#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৩
পরেরদিন বিকেল বেলা ঘুম ভাঙলো মাহমুদের নকের আওয়াজে। হাই তুলে দরজা খুললো মেহরিন। মাহমুদ তাঁর আপাদমস্তক একঝলক লক্ষ্য করে ব্যস্তভঙ্গিতে বললো,’আমাদের বেরোতে হবে। আধঘন্টা সময় আছে হাতে।’
ফের হাই তুললো মেহরিন। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,’আসছি।’
দরজা থেকেই চলে গেলো মাহমুদ। ফ্রেশ হতে দশমিনিটের বেশি সময় নিলো না মেহরিন। এমনিতেও গতকাল তাঁর ফ্রেশ হওয়া নিয়ে অনেক কথা শুনেছে শয়তানটা। আজকে আর খামোখা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করতে চাইলো না। হালকা নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়লো।
★
সোহাগ এবং মাহমুদ ম্যাপ দেখছে। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরিন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ম্যাপটার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,’হোটেলের লোকজন আগে থেকেই সরিয়ে ফেলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয় ওরা টের পেয়ে যাবে।’
সমর্থণ করলো সোহাগ। মাহমুদ চুলের গোড়ায় আঙ্গুল চালাতে চালাতে বললো,’আমি সিগন্যাল পাঠানোর আগ পর্যন্ত ভেতরে ঢুকবে না কেউ। যত দ্রুত সম্ভব সিগন্যাল পাঠানোর চেষ্টা করবো আমি।’
-‘তুমি সিগন্যাল পাঠাবে মানে? ভেতরে তো আমার ঢোকার কথা ছিলো?’
কালকে সারারাত একফোঁটাও ঘুমায় নি মাহমুদ। বসে বসে প্ল্যানটা নিয়ে ভেবেছে। কিভাবে প্ল্যানটাকে আরো বেশি সেইফ করা, রিস্কের সম্ভাবনা কমানো, সহজ থেকে সহজ করা যায় এসবই ভেবেছে। ইরফান সাহেবকেও শান্তিতে থাকতে দেয় নি। ফোন করে বারবার বিরক্ত করেছে।
ইরফান সাহেব অবশ্য বিরক্ত হন নি। ঠান্ডা মাথায় সব শুনেছেন। সবশেষে গম্ভীর কন্ঠে বলেছেন,’তোর ওপর আমি ভরসা করি মাহমুদ। তুই চাইলে তোর সুবিধামত প্ল্যান গুছিয়ে নিতে পারিস কিন্তু একটা কথা অবশ্যই মাথায় রাখবি, প্ল্যান কিন্তু সাকসেসফুল হওয়া চাই। অ্যাট এ্যানি কস্ট!’
-‘হবে।’, আত্মবিশ্বাসী কন্ঠস্বর মাহমুদের।
-‘ঠিক আছে রাখছি আমি।’
★
আজকে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ মাফিয়া দলটির বিদেশী কিছু ক্রিমিনালের সঙ্গে একটা মিটিং আছে। স্থানীয় একটা হোটেলে খুব সিক্রেটভাবে মিটিংটার আয়োজন করেছে তাঁরা। খুব সম্ভবত তাদের দলনেতাও মিটিংটাতে থাকবে। তাই মাহমুদদের মধ্য থেকে কোন একজনকে ভেতরে ঢুকে ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে জানাতে হবে। সেই অনুযায়ী পজিশন নেবে পুরো টিম।
ভেতরে ঢোকার কাজটা মেহরিনের! কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না মাহমুদের। একই পরীক্ষা বারবার দিতে চায় না সে। ভেতরে ঢোকা মানে নিশ্চিত ভাবে ধরা পড়ে যাওয়া। শত্রুপক্ষের রেস্ট্রিকশন এরিয়ার ভেতরে বিপক্ষদলের এজেন্ট ঢুকবে অথচ তাঁরা টের পাবে না এত অল্প সিকিউরিটি নিয়ে নিশ্চয়ই মিটিং এরেঞ্জ করে নি তাঁরা? কিন্তু তাহলে ঢুকবে কে? এনাকে অবশ্য দেওয়া যায়। স্বাচ্ছন্দ্যেই রাজি হয়ে যাবে সে! কিন্তু যেখানে মেহরিনকে পাঠাতে মন সায় দিচ্ছে না সেখানে এনাকে পাঠাতে বিবেকে বাঁধছে। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলো সে-ই ভেতরে ঢুকবে। এর চাইতে ভালো উপায় আর হতেই পারে না। সকালেই সোহাগের সাথে এই ব্যপারে আলোচনায় বসলো। সোহাগ আপত্তি করলো না। কাজের দিক থেকে ইইরফান আহমেদের মতন সে চোখ বন্ধ করে ভরসা করে মাহমুদকে। আর যাই হোক দলের ক্ষতি করে কোন সিদ্ধান্ত নেবে না মাহমুদ।
এদিকে মেহরিন জবাবের অপেক্ষায় ধারালো দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে। মাহমুদ আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে বললো,’ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে।’
-‘নির্দেশ এসেছে না তুমি আনিয়েছো? কি প্রমাণ করতে চাও তুমি? আমি অযোগ্য?’
জবাব দিলো না মাহমুদ। নিজের মত করে রেডি হতে শুরু করলো। রাগে কেঁদে ফেলার উপক্রম মেহরিনের! তবে এই প্রথমবার মাহমুদের পক্ষ নিলো সোহাগ। সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বললো,’তুমি ভুল বুঝছো মেহরিন। এই ব্যপারে মাহমুদ ভাইয়ের সত্যিই কোন হাত নেই।’
মেহরিন শুনলো না। মাহমুদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে বললো,’কেন করছো এসব?’
-‘আমি কিছু করি নি!’
-‘তাহলে এসব কেন হচ্ছে?’
-‘বললাম তো বসের অর্ডার এসেছে।’
বেশকিছুক্ষণ নিরবে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো মেহরিন। তারপর পথ ছেড়ে দিলো। মাহমুদ ওয়াটকিটা দেখে নিতে নিতে সোহাগকে উদ্দেশ্য করে বললো,’এনাকে একটু ডেকে পাঠাও তো সোহাগ। আমার গানটা ওর ব্যাগে আছে বোধহয়।’
সোহাগ বেরিয়ে গেলে শান্তভাবে নিজের কাজ গোছানোয় মনোযোগ দিলো মাহমুদ। ভেতরে ভেতরে মেহরিনের বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছিলো। মেহরিন গেলো না।
-‘তুমি দাঁড়িয়ে আছো যে? রেডি হবে না?’
-‘আমি তোমাদের সঙ্গে মিশনে যাচ্ছি না।’ শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো মেহরিন।
ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকাতেই গানটা পেয়ে পেলো মাহমুদ। এনা তাঁর ব্যাগেই ঢুকিয়েছে। সেটা কোমরে গুঁজে নিতে নিতে বললো,’তুমি খামোখা আমার ওপর রাগ করছো মেহরিন। আমি হচ্ছি হুকুমের গোলাম! তোমাকে যেমন উপরমহলের নির্দেশ মেনে চলতে হয় তেমনি আমাকেও চলতে হয়। আমরা কেউ-ই বসের নির্দেশের উর্ধে নই!’
-‘কেবল তুমি আমার সঙ্গে থাকলেই কেন বসের নির্দেশ গুলো পাল্টে যায়? অন্যসময় তো ঠিকই থাকে!’
-‘কারণ বেছে বেছে রিস্কি মিশনগুলোতেই আমাদের দুজনকে একসঙ্গে পাঠানো হয়। আর তুমি তো ভালো করেই জানো এসব মিশন নির্দিষ্ট কোন স্কিম অনুযায়ী হয় না। সিচ্যুয়েশন অনুযায়ী স্কিম চেইঞ্জ করে নিতে হয়!’
-‘এখনকার সিচ্যুয়েশনটা কি শুনি?’
-‘ওদের রেস্ট্রিকশন এরিয়ার ভেতরে অচেনা মেয়ে দেখলে ওরা নির্ঘাত বুঝে ফেলবে শত্রুপক্ষের এজেন্ট তাই আমাকে ওয়েটার হিসেবে ভেতরে ঢুকতে হবে। এইব্যপারে এখানকার পুলিশ আমাদের সহযোগীতা করবে।’
-‘তুমি সিউর ওয়েটার সেজে ঢুকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই?’
-‘আছে কিন্তু সময় পাওয়া যাবে। ওরা টের পাওয়ার আগেই আমি সিগন্যাল পাঠিয়ে দিতে পারবো।’
এবার বোধহয় কিছুটা শান্ত হলো মেহরিন। নরম গলায় বললো,’বস তোমাকে কখন জানিয়েছেন?’
-‘কালরাতে।’
তথাপি সন্দেহ পুরোপুরি গেলো না মেহরিনের। তবে তর্ক করার মতন আর কোন যুক্তিও খুঁজে পেলো না সে। মাহমুদ মুচকি হেসে বললো,’আশাকরি, আর কোন কনফিউশন নেই তোমার?’
ইনডাইরেক্টলি মেহরিনকে বেরিয়ে যেতে বলছে মাহমুদ। প্ল্যানটা সে চেইঞ্জ করেছে বুঝতে পারলে আর কিছুতেই মানানো যাবে না মেহরিনকে। দেখা যাবে, তাঁর আগে ভেতরে ঢুকে বসে আছে মেহরিন। তাই কথাগুলো বলার সময় ভেতরে ভেতরে টেনশন হচ্ছিলো তাঁর। সেটা চাপতেই মেহরিনকে তাড়াতাড়ি বের করে দিতে চাইলো।
এদিকে ‘ঠিক আছে’ বলেও বেরোলো না মেহরিন। মাহমুদ পুনরায় গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’এবার কি আমি আমার কাজগুলো সেরে নিতে পারি? আসলে বেশ কয়েকটা ফোন করার ছিলো।’
বেরিয়ে গেলো মেহরিন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো মাহমুদ।
★
এনাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে বাধ্য হয়ে ফিরে এসেছে সোহাগ। ফোনও ফেলে গেছে রুমে। এদিকে অলরেডি সাড়ে চারটা বেজে গেছে। আর বেশী দেরী করা যাবে না। বাধ্য হয়ে মাহমুদ নিজেই খুঁজতে বেরোলো।
স্পা এরিয়াতে উঁকি দিতেই দেখা মিললো তাঁর। মাহমুদকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো,’দারুণ মাস্যাজ করে এরা। নেবে নাকি?’
না-সূচক মাথা দোলালো মাহমুদ। তাড়া দিয়ে বললো,’আমাদের কে এক্ষুনি বেরোতে হবে এনা। হাতে সময় খুব কম।’
মুখে আন্তরিক দুঃখভাব ফুটে উঠলো এনার। এভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত স্পা এরিয়াতে বসে থাকা একদমই উচিৎ হয় নি তাঁর। তবে দেরী করলো না সে। ঝটপট উপরে চলে গেলো রেডি হওয়ার জন্য।
★
নিচে দাঁড়িয়ে এনার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। মজার বিষয় হলো আজকেও স্বামী স্ত্রী সেজে বেরোতে হবে তাঁদের। সন্দেহ ঠেকাতে কাধে একটা ছবি তোলার ক্যামেরা ঝুলিয়েছে সোহাগ। সেটাই নেড়েচেড়ে দেখছিলো। মাহমুদ ফোন স্ক্রল করছে। মেহরিন গম্ভীরমুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর দিকে চোখ পড়তেই সোহাগ ফিসফিস করে বললো,’মানানো কি গেছে স্যার? নাকি আগের মতনই আছে?’
মাহমুদ হাসলো। ঠাট্টার সুরে বললো,’গেছে। বললাম,তুমি গেলে আমাদের সোহাগের কি হবে ভাই? বেচারা এমনিতেও সারাক্ষণ তাঁর মেহরিন ম্যামকে নিয়ে টেনশনে থাকে। ওকে আর টেনশন দিও না।’ কথা শেষ করে শব্দ করেই হাসলো সে।
-‘ব্যপার উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতন হয়ে গেলো না?’, সোহাগও হাসিমুখেই খোঁচাটা মারলো।
হাসি থেমে গেলো মাহমুদের। স্থির ভাবে সোহাগের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর? তারপর অস্বীকার করতে গিয়ে ফের হেসে ফেললো সে! ততক্ষনে এনাও নেমে এসেছে। সোহাগের ঘাড়ে আলতো করে চাপড় দিয়ে বললো,’চলো বেরোই।’ তারপর একসঙ্গেই বেরোলো চারজন।
.
.
.
চলবে