গল্পঃ হৃদয়ের বন্ধন।
পর্বঃ ২৬।
লেখাঃ #মেহের।
বাসার সবাই শুধু মারুফের একটা খবর পেতে উৎসুক হয়ে আছে।
চাঁদনী বানুর মনে হচ্ছে,মারুফ এখনেই এসে বলবে , আমার ক্ষুধা লেগেছে কেউ কি আমাকে আজকে খেতে দিবে?
কিন্তু না এ কথা বলতো তো তখন যদি মারুফ বাসায় থাকতো।
হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেছে সে।
কত রাত হয়ে গেছে এখনো মারুফের কোন খোঁজ খবর নেয়।
একটা সুস্থ্য সবল মানুষ কেমন করে এভাবে হারিয়ে যেতে পারে তাই পাচ্ছে না মারুফের পরিবার।
তাদের চিন্তা হচ্ছে যে,মারুফের সাথে কোন অঘটন ঘটে যায়নি তো!
মারুফের পরিবারের কাছে এই মুহূর্তে এক একটা মিনিটও মাসের সমান মনে হচ্ছে।
মারুফের অপেক্ষা করেও ওঁর দেখা তো দূরের কথা ওঁর ছায়াও দেখছে না।
সেজন্য কষ্টে মারুফের মায়ের বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
মায়া বেগম এবং চাঁদনী বানু তো মনে মনে ভয় পাচ্ছে ।
ওদের মারুফের কোন বড় বিপদ হয়নি তো !
বিকেলে থেকে এসব আজে বাজে ভেবে তাদের মনে কুডেকে যাচ্ছে ।
কোথায় আছে তাদের আদরের মারুফ।
রাশেদ আর ইসহাক খান থানায় গিয়েছিল।
পুলিশ বলছে চব্বিশ ঘণ্টার আগে কোন রিপোর্ট লেখবে না।
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মারুফ ফিরে না এলে তাদের জানাতে।
রাশেদ এদের কথার কোন ভেবে পাচ্ছে না ।
চব্বিশ ঘন্টা পার হওয়ার আগেই যদি ভাইয়ের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়।
তাহলে কি হবে?
তাদের দেরি করে রিপোর্ট লেখাতে ক্ষতি হলে হবে আমাদের তা কেন বুঝতে পারছে না লোকটা।
পুলিশের কথা শুনে ওঁরা মারুফকে নিজেদের মত করে খুঁজ নিতে থানায় বের হয়ে গেল।
রাতের বারোটা পর্যন্ত রাশেদ আশেপাশের সব জায়গায় খুঁজে ভাইকে না পেয়ে শূন্য হাতে বাড়িতে ফিরলো।
উকিল সাহেব কয়েকটি হসপিটালে গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন।
সেখানেও মারুফের কোন খবর পায়নি।
জেসিকা তাকে বারবার ফোন দিচ্ছে।
দিয়ে বলছে ,মারুফের কোন খোঁজ খবর পেয়েছে নাকি! মারুফ কেমন আছে কিছু জানতে পেরেছে কিনা?
উকিল সাহেব মেয়েকে বুঝাতে পারছে না যেখানে সে মারুফকে কেনো খোঁজেই পাচ্ছে না।
সেখানে মারুফ সুস্থ্য বা ভালো আছে তা জানবে কি করে!
মেয়েটা সন্ধ্যা থেকে পাগলের মত আচরণ করছে।
মারুফের নিখোঁজ হওয়ার কারণে জেসিকার বাবা বুঝতে পারছে তার মেয়েটা মারুফকে কত ভালোবাসে।
নাহলে এই সত্যি হয়তো তার অজানা রয়ে যেত।
এদিকে জেসিকা বাবার, রাশেদ, চাচ্চু কারো কাছে থেকে মারুফের কোন খোঁজ পাচ্ছে না।
জেসিকা বিরক্ত হয়ে বলল বাবা এতো বড় উকিল হয়ে লাভ হলো কি?
ওঁর এবং মারুফের জন্য কিছুই করতে পারছে না।
জেসিকা একা একা বিরবির করে বলছে, আমার সঙ্গে রাগ করে মারুফ কোথাও চলে যায়নি তো!
কিন্তু আবার মনে মনে ভাবলো মারুফের মত একজন দায়িত্ববান ছেলে কখনও সামান্য কারণে রাগ করে হারিয়ে যাবে না।
হয়তো কোথাও কাজে গিয়ে আটকে গেছে।
কিন্তু কাজে আটকে গেলে তো একটা ফোন করে জানিয়ে দিতো।
চাহলে কি ওঁর মারুফ কোনো বিপদে পড়েছে?
জেসিকার এসব ভেবে অস্থির লাগছে।
জেসিকা মনে মনে বলল,মারুফের কোন বন্ধুদের থেকেও ওঁর কোন খোঁজ খবর জানতে পারব না।
কারণ তাদের কারো সাথে তো
আমার চেনা জানা নেই।
মারুফ রাগ বা অভিমান হলে কোথাও ঘুরতে যায় কিনা তা জেসিকা জানে না
বা কখনো সে বিষয়ে জানতে চায়নি।
জেসিকা মনে মনে নিজেকে দীক্ষার দিচ্ছে,সে কেমন স্ত্রী যে স্বামীর মন বুঝতে পারেনি।
সবকিছুকে এমন হেলাফেলার নজরে দেখেছে কেন?
যেখানে জেসিকা মারুফকে ছেড়ে কিছু ঘন্টা থাকতে পারছে না।
নিজেকে ওঁর এই মুহূর্তে বদ্ধ উন্মাদ মনে হচ্ছে
সেখানে একসময় কি ভেবে মারুফকে সারাজীবনের জন্য ছাড়তে চেয়েছিলে তা ওঁর জানা নেই!
জেসিকা এখন মারুফকে এক নজর দেখতে ছটফট করছে।
কোনভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না।
জেসিকা কখন যে নিজের মনের অজান্তেই মারুফকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে।
তা এতদিন বুঝতে পারেনি।
আজকে মারুফের কিছুক্ষণের অনুপস্থিতিতে ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে মারুফ ওঁর হৃদয়ের কতটা জুড়ে রয়েছে।
মারুফ জেসিকার কাছে কতটা মূল্যবান।
জেসিকা হঠাৎ মনে পরলো মারুফ কালকে বিকালে একটি শার্ট অল্পসময়ের জন্য গায়ে দেয়।
তখন শার্টের পকেটে কি কাগজ যেনো রেখেছিলো।
অল্প সময়ে এজন্য বলেছে কারণ শার্ট পড়ার পর মারুফ দেখে ওটায় দুইটা বোতাম ছিঁড়ে গেছে তাই বাজে দেখাচ্ছে। তা দেখে শার্টটা খুলে আলমিরাতে রাখে।
কিন্তু শার্ট খোলার সময় কাগজটা বের করতে হয়তো ভুলে গেছে।
সেই কাগজের টুকরোতে কিছু লেখা নেয়তো।
এসব ভাবতে ভাবতে জেসিকা আলমিরা খুলে শার্টটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এক সময় ভিতরের দিকে শার্টটা দেখে টান দিয়ে বের করার সময় আলমিরার ভিতরে থেকে একটি মাঝারী সাইজের প্যাকেট ফ্লোরে পড়ে যায়।
জেসিকা সেদিকে খেয়াল না করে শার্টটা কিছুক্ষণ বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখে আবার শার্ট নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ শুঁকে নিচ্ছে।
জেসিকার কাছে এই শার্টে যে ওঁর মারুফের গায়ের গন্ধ ভেসে আসছে।
শার্ট থেকে অনেকক্ষণ ঘ্রাণ নেওয়ার পরে জেসিকার মনে পরে পকেটে
চেক করার কথা।
মনে পরার সাথে সাথে জেসিকা তাড়াহুড়ো শার্টের পকেটে চেক করছে।
শার্টের পকেটে চেক করে একটা কাগজ বের করে।
কাগজে কি আছে তা দেখতে অস্থির হয়ে কাগজের ভাজ খুলে দেখে কাগজের ভাজে টাকা রাখা।
আর কাগজটা পুরোপুরি সাদা।
এতে কিছুই লেখা নেয়।
তা দেখে জেসিকার চোখে মুখে হতাশায় ঘিরে রেখেছে।
জেসিকা ভেবেছে এখানে হয়তো কিছু লেখা থাকতে পারে।
কিন্তু তা না পেয়ে এখন কি করবে তা ভেবে পাচ্ছে না।
আগে শার্টটি রাখতে হবে সেজন্য জেসিকা মারুফের শার্টটা টাকাসহ যেখান ছিল সেখানে রেখে দিয়ে আলমিরার পার্ট বন্ধ করতে নেয়।
পার্ট বন্ধ করতে গিয়ে নিচে পড়া প্যাকেটির সাথে লেগে শব্দ হলো।
হঠাৎ শব্দ শুনে জেসিকা নিচে তাকিয়ে প্যাকেটি দেখে অবাক হয়ে যায়।
জেসিকা নিচু হয়ে প্যাকেটি হাতে নিয়ে খুলে দেখে একটা নীল শাড়ি ও ম্যচিং করে স্টোনের কিছু অলংকার আছে এতে।
এগুলো দেখে জেসিকার চোখে পানি ছলছল করছে যে কোন মুহুর্তে তা চোখ বেয়ে নিচে পড়বে।
প্যাকেটে জিনিসপত্র গুলো দেখে জেসিকার কিছু দিন আগের কথা মনে পড়ে গেল।
মারুফ যে বাজারে দোকান করে সেদিন ওখানে দুই দিনের জন্য সব কিছুর মেলা বসেছিল।
মেলার প্রথম দিনেই সেখানে থেকে কোমল ও ঝর্নার জন্য থ্রিপিস আর স্টোনের গহনা আনেন।
বাসায় এসেই মেলা থেকে আনা জিনিসগুলো ওদেরকে দিয়েছে।
অবশ্য ওঁর জন্য এগুলো সেদিনই এনেছিল কিন্তু কারো সামনে দেয়নি।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পরে জেসিকা সব কাজ সেরে যখন রুমে ঢুকে তখন মারুফ ওকে পিছনে থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ গুজে ঘ্রাণ নিচ্ছি আর চুলে বারবার চুমু দিচ্ছিল।
মারুফের এমন হুটহাট আচরণে জেসিকা বিরক্ত হওয়ার ভান করে মারুফকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেও বিফল হয়।
মারুফ জেসিকার অবস্থা দেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,বৌ তুমি এমন করছো কেন?
সারাদিনে একবারে কি আমার কাছে আসতে আমাকে আদর করতে তোমার ইচ্ছে জাগে না?
মারুফের কথা শুনে জেসিকা বলল,না হয়না , বিরক্ত না করে এবার আমায় ছাড়ুন তো!
মারুফ জেসিকাকে আরও চেপে ধরে বলল, তোমার আমাকে আদর করতে ইচ্ছে না হলে কি আর করার!
জানো তো আমার খুব ইচ্ছে হয় তোমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে দুজনে মিলেমিশে এক হতে।
তবে তুমি তা হতে শুধু বাঁধা দাও এটা কি ঠিক!
কিন্তু জেসিকা মারুফের আবেগী কথা শুনতে চাচ্ছে না ।
এসব শুনলে ওঁর মন দূর্বল হয়ে যায় মারুফের স্পর্শ পেতে।
সেজন্য তো মারুফকে নিজের থেকে দূরে রাখছে।
মারুফ জেসিকাকে বলল,বৌ মেলা থেকে তোমার জন্য একটা নীল রঙের শাড়ি ও কিছু পাথরের অলংকার এনেছি।
জেসিকা মারুফের কথা শুনে বলল, আপনাকে এসব আনতে কে বলেছে?
মারুফ জেসিকার কথা শুনে কথা ঘুরিয়ে বলল,জানো আমার খুব ইচ্ছে করছে, আজকে তুমি এগুলো পরে সেজেগুজে আমাকে দেখাবে।
তোমাকে নীল শাড়িতে দেখে আমি আমার দুই চোখকে সার্থক করব।
একথা বলেই মারুফ
জেসিকাকে ঘুড়িয়ে বলে ,বৌ তোমাকে পাওয়ার তৃষ্ণা আমার যে দিন দিন বেড়েই চলেছে।
তা কি তুমি দেখতে পাও না? মারুফ কথাটা বলে জেসিকার ওষ্ঠ দখল করে নেয়।
জেসিকা সেদিন মারুকে ধাক্কা দিয়ে মারুফের কাছে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আপনি না আমাকে একদিন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন?
আর আজকে সেই আমাকে কাছে পেতে এতো অস্থির হয়ে কি গেছেন ব্যাপার!
আমাকে আজকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে পটাতে এসেছেন!
না অন্য কিছু?
এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাকে ফাঁসিয়ে শরীর ভোগ করতে চান তা সরাসরি বললেই তো হয়!
মারুফ জেসিকার কথা শুনে রাগে থাপ্পর মারতে গিয়েও হাত সরিয়ে নেয় ।
ওঁর শরীর রাগে কাঁপছে জেসিকা এমন কথা বলল কি করে এসব ভেবে ক্ষেপে গিয়ে জেসিকার জন্য আনা প্যাকেটটি আলমিরাতে রেখে দিয়ে বলে, শুনো বৌ ,তুমি আমার স্ত্রী তোমার উপরে আমার অধিকার আছে।
সেখানে ভোগ করার কথা আসে কি করে?
আর তোমাকে পেতে মানে তোমার কাছে যেটা ভোগ তা করতে হলে আমার মিষ্টি কথা দরকার হবে না তা মাথায় ঢুকিয়ে নিও।
একথা বলেই মারুফ সেদিন রাগ করে শুয়ে পরে।
এরপর দুইদিন অভিমান করে জেসিকার সাথে কোন কথা বলেনি।
শাড়ি দেখে হঠাৎ জেসিকা এসব কথা মনে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
এইদিন গুলিতে জেসিকা মারুফকে কেন এতো কষ্ট দিয়েছে?
কেন এমন অবহেলা অনাদাড় করেছে?
তা এখন ভেবে পাচ্ছে না।
ওঁর এইসব কাজে আল্লাহ ওঁর সঙ্গে অসন্তুষ্ট হয়ে ওকে মারুফের প্রতি করা অন্যায়ের কাজের শাস্তি দিচ্ছে না তো!
মারুফ তো বারবার বলতো কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীকে গভীর ভাবে কাছে পেতে চায়লে স্ত্রীকে সব কাজ ফেলে হলেও স্বামীর কাছে আসতে হয়।
কিন্তু জেসিকা তো মারুফের স্ত্রী হয়ে কখনও মারুফের চাওয়া পাওয়া নিয়ে ভাবেনি।
জেসিকা বিরবির করে বলছে, আল্লাহ তুমি আমার কাছে ওকে সুস্থ্য ফিরিয়ে দাও।
আমি আর কখনও মারুফের অবাধ্য হবো না।
নিজেকে ওঁর দাসী রূপে সঁপে দিবো।
জেসিকা রুমে বসে সারারাত এমন ছটপট করতে থাকে।
জেসিকা বাহিরে আযানের ধ্বনি শুনে ওযু করে নামাযের জন্য দাঁড়ায়।
এখনো মারুফকে কোন খোঁজ খবর মিলেনি়।
হঠাৎ করে একটা মানুষ কি করে এমন নায় হয়ে গেছে।
তা কেউ বলতে….