হৃদমোহিনী
পর্ব ২৮
মিশু মনি
.
৩৬.
মৌনি অনেকটা ডিটেকটিভ মাইন্ডের মেয়ে। সবসময় রহস্য খুঁজতে আর উদঘাটন করতে ভালোবাসে। প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়েটি কখনো অন্যায়ের কাছে হার মানেনা। স্পষ্ট কথা অনায়াসে বলে ফেলে আর সবসময় আত্মবিশ্বাসী। বাবাকে হসপিটালে অসুস্থ অবস্থায় রেখেই বেড়িয়ে পড়েছে সমস্যার সমাধান করতে। মাকে রেখে গেছে বাবার পাশে। মা নিজেও একজন ভালো ডক্টর। মা থাকতে বাবার পাশে আর কাউকে প্রয়োজন নেই।

যে আত্মীয়ের কাছ থেকে বাবার কাছে প্রথম কল এসেছে প্রথমেই তার কাছে যাবে ও। মেঘালয়ের মানসিক অবস্থা এখন খুবই খারাপ। সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সামান্য উপকারে আসতে পারলেও মৌনির নিজেকে বোন হিসেবে সার্থক মনে হবে। মেঘালয় মৌনির কলিজার অর্ধেক। মেঘের জন্য সবচেয়ে বেশি কেউ ভেবে থাকলে সেটা মৌনি নিজেই।

মৌনির এক পরিচিত মেয়ে এয়ারলাইন্সের টিকেট বিক্রির জব করে। ও সবার আগে মেয়েটিকে ফোন দিয়ে বলে দিলো যেভাবেই হোক কক্সবাজার থেকে ঢাকার দুটো টিকেট ম্যানেজ করতে পারবে কিনা? মেয়েটি বলেছে খোঁজ নিয়ে জানাবে।

এরপর গেলো সেই আত্মীয়ের বাসায়। লোকটি মেঘালয়ের চাচাতো ভাই। বয়সে মেঘালয়ের চেয়ে বছর চারেক বড় হবে। মৌনি সোজা বাসায় গিয়ে ওকে ডেকে নিয়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। বাড়ির লোকজন সবাই থ!

মৌনি সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, ‘রাফিন ভাইয়া তুমি কি দেখেছো ফেসবুকে ক্লিয়ার করে বলোতো?’

রাফিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মৌনির দিকে। মৌনির চেহারায় যে দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে তা দেখেই ভেতর থেকে একটা ভালোলাগা কাজ করছে। ইচ্ছে করছে অকপটে কথা বলি মেয়েটার সাথে।

রাফিনকে চুপ থাকতে দেখে মৌনি বললো, ‘ভাইয়া এখানে কয়েকটা জীবনের জীবন মরণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। একটা ফ্যামিলির সম্মান জড়িয়ে আছে।’
– ‘মানে!’
– ‘বাবার হার্ট এটাক হয়েছে।’

হা হয়ে গেলো রাফিন। আকাশ আহমেদকে সবাই যে পরিমাণ ভালোবাসে আর সম্মানের চোখে দেখে, তাতে এরকম খবর শুনলে সত্যিই খারাপ লাগে। রাফিন বললো, ‘আমি তোকে পোস্টটা দেখাচ্ছি।’
– ‘একটা পোস্টও যে কারো হার্ট এটাকের কারণ হতে পারে জানতাম না। আমাদের আত্মীয়রা নিশ্চয়ই খুব মেতেছে এটা নিয়ে?’

রাফিনের সাথে কথা বলে বোঝা গেলো এখনো সেরকম ভাবে ছড়ায়নি কথাটা। তবে অনেকবার শেয়ার হয়েছে পোস্টটা। মেঘালয়ের স্টুডেন্টস রা কেউই হয়ত জানেনা এটার ব্যাপারে। জানলে হাজারবার শেয়ার হতো পোস্টটা। মৌনি সব শুনে বললো, ‘দেখি আমাকে দেখাও।’

রাফিন তৎক্ষণাৎ ফেসবুকে ঢুকে সেই পোস্টটা বের করে দেখালো মৌনিকে। পোস্টে মেঘালয় ও মিশুর যে ছবি দেয়া, সেটা দেখে মোটেও মেঘালয়কে ধর্ষক কিংবা অপরাধী মনে হচ্ছেনা। বরং দুজনকে সুখী নব দম্পতি মনেহচ্ছে। মৌনি ভালো করে খেয়াল করে দেখলো ছবিটা বিয়ের পর তোলা। কারণ বিয়ের আগে মেঘালয়ের গায়ে মাত্র একটা শার্ট ছিলো আর এখন যে শার্টে আছে সেটা নতুন কেনা। তারমানে ছবিটা কেউ মিশুদের বাড়িতে থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করেছে! অন্যরকম রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে মৌনি।

মিশুদের বাড়িতে থাকা অবস্থায় এই ছবি আর এই নিউজ আপলোড দিয়ে সে কি বুঝাতে চায়? ওদের তো বিয়েই হয়ে গেছে, তাহলে? রহস্যজনক ব্যাপার। কোনো একটা ব্যাপার এখানে নিশ্চয়ই আছে। মৌনি পোস্টের তারিখ ও সময় দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো যে এটা কারো ইচ্ছেকৃত ভাবে করা ষড়যন্ত্র। কারণ পোস্টটা যেদিন আপলোড করা হয়েছে সেদিন মিশু আর মেঘালয় কক্সবাজারের পথে। তারমানে!

মৌনি পোস্টদাতা ব্যক্তির ওয়াল ও এবাউট পড়ে পুরোপুরিভাবে বুঝে গেলো ব্যাপারটা। শার্লক হোমসের মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস মৌনির। পোস্টকারীর বাসা রংপুরে। এই ব্যক্তি কে হতে পারে আগে সেটা জানা দরকার।

মৌনি পূর্বকে কল দিয়ে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললো। তারপর পোস্ট টার স্ক্রিনশট সহ পোস্টদাতার ছবি পাঠিয়ে দিলো পূর্ব’র কাছে। পূর্বকে দ্রুত বলে দিলো মিশুদের বাসায় যেতে।

পূর্ব ও সায়ান দ্রুত গতিতে বাইক চালিয়ে মিশুদের বাসায় গিয়ে হাজির। মিশুর বাবাকে ছেলেটার ছবি দেখানোর পর আংকেল জানালেন এটা তার আপন ছোট ভাইয়ের ছেলে অর্থাৎ মিশুর চাচাতো ভাই। ছেলেটা বহু আগে থেকেই মিশুর কোনোরকম সাফল্য সহ্য করতে পারতো না। তাছাড়া পারিবারিক একটা দ্বন্দ্ব তো আছেই। এই দ্বন্দ্ব থেকেই শত্রুতা করে সে ইচ্ছেকৃত ভাবে কাজটি করেছে।

সমস্যা উদঘাটন করা হলো, এবার সমাধান দরকার।

সায়ান ফোনে মৌনিকে বললো, ‘আইডি ডিজেবল করে দিই?’

মৌনি বাঁধা দিয়ে বললো, ‘তাতে সমস্যা আরো বাড়বে। অলরেডি পোস্টটা একাশি বার শেয়ার করা হয়েছে। যদি তিনশ জন মানুষ ও দেখে থাকে, তাদের থেকে এক হাজার জনে ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কাজেই আমাদেরকে কঠিন ভাবে একটা সমাধানে আসতে হবে।’

সায়ান কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি করতে চাইছো তুমি?’

মৌনি বললো, ‘আমি যা করার করেছি। এখন বাকি কাজ করবে তোমরা। শুধুমাত্র আমার প্লান অনুযায়ী করতে হবে। যদি প্লান সাকসেসফুল হয় তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে।’

এরপর মৌনি পুরো প্লানটা খুলে বললো সায়ান ও পূর্বকে। কথাগুলো শোনার পর হেসে উঠলো সায়ান। মৌনির বুদ্ধির সাথে পারে কে? এত ট্যালেন্ট মেয়ে খুব কমই আছে জগতে। ওরা দ্রুত নেমে পড়লো কাজে।

৩৭.
মেঘালয় মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছে এবার কি হবে? বাবার জন্য বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে ওর। কোথ থেকে কি হয়ে গেলো! এতকিছু ঝামেলা কিভাবে মিটবে কেউ বলতে পারেনা। বাবা সুস্থ হবে কিনা, সবার কাছে সত্য ঘটনাটা কিভাবে বেরিয়ে আসবে সবকিছুই ভাবাচ্ছে মেঘালয়কে। অপরাধ না করেও আজ সবার চোখে খারাপ হতে হলো তাকে। অসহ্য একটা ব্যাপার।
মেঘালয় মাথা তুলে দেখলো মিশু রুমে নেই।

বেলকুনিতে গেছে হয়ত এটা ভেবে চুপচাপ বসে রইলো সে। এমন সময় মৌনির নাম্বার থেকে কল। মেঘালয় রিসিভ করতেই মৌনি বললো, ‘ভাইয়া, আব্বুর শরীর সুস্থ হয়ে যাবে দেখিস। টেনশন করিস না।’
– ‘কি হবে এবার?’
– ‘সব ঠিক হয়ে যাবে ভাইয়া। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। টিকেটের ব্যবস্থা হয়ে গেছে, দ্রুত এয়ারপোর্টে গিয়ে কনফার্ম করে আয়।’
– ‘মানে! এত দ্রুত কিভাবে পারলি?’
– ‘ভাইয়া, মৌনিকে কি মনেহয় তোর? ফ্লাইট কখন জেনে আয়। আর টেনশন না করে তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আয়। আমি দেখছি কি করা যায়। এমন প্লান করেছি, এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মরবে এবার।’
– ‘বুঝলাম না। কিসের পাখি?’
– ‘অনেক গুলো পাখি। এক প্লানে কতগুলো কাজ কার্যকর করি দেখার জন্য অপেক্ষা কর। শুধু আমাকে এখন বুদ্ধি খাটিয়ে কাজটা করতে হবে।’
– ‘কি করতে চাইছিস বলতো?’
– ‘সেটা না হয় রহস্যই থাক। ধামাকা দেখার জন্য অপেক্ষা কর। আর দোয়া করিস যেন সাকসেস হই।’
– ‘আচ্ছা। আমি মিশুকে ডেকে আনি, ফোন রাখ। আর আব্বুর শরীর কেমন হয় আমাকে আপডেট জানাস।’

মেঘালয় ফোন রেখে বেলকুনিতে এসে খুঁজলো কিন্তু মিশুকে পেলোনা। করিডোরেও মিশুকে দেখতে না পেয়ে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো ওর। দরজা খোলা দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো। দরজা খোলা, তারমানে মিশু? ভাবতে পারছে না মেঘালয়। মেয়েটা গেলো কোথায়? একসাথে এতগুলো টেনশন দিলে কেমন লাগে?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here