গল্প# হীরের নাকফুল ও লাল বেনারসি

“আমাদের ফ্যামিলির মেয়েরা কিন্ত নাকফুল পরে না।”

“তাই! “

গলা থেকে শব্দটা বেশ জোরে ছিটকে বেরিয়ে এল স্বর্ণার।

“ তোমাদের ফ্যামিলির মেয়েরা নাকফুল পরে না!”

বিস্মিত গলায় বলে উঠল।

“ না, তুমি তো মাত্র দুইদিন আমাদের দেখেছো, যেদিন তোমাদের বাসায় আমরা তোমাকে দেখতে গেলাম সেদিন আর আকদ-এর দিন ।তাই খেয়াল করোনি।আমাদের কোনো বোনের নাক ফুটোই করা হয়নি।আব্বা একদম পছন্দ করেন না। তাই মাও পরে না।সবচে অপছন্দ করে শাহেদ ভাইয়া, মানে তোমার বর।”

ল্যান্ডফোনে ননদের সাথে কথা বলছিল স্বর্ণা।

ফোন নামিয়ে রেখে ,মুখে শ্রাবণের মেঘ নিয়ে ঝুম হয়ে বসে থাকে।

ছোটো বোন শবনম ও ছোটো খালা মগ্ন হয়ে ভিসিআরে হিন্দী সিনেমা দেখছে।ছবির নাম ‘চাঁদনি।’
শ্রীদেবী নেচে নেচে গাইছে, “মেরে হাতো মে ন’ ন’ চুড়িয়া হ্যায়”, হীরের নাকফুলটা আলো হয়ে জ্বলছে।

সেদিকে তাকিয়ে মনে দুঃখবোধ ছলকে ওঠে।
পনেরো দিন আগে ওর আকদ হয়েছে।আকদ-এর পরের দিন ডাইনিং টেবিলে খালা,ফুপু,চাচীদের জমাট গল্পের আসরে বড় চাচী বলেছিলেন,

“ স্বর্ণা এবার পার্লারে গিয়ে নাকফুল পরে আয়।ডায়মন্ডের নোজ পিন পরিস।।তোকে নাকফুলে অনেকটাই মাধুরী দীক্ষিতের মত লাগবে।তোর সাথে চেহারায় মিল আছে।মাধুরীকে নাকফুলে কী সুন্দর লাগে! তাই না?”

ছোটো চাচী বলেছিলেন ,

“ আমার নাকফুলে সবচে সুন্দর লাগে শ্রীদেবী আর রেখাকে।মুনমুন সেনকেও ভালো লাগে।”

“ আমার নাকফুলে ভালো লাগে সূর্বণা মুস্তাফাকে।”
চায়ে চুমুক দিতে দিতে মা বলেছিলেন।

স্বর্ণা স্বপ্নময় চোখে সবার কথা শুনছিল।
উড়ন্ত শঙ্খচিলের মত ওর মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন তখন ঘুরে-ঘুরে উড়ছিল, হীরের একটা নাকফুল পরে বউ সাজার স্বপ্ন।

হায়! ওর এই স্বপ্নটা যে স্বপ্নই থেকে যাবে!
নিরুপায় একটা আক্ষেপে চোখে জল আসে উনিশ বছরের কিশোরী স্বর্ণার।
পনেরো দিন আগে যার হুট করে আকদ্ হয়েছে।
বিশ দিন পর বিয়ের আনুষ্ঠানিক আয়োজন হবে।
আজকে বিকেলে পার্লারে গিয়ে নাক ফোড়ানোর কথাটা ফোনে ননদকে বলতেই ননদের কাছ থেকে এই দুঃসংবাদ শুনল।

স্বর্ণার মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে শবনম ও ছোটখালা প্রশ্নবোধক চোখে ওর দিকে তাকাল।

সব শুনে ছোটোখালা বলল,

“ তোর ননদকে বলাই উচিত হয় নাই।ওদের পছন্দকে এত পাত্তা দেওয়ার দরকার কী? তুই চুপচাপ নাক ফুটা করে নাকফুল পরে বসে থাক।”

“ শাহেদও তো শুনলাম পছন্দ করে না।”

“ সেটা বিকেলে শাহেদকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।”

আকদ-এর পর থেকে প্রায় দিন বিকেলে শাহেদ এ বাডির সামনে আসে।স্বর্ণা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে শাহেদের গাড়িতে ওঠে।গাড়ি ছুটে চলে এয়ারপোর্ট রোডের নিরিবিলি রাস্তায়।কখনো থামে গুলশানের ‘ডলসি ভিটা’ আইসক্রীম পার্লারের সামনে।কখনো থামে কোনো চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে।

সেদিন বিকেলে, গাড়িতে বসে স্বর্ণার প্রিয় চকলেট ফ্লেভারের কোন আইসক্রীম খেতে খেতে স্বর্ণা নাকফুলের প্রসঙ্গটা তোলে।

শাহেদের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
একটু গম্ভীর গলায় বলে,

“ নাকফুল খুব বাজে লাগে দেখতে।নাকের মধ্যে একটা ফুল! ইট লুকস্ আগলি।”

একটা আশা মনের প্রান্তে ভাসা-ভাসা ভাবে জেগেছিল।শাহেদের কথায় সেটা ডুবে গেল।

“ আমার হীরের নাকফুল পরার খুব শখ ছিল।”

অস্ফুটে এ কথা বলে আশাহত চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকায় স্বর্ণা।
চোখ দু’টো অবাধ্য হয়ে উঠতে চায়।ঠেলে-ঠুলে বের হতে চায় জল।
মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকায়।
চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করে।

শাহেদ আবারও গম্ভীর গলায় বলে,

“ আইসক্রীম খাচ্ছো না কেন? গলে যাবে তো। আর নাকফুল-টুল পরার আইডিয়া মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভালো।”

স্বর্ণা কথা বলে না।
সন্ধ্যার আকাশের রঙ বদলাতে থাকে।
সেদিকেই তাকিয়ে থাকে।
শাহেদ ড্রাইভ করতে করতে স্বর্ণার দিকে তাকায়।

স্বর্ণা নিশ্চুপ বসে থাকে।

“গান শুনবে?”

শাহেদ জানতে চায়।

স্বর্ণা নিরুত্তর।

শাহেদ কাঁধ ঝাকায়।

“ ঠিক আছে।নাকফুল পরে এত সুন্দর চেহারাটা যখন নষ্ট করার এত ইচ্ছা তাহলে পর নাকফুল।”

স্বর্ণা এবার ঝট করে ঘুরে তাকায়।

“নাকফুল পরলে চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়? “

ওর চোখেমুখে বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে।

“ একদম।”

“আমার মা নাক ফুল পরে।বড় আপা পরে।তাদের কারো চেহারার তো সৌন্দর্য নস্ট হয়নি,বরং বেড়েছে।কয়দিন আগে দোলা আপুর বিয়ে হল।হীরের নাকফুল, লাল বেনারসিতে ওকে রাণীর মত লাগছিল।”

“ দোলা আপু যেন কে? তোমার কাজিন, রাইট?”

“ হ্যাঁ, বড় চাচার মেয়ে।ওকে খুবই সুন্দর লাগছিল।আর ওর লাল বেনারসি শাড়িটা যে কী সুন্দর!”

“এইরে! এখন আবার বোলো না যে তোমার লাল বেনারসির খুব শখ।বিয়ের শাড়ি কিন্ত অনেক আগেই কেনা হয়ে গেছে।মা, বড় আপা দুই বছর আগেই কিনে রেখেছে।একটা শাড়ির রং গোল্ডেন,আরেকটার রং বেগুনি।”

“ বিয়েতে বেগুনি শাড়ি! বেগুনি আমার সবচাইতে অপছন্দের রঙ।আমি বিয়েতে বেগুনি শাড়ি পরতে চাই না।”

নিজের অজান্তে মুখ ফসকে বলে ফেলল স্বর্ণা।

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবেগপূর্ণ গলায় বলল,

“ আমার খুব শখ বিয়েতে লাল বেনারসি শাড়ি পরার।”

শাহেদ গভীর চোখে স্বর্ণার দিকে তাকায়।
উনিশ বছরের কিশোরীর আবেগ ওকে স্পর্শ করে।

মাথা চুলকে বলে,

“ দেখি, বাসায় বলতে হবে।বাড়ির মহিলারা শপিং করেছে।এখানে আমার ইনভল্বমেন্ট নেই।তাছাড়া আমাদের বাড়িতে মায়ের কথাই শেষ কথা।আচ্ছা, দেখি বলে কাজ হয় কিনা।”

পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে লাল বেনারসির প্রসঙ্গ তুলতেই শাহেদের মা’র মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।

এটা যে ঝড়ের পূর্বাভাস শাহেদ বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে অফিসের পথ ধরে।

শাহেদের মা ঘটককে ফোন করে ঝাল ঝারেন।

“ এই না বলেছিলেন মেয়ে খুব ভদ্র,শান্ত-শিষ্ট।তা এমন শান্ত-শিষ্ট, ভদ্র মেয়ে আকদ-এর পনের দিনের মধ্যে জামাইর কাছে লাল বেনারসি চায় কীকরে? এই মেয়ে এখনো এই সংসারে পা রাখে নাই।এর মধ্যে আমার ছেলেকে বশ করে ফেলেছে।যেই ছেলে কখনো মায়ের মুখের ওপর কথা বলে না সেই ছেলে মায়ের মুখের ওপর কথা বলছে।এই মেয়ে আমার সংসারে আসলে না যেন কী করবে।”

ঘটক জুবাইদা বেগম পেশাদার ঘটক নন।তাকে শৌখিন ঘটক বলা যায়।এর আগে দু’টো ঘটকালি করেছেন।
শাহেদের মা’র কথায় তিনি হাসলেন।দৃঢ় গলায় বললেন,

“ মেয়ে আসলেই খুব ভদ্র,খুব লক্ষী টাইপের।আমি এখন যেমন আপনাদের প্রতিবেশী, ওদের এলাকায়ও ছিলাম অনেকদিন,এটাতো জানেন।মেয়েটা বেহায়পনার কী করেছে ঠিক বুঝলাম না।স্বামীর কাছে শুধু বলেছে যে ও বিয়েতে লাল বেনারসি পরতে চায়।এখন তো নতুন ট্রেন্ড চলছে।ছেলের ফ্যামিলি হবু বৌকে শপিং মলে নিয়ে যায়, শাড়িও কেনা হয় হবু বৌয়ের পছন্দে।স্বর্ণার বড় বোন সোহানার বিয়ে হয়েছে এক বছর আগে।ওর বিয়েতেও কিন্ত ছেলেপক্ষের লোকজন ওকে শপিং মলে নিয়ে গিয়েছিল।শাড়িও কেনা হয়েছিল ওর পছন্দে।”

“ ওদের ফ্যামিলিতে কী হয় সেগুলো আমি শুনতে চাচ্ছি না। আমাদের ফ্যামিলিতে এসব বেহায়াপনা চলে না।আমিও দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।কই? তাদের বিয়েতে তো এমন কিছু হয়নি।আমি দুই বছর আগে মেডিকেল চেকআপের জন্য ইন্ডিয়ায় গিয়েছিলাম।তখন নিজে পছন্দ করে ছেলের বৌয়ের জন্য দুইটা শাড়ি কিনে রেখেছিলাম।আমার পছন্দের কোনো দাম নাই নাকি? “

শাহেদের মা ঝাঁজ গলায় বলেন।

ঘটক জোবাইদা বেগম আবারও হাসেন।

“আপা, একটু বোঝার চেষ্টা করেন।আপনার মেয়েদের বিয়ে হয়েছে আশির দশকে।এটা ১৯৯৫, যুগের হাওয়ায় কতকিছু‌ই তো বদলে গেছে।যার বিয়ে শাড়িটা তো তার পছন্দসই হওয়া উচিত।আপনার পছন্দের কেনা শাড়ি না হয় পরে পরবে।”

“ আমি এতকিছু বুঝি না।লাল বেনারসি কেনা হবে না।আমরা যেই শাড়ি কিনেছি সেটাই বিয়েতে পরতে হবে।”

লাল বেনারসি নিয়ে শাহেদের মা’র উত্তপ্ত কথার আঁচ স্বর্ণাদের বাড়িতেও পৌঁছে গেল।

স্বর্ণার বড় ফুপু উত্তেজিত গলায় বললেন,

“ওদের কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।কালকেই আমরা মার্কেটে যাব।স্বর্ণার পছন্দের লাল বেনারসি কিনব।ওদের শাড়ি পরবে না স্বর্ণা।”

স্বর্ণার মা শান্ত গলায় বলেন,
“ সেটা মনে হয় ঠিক হবে না।সম্পর্কটা খারাপ হবে।”

বড় চাচী উগ্বিগ্ন গলায় বলেন,

“ আমি ভাবছি অন্য কথা।স্বর্ণা ঐ বাড়িতে যাওয়ার পর এই দজ্জাল মহিলা না জানি ওকে কি পরিমাণ যন্ত্রণা দিবে।সাথে তো অবিবাহিত এক ননদও আছে।দুই ননাসও শুনলাম ঘন ঘন আসে।”

স্বর্ণার সোনালি মুখ তাম্রবর্ণ ধারণ করে।
শুধু লাল বেনারসির কথা বলায় এত এত কথা!
কোন যুদ্ধক্ষেত্রে না যেন ও যাচ্ছে।সারাক্ষণ কথার বাণ ছুঁড়ে ছুঁড়ে ওরা নিশ্চয়ই ওকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলবে।জীবন নিশ্চয়ই নরক বানিয়ে ছাড়বে।ভেবে শরীরে শীতল স্রোত বয়ে যায়।

স্বর্ণার মা চোখ সরু করে স্বর্ণাকে দেখেন।

গলার স্বাভাবিক সুর ধরে রেখে বলেন,

“আহ্! তোমরা নানান পদের কথা বলে মেয়েটাকে আর নার্ভাস কোরো না।ওর মুখের অবস্থা দেখেছো।মনে হচ্ছে ওকে যেন ফাঁসির মঞ্চে পাঠানো হচ্ছে।”

স্বর্ণার মা ফেরদৌসী আহমেদের কথায় বেড়াতে আসা আত্মীয়দের কথার ঝড় থামে।

“ ঘটক জোবাইদা আপা তো বলেছেন শাহেদদের বাড়িতে অনেকদিন কারো বিয়ে হয়নি।ওরা এই সময়ের ব্যাপারগুলো ঠিক জানে না।ওর মা বয়স্ক মানুষ, একটু প্রাচীনপন্থী।তাই হয়ত এভাবে রিআ্যাক্ট করেছেন।পরে হয়ত দেখা যাবে উনি খুব ভালো মনের মানুষ।শুধু রেগে গেলে উল্টা-পাল্টা কথা বলেন।”

ফেরদৌসী আহমেদ হালকা সুরে বলেন।

স্বর্ণার ছোট খালা ঠাট্টার সুরে বলল,

“আপা,তুমি অংকের টিচার তো।তাই সব হিসাব অংক করে বের করে ফেলেছ।”

তারপর বিরস মুখে বলল,

“যত যাই বলো আপা,ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি।মেয়েদের স্যাক্রিফাইসের শুরুটা হয় বিয়ের পর অন্যের বাড়িতে যাওয়ার মাধ্যমে।স্বর্ণার স্যাক্রিফাইস আগেই শুরু হল।”

স্বর্ণার বড়বোন সোহানা বলে উঠল,

“আমারও ভালো লাগেনি।স্বর্ণার কত শখ ছিল ডায়মন্ডের একটা নাকফুলের, একটা লাল বেনারসির।এখন কিছুই হবে না।সব স্যাক্রিফাইস শুধু মেয়েদেরকেই করতে হয়।”

ফেরদৌসী আহমেদ আবারও হালকা গলায় বললেন ,

“ ছেলেরাও স্যাক্রিফাইস করে।নইলে কী আর দুইজনের সংসার সারাজীবন টেকে?”

সোহানা চমকে ওঠার কৃত্রিম ভঙ্গী করে বলল,

“আ্যাঁ? এটা ঝানতাম না।”

স্বর্ণার ছোটবোন শবনম এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল।
সোহানার মুখভঙ্গী দেখে শব্দ করে হেসে ওঠে।
ঘরের অন্য সবাইও হেসে ওঠে।

ফেরদৌসী আহমেদ মিটমিট করে হাসেন।

সোহানার দিকে তাকিয়ে বলেন,

“ছেলেরাও করে।বিয়ের বয়স যত পার হবে এটা তত বুঝতে পারবি।স্বর্ণাও বিয়ের পর ধীরে ধীরে বুঝবে।”

স্বর্ণা ড্রইংরুম ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় মা’কে চাপা গলায় বলতে শোনে ,

“ স্বর্ণার সামনে কোনো নেগেটিভ কথা বোলো না।আমি চাই মেয়েটা আনন্দ নিয়ে ঐ বাড়িতে যাক।ওর মনে যেন ভয় না থাকে।”

বিয়ের সময় যত এগিয়ে আসতে থাকে স্বর্ণার চেহারার স্বর্ণালী, উজ্জ্বল আভা তত বিবর্ণ হতে থাকে।
ভেতরের চাঞ্চল্য, উৎসাহ উধাও হতে থাকে।সেই জায়গায় একটু একটু করে জমতে থাকে অজানা উদ্বেগ ও ভয়।

(চলবে )

– [ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here