হৃদমোহিনী
পর্ব ৪
মিশু মনি
ট্রেন তো ফেলে চলে গেলো। এবার কি হবে?
মিশু শানের উপর বসে একটু ঝুঁকে আছে পায়ের দিকে চেয়ে। হাঁটুতে বেশ জোরেই আঘাতটা পেয়েছে। ব্যথার চোটে চোখ আপনা আপনি বুজে আসতে চাইছে। খুব সম্ভবত জায়গাটা ছিলে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করতে চেষ্টা করলো মিশু। তাকালো মেঘালয়ের দিকে।
মেঘালয় খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। বাম পায়ে ব্যথা পেয়েছে নাকি ডান পায়ে সেটা ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছেনা। মনেপ্রাণে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটার,তবুও বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। হাঁটার গতিও দ্রুত হচ্ছেনা। সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে পায়ে ইনজুরি হয়েছে। তবুও মেঘালয় দ্রুত এগোচ্ছে মিশুর দিকে। মিশু উঠে দাঁড়াতে পারছে না, বসে ঝুঁকে আছে।
মেঘালয় কাছাকাছি আসার পর মিশু উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো। মেঘালয় হাত ধরে টেনে তুললো ওকে। মিশু উঠে দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে বললো, “কি হয়েছে আপনার পায়ে?”
-“ও কিছুনা। তুমি এরকম বোকার মত কাজটা করলে কিভাবে? এভাবে কেউ চলন্ত ট্রেন থেকে লাফায়?”
-“আপনাকে এ অবস্থায় দেখার পর কিভাবে ফেলে যাই?”
-“গাড়ির শিকল টেনে ধরলেই পারতে।”
-“শিকল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আপনি ব্যথা পেলেন কিভাবে বলুন তো?”
মেঘালয় ডান পা টা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, “আর বলোনা। দু তিনটা ছোট ছোট বাচ্চা আমার ফোন ছিনতাই করার চেষ্টা করছিলো আরকি। অনেক্ষণ থেকে ফলো করছিলো মেয়বি। আমি একটাকে ধাওয়া করতে যেতেই ইট ছুড়ে মেরেছে পায়ে।”
মিশু মেঘালয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “ইস! খুব লেগেছে তাইনা?”
-“সেরকম নয়। আমিতো ভাবলাম তোমার পা ভেঙে গেছে।”
-“আমার পা ঠিক আছে একদম। তবে একটু জোরে লেগেছে আরকি।”
মেঘালয় একটা বেঞ্চ দেখতে পেয়ে সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু মিশু চেষ্টা করেও টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলো। পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে এখন। মেঘালয় হাত ধরে ধরে ওকে নিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসালো। জিজ্ঞেস করলো, পায়ে কেটে গেছে এরকম ফিল করছে কিনা?
মিশু উত্তর দিলো, “তেমন কিছু হয়নি। এত চিন্তা করতে হবেনা আপনাকে। আপনার ফোন কি নিয়ে গেছে ওরা?”
-“না,ফোন নিতে পারেনি।”
-“হুম, আল্লাহর প্রশংসা সবই। আপনার পায়ে স্যাভলন লাগাতে হবে না?”
-“হা হা হা, নিজের পায়ে বেশি ইনজুরি হয়েছে আর সে কিনা আমার পায়ের কথা ভাবছে। যাক, আজকালকার মেয়েদের মতন স্বার্থপর হওনি সেটা দেখে ধন্য হলাম।”
মিশু ভ্রু কুঁচকে তাকালো, “আজকালকার মেয়েরা বুঝি স্বার্থপর হয়? মেয়েদেরকে কতটা জানেন আপনি?”
মেঘালয় হেসে বললো, “বাব্বাহ! বোধহয় আমার চেয়ে বেশি জেনে ফেলেছো? শোনো মেয়ে,তুমি নিজে মেয়ে হলে কি হবে। মেয়েদের সম্পর্কে অনেক কিছুই তোমার অজানা যেগুলো আমি জানি। আমার ফ্রেন্ড দুপুরের কথাই ধরো। আমি তোমার সেবা করছিলাম দেখে মেয়েটা কিরকম জেলাস হচ্ছিলো দেখছিলে না?”
-“মেয়েরা একটু হিংসুটে সেটা মানতে হবে। একটা মেয়ে কখনো আরেকটা মেয়ের রূপের প্রশংসা শুনতে পারেনা। সেখানে আপনার মত একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ আমার সেবা করছে সেটা দেখলে একটু তো জ্বলবেই।”
-“হা হা হা।”
মেঘালয় শব্দ করে হাসছে মেয়েটির কথা শুনে। যেন খুব মজার কথা বলেছে। মিশু মুগ্ধ হয়ে শুনছে সে হাসির শব্দ। আর মাঝেমাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে মেঘালয়ের মুখের পানে। সরাসরি তাকাতে বড্ড লজ্জা লাগে ওর।
মেঘালয় হাসি থামিয়ে বললো, “তোমার মিস্টার টুইস্ট আনতে পারিনি।”
-“লাগবে না আমার মিস্টার টুইস্ট। এখন যাওয়ার উপায় কি? এরপর আবার কখন ট্রেন আসবে?”
-“ট্রেন তো সারারাত আসবে, সারারাত যাবে। ট্রেনের সংখ্যা অগণিত। কিন্তু সব ট্রেনে তো উঠলে হবেনা। রংপুর এক্সপ্রেস কমলাপুর ছাড়ে সকাল ৮ টায়।”
-“তারমানে কালকে দুপুর পর্যন্ত আমরা এখানে বসে থাকবো?”
-“অবশ্যই না। আমাদের কে অন্য কোনো ট্রেনে উঠতে হবে।”
মিশু একটু মুখ টিপে কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, “অযথা কোন ট্রেনে উঠবো? সিট তো পাবোই না। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে যাবো কিভাবে? দুজনেরই পায়ের অবস্থা খারাপ।”
-“যে ট্রেনেই ওঠো সিট পাওয়ার সম্ভবনা ক্ষীণ। আমাদেরকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।”
-“কি ব্যবস্থা করবেন?”
মেঘালয় একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপাতত জোৎস্না স্নান করবো। মৃদু কুয়াশা, পূর্ণিমার চাঁদ, আকাশভরা নক্ষত্র। যমুনার বুকে ভেসে ভেসে জোৎস্না উপভোগ করতে কেমন হয় বলোতো? আলোয় ভিজে যাবো দুজনে। কখনো আলোয় ভিজেছিলে মিশু?”
মিশুর চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠলো। আলোয় ভেজা যায়! হ্যা যায় তো। জোৎস্না স্নান করা গেলে আলোয় ভেজা যাবেনা কেন? প্রখর রোদেও ভেজা যায়। সেটাকে বলা যায় রোদভেজা। বৃষ্টিভেজার মতন,রোদেভেজা।
মিশু বললো, “আমি প্রখর রোদে ভিজেছি। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি গায়ে মেখেছি অজস্রবার।”
-“বাহ! চাঁদের আলোয় ভিজেছিলে?”
মিশু একটু থমকে কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, “চাঁদের আলো গায়ে মেখেছি কিন্তু কখনো ভেজা হয়নি। আর আপনার কথানুযায়ী যমুনার বুকে ভেসে ভেসে চাঁদ দেখতে পারলে আমার জীবন টা ধন্য হয়ে যেতো।”
মেঘালয় রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো। একটা জিনিস খেয়াল করে দেখলো মিশু ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছে। ওর ডিপ্রেশন কাটানোর একটা ভালো উপায় হচ্ছে কোনো এডভেঞ্চারে ডুবানো। এখন একটা এডভেঞ্চারের ব্যবস্থা করলে বেশ হয়। কিন্তু এখানে সবর্ত্র গার্ড আছে, রাত্রিবেলা ইকো পার্কে ঢোকার কোনো নিয়ম আছে কিনা মেঘালয়ের জানা নেই। এক পা এগোলেই তো পুলিশ এসে ধরে ফেলবে। তার উপর এখন আবার মাঝরাত।
মেঘালয় চিন্তাভাবনা করে একটু দূরে গিয়ে বাবাকে ফোন করলো। একজন আংকেলের ট্রাকের ব্যবসা আছে। ওনার সাথে যোগাযোগ করলে উনি খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবেন এখন কোনো ট্রাক উত্তরাঞ্চলের দিকে যাচ্ছে কিনা। যদি সেরকম পাওয়া যায়,তাহলে ট্রাকে জার্নি করার একটা সুযোগ মিলবে। ট্রাকের উপর দাঁড়ালে সবকিছুই অন্যরকম লাগে। এলোমেলো বাতাস এসে সমস্ত যন্ত্রণা যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়। মিশুকে ট্রাকে জার্নি করাতে পারলে বেশ এডভেঞ্চার হয় একটা।
বাবাকে ফোন দিয়ে আংকেলের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে বললো। উনি কিছুক্ষণ বাদে জানাবেন বলেছেন। মেঘালয় এসে মিশুকে বললো, “যমুনার বুকে ভেসে জোৎস্না দেখতে চাইলে অন্যভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। আজকে অন্তত হবেনা।”
-“কেন হবেনা?”
-“এখানে কোথায় ঘাট আছে আমার জানা নেই। সন্ধ্যেবেলা হলে নাহয় একটা চেষ্টা করে দেখতাম। এত রাতে কোথাও যাওয়াটা খুব বেশি রিস্কি। তাছাড়া খেয়ার ব্যবস্থা আগেই করে রাখতে হয়।”
-“আপনি কখনো নদীর বুকে ভেসে চাঁদ দেখেছেন?”
-“হ্যা, চারবার।”
-“আল্লাহ! আমিতো বিশ্বাস ই করতে পারছি না। আপনি বুঝি এডভেঞ্চার খুব ভালোবাসেন?”
-“হুম প্রচুর। সেজন্য তো আজকেও একটা এডভেঞ্চার খুঁজছি। আপাতত চলো রেললাইন ধরে হাঁটা যাক।”
মিশু উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো। মেঘালয়কে এখন ওর আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। ছেলেটা এমন ভাবে জোৎস্না স্নানের কথা বললো যে, মিশুর মনটাও উতলা হয়ে গেছে নৌকায় ভেসে চাঁদ দেখার জন্য। কিন্তু সেটা এখানে কিছুতেই সম্ভব না। সম্ভব না জেনেও ছেলেটা কেন যে বলতে গেলো, এখন খুব ইচ্ছে করছে নদীতে ভেসে ভেসে চাঁদ দেখি।
মিশু কথাটা বলার পর মেঘালয় একটু ভেবে বললো, “তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে তিস্তা নদীতে ভেসে ভেসে জোৎস্না দেখতে পারি। সেটা তোমার বাড়ির কাছেই হবে, আর আগামীকাল রাতেই আমি ম্যানেজ করে ফেলতে পারবো। রংপুরে আমার একজন ভালো বন্ধু আছে।”
মিশু উৎফুল্ল হয়ে বললো, “সেটাই সবচেয়ে ভালো হবে। আচ্ছা কেমন লাগে নদীর বুকে শুয়ে চাঁদ দেখতে?”
মেঘালয় বললো, “একবার ভাসলে এই লোভ সামলাতে পারবা না। শিরশিরে বাতাসে গা হিম হয়ে আসে। নৌকা বাতাসে দোলা খায়, পানির কলকল শব্দ কানে আসে। মাঝেমাঝে স্রোত খুব বেড়ে যায়। নিজেকে মনেহয় শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। আর মাথার উপরে বিশাল আকাশ। আকাশে ঝুলে আছে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র, একটা লোভনীয় চাঁদ। ইচ্ছে করে চাঁদ টাকে ধরে গিলে খেয়ে ফেলি।”
মিশু উত্তেজনায় বাহু চেপে ধরলো মেঘালয়ের। গায়ের পুরোটা ভর মেঘালয়ের গায়ের উপর ছেড়ে দিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকালো রেললাইনের দিকে। সামনে দুদিকে গাছের সাড়ি, আর চাঁদের আলোয় যতদূর দেখা যাচ্ছে লম্বা রেললাইন। মেঘালয়ের কথা শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেছে ও। মনেহচ্ছে সে নিজেই এখন নদীর মাঝখানে নৌকায় ভেসে চলেছে। কি থ্রিলিং উফফ!
মেঘালয় বুঝতে পারছে মিশু ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছে। মিশুর ডিপ্রেশন কাটিয়ে দেবার ভালো উপায় পেয়ে গেছে তাহলে। সুযোগ টাকে কাজে লাগাতে হবে, মেয়েটার চঞ্চলতা ফিরিয়ে দিতে হবে ওকে। মাঝেমাঝে ওর চোখেমুখে যে খুশির রেখা ফুটে উঠে আবারো মিলিয়ে যায়,সেটাকে দীর্ঘস্থায়ী করার ইচ্ছে জাগছে। মেয়েটাকে দেখলেই বোঝা যায় কত উচ্ছল এক কিশোরী, দূরন্তপনা ছুঁয়ে আছে যার সবটা জুড়ে। একটা আঘাত কখনো এই উচ্ছলতাকে দমিয়ে দিতে পারেনা।
মেঘালয় নিজেও ভালোমতো হাঁটতে পারছে না। তবুও মিশুকে ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রেললাইনের দিকে। জিজ্ঞেস করলো, “তোমার সাথে ঠিক কি কি ঘটেছে বলবে আমায়?”
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “এখন বলতে ইচ্ছে করছে না।”
-“বেশ। শীত করছে তোমার?”
-“নাহ। খুব আনন্দ হচ্ছে।”
দুজনে রেললাইনে নেমে লাইন ধরে সোজা হাঁটতে লাগলো। মেঘালয় খুব সতর্ক হয়ে আছে কারণ যেকোনো মুহুর্তে ট্রেন চলে আসতে পারে। বেশ কিছুদূর দুজনে নিঃশব্দে হাঁটলো। ফাঁকা রেললাইন ধরে হাঁটছে দুজনে, মাথার উপরে শুক্লপক্ষের চাঁদ। চাঁদের মায়াময় আলো ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। আলোয় ভিজে যাওয়া বোধহয় একেই বলে। মিশু বললো, “আচ্ছা আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
-“আপাতত পুলিশের হাতে ধরা খেতে যাচ্ছি।”
-“মানে! পুলিশ কেন ধরবে আমাদের?”
-“সবখানে গার্ড থাকার কথা এই এলাকাটায়। কিন্তু এখনো পুলিশ কেন ধরছে না সেটাই ভাবছি।”
-“পুলিশ ধরে কি করবে আমাদের?”
মেঘালয় হেসে বললো, “পুলিশ ধরে আবার কি করে জানোনা? আমাকে জামাই আদর আর তোমাকে বউ আদর করবে। আদর করে নিয়ে গিয়ে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেবে।”
মিশু শিউরে উঠে বললো, “সেকি! আমাদের কোনো দোষ নেই। তবুও কেন ধরে নিয়ে যাবে?”
-“এইযে এভাবে পাগলের মত মাঝরাতে রেললাইনে হাঁটছি। এ ধরণের পাগলদেরকে ধরতে পুলিশের কোনো অভিযোগ লাগেনা। বাংলাদেশের এটা অনেক বড় সুবিধা, পুলিশের হাতে ধরা খেতে চাইলে রাত্রিবেলা রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ো।”
মিশু মেঘালয়ের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছে না। ও বললো, “এরকম রহস্য করছেন কেন? আপনি কি রহস্য করতে ভালোবাসেন?”
-“হা হা হা। রহস্য কখন করলাম?”
-“আপনার চাহনি টাই রহস্যজনক। এইযে এভাবে বলছেন, পুলিশ আমাদের ধরবে সেজন্য আপনি রেললাইনে হাঁটছেন। এগুলা কেমন কথাবার্তা?”
-“এগুলো পাগলামি। পাগলরা এসবই বলে।”
-“আপনি নিশ্চয়ই পাগল নন?”
মেঘালয় হেসে বললো, “আমরা জগতের সব মানুষ ই পাগল। কেউ একটু বেশি পাগল,কেউ একটু কম পাগল। কিন্তু প্রত্যেকেই সুস্থ থাকার ভান করি সবসময়।”
-“হ্যা। তারমানে আমরা সবাই পাগল?”
-“সবাই কেন পাগল হবো? জীবনের যেকোনো একটা মুহুর্তে এসে প্রত্যেকেই পাগলের মত কথা বলি কিংবা আচরণ করি। তাই বলে তো সবাই পাগল হয়ে যাই না।”
মিশুর মাথা ঘুরতে শুরু করেছে মেঘালয়ের কথা শুনে। ও বললো, “একবার বলছেন সবাই পাগল,একবার বলছেন পাগল কেন হবে? আপনার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছে। এরকম কেন করছেন?”
মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো, “মজা করছিলাম। মাঝেমাঝে একটু রহস্য করতে ভালোলাগে।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “সত্যিই আপনি খুব অদ্ভুত। দারুণ রহস্য করতে জানেন। কথার প্যাঁচ এমন ভাবে লাগিয়ে দেন যে,মাথা এলোমেলো হয়ে যায় একেবারে।”
মেঘালয় আবারও হেসে উঠলো। আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে দুজনে প্লাটফর্মে ফিরে এলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত দুটো বেজে গেছে। ভোর হতে এখনো অনেক রাত বাকি। আংকেল ফোন দিয়ে একজন ড্রাইভারের নাম্বার দিলেন। ওনার সাথে আলাপ করে ট্রাকের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ট্রাকটা ঢাকা থেকে দিনাজপুর যাচ্ছে। সেতুতে পৌছাতে আরো চল্লিশ মিনিটের মত সময় লাগবে। এটুকু সময় এখানেই বসে থাকতে হবে। বাবা ও চাচার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো মেঘালয়।
মিশু বারবার তাকাচ্ছে মেঘালয়ের মুখের দিকে। চিন্তা করার সময় মেঘালয়ের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। সেটার দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে রইলো খানিক্ষণ। মেঘালয় কি ভাবছে সেটা অনুধাবন করার চেষ্টা করলো।
একটা ট্রেন এসে দাঁড়ালো স্টেশনে। মিশু জিজ্ঞেস করলো এই ট্রেনে উঠবে কিনা। মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “না।”
মিশু আর কিছু বললো না। এখন শরীরটা বেশ ফুরফুরে লাগছে কিন্তু পায়ের চোটটা চিনচিন করছে ব্যথায়। মুখটা গোল করে চেয়ে রইলো লাইনের দিকে। এখানে প্রায় সবসময় ই গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এরই মধ্যে দুটো গাড়ি চলে গেলো। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “এই মেয়ে তোমার ভয় করছে না?”
-“কেন? কিসের ভয়?”
-“আমাকে, একজন পুরুষ মানুষকে এত রাতে কিসের ভয় পাওয়া যেতে পারে?”
-“যে মানুষটা ওরকম ভাবে কারো সেবা করতে পারে তার উপর ভরসা করাই যায়।”
-“আমিতো তখন থেকেই মজা করছি একটু ভয় পাইয়ে দেবার জন্য। তবুও ভয় পাচ্ছোনা?”
-“একটু তো ভয় পেয়েছিলাম ই। মনেহচ্ছিলো আপনি একজন খারাপ লোক। কিন্তু খারাপ লোক হলেও এখন আপনি ই আমার ভরসা। আপনার সাথেই আমাকে যেতে হবে।”
-“খারাপ লোকটার সাথেই যেতে হবে?”
মিশু বললো, “হুম হবে। আর আপনি খারাপ হলেও সাত খুন মাফ। হুমায়ূন আহমেদ স্যার যেমন বলতেন,রূপবতী মেয়ের সব দোষ আমি ক্ষমা করে দিতে পারি। তেমনি আমার ও আপনাকে দেখে সেরকম বলতে ইচ্ছে করছে।”
মেঘালয় হেসে ফেললো আবারো। চোখ কপালে তুলে বললো, “আমি কি ভয়ংকর রকমের রূপবান?”
মিশু বললো, “একদমই। বিপজ্জনক রকমের হ্যান্ডসাম। ছেলেদের কখনোই এত সুন্দর হতে নেই। খারাপ লোক হলেও এই গুনগুলোর জন্য আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিতে পারি। কিন্তু আপনার পারসোনালিটি একদম ইউনিক,আপনাকে আমি খারাপ বললে পাপ হবে আমার।”
-“হা হা হা। আমার পারসোনালিটি ইউনিক? হ্যা, সেটার সম্ভাবনা আছে। দেখো, আবার প্রেমে পড়ে যেওনা।”
-“একবার প্রেমে পড়েই তার ঘানি টানার শক্তি পাচ্ছিনা। আবারো ওই ভূল? মানুষ জীবনে কতবার ভূল করে?”
-“অনেক বার,অনেকবার ভূল করে।”
মিশু ক্ষেপে গেলো। মেঘালয় হেসে উঠলো শব্দ করে। সত্যিই এই লোকটাকে এখন খুব খারাপ লোক মনেহচ্ছে মিশুর। সেইসাথে দারুণ রহস্যজনক ও। এত রহস্য করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে লোকটা যেন ডিটেকটিভ উপন্যাসের নায়ক। অদ্ভুত!”
মেঘালয় ফোনে কার সাথে যেন কথা বললো। একজনের কাছে ফোন নাম্বার নিয়ে আবারো আরেকজনকে কল করলো। ট্রাক, নাম্বার, রোড ইত্যাদি ইত্যাদি কিসব বললো কিছুই বুঝতে পারলো না মিশু। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এসব কি আলাপ করছেন আমাকে বলা যাবে?”
-“ব্যবসা করছি ব্যবসা। ইয়াবা হিরোইনের ব্যবসা,আমার মাল কদ্দুর সেই কথা শুনলাম।”
মিশুর মুখটা শুকিয়ে গেলো ভয়েই। যদিও কথাটা মিথ্যে সেটা ওনার হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অন্তত এই লোকটা কখনো ওসব ব্যবসা করতেই পারেনা, সেটা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু এরকম মজা করার কারণ? ভয় হয় তো।
মেঘালয় ওর ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো শব্দ করে। হাসতে হাসতে বললো, “সিরিয়াসলি তুমি ভয় পেয়েছো? আমি তাহলে সার্থক।”
-“আপনি এত মজা কেন করছেন?”
-“হা হা, তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য।”
-“আপনি কি জানেন আপনি লোকটা খুব খারাপ?”
-“হ্যা জানি।”
-“আপনি কি জানেন আপনি লোকটা খুব সুইট?”
-“কিহ!”
মুচকি হাসলো মিশু। আবারো কপালে ভাঁজ পড়লো মেঘালয়ের। মনেমনে ভাবলো মেয়েটাকে আর ভয় দেখানো উচিৎ হবেনা। অনেক মজা করা হলো। এবার থামানো দরকার।
মেঘালয় মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “রাগ করছো কেন? আরে পাগলী মেয়ে,আমি এতক্ষণ মজা করছিলাম তোমার সাথে। ভয় দেখানোর জন্য এমন করছিলাম। ভয় পেওনা, আমাকে বিশ্বাস করতে পারো তুমি।”
মিশু মেঘালয়ের কাছাকাছি সরে বসলো। বললো, ” ভয় দেখানোর জন্য এমন করলে ভয় পাওয়াটা উচিৎ না?”
-“হুম উচিৎ। ভয় তো পেয়েছো, এবার আবার স্বাভাবিক হও। এত ভয় পেতে হবেনা,এটুকু বিশ্বাস রাখো যে যতক্ষণ আমার সাথে ততক্ষণ তুমি নিরাপদ।”
-“আমি জানি সেটা। আপনি আর আপনার বন্ধুরা একদম আলাদা। যেখানে পিরিয়ডের ব্যাপার গুলো নিয়ে ছেলেরা হাসাহাসি করে,সেখানে আপনারা… আমি আপনাদের মত মানুষ কখনো দেখিনি।”
মেঘালয় আড়চোখে তাকালো মিশুর চোখের দিকে। ওর ফোন বেজে উঠলো। ফোনে কথা বলার পর মিশুকে বললো, “একটু আগে জানতে চাইছিলে না কিসের ট্রাক? কিসের আলাপ করলাম?”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে হুম বললো। মেঘালয় ট্রাকের ব্যাপার টা খুলে বললো মিশুকে। মিশু অবাক হয়ে বললো, “সত্যিই এখন আমরা ট্রাকে জার্নি করবো!”
-“হুম। অনেক থ্রিলিং না?”
-“হ্যা তা তো বটেই। আমি ভাবছি আপনার বাবাকে বলতেই উনি ব্যবস্থা করে দিলেন?”
-“আমার বাবা এমন ই, আর চাচার এই লাইনে বিজনেস আছে আর পরিচিতি বেশি সেজন্যই সম্ভব হয়েছে।”
মিশুর বিস্ময়ের সীমা রইলো না। আজকের রাতটাকে ওর স্বপ্নের মত লাগছে। একটা দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা, তারপর মেঘালয় ও ওর বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়া, ট্রেন থেকে লাফানো, রেললাইনে হাঁটা, ট্রাক জার্নি সবই কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। স্বপ্নেই সাধারণত এমন হয়। অবিশ্বাস্য লাগছে সবকিছু। কিন্তু নিজের পায়ের ব্যথার জন্য স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হওয়াটা ভূল ভাবতে হচ্ছে। স্বপ্নে কখনো ব্যথা অনুভূত হয়না।
মিশু বললো, “আমার মনেহচ্ছে আমি আজকের রাতে কোনো বিদেশি উপন্যাসের নায়িকা হয়ে গেছি আর আপনি হচ্ছেন নায়ক।”
হেসে উঠলো মেঘালয়। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালো। এখন মেইন রোডের দিকে যেতে হবে। মিশু থ মেরে বসেই চেয়ে রইলো মেঘালয়ের হাসি হাসি মুখটার দিকে। বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জন্মাচ্ছে মেঘালয়ের। বাবাকে যত রাতেই স্মরণ করা হোকনা কেন,যেকোনো ইচ্ছে পূরণ করতে উনি তৎপর। অনেকদিন ট্রাকে জার্নি করা হয়না।
মেঘালয় মিশুর হাত ধরে ওকে তুললো। মিশু ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছে। ট্রাকের উপরে উঠে যেতে হবে, ঠাণ্ডা বাতাসে চুল উড়বে ভাবলেই গা শিউরে উঠে। একদিকে মেঘালয়কে খুব বিশ্বাস করছে,আবার ভয়ও পাচ্ছে। ছেলেটাকে খুব ভালোও লাগছে,আবার রহস্যজনক ও লাগছে। একইসাথে কয়েক ধরণের অনুভূতি কাজ করছে ওর। সবমিলিয়ে অনুভূতিটা অন্যরকম।
মিশু মেঘালয়ের বাহু চেপে ধরে বললো, “জানেন আমি কখনো ট্রাকে উঠিনি।”
চলবে..