হৃদমোহিনী
পর্ব ৪৭
মিশু মনি
.
৬৯
ঘুমিয়ে পড়েছে মিশু। মেঘালয় একটা বিষয়ে রিসার্চ করছিলো। হঠাৎ চোখ ঘুরাতেই দেখলো মিশু গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। ল্যাপটপটা বন্ধ করে পাশের টেবিলে রেখে দিলো মেঘালয়। তারপর নিচু হয়ে এগিয়ে এলো মিশুর দিকে৷ মিশুর বাহুতে হাত দিয়ে দেখলো শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। একটা কাঁথা টেনে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো মেঘ। এক হাতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো হা করে।

মিশু গভীর ঘুমে মগ্ন৷ চিবুকের উপর থেকে এক গোছা চুল সরিয়ে মিশুর গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো মেঘালয়। এক স্নিগ্ধতায় ভরা সুগন্ধ মিশে আছে মেয়েটার শরীরে। মিশুর একহাতের উপর নিজের হাত রেখে আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে দিলো মেঘালয়। তারপর উপুড় হয়ে এসে মিশুর বুকের মাঝখানে মাথা রাখলো। গেঞ্জির উপরেই মাথা ডুবিয়ে দুবার শ্বাস গ্রহণ করতেই চমকে উঠলো মিশু। টের পেলো মেঘালয় আঙুলের মাঝে আঙুল বেঁধে রেখেছে। ও আরেকহাতে মেঘালয়কে বুকে চেপে ধরলো। ঘুমের ঘোরেই বললো, ‘আমার কলিজার ভেতরে ঢুকে যাও প্লিজ, কেউ যেন আর আলাদা করতে না পারে।’

মেঘালয় মিশুকে শক্ত করে জাপটে ধরে বললো, ‘কেউ আলাদা করবে না পাগলী।’
– ‘আমার ভয় হচ্ছে মেঘ, খুব ভয় হচ্ছে।’

মেঘালয় বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। মিশুকে বুকের উপর টেনে নিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘ভয় পেওনা। আমিতো আছি সবসময়।’
– ‘আমি তোমাকে ছেড়ে দেশের বাইরে চলে যেতে পারবো না মেঘমনি।’
– ‘আমিও তোমাকে যেতে দিবো না মিশুমনি।’
– ‘আমাকে আগলে রাখো না প্লিজ।’

মিশুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে চোখ বুজে রইলো মেঘালয়। কিছুক্ষণ পর মিশু বললো, ‘আমার খুব পা দুটো ব্যথা করছে।’
– ‘সেকি, কেন?’
– ‘জানিনা। ব্যথা করছে হঠাৎ।’
– ‘কোথায় ব্যথা করছে?’

মিশু হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো হাঁটুর নিচে। মেঘালয় মিশুকে শুইয়ে দিয়ে উঠে এসে লাইট নিভিয়ে দিলো। তারপর বিছানায় মিশুর পায়ের কাছে বসে পা টেপার জন্য হাত বাড়ালো। মিশু চমকে উঠে বললো, ‘এই কি করছেন আপনি!’
– ‘তোমার না পা ব্যথা করছে।’
– ‘ধেৎ, সেজন্য টিপে দিতে হবে নাকি। শুয়ে পড়ুন তো।’
– ‘চুপচাপ ঘুমাও তুমি। আমি এক্ষুনি ব্যথা সাড়িয়ে দিচ্ছি। তুমি ঘুমিয়ে যাও।’

মিশু অনেক চেষ্টা করেও মেঘালয়কে সরাতে পারলো না। মেঘ প্রথমে দুহাতে মালিশ করে দিলো। তারপর প্লাজো তুলে আলতো করে চুমুতে ভরিয়ে দিলো মিশুর দুই পা। বারবার শিহরিত হয়ে উঠতে লাগলো মিশু। চোখ বেয়ে পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু কেন কাঁদছে নিজেও জানেনা মিশু।

পরদিন সকালেই মিশুকে রংপুরের বাসে তুলে দিলো মেঘালয়। গাড়িতে ওঠার সময় মিশু মেঘালয়ের হাত চেপে ধরে বললো, ‘আমার একা একা যেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি আমাকে রেখে আসুন না।’

মেঘালয়ের ও যেতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু সংশয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। ছেলেটা কেন মায়ের পিছনে লেগেছে দেখাটা জরুরি। যাওয়ার সময় বারবার করুণ চোখে মেঘালয়ের দিকে তাকাচ্ছিলো মিশু। ও মোটেও একা যেতে চাচ্ছে না। মেঘালয় অনেক বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলো ওকে। বাসে উঠে একবারও মেঘালয়ের দিকে তাকালো না মিশু। রাগ করে গাল ফুলিয়ে রইলো। মেঘালয় ছুটে গিয়ে একগাদা আইসক্রিম নিয়ে এসে ওর কোলের উপর দিয়ে বললো, ‘এগুলো খেও। আর মন খারাপ করে না পাগলী টা, আর তো মাত্র দুটো দিন ই। তারপর সারাজীবনের মত সবসময় আমার সাথে সাথে রাখবো।’

তবুও মিশু কোনো কথা বললো না। গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। বাস ছেড়ে দিলো এমন সময়। মেঘালয় নেমে পড়লো বাস থেকে। জানালায় রাখা মিশুর হাতের দিকেই তাকিয়ে রইলো মেঘালয়। মিশু অভিমান করে বসে আছে, একবারও তাকাচ্ছে না মেঘালয়ের দিকে। বাস অনেক দূর চলে আসার পর হঠাৎ একবার জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাইরে তাকালো মিশু। কিন্তু তখন আর মেঘালয়কে দেখতে পেলো না। বাস অনেক দূর চলে এসেছে।

ইয়ারফোনে ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে রইলো মিশু। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। এবার একা একা একদমই যেতে ইচ্ছে করছিলো না, মেঘালয়টা বুঝলো না কিছুতেই। কান্না পেয়ে যাচ্ছে মিশুর। চোখ বন্ধ করে বসে রইলো অনেক্ষণ। হঠাৎ পাশের সিটে কারো বসার আওয়াজ পেয়ে চোখ মেলে তাকালো। এরপর দুজনেই অবাক!

তন্ময়!

তন্ময় নিজেও অবাক হয়ে মিশুর নাম উচ্চারণ করলো। মিশুর চোখ এমনিতেই ছলছল করছিলো। এখন তন্ময়কে দেখে মেজাজটা আরো বিতৃঞ্চায় ভরে গেলো। কোনোমত নিজেকে সামলে নিয়ে মিশু বললো, ‘তুমি এখানে কেন?’

তন্ময় কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মিশুর দিকে। মিশু আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি আমার পাশে কেন? যাচ্ছো কোথায়?’
– ‘আমি একটু বগুড়ায় যাবো, কাজ আছে।’

মিশু রেগে বললো, ‘যাও। তো আমার পাশে কেন তুমি?’
– ‘কি আজব! আমি কি করে জানবো আমার পাশের সিটটাই তোমার?’
– ‘মেঘালয় জানে?’
– ‘কি?’
– ‘এইযে তুমি বগুড়া যাচ্ছো। তাও আবার আজকেই আর আমার পাশেই বসেছো? আমার তো মনেহচ্ছে তুমি জেনেশুনে এখানে টিকেট কেটেছো। বাসে ওঠার সময় আমাদের দেখোনি?’

তন্ময় ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, ‘আমি সত্যিই জানিনা তুমি এখানে বসবে। আমার টিকেট তো আমি কাটিনি, একটা ফ্রেন্ডকে বলেছিলাম। আর তুমি বাসে উঠেছো কোথায় তা তো জানিনা, আমি মাত্র উঠলাম।’

মিশু রাগটা সামলে নিয়ে ইয়ারফোন খুলে চুপচাপ বসে রইলো। কি কাকতালীয় ভাবে তন্ময়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। তাও আবার সে পাশের সিটেই বসেছে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তন্ময়কে আজ খুব অসহ্য লাগছে। কয়েকদিন আগে ওর জন্যই মেঘালয় আর শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে ঝামেলা হয়েছিলো মিশুর। তন্ময়কে অসহ্য লাগাটাই স্বাভাবিক। ইয়ারফোন কানে দিয়ে ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে দিলো মিশু। খুব অপ্রস্তুত বোধ করছে আজকে।

অনেক্ষণ কেটে যাওয়ার পর তন্ময় জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার উপর রেগে আছো?’

মিশু শুনতে পায়নি কথাটা। তন্ময় হাত রাখলো মিশুর হাতের উপর। শিউরে উঠে হাত সরিয়ে নিলো মিশু। চমকে উঠে তাকালো তন্ময়ের দিকে। চোখাচোখি হতেই কিছুক্ষণের জন্য দৃষ্টি আটকে গেলো মিশুর। তন্ময়ের দৃষ্টি কত শীতল! এ চোখে কোনো ভয় নেই, পাপ নেই, কোনো করুণা নেই। যেটা আছে সেটার নাম কান্না। বাবা মা সবাইকে হারিয়ে কতটা অসহায় হয়ে গেছে ছেলেটা। ওর চোখ জুড়ে আজকে শুধুই কান্না, হাহাকার। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না মিশু। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।

তন্ময় বললো, ‘কি হলো মিশু?’

মিশু মাথটা ঝেড়ে বললো, ‘কিছু না।’
– ‘মাত্র কয়েকদিনেই তুমি অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছো।’
– ‘একটা রিকুয়েষ্ট করবো? পুরোটা রাস্তা দয়া করে চুপচাপ থাকতে পারবা?’

চুপ করে গেলো তন্ময়। ওর কিছু বলার মুখও নেই। কত দ্রুত হারিয়ে ফেললো মিশুকে! আর নিমেষেই অন্য কেউ আপন করেও নিলো মেয়েটাকে। খারাপ কই, মেয়েটা তো অনেক সুখেই আছে। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো তন্ময়।

এদিকে মেঘালয় মাকে ফলো করে অফিস থেকে বেরিয়েছে মাত্র। সংশয়কে দেখেই বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর। মায়ের গাড়িটা আগে আর মেঘালয় পিছনে। কিছুদূর আসার পর হঠাৎ মায়ের গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। লোকজন ছুটে গেলো সামনের দিকে। মেঘালয়ও গাড়ি থেকে নেমে ছুটে বাইরে এলো। একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here