#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৪
ধরা পড়েছে আবার পড়েও নি মাহমুদ। ওয়েটার সেজে বিয়ার পরিবেশন করা কালীন হাঁটার ওপর দিকে ভেতরে একঝলক উঁকি দিয়েছিলো সে। ভেতরে শত্রুপক্ষের নেতা আছে। স্বচ্ছ কাঁচের দরজা ভেদ করে সাউন্ড যদিও বাইরে আসছে না তবে স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে সবকিছু। আড়ালে সরে গেলো সে। কোমরের কাছ থেকে ওয়াকিটকি টা বের করে দ্রুত সিগন্যাল পাঠালো। এদিকে ভেতরে থেকে সিসিটিভিতে বাইরের সবকিছু মনিটরিং করছিলো শত্রুরা। মাহমুদকে উঁকি দিতে দেখে আর একমুহূর্তও দেরী করে নি। দ্রুত বেরিয়ে এসেছে দুই তিনটা ষন্ডা টাইপের লোক। কিন্তু লাভ হলো না। ওরা মাহমুদ অব্দি পৌঁছানোর আগেই পুরো ফোর্স নিয়ে ভেতরে ঢুক পড়েছে সোহাগ। সঙ্গে মেহরিন এবং এনাও আছে। তারপর শুরু হলো মুখোমুখি আক্রমণ।
তবে সিক্রেট মিটিং হওয়ায় দরুন আক্রমণের পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে আসে নি শত্রুপক্ষ। তাই বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারলো না। আধঘন্টা মধ্যেই ধরাশায়ী হয়ে গেলো।
★
ক্রিমিনালদের আপাতত তাসখন্দের পুলিশ কাস্টোডিতে রাখা হবে। সেখান থেকেই বাংলাদেশে পাঠাবে উজবেকিস্তান সরকার। হোটেলের যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটাও সরকারের পক্ষ থেকে মিটিয়ে দেওয়া হবে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মাহমুদরা সবাই। আনন্দ দৌড়ে গিয়ে মাহমুদকে জড়িয়ে ধরলো এনা। নতুন এজেন্ট হওয়ায় বিদেশী মিশনগুলো খুন এঞ্জয় করে সে। সেই সাথে মিশন সাকসেসফুল হলে তো কথাই নেই। আনন্দ রাখে কে? মাহমুদ আলতো করে তাঁর পিঠে চাপড় দিয়ে বললো,’আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ!’
মেহরিন সোহাগের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। চোখাচোখি হতেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এনাকে ছেড়ে সোহাগের সঙ্গে কোলাকুলি করলো মাহমুদ। ভ্রু কুঁচকে ফেললো মেহরিন। মাহমুদ কি তাকেও জড়িয়ে ধরবে? লক্ষণ তো তাই মনে হচ্ছে! না! সেই সুযোগ তাঁকে কোনভাবেই দেওয়া যাবে না। সবকিছু শেষ করার সিদ্ধান্ত যখন মেহরিন নিয়েই নিয়েছে তখন সেটা পুরোপুরি শেষ করা উচিৎ। ইমোশনকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে ফাঁক রেখে দেওয়া। হাতদুটো ভাঁজ করে আড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ব্যপারটা নজরে এড়ালো না মাহমুদের। হ্যান্ডশেইক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো সে।
যদিও মেহরিনের ওপর মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়ে আছে সে। এই নিয়ে যতবার মেহরিন তাঁর সঙ্গে মিশনে এসেছে ততবারই মাহমুদকে বাড়তি টেনশন মাথায় নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। আজকেও তাঁর ব্যতিক্রম হয় নি। আরেকটু হলেই গেছিলো মেহরিন যদি না উল্টো দিক থেকে পরপর দুটো গুলি এসে শত্রুটিকে ঘায়েল না করতো। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রথম গুলিটা মাহমুদই করেছে। আর দ্বিতীয় গুলিটা?
দ্বিতীয় গুলিটা, এনা করেছে! হ্যাঁ, সোহাগ তখন আশেপাশেও ছিলো না। এবং বলতে দ্বিধা নেই, এনা এত দ্রুত শুট করেছে যে মাহমুদের গুলিটা মিস হলেও বেঁচে যেত মেহরিন।
মেহরিন বরাবরই জেদী, একরোখা! প্রয়োজনে নিজে শহীদ হয়ে যাবে কিন্তু শত্রুপক্ষকে ছাড়বে না। এছাড়া টিম লিডারের নির্দেশ অমান্য করা তাঁর খুব কমন একটা বদঅভ্যাস। যেটা নিয়ে শুধু মাহমুদ নয়, বিদেশি অনেক এজেন্টও তাঁর বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছে ইরফান আহমেদের কাছে। প্রথম প্রথম তিনি প্রায় প্রতিটা মিশন শেষেই পানিশমেন্টের ব্যবস্থা করতেন মেহরিনের জন্য। কিন্তু লাভ হয় নি। ফলাফল শূন্য! মেহরিন যেমন ছিলো, তেমনই আছে। তাই আস্তে আস্তে সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। যাই করুক না কেন, দলের ক্ষতি তো আর করছে না? উপরন্তু মিশনগুলোও সাকসেসফুল হচ্ছে। কিন্তু মাহমুদ? সর্বদা আতঙ্কে থাকে সে! গম্ভীর মুখে হ্যান্ডশেইক করে বললো,’কংগ্রাচুলেশন! তুমি বেঁচে আছো!’
খোঁচা সহ্য করার পাত্রী মেহরিন নয়। তাঁর ধারণা প্রাণ বাঁচিয়ে তাঁকে খোঁটা দিচ্ছে মাহমুদ। তাই দুকথা শুনিয়ে দিতে সে-ও ছাড়লো না। নিজের বাড়ানো হাতটা চট করে সরিয়ে নিয়ে এনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’থ্যাংক ইউ এনা। ইউ হ্যাভ ডান আ লট টু মি।’ জবাবে এনা বিনয়ী হাসলো। তারপর মাহমুদকে উদ্দেশ্য কটাক্ষ করে বললো,’অলসো থ্যাংকস টু ইউ মি.মাহমুদ। যদিও এটা টিম ওয়ার্ক ছিলো। অ্যাজ ইউ নো দ্যাট, টিমের একজন বিপদে পড়লে আরেকজন এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু তবুও, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আফটার অল, ইউ সেইভড্ মাই লাইফ।’
মেহরিনের এমন আক্রমণে খানিকটা বিব্রত হলো এনা। যদিও মেহরিন তাঁকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে নি তথাপি মাহমুদের সঙ্গে এহেন আচরণ মেনে নিতে পারলো না সে। মেহরিন শুধু শুধু মাহমুদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে! জবাবে সে খুব শান্তভাবে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তাঁর আগেই মাহমুদ থামিয়ে দিলো। ইশারায় বেরিয়ে তাঁকে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। বাধ্য হয়ে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসলো এনা। সে বেরিয়ে গেলে মাহমুদ হেসে উঠে বললো,’বাহ! তোমার মুখ থেকে থ্যাংক ইউ? ইট সাউন্ডস লাইক মিউজিক। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’
রাগের বিপরীতে মাহমুদের হাসি আরো বেশি মেজাজ গরম করিয়ে দিলো মেহরিনের। থমথমে মুখে বললো,’দিস ইজ নট ফান অ্যাট অল।’,
-‘আমি কখন বললাম এটা মজা? ডিড আই এভার স্যে দ্যাট?’
-‘আলবৎ বলেছো। তুমি আমাকে ডিমিন করতে চাইছো।’
-‘আমি মোটেও তোমাকে ডিমিন করতে চাইছি না। তুমি অকারণেই আমার ওপর খেপে যাচ্ছো।’
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলো মেহরিন। চেঁচিয়ে উঠে বললো,’আমি অকারণে তোমার ওপর খেপছি মানে? আমি কি পাগল?’
মেহরিনকে শান্ত করানো যাবে না বুঝতে পেরে সোহাগ তাড়াতাড়ি মাহমুদকে বাধা দিয়ে বললো,ইট’স ওকে স্যার। চলুন আমরা গাড়ির দিকে যাই।’
মাহমুদ তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বললো,’সবসময় তোমার মেহরিন ম্যামকে সাপোর্ট করা বন্ধ করো সোহাগ! এটা জরুরী নয় যে সবসময় কেবল সে-ই ঠিক হবে আর বাদবাকি সবাই ভুল। সেল্ফ-ডিফেন্স বলে যে একটা ব্যপার আছে সেটা তো তোমার ম্যাম মানতেই রাজি নন।’
ধমক খেয়ে সোহাগ তাঁকে আর কিছু বলার সাহস পেলো না। মেহরিনকে কিছু বলার আগেই সে রাগে কটমট করে চাইলো। ভয়ে বেচারা আর দাঁড়ালো না। যা খুশি করুক, ঝগড়া করতে করতে দুজনে শহীদ হয়ে যাক। তাঁর কি? এরা কি তাঁর কথা শুনবে? শুনবে না। অতএব নিরিবিলিতে গাড়িতে গিয়ে বসাই শ্রেয়।
এদিকে মাহমুদের কথা শেষ হওয়ার সাথেই পালটা জবাব দিলো মেহরিন। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’সেটা আমার পার্সনাল ইস্যু। তোমার কি?’
-‘আমার কি মানে? তুমি জানো না, টিমের কোন সদস্যের ক্ষতি হলে বাকিদের মনোবলের ওপরে তাঁর ইফেক্ট পড়ে? আর এজেন্সির একজন সিনিয়র এজেন্ট হিসেবে আমি নিশ্চয়ই চাইবো না আমার টিম মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ুক?’
-‘ও তারমানে তুমি একলাই কেবল প্রফেশনালিজম মেইনটেইন করতে পারো আর কেউ পারে না? সবাই বোকা?’
-‘আমি একবারও সেই কথা বলি নি মেহরিন। আমি শুধু তোমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।’
-‘সেই সাথে নিজের ঢোল নিজে পিটিয়েছো।’
মাহমুদ এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা চেয়ার টেনে তাতে বসে পড়লো। কপালের রগ চেপে ধরে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো সে। মেহরিন জীবনেও ভুল স্বীকার করবে না। অতএব হার যদি কাউকে স্বীকার করতে হয় সেটা তাঁকেই করতে হবে। নতুবা আজকে সারারাতেও আর্গুমেন্ট শেষ হবে না। বাম হাতে মাথার তালু চুলকালো সে। শান্ত কন্ঠে বললো,’ঠিক আছে বাদ দাও। আসল কথা হলো প্ল্যান সাকসেসফুল হওয়া নিয়ে। সেটা যখন হয়েছে তখন আর তর্ক করে লাভ নেই। চলো, বাইরে ওরা অপেক্ষা করছে।’
বিজয়ীর ভঙ্গিতে মাথা দোলালো মেহরিন। গম্ভীর মুখে বললো,’চলো।’
★
যাওয়ার সময় গাড়িতে সোহাগ এবং মেহরিন একসাথে বসলো। এনা পেছনের সীটে একা বসেছে। ভিউ দেখবে বলে ড্রাইভারের পাশে সামনে বসেছে মাহমুদ। রিভার ভিউ মিররে আড়চোখে মেহরিনের দিকে একবার চাইলো সে। মুখ ভার করে বসে আছে। কারণটা তাঁর অজানা নয়। ঝগড়া হলেই মেহরিন এমন করে। প্রথমে কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে তারপর নিজে নিজেই কষ্ট পাবে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে বাইরে দিকে চাইলো সে।
তবে আজকে মেহরিনের মন খারাপের কারণ মাহমুদের সঙ্গে ঝগড়া নয়। অন্য একটা কারণে মন খারাপ তাঁর। যেটা সে চাইলেও অস্বীকার করতে পারছে না। তখন মাহমুদ হ্যান্ডশেইক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় মুখের হাসির রেখা সে টেনে নিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু খারাপ লেগেছে তাঁর। খুব খারাপ লেগেছে। মাহমুদ তাকে জড়িয়ে ধরলে হয়ত আরো বেশি খারাপ লাগতো, রাগ হতো, অন্যায় মনে হতো। মনে হতো বুঝি সে এনাকে ঠকাচ্ছে, কিন্তু এখন কষ্ট হচ্ছে! খুব কষ্ট হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে সবকিছু ভুলে একবার যদি মাহমুদের বুকে মাথাটা রাখতে পারতো তাহলে সব কষ্ট দূর হয়ে যেত তাঁর! আসলে আবেগ জিনিসটা বরাবরই খুব আনপ্রেডিক্টেবল। কখন কোন দিকে মোড় নেয় কেউ বলতে পারে না। চোখ বন্ধ করে সীটে মাথা এলিয়ে দিলো সে। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। শক্ত থাকতে হবে তাঁকে।
.
.
.
চলবে