#ধারাবাহিক_গল্প
#হৃদয়ে_রেখেছি_তোমায়
#ষষ্ঠ_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস

-কোথায় যাচ্ছো মৃদুল?
-বাজারে। বাসায় ভালো কিছু নেইতো, তাই।
-ভালো কিছু লাগবে না, যা আছে তা দিয়েই খেতে পারবো। আর যদি যেতেই হয় আমি যাই নাহয়, তুমি বাসায় থাকো প্লিজ!
-আমার একঘন্টার বেশী লাগবে না। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে তোমার বাজারে ঘোরাঘুরি করার দরকার নেই। তাছাড়া, কতদিন তুমি দুপুরে বাসায় খাওনা,যা তা দিয়ে খাওয়াই কি করে বলো?
আবীরের চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে ও খুশি হতে পারছেনা।
মৃদুলা বললো, চিন্তা কোরোনা, আমি প্রায়ই বাজারে যাই, সমস্যা হবেনা।
আবীর চুপ করে আছে।
মৃদুলা বললো, আচ্ছা শোন, অবনী ওর রুমে আছে, বুয়া কাজ করছে। তুমি একটু খেয়াল রেখো কেমন?
আবীর নীরবে মাথা ঝাকালো।
মৃদুলা উঠতে যাচ্ছিলো, আবীর বললো, না গেলে হয়না মৃদুল?
না, হয়না আবীর। আমার মন মানবে না। মৃদুলা হেসে বললো।

মৃদুলা বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর আবীর অবনীর ঘরে ঢুকলো। অবনী মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। আবীর বললো, কি ব্যাপার মামনি, পড়তে বসোনি?
বসবো বাবা। আমি আমার বন্ধুদের সাথে এখন অনলাইনে গ্ৰুপ স্টাডি করবো।
-ও আচ্ছা।
আবীর গিয়ে খাটে বসলো।
-কি হলো বাবা এখানে বোসছো যে, বললাম না, আমি আমার বন্ধুদের সাথে এখনই কথা বলবো!
-অসুবিধা নেই। তোমাদের কাজ তোমরা করো না, আমি শুধু তোমার কাছে বসে থাকবো।
-না বাবা, তুমি এখানে বসে থাকলে ওরা কথা বলতে পারবেনা। ওদের লজ্জা লাগবে। আর আমিও কথা বলতে পারবেনা।
-চলে যাবো তাহলে?
অবনী মাথা ঝাঁকালো। আবীর তবুও উঠছেনা।
অবনী কান্না কান্না মুখ করে বললো, প্লিজ বাবা, যাও না!
আবীর উঠে দাঁড়ালো। মনটা একটু খারাপ। ও পা বাড়াতেই অবনী বললো, বাবা, আমাদের কথা শেষ হলেই আমি গিয়ে তোমাকে ডেকে নিয়ে আসবো। প্লিজ, মন খারাপ কোরোনা।
আবীর কিছু বললো না, হাসলো শুধু। অবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো, এরপর বেরিয়ে গেলো।
পুরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর। অবনী দৌড় দিয়ে রুমে ঢুকলো। আবীরকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, বাবা ওঠো, ওঠো,
আবীরের চোখটা লেগে গিয়েছিলো, অবনীর ডাকে বলতে গেলে লাফ দিয়েই ঘুম থেকে উঠেছে।
অবনী হাসিমুখে বললো, বাবা চলো আমার ঘরে। কথা শেষ।
আবীরের আসলে এখন‌ উঠতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। আরো কিছুক্ষণ ঘুমাতে চায়। কিন্তু অবনীকে না বলতেও মন চাইছে না। এত শখ করে এসেছে মেয়েটা! আবীর বললো, তুমি যাও, আমি আসছি।
একটু পর আবীর যখন অবনীর ঘরে ঢুকলো। তখন ও ছবি আঁকছে। আবীর বললো, কি ব্যাপার পড়া শেষ?
-পড়বো, কিছুক্ষণ পর। এতক্ষণ তো পড়াশোনা নিয়েই কথা বললাম, এখন কিছুক্ষণ ছবি আঁকি, তারপর আবার পড়া শুরু করবো।
আবীর ওর পাশে বসলো। অবনী বললো, আচ্ছা বাবা, তুমি কি আমার সাথে ছবি রং করবে? মা কিন্তু প্রায়ই করে।
তোমার ভালো লাগে? আবীর হেসে প্রশ্ন করলো।
-ভীষন!!!
-তাহলে চলো তাইই করি।
অবনী একটা বই বের করলো। সেখানে ছবি আঁকাই আছে। শুধু রং করতে হবে।
ও বললো, বাবা তুমি গাছটা রং করো, আমি সূর্যটা করছি।
আবীর ইচ্ছে করেই হলুদ রং তুলে নিলো। অবনীর প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়। একদাগ দিতেই অবনী বললো, কি করছো বাবা, গাছের রং কখনো হলুদ হয় নাকি?
ওহ্ সরি। কি রং করবো?
সবুজ! বাবা তুমি এটাও জানো না।?
আবীর হেসে ফেললো।
-আচ্ছা বাদ দাও। তুমি এই বাড়িটা রং করো।
এবার আবীর কালো রং বেছে নিলো।
অবনী বললো, বাবা আমার কালো রঙের বাড়ি ভালো লাগে না।
-তাহলে লাল রং করবো?
-আরে না, না। লাল টুকটুকে বাড়ি সেটাই বা কেমন লাগবে? আমি কখনো এমন বাড়ি দেখিনি।
-তাহলে কি রং করবো তুমি বলো?
-থাক তোমার কিছুই করতে হবে না। তুমি বসে বসে দেখো, আমিই রং করছি।
-ঠিক আছে। যেমন তোমার ইচ্ছে। আবীর হেসে বললো।
ও চুপচাপ বসে আছে। অবনী রং করছে। আবীর বললো, আম্মু, তোমাকে অনেক থ্যাংকস। কাল তুমি বাবার জন্য এতটা চিন্তা করেছো, আমাকে ছাড়া খেতেই বসোনি!
অবনী হেসে বললো, হ্যাঁ, মা বললো, যাও বাবাকে ডেকে তোলো, তাইতো এসেছিলাম।
আবীর ধাক্কা খেলো রীতিমত! বললো, মা বলেছে? একটু সময় লাগলো সামলে নিতে। একটু থেমে বললো, আর কি বলেছে মা?
বলেছে, তোমার শরীর ভালো নেই, মনটাও খারাপ।
এতক্ষণে আবীর মৃদুলার সকালের হাসির অর্থ বুঝতে পারলো। এবং তখনই কলিং বেলটা বাজলো।
মৃদুলা ফিরেছে হয়তো। আবীর উঠতে যাচ্ছিলো, এমন সময় দেখলো বুয়া দরজা খুলতে যাচ্ছে। আবীর বসে পড়লো।
কিছুক্ষণ পর অবনীর ঘরে ঢুকলো মৃদুলা। হাত মুখ ধুয়ে এসেছে। আবীরকে দেখেই বললো, তুমি একটুও রেস্ট নাওনি তাইনা?
কি অবনী, তোমাকে না নিষেধ করেছিলাম বাবাকে বিরক্ত করতে?
-আরে ওর কি দোষ, আমি তো মাত্র এসে বসলাম। সারাক্ষণ শুয়েই থাকতে হবে এমন তো কোন কথা নেই।
মৃদুলা কিছু না বলে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, আবীর বললো, আবার কোথায় যাচ্ছো?
বুয়া বাজার নামাচ্ছে। আমি একটু দেখে আসি, সব ঠিকঠাক করে দিলে রান্না বসাবো।
আচ্ছা, তুমি কি সারাদিন এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকবে? তাহলে আমি বাসায় কেন আছি?
-সরি, বেশিক্ষণ লাগবে না।
-ভালো লাগছেনা মৃদুল তোমার এ কথাগুলো!
-ওহ ভালো কথা, সিঙাড়া এনেছি তোমার জন্য, এসো খাবে।
-তুমি কি আমাকে অবনী পেয়েছো?
মৃদুলা ফিক করে হেসে ফেললো। বললো, ওমা রেগে যাচ্ছো কেন, সিঙাড়া না তোমার পছন্দ?
আবীর আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো এমন সময় মৃদুলার ফোনটা বেজে উঠলো। ও বললো, আ্যই, চুপ, চুপ। মা ফোন করেছেন।
মৃদুলা ফোন ধরে বললো, জ্বি মা, সরি। ও সময় ফোন ধরতে পারিনি। আমি একটু বাইরে ছিলাম।
ওপাশ থেকে কিছু বলা হলো। উত্তরে মৃদুলা বললো, না মানে আজকে আবীর বাসায় তো, শরীরটাও ভালো নেই ওর। ভাবলাম, ভালোমন্দ কিছু খেলে ভালো লাগবে। তাই বের হয়েছিলাম।
ওপাশের উত্তর মনোযোগ দিয়ে শুনলো মৃদুলা। এরপর বললো, জ্বি মা দিচ্ছি। এখানেই আছে ও।
ফোনটা আবীরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মৃদুলা বললো, নাও কথা বলো। মা তোমাকে চাইছেন।
আবীর ফোনটা নিয়ে বললো, হ্যালো,
কিরে, তোর নাকি শরীর খারাপ? মায়ের কন্ঠে উৎকণ্ঠা।
-না, শরীর খারাপ না। এই একটু দুর্বল।
-শুনি তো প্রতিদিন মৃদুলার কাছে, তোর নাকি একমিনিটের অবসরও নেই। এত ব্যস্ত থাকলে শরীর তো খারাপ হবেই!
-বাদ দাও তো মা। এখন বলো, তুমি কেমন আছো?
-আমাদের খোঁজ খবর নেয়া তো তুই ছেড়েই দিয়েছিস, কবে শেষ বাসায় এসছিস মনে করে দ্যাখ তো!
-মা তুমি কি এসব কথা বলার জন্যই আমাকে চেয়েছো?
-থাক, থাক আর বিরক্ত হয়ে কথা বলতে হবেনা। তারচেয়ে বরং মৃদুলাকেই দে। মেয়েটাই আজকাল আমাদের খোঁজ খবর নেয়।
মৃদুলা বেরিয়ে গেছে একটু আগে। আবীর ফোন নিয়ে রুম থেকে বের হলো। রান্নাঘরের দরজায় পাওয়া গেলো ওকে। বুয়াকে নিয়ে বাজার গোছগাছ করছে। আবীর মৃদুলাকে ফোনটা দিয়ে বললো, নাও, মা তোমার সাথেই কথা বলতে বেশী আগ্ৰহী।
মৃদুলা হেসে ওর হাত থেকে ফোনটা নিলো। এবং ইশারায় ওকে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করে ফোনটা কানে ঠেকিয়ে বললো, জ্বি মা।
এমন সময় আবীরের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা বেডরুমেই রয়ে গেছে। ফোন আনতে বেডরুমে ঢুকলো আবীর, এসে দেখে আঁখি ফোন করেছে। আবীর ধরে বললো হ্যালো,
-কিরে ভাইয়া আজ নাকি তুই বাসায়?
-এটা কি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান খবর যে, জায়গায় জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে?
আঁখি হেসে ফেললো। বললো, সেকি, চটছিস কেন? আমি সকালে ফোন ককরেছিলাম। ভাবি বললো, তোর শরীর ভালো না, বাসায় আছিস আজকে। তখন কথা বলতে পারিনি তাই এখন ফোন করলাম।
-বল কি বলবি? আবীর একটু বিরক্ত হয়ে বললো। আসলে সবাই জেনে যাচ্ছে ওর শরীর খারাপ, ব্যপারটা ওর পছন্দ হয়নি।
-কি খাবি বল, কি পাঠাবো তোর জন্য ভাইয়া?
-আরে তুই ব্যতিব্যস্ত হোস না তো, এমনিতেই তোর ভাবি হুলুস্থুল শুরু করেছে।
-সে তো হবেই, এতদিন পর তুই বাসায় আছিস, ব্যপারটা উৎসবের চেয়ে কম কিসে! তাছাড়া তুই বাসায় আজকাল একদম সময় দিতে পারিস না। ব্যপারটা ভাবিকে খুব কষ্ট দেয়।
আবীর চুপ করে গেলো।
আঁখি বললো, আচ্ছা ভাইয়া, আমার কথা কি তোর একটুও মনে পড়ে না? কতদিন আসিস না! একবারও কি মনে হয়না আঁখিটাকে দেখে আসি। জানতে ইচ্ছে করেনা, তোর আদরের ছোট বোনটা কেমন আছে তার সংসারে?
আবীর বললো, দ্যাখ আঁখি, মনটা খারাপ করিস না প্লিজ! তোরা সবাই তো এমন ভাবে অভিযোগ করছিস যেন আমি ইচ্ছে করে তোদেরকে অবহেলা করছি। আমার অবস্থান থেকে একটু বোঝার চেষ্টা কর, তোরা যে এভাবে বলছিস, শুনতে আমার কেমন লাগছে!
-আচ্ছা সরি। ভাইয়া, মন খারাপ করিস না। আর তুই আসতে না পারলে কি হয়েছে, ভাবি কিন্তু অবনীকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই আসে আমার খোঁজ খবর নিতে।
আবীর একটু থমকে গেলো।
আঁখি বললো, ভাইয়া রাখিরে।পরে কথা বলবো। আমার একটা ফোন আসছে।
-ঠিক আছে।
ফোন রেখে আবার মৃদুলার কাছে ফিরে এলো আবীর। মা এখনো মৃদুলার সাথে কথা বলছেন। ও কথা বলতে বলতেই বুয়াকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। আবীর কাছাকাছি একটা চেয়ার নিয়ে বসলো। দেখতে পাচ্ছে মৃদুলা বেশ হেসে হেসেই মার সঙ্গে কথা বলছে।
আবীর মনে মনে ভাবছে, মৃদুলাক মেনে নিতে মা বাবার বেশ সময় লেগেছে। মা চেয়েছিলেন আবীরের জন্য মেয়ে তিনি নিজে পছন্দ করবেন। সেই মেয়ের রুপ যেমনই হোক, তাকে ঘরোয়া হতে হবে। হতে হবে কাজে কর্মে ভীষণ পটু। সেখানে মৃদুলার মতো মেয়ে যে কিনা অবস্থাস্পন্ন বাবার একমাত্র সন্তান, যথেষ্ট স্বাধীনচেতা এবং স্পষ্টবাদী, এমন মেয়েকে মা বাবা মেনে নিতে চাননি। কিন্তু আবীরের জেদের কাছে তাঁদেরকে হার মানতে হয়েছে। আসলে তারাও আবীরের মনে কষ্ট দিয়ে ওর মতের বিরুদ্ধে যেতে চাননি। মেনে নিয়েছেন। কিন্তু বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই মা বুঝতে পারলেন ছেলের বউ তাঁর মনের মতো হয়নি। ঘরোয়া কাজে সে মোটেই পটু নয়। তাছাড়া, মার ভাষায় মৃদুলা যথেষ্ট ঝগরাটে। বিয়ের পর ওদের পরিবারে মানিয়ে নিতে কষ্টই হয়েছে মৃদুলার, মাঝে মাঝেই রাতে শুয়ে শুয়ে নীরবে কাঁদতো মৃদুলা, আবীর সবটাই বুঝতো কিন্তু ওর কিছু করার ছিলো না।
মাও আবীরের কাছে প্রায়ই হালকা অভিযোগ করতেন। এভাবেই মনে কষ্ট চেপে মা বাবা এবং মৃদুলা ধীরে ধীরে পরস্পরের সাথে স্বাভাবিক হয়েছে। সম্পর্কটা স্বাভাবিক এমনটাই জানা ছিলো আবীরের, কিন্তু সেই সম্পর্কটা কখন যে এতটা অন্তরঙ্গ, সাবলীল হয়ে গেছে তাতো চোখে পড়েনি! এমনকি মৃদুলাও ওকে কখনো কিছু বলেনি!

চলবে

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here