হৃদমোহিনী
পর্ব ৩৭
মিশু মনি
.
৫২
হঠাৎ মায়ের গলা শুনতে পেলো মিশু। মা এসে যে কথাটা বলে গেলো সেটা শোনার জন্য ওরা কেউই প্রস্তুত ছিলোনা। তন্ময় সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলো। এখন ওর শারীরিক অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই বারবার মিশুকে দেখতে চাইছে। তন্ময়ের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। আপনজন বলতেও কেউ নেই ওর। এমতাবস্থায় মিশুকে দেখতে চাইলে মিশু না গেলে ব্যাপারটা বাজে হয়ে যায়। একটা জীবনের মূল্য তো আছে।
মিশু ও মেঘালয় একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। চোখেচোখে কি বলে নিলো বোঝা গেলো না। উদভ্রান্ত দৃষ্টি, দৃষ্টিতে কোনো ভাষা নেই। মেঘালয় বলতে চাইছে যেওনা, আবার যাওয়াও উচিৎ। এদিকে মিশুও বলতে চাইছে, আমি যেতে চাইনা কিন্তু একবার যাওয়াটা দরকার। দুজনে দুজনের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মেঘালয় বললো, ‘চলো আমরা দুজনই যাই, দেখে আসি ওকে।’
শেষ পর্যন্ত মেঘালয়ের সিদ্ধান্তকেই মেনে নিলো মিশু। দ্রুত রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়তে হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। মনটা কেমন কেমন করলেও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো মিশু। ভালোবাসার দিক থেকে নয় বরং মানবিক দিক থেকেই খারাপ লাগা কাজ করছে তন্ময়ের জন্য। তন্ময় না থাকলে একটা সময় ঠিকই ভূলে যাবে। কিন্তু আজ তন্ময়ের কিছু হয়ে গেলে সবসময় ব্যাপারটা মানসিক যন্ত্রণা দেবে। এরকম একটা মানুষ কিভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে জানা নেই কারো।
মেঘালয় সেদিন রাতে আসার সময় গাড়ি নিয়ে এসেছিলো। ড্রাইভার এখনো থেকেই গেছেন। গাড়ি নিয়েই আজকে বেড়িতে পড়তে হলো। এত ঝামেলা আর ধকল কবে যে শেষ হবে কে জানে। একটার পর একটা ঝামেলা পিছু লেগেই থাকে। সব ঝামেলার পিছনে যদি ভালো কিছু থেকে থাকে তাহলে এরপর নিশ্চয়ই অনেক ভালো কিছুই অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। মেঘালয়ের জীবনেও এরকম ঝামেলা প্রথম ঘটছে।
মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে রইলো মিশু। বুকের ঢিপঢিপ শব্দটাকে শোনার চেষ্টা করলো।
মেঘালয় বললো, ‘তুমি তো দিনদিন মারাত্মক সুন্দর হয়ে উঠছো। তন্ময়ের মাথাটাই খারাপ হয়ে যায় কিনা দেখো।’
– ‘কি যে বলো। অবশ্য এটাই হয়ত ঠিক। তোমরা পুরুষরা সৌন্দর্যের পূজারি।’
– ‘হ্যা কিন্তু শুধু শারীরিক সৌন্দর্য নয়, সবদিক থেকেই যে সুন্দর আমি তাকে রেসপেক্ট করি। ব্যক্তিত্ব সুন্দর হলেই একটা মানুষ সুন্দর।’
– ‘আমার ব্যক্তিত্ব তো অতটাও সুন্দর নয়, আমিতো নিতান্তই পাগলী একটা মেয়ে। যদি নিজেকে বদলাতে না পারি, তুমি কি আমাকে ছেড়ে যাবা?’
মেঘালয় মিশুর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘ছেড়ে গেলে শুরুতেই যেতে পারতাম। যেহেতু ডিভোর্সের সুযোগ তুমি দিয়েছিলে।’
– ‘আচ্ছা, যদি আমরা ভূলেও কখনো আলাদা হয়ে যাই। একে অপরকে ডিভোর্স দিয়ে দিই, এরপর যদি নিজের ভূল বুঝতে পেরে আবার এক হতে চাই? তখন কি আবার বিয়ে করতে হবে?’
– ‘এসব বাজে কথা কেন বলছো?’
– ‘আহা বলোনা। এরকম হতে পারেনা? তাহসান মিথিলার ডিভোর্স হয়নি? ওরা বেস্ট একটা কাপল ছিলো।’
– ‘আমাদের কখনো হবেনা। অন্তত আমি সেটা হতে দিবোনা।’
– ‘একটা সময় আমার উপর তোমার বিরক্তি আসবে দেখো। ঠিকই চলে যাবে আমাকে একা রেখে।’
– ‘একদম চুপ। মাইর শুরু করবো নয়তো।’
মিশু চুপ করে গেলো। মেঘালয়ের গলা জাপটে ধরে বসে রইলো শান্ত হয়ে। আস্তে আস্তে হাতটা শিথিল করে দিলো। গলা ছেড়ে দিয়ে চুপটি মেরে রইলো। অনেক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না। দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লো আস্তে আস্তে।
৫৩
তন্ময়কে দেখে ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো মিশুর। ডাক্তার বলেছেন, এরকমভাবে সুইসাইডের চেষ্টা করলে বেশিরভাগ সময় রোগী কোমায় চলে যায়। কেউ আবার একেবারে প্যারালাইজড রোগী হয়ে যায়। তন্ময় এখনও অনেকটা স্বাভাবিক আছে সেটা সৌভাগ্য। মিশুকে দেখে ও আরেকটু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
মেঘালয় পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। মিশু তন্ময়ের বেডের কাছে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তন্ময়ের দিকে। আর তন্ময় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মিশুর দিকে। চোখের পলকও পড়ছে না। মিশুর প্রতি ভালোবাসা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে ওর। মিশুকে ছাড়া থাকার কথাও কল্পনা করতে পারেনা। সেজন্যই আজ মৃত্যুর রাস্তাটা বেছে নিয়েছে সে। গত কয়েকদিন যাবত ডিপ্রেশন আর প্রিয় মানুষ গুলোকে হারানোর শোকে মাথা কাজ করছে না। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে আত্মহত্যার পথটাকেই সহজ মনে হয়।
মিশুর চোখে পানি। তন্ময় ইশারায় বললো হাতটা একবার ধরতে। কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। মিশু হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের হাত স্পর্শ করলো। সুখের আবেশে চোখ বুজে ফেললো তন্ময়। প্রিয় মানুষটা সামান্য হাত ধরলেই এত শান্তি লাগে! আগে কেন বুঝতে পারেনি নিজের ভূলটা? চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগলো মিশুকে। মিশুর ছোট্ট পরীর মত মুখটা বুকের ভেতর গাঁথা হয়ে গেছে। এই মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেয়ার যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো ও। মিশু মানেই একটা ভালোবাসার নাম। মনে পড়ছে সেই রাতগুলোর কথা।
প্রতি রাতে কাজ শেষ করে তন্ময় যখন ফোন দিতো, রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় মিশু বলতো, ‘এরকম করলে তোমার সংসারে থাকবো না। সব কাজ শেষ করার পর বুঝি মনে পড়ে?’
– ‘ঠিকাছে রেখে দিচ্ছি তাহলে। তুমি ঘুমাও।’
মিশু তখন লাফিয়ে উঠে বলতো, ‘এই না না না। আমিতো মজা করছিলাম। তোমার জন্য একটা জীবন অপেক্ষা করতেও আমার কষ্ট নেই। কোনো অভিমান নেই।’
তন্ময় তখন ফিসফিস করে বলতো, ‘ভালোবাসি পাগলী টা।’
এই মেয়েটাকে চরম অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছে। তারপর বিপদেও ফেলে দিয়েছে। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না কিছুতেই।
কথাগুলো মনে করে আবারো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে তন্ময়ের। বুকটা জ্বালাপোড়া করছে। বারবার হাঁসফাস করতে লাগলো। মিশু ওর হাতটা শক্ত করে ধরতে ধরতে অস্থির হয়ে উঠতে লাগলো। চোখের সামনে কোনো মানুষ এভাবে শ্বাসকষ্টে হাসফাস করলে খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। দেখলেই বুকটা কেমন করে ওঠে। যেন এই বুঝি গলাকাটা পশুর মত ছটফট করতে করতে মানুষটা মরে যাবে।
চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো মিশুর। নিজের অজান্তেই তন্ময়ের এই অবস্থা দেখে কাঁদতে লাগলো। মেঘালয় পিছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তন্ময়কে দেখে খারাপ লাগছে ঠিকই কিন্তু মিশুকে তন্ময়ের জন্য কাঁদতে দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। ভালোবাসা এমন কেন? চরম বিপদের মুহুর্ত গুলোতেও ভালোবাসা এক সেকেন্ডের জন্যও প্রিয় মানুষটাকে অন্য কারো হতে দেয়না। ভালোবাসারা কি এমনি? শুধুমাত্র হাত ধরেছে দেখেই মেঘালয়ের কলিজা ছিঁড়ে যেতে চাইছে? এ দহন দেখা যায়না, গন্ধ পাওয়া যায়না, শুধু ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
মিশু তন্ময়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘কষ্ট হচ্ছে খুব?’
তন্ময়ের শ্বাসকষ্ট আরো বেড়ে গেলো। গলায় ফাঁস দেয়ার দাগটা খুব তীব্রভাবে দেখা যাচ্ছে। মেডিসিন লাগানো হয়েছে। দেখলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তন্ময় মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখেচোখে বোঝাতে চাইলো, ‘আমাকে মাফ করে দিও।’
ডাক্তারকে ডাকার জন্য চেম্বারের দিকে যেতে যেতে মেঘালয় মনে মনে একটা কথাই ভাবছিলো, মিশু পাগলের মত কাঁদছে। ওর কান্না দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা এখনো তন্ময়কে ভালোবাসে। তন্ময়ের চোখেও এখন মিশুর জন্য খাঁটি ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। তন্ময় তো নিজের ভূল বুঝতে পেরেছে তাহলে কি মিশুকে ওর কাছেই রেখে যাওয়া উচিৎ? কিন্তু মিশুকে ছাড়া মেঘালয়ই বা বাঁচবে কি নিয়ে? ওদের অবস্থা দেখে ইচ্ছে করছে মিশুকে ছেড়ে দিই। ওরা সুখী হোক। কারণ যদি সত্যিই মিশু তন্ময়কেই ভালোবেসে থাকে, তাহলে মেঘালয়ের সাথে কখনো সুখী হতে পারবে না। কিন্তু মেঘালয় নিজেই তো এখন মিশুকে ছাড়ার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। কষ্ট হচ্ছে, প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে।
চলবে..