষ্যের প্রয়োজন নেই। একপর্যায়ে একটু হেসে প্রসঙ্গ ঘোরাল মেয়েটা। বলল, আমার ভালো লাগছে না! একটু রেস্ট নিতে চাই, মুকুল ফিরলে ওর হোমওয়ার্কটা ঠিকমতো শেষ করেছে কিনা, তুমি দেখো প্লিজ!
ফয়সাল কী বলবে ভাবছে, এমন সময় কলিংবেলটা বাজল।
ওকে ইশারায় বসতে বলে মল্লিকা উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, তুমি খাও, খাবারটা শেষ করো!
এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখা গেল এক এক করে ভেতরে ঢুকছে সবাই। ছোটো মামা ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ঝড়বৃষ্টি তো থামার নাম নেই, কারেন্টও আসা যাওয়ার মধ্যে আছে! তুমি ভয় পাও দেখে আর দেরি করলাম না বউমা, সোমা আপার গাড়ি দিয়ে চলে এসেছি!
খুব ভালো করেছেন মামা!
চেহারায় মিটি মিটি হাসি নিয়ে মল্লিকা ফিরে তাকাল। ফয়সালেকে দেখছে চুপচাপ।
ছেলেটার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি! ও যেন বলতে চাইছে, মল্লিকার জন্য আমিই যখন তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরলাম, তখন তোমাদের আর এত জলদি আসার দরকারটা কী ছিল! একটু দেরি করে ফিরতে পারলে না?
দুঘন্টা পর।
ড্রইং রুমে বসে পরিবারের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে ফয়সাল। মুকুলের হোমওয়ার্ক শেষ করিয়ে ও ফিরেছে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট, মল্লিকা রান্নাঘরে ছিল অনেকক্ষণ, পনেরো বিশ মিনিট হলো নিজের ঘরে গিয়েছে।
কিন্তু ফয়সাল উঠতে পারছে না, বাবা এবং ছোটো মামা জরুরি কথা বলছেন, শামীমও অফিস থেকে ফিরেছে একটু আগে। খানিকক্ষণ তো ওর সঙ্গে বসতেই হয়!
আরও পাঁচ মিনিটের মতো কাটিয়ে ফয়সাল উঠল। মল্লিকার শরীরটা কেন খারাপ হলো জানতে হবে।
ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। জলদি পা চালিয়ে ভেতরে এসে ঢুকল ছেলেটা। কিন্তু একি, মল্লিকা যে ঘুমিয়ে পড়েছে!
ফয়সাল এগিয়ে এলো, শরীরের উপর একটা কাঁথা টেনে অঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা, ওর হাতের বইটা বেকায়দায় ঢলে পড়েছে।
বইটা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে, কাঁথাটা ঠিক করে, ফয়সাল মল্লিকার কপালে হাত রেখে দেখল জ্বর এসেছে কিনা।
না, শরীর ঠান্ডা।
ও ঘুমাচ্ছে ঘুমাক, রাতের খাবারের সময় ডেকে দিলেই হবে। ঘরের বাতি নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালালে মনে হয় ভালো, মেয়েটা আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারবে। কিন্তু যেতে যেতেই আবার ফিরে তাকাল ফয়সাল, আচ্ছা, মল্লিকা কেঁদেছে কি? ঠিক যেন বোঝা যায়, আবার যায় না!
ফয়সাল টেবিলের পেপারওয়েটটা নিয়ে খেলছে চোখের পর্দায় এক এক করে আয়নার মতো ভেসে উঠছে গত তিনদিনের দৃশ্যগুলো, মল্লিকার সঙ্গে সরাসরি কথা না বললে মনটা শান্ত হবে না হয়ত!
বাসা থেকে খাবার এসেছে অনেক আগে, আকাশ নিয়ে এসেছে। এ অফিসেই কাজ করে আকাশ, প্রতিদিন বাড়ি থেকে খাবার আনার দায়িত্বটা ওরই। কাজের চাপ, মনের অবস্থা দুইয়ে মিলে খাওয়াটা হয়নি। ফয়সাল ব্যগটা টেনে নিলো। টিফিন ক্যারিয়ার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সঙ্গে আরেকটা বড়োসড়ো বাটি, এটায় কী থাকতে পারে, ফল টল নাকি!
প্লেট গ্লাস পানি, রেডি থাকা সত্ত্বেও টিফিন ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে ছেলেটা বাটিটাই খুলল আগে,কৌতুহল বড়ো অদ্ভুত জিনিস!
বাটির ভেতর একটা কাপড়ের ফুল, অনেকগুলো চকলেট, এবং বেশকিছু কাগজ পেপার ক্লিপ দিয়ে আটকে ভাজ করে রেখে দেয়া হয়েছে।
আশ্চর্য, খাবারের সঙ্গে এগুলো কী!
একটু সিদ্ধান্তহীনভাবেই ও কাগজগুলো হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলল। ওমা! এতো দেখি মল্লিকার হাতের লেখা, চিঠি নাকি!
মল্লিকা লিখেছে,
ফয়সাল,
তোমার মনে হয় না, তোমার এই নিজের মতো মন খারাপ থাকার সময়কাল এক সপ্তাহ পেরিয়ে আরও বেশি হয়ে যাচ্ছে! অন্তরের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই তো তোমার মন খারাপ, তাহলে হিসেবটা যে সেভাবেই কষতে হবে, নাকি!
আসলে আমি বলতে পারব না ঠিক কদিন পেরিয়েছে, আজকাল পেরিয়ে যাওয়া খানিকটা সময়ও যেন একেকটা দিনের মতো মনে হয়! এমন শূন্যতা আমি আগে কখনো অনুভব করিনি! সেজন্য অপেক্ষা তো আমিও করছি তবে ঠিক জানি না, এই কষ্টের শেষ কোথায়! কাল সন্ধ্যায় কথাগুলো বলার একটা সুয়োগ হয়েছিল, হয়ত বলতামও, কিন্তু দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ওঠার আগেই সবাই চলে এলো। বাড়িতে এমন হৈচৈ, কোলাহল আরও কিছু দিন থাকবে, কিন্তু এতটা কষ্ট ততদিন বয়ে বেড়ানো আমার জন্য কঠিন। তাই ভাবলাম, এভাবেই লিখি। তাছাড়া, তুমি কথা শোনার চেয়ে বলতে বেশি ভালোবাস তোমার যুক্তি পাল্টা যুক্তির মাঝখানে আমাকে ভাষ্য হারাতে হয় সবসময়, তাই আমার কথাগুলো লিখে জানানোই হয়ত উত্তম।
বুঝতে পারছি তুমি আঘাত পেয়েছ, অন্তরের ব্যপারটা আগে থেকে জানা না থাকায় ধাক্কাটা লেগেছে বেশি! এখানেই বোধহয় ভুল ছিল আমার। আমি আমার ভুলের ব্যপারে এ মুহূর্তে ব্যাখ্যা দেবো না, আগে গল্পটা বলতে চাই!
অন্তরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের শুরু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, ও আমার ক্লাসমেট। অনার্স পড়াকালীনই আমাদের পরিচয়, পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। পরস্পরকে ভীষণ ভালোবাসতাম আমরা, মুখে না বললেও দুজন দুজনের মনের কথা ঠিক বুঝতাম। পরস্পরের বাসায় বেশ আশা যাওয়াও ছিল। একটা সময়ের পর আমাদের একে অপরকে পছন্দ করার ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলছিল দু পরিবারই। দুজনেই মেধাবী ছিলাম, ভেবেছিলাম পড়াশোনা শেষ করে চাকরি বাকরি হলে পরে বিয়ে করব।
কিন্তু অনার্স পরীক্ষার পরই একদিন আংকেল বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। আমারা ভেবেছিলাম, তিনি হয়ত বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলবেন। কিন্তু সেদিন আকারে ইঙ্গিতে অর্থের দম্ভ দেখিয়েছিলেন আংকেল, আমাদের সঙ্গে উনাদের আর্থিক অবস্থার পার্থক্যটা কথার ছলে তুলে ধরেছিলেন বেশ শক্তভাবেই, এককথায় বাবাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে অপমান করেছিলেন।
বাসায় ফিরে বাবা আমাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন অন্তরকে ভুলে যেতে। বললেন, ওদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা চলে না, তারচেয়েও বড়ো কথা ও বাড়িতে বিয়ে হলে আমি সুখে থাকতে পারব না। সময় অসময়ে কথা শুনতে হবে!
এরপরও আরও বেশ কবার দেখা করেছিলাম আমরা। আমি অন্তরকে বারবার বলেছিলাম বাবাকে, আংকেলকে, বোঝাতে,সময় দিতে। কিন্তু তার এক কথা, এতে খুব একটা লাভ হবে না, আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেয়া উচিত। একটু গুছিয়ে নিয়ে, বাড়ির বাইরে নিজেদের মতো সংসার করা উচিত। অন্তর আমাকে স্পষ্টভাবে বলেছিল, ও চাকরির চেষ্টা করছে, পেয়ে গেলেই আমাদের বিয়ে হবে। এক কথায় চাকরিটা হলে ওর সঙ্গে আমাকে পালিয়ে যেতে বলেছিল।
আমি মা বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি পরিবারের অমতে গিয়ে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেবার মতো সাহস করতে পারিনি। অন্তরকে, বাবাকে অনেক বোঝাতে চেয়েছিলাম, লাভ হয়নি। বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হবার পর একপর্যায়ে আমি নিজেকে গুটিয়ে নেই।
আসলে, অন্তর এবং আমি দুজনেই ভীষণ জেদি, পরস্পরের সামনে নতি স্বীকার করতে পারিনি। কষ্ট পেয়েছিলাম, প্রিয় মানুষদের সামনে অসহায় বোধ করেছি ভীষণ। যার সরাসরি প্রভাব আমার শিক্ষাজীবনে পড়ল, জেদ করে মাস্টার্স করলাম না। চাকরি বাকরি করার ইচ্ছেও ছিল না আর। হয়ত অনেক অভিমান জমে গিয়েছিল মা বাবার উপর, অন্তরের উপর, এভাবেই অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল।
আমি যখন আত্মঅভিমানে নিজেকে হারাতে বসেছি, তখন হঠাৎই আমাদের বিয়ের কথাবার্তা হয়। আমি আপত্তি করিনি, কিন্তু খুব একটা চাওয়া পাওয়াও ছিল না। জীবনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মানিয়ে নিচ্ছিলাম।
নতুন বউ হয়ে আমি যখন এ বাড়িতে আসি, সেসময় বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, উপচে পড়া আনন্দ, কিংবা অদ্ভুত ভালো লাগা, কিছুই খুব একটা অনুভব করিনি। আমার চোখে হাজার রঙের স্বপ্ন ছিল না, বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা ছিল শুধু, ঠিকই বলেছ, প্রথম প্রথম তোমাকে অন্তরের ব্যপারটা বলার মতো সাহস আমার হয়নি!
সে যাইহোক, আমাদের কথায় আসি, আমি নিজেকে হারিয়েই সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চাইছিলাম কিন্তু তুমি তা হতে দাওনি! আমি চুপচাপ থাকতে চাই, তুমি অনর্গল কথা বলো, আমাকে ঘিরে তোমার আগ্ৰহের শেষ নেই, প্রশ্নের শেষ নেই, ভালোবাসার কমতি নেই। আমি ঘর আঁকড়ে বসতে চাই, তুমি জোর করে ঘুরতে নিয়ে যাও, আমার উপহার পাবার খুব একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে না, অথচ তুমি প্রতিদিনই কিছু না কিছু কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরো, বলতে গেলে এমন ছোটো ছোটো হাজারটা ঘটনা! কটা বলব, বিশ্বাস করো, আমিও একসময় নিজের মতো থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার ভালোবাসার মায়ায় কখন যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি হয়ত নিজেরও জানা নেই। আমার দুঃখ বেদনা ভুলে গিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমাকে! হ্যাঁ ভালোবেসে ফেলেছিলাম, সত্যি বলছি, ভালোবাসতাম, ভালোবাসি, ভালোবাসব।
চলবে