# হায়েনা ৩য় পর্ব
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

জোহরা বেগম জ্ঞান হারাতে যেয়েও হারালেন না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে,খুব ঠান্ডা। এমনিতেই তাঁর পরিবারের চরম দুর্নাম, তার মধ্যে যদি এই ঘটনা জানাজানি হয়,পৃথিবীর কারো সামনে আর মুখ দেখানো লাগবে না।

জোহরার বাবা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছিলেন। খুবই খ্যাতি ছিল তাঁর, তবে কুখ্যাতি। স্ত্রী ছিলেন একদম বিপরীত। অভিজাত,ভদ্র, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। বাসার কাজকর্মে সাহায্যের জন্য তিনি নিজের দাদাবাড়ি থেকে একজন গরীব মেয়েকে নিয়ে আসেন। বিশ-বাইশ বছর বয়স। মহা সুন্দরী। মেয়েটিকে না এনে উপায় ছিলো না। কারণ ছোট-ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে পিএইচডি র কাজ,রান্না-বাড়া তিনি একহাতে সামলাতে পারছিলেন না। এর মধ্যে হল জন্ডিস। মাসখানেক ভুগে এতো দুর্বল হয়ে পড়লেন যে বাসায় মহিলা সহকারী আনতে বাধ্য হলেন। স্বামীর অনেক দূর্নাম তাঁর কানে এসেছে, কিন্তু চাক্ষুষ প্রমাণ না থাকায় এগুলো নিয়ে নাড়াঘাটা করার রুচি তাঁর হয়নি।

মেয়েটির নাম সাহারা। শাম্মি যখন একদিন অধ্যাপক স্বামীকে
সাহারার সাথে চরম আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেললেন, তখন মেয়েটি অলরেডি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অধ্যাপক সাহেব সেই অনাগত শিশুর বাবা। শাম্মী ওইদিনই বাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য বের হয়ে গিয়েছিলেন দুই বাচ্চাকে নিয়ে, ডিভোর্স দিয়েছিলেন,আর প্রফেসর সাহেবের কাজের মেয়েটিকে বিয়ে করার সামান্য ইচ্ছে না থাকলেও প্রাণভয়ে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ সাহারার বাপ-ভাই এসে তাঁর গলায় বটি ধরেছিলেন।

সেই সাহারা খাতুন ই জোহরা বেগমের মা। জোহরাদের চার ভাই বোনকে তাঁদের দাদার বাড়ি কখনোই মেনে নেয়নি, প্রফেসরকেই তারা ত্যাজ্য পুত্র করেছিল। বাবার কুকীর্তি সবাই জানতো। ক্যাম্পাসের লোকজন জোহরাদের দেখলেই কানাকানি শুরু করতো “লুচ্চাটার বাচ্চা,এর মা-ই কাজের বেটি ছিল, এখন প্রফেসরের বৌ হয়ে ডাঁট দেখো।”

এসব কথা শুনতে শুনতেই বড় হয়েছেন জোহরারা চার ভাই -বোন। যুগের পর যুগ কেটে গেছে,কিন্তু তাঁদের নিয়ে রসাত্মক আলোচনা বন্ধ হয়নি।

সামাদ সাহেব টিভি দেখছেন। জোহরা বেগম স্বামীকেও জানালেন না। ফোন করলেন আরিশার বন্ধু তরীকে।

জোহরা বেগম বলতে তাঁর তিন ছেলেমেয়ের বন্ধু -বান্ধব ই অজ্ঞান। এতো ভালো মানুষ হয়? আব্বু,আম্মু,মামনি ছাড়া কথা নেই। কথায় কথায় দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো। তাদের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। ছেলেমেয়েদের বন্ধুদের মা’দের সাথে ঘনিষ্ঠতা।প্রায়ই সেই ভাবীদের শাড়ি উপহার দেওয়া। তাদের বাড়িতে নিজের বানানো আচার,জেলি উপহার পাঠানো। আনিলা-আরিশা-সুমনের বন্ধুরা আন্টি বলতে অজ্ঞান।

এহেন স্নেহশীলা জোহরা একদিন দারুণ পিটিয়েছিলেন আনিলাকে ক্লাস এইটে পড়ার সময়।আনিলার অপরাধ, সে তার কয়েকজন বন্ধুকে আতিক স্যারের গোপন নোট বিলি করেছিল মায়ের নিষেধ স্বত্বেও।

জোহরার চাপে পড়ে তিনজনকেই সব সাবজেক্টে সবচেয়ে নামকরা টিচারদের কাছে প্রাইভেট পড়তে হতো। ছেলেমেয়েদের মা পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, একটা নোটও যেন অন্য বন্ধুদের কাছে না যায়। স্যার -আপাদেরও জোহরা বেগম নিয়মিত সম্মানী দিয়ে আসতেন,বেতনতো আছেই,সাথে শার্ট, শাড়ি, ঘরে বানানো রসগোল্লা,হালুয়া, এমনকি বড় হটপট বোঝাই করে বিরিয়ানি,ইলিশ পোলাও। আচার,জেলিতো মামুলি ব্যাপার।

“আপা, ওইদিন মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে এই শালটা চোখে পড়লো। মনে হলো এটা আপনাকে ছাড়া আর কাউকে মানাবেনা। না করতে পারবেন না,আপা। এক বোন আরেক বোনকে ভালোবেসে দিচ্ছে। এখানে স্বার্থের কোন ব্যাপার নেই। ”

” স্যার,শুনলাম, আজ আপনার জন্মদিন। আমার ছেলেমেয়েরা আপনার ভারী ভক্ত, শার্টটা ওদের দেওয়া উপহার। আমিও শিক্ষকের মেয়ে। উপহারটা না নিলে খুব কষ্ট পাবো।”

আসল উদ্দেশ্য, ছেলেমেয়েগুলো যেন সবচেয়ে ভালো নোটস পায়। বাচ্চাদের মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলেন, কোন ভাবে তারা যেন গোপন নোটগুলোর কথা কাউকে না বলে। সেখানে বোকা মেয়েটা বন্ধুদেরতো বললোই, “জানিস,স্যার ম্যাডামরা আমাকে আলাদা নোট দেয়”, সেইসাথে অকাতরে বন্ধুদের হাতে সব তুলেও দিলো,” তাড়াতাড়ি তুলে নিস,তারপরে ফেরত দিস।যা পাবো,তোদেরকেও দিবো।”

খবরটা কানে পৌঁছেছিল জোহরা বেগমের। টিচারদের মাধ্যমেই। আচ্ছা মার মেরেছিলেন আনিলাকে।সাথে কুৎসিত গালি।

আনিলা খুব অবাক হয়েছিল,”তুমি না আমার বন্ধুদের খুব ভালোবাসো?তাহলে ওরা নোট পেলে তোমারতো খুশি হওয়ার কথা।রাগ করছো কেন তাহলে?”

“আমার কাজ নাই দুনিয়ার সব পোলাপানকে ভালোবাসবো!”

“তাহলে তুমি যে ওদের সোনা,ময়না বলো,মুখে তুলে খাওয়াও,পোলাও -রোষ্ট রান্না করো ওরা আসলে,ওদের জন্য নাকি নামাজ পড়ে দোয়া করো?”

” আমি যা করি করবো,তুই ওদের আর একবারও নোট দিবিনা।”

“আমি যে বলে ফেলেছি ওদের নিয়ম করে নোট দিব?”

জোহরা বেগম আবার ঠাস করে চড় লাগিয়েছিলেন মেয়ের গালে,” কাল যেয়ে বলবি,স্যার আর নোট দেবেনা বলেছে।”

“আমি মিথ্যা বলতে পারিনা মা।”

“তোকে বলতে হবে।নইলে পেটে পাড়া দিয়ে মেরে ফেলবো।”

আনিলা ঐ ক্লাসে আর প্রাইভেট পড়লোইনা,কিছুতেই না।

জোহরা বেগম একদিন মুখ ফসকে বলে ফেললেন, ছেলেমেয়েদের বন্ধুদের তিনি খাতির করেন যেন সব জায়গায় তাঁর তিন ছেলেমেয়ের মাথা উঁচু থাকে,সবাই যেনো তাদের খাতির করে, ভক্ত হয়।

অশ্রুর প্রাইভেট টিউটর ছিলোনা। ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষার ছয়মাস আগের থেকে স্কুলে কোচিং করেছিলো। তাতেই জোহরা বেগমের মুখ ভার।

ক্লাস নাইনে বেচারা বহু সংকোচে বাবার কাছে টিউটরের কথা বলেছিল। সামাদ সাহেব মুখ খোলার
আগেই জোহরা বেগম তড়বড় করে উঠেছিলেন, “উনি কয় পয়সা বেতন পান,জানোতো নিশ্চয়? সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছি। সুতরাং যা করার বুঝে শুনে কোরো।”

শেষ পর্যন্ত অংক আর বিজ্ঞান পড়তো অশ্রু স্যারের কোচিং এ যেয়ে। তাও ক্লাস টেন থেকে। তারপরে জোহরা বেগমকে স্তব্ধ করে দিয়ে ছেলেটা ঢাকা বোর্ডে থার্ড হয়ে বসলো।

রেজাল্ট দেওয়ার কথা বিকালে। সকাল থেকে বাসায় সাংবাদিকদের ভীড়। এ বাড়ির ছেলে সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় হয়েছে। বাপ-মা-ছেলের সাক্ষাৎকার লাগবে।

জোহরা বেগমের তখন দোটানা অবস্থা। অশ্রুর এতো সাফল্য হজম হচ্ছে না, এদিকে ইন্টারভিউ দেওয়ার শখ ষোল আনার উপরে আঠারো আনা। এরমধ্যে টিভির লোকজন ও এসে পড়েছে। অশ্রুর বন্ধুরা চলে এসেছে। জোহরার জন্য খুবই বিব্রতকর অবস্হা। অশ্রুর বন্ধুদের বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ ছিল। জোহরা খড়খড়ে গলায় অশ্রুকে বলে দিয়েছিলেন, “দেখো বাপু, ঘরে আমার সোমত্ত মেয়ে। বন্ধু বান্ধব ঘরে এনে নরক গুলজার করা যাবেনা।”

যদিবা কোন কারণে দু-একবার কেউ এসেছে, এক কাপ চাও পায়নি। বরং তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে জোহরা নানা কটু কথা বলেছেন, ” বাইরে আড্ডা মেরেও আঁশ
মেটেনা, ঘরেও মচ্ছব করতে হবে। ঘরে বাইরের লোক আসা আমার পছন্দ না,দয়া করে বলে দিও।”

আজ সেই বন্ধুরা বাসায়। অশ্রুর স্কুলের টিচাররা অনেকেই এসেছেন। সামাদ সাহেব সেদিন বৌএর অনুমতির তোয়াক্কা না করে ছুটেছিলেন মিষ্টি কিনতে।

এক মহিলা রিপোর্টার জোহরা বেগমকে বলেছিল, “আপনি অশ্রুর মা?খালাম্মা, শাড়ি পাল্টে আসেন। সাক্ষাৎকার নিবো।”

জোহরা বেগম শাড়ি পাল্টালেন, লিপস্টিক লাগালেন, আনিলাকে দিয়ে বাহারি খোঁপা বাঁধালেন।তারপরে সোফায় বসলেন অশ্রুর পাশে,স্নেহময়ী মায়ের মতো একেবারে ছেলের গা ঘেঁষে, এক হাত দিয়ে বেড়ি দিয়ে ধরলেন ছেলেকে। সোফায় ছেলের অপর পাশে তার বাবা। সামাদ সাহেব আন্তরিক ভাবেই ঘন ঘন চোখ মুছছিলেন।

ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। অনবরত ক্যামেরার শাটার পড়ছে,ভিডিওর চড়া লাইট, সাংবাদিকদের অবিরাম প্রশ্ন।

“অশ্রু, তোমার এই সাফল্যের ভাগ কাদের দিতে চাও?”

“আল্লাহ মেহেরবান। আমার শিক্ষক,কয়েকজন বন্ধু এবং আমার বোন আনিলার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। ”

“বড় হয়ে কি হতে চাও?”

“ইন্জিনিয়ার।”

” তোমার অনুজ ছাত্র ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলো।”

” যে কোন সৎ কাজে জেদী,সৎ, পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী হও।”

“সন্তানের সাফল্যে মায়ের অনুভূতি কেমন?”

“এই আনন্দ যে কি আনন্দ, তা বলার নয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় আমার ছেলের জন্য দোয়া করেছি,কান্নাকাটি করেছি,নফল নামাজ পড়েছি,কোরান খতম দিয়েছি,আজ আমার মতো সুখী মা আর নাই।”

এই নির্লজ্জ ভাষণে সামাদ সাহেব পর্যন্ত লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলেন।

“অশ্রু, দুই হাতে বাবা-মা’কে জড়িয়ে ধরো।”

সেদিন অশ্রু ফটোগ্রাফারের এই নির্দেশনা পালন করতে পারেনি। হাত গুটিয়ে চুপ করে বসেছিল। সামাদ সাহেব অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কাটাতে বললেন,”ছেলে আমার বড্ড লাজুক। ”

অশ্রু বলে বসলো,”আমি আমার বোন আনিলাকে নিয়ে ফটোসেশন করতে চাই। ”

সব পেপারে ভাই -বোনের হাস্যোজ্জ্বল ছবি বের হলো।ছবিগুলো এতো সুন্দর আর জীবন্ত ছিলো যে সব কটা পেপার ভাই -বোনের ছবি ছাপালো,বাপ-মা-ছেলের নয়।

টিভিতে যখন সামাদ-জোহরা আর অশ্রুকে দেখাচ্ছিলো,আনিলা ভাইকে টেনেও তার ঘর থেকে বের করতে পারলো না। জোহরা টিভিতে চোখ সাঁটিয়ে বসে রইলেন। সেসব কতো আগের ঘটনা।

জোহরা বেগম নিচু কিন্তু খুব স্বাভাবিক গলায় তরীকে জিজ্ঞেস করলেন,”তরী,কেমন আছ মামনি?”

“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”

“ভাল থাকি কি করে মা? কতোদিন আমার মা’টাকে দেখিনা। আন্টির কথা সবাই ভুলে গেছে। ”

“না,না,আন্টি,পরীক্ষার চাপে আসা হচ্ছে না।”

” এর মধ্যেই সময় করে এসো মা। তোমার পছন্দের দইবড়া আর চটপটি বানাবো। কাস্টার্ড বানাবো আরও স্পেশাল করে।”

তরী অভিভূত হয়ে যায়। এতো মমতা এই নারীর বুকে?
আরিশাটার যে কি ভাগ্য!

“আরিশা কোথায় আন্টি?”

যাক,নিজের থেকেই প্রসঙ্গ টানলো।

“আরিশা তো মা মার্কেটে গেছে।ফোন ভুলে ফেলে গেছে। তুমি লক্ষী মেয়ে মা,পড়তে বসছো,আরিশার লেখাপড়ায় একদম মন নাই। অথচ মাথাটা পরিস্কার।”

” কলেজেওতো আসেনা ঠিক মতো।”

জোহরা বেগম একটা জোর ধাক্কা খেলেন ।মেয়েকে তিনিই কলেজে পৌঁছে দিয়ে আসেন আবার নিয়েও আসেন। তাহলে মাঝখানের সময়টা কি করে মেয়ে?

“মাগো,আরিশা ছটফটে হলে কি হবে, কিছু ব্যাপারে খুব লজ্জা পায়। এতো বিয়ের প্রস্তাব আসে,সব না করে দেয়।”

“আন্টি, কি বলেন,এতো তাড়াতাড়ি ওর বিয়ের চিন্তা করছেন কেন?”

“আর মা,বোলোনা। কি যে জ্বালার মধ্যে আছি। দিনে কয়টা করে প্রস্তাব যে আসে! খুব ভাল ভালো প্রস্তাব। আবার এদিকে বখাটেদের হুমকি-ধামকিতো লেগেই আছে, এসিড দিয়ে নাকি মুখ পুড়িয়ে দিবে। কলিজায় তখন পানি থাকে নাকি? তাই ভাবছিলাম, বিয়ে দিয়ে দিই।এত টেনশন আর সহ্য হয়না। তা মেয়েকে কতো করে জিজ্ঞেস করলাম তার কোন পছন্দ আছে কিনা,কোন জবাব নেই। তোমরা কাছের বন্ধু, তোমাদের কিছু বলে টলে নাকি?”

“আন্টি, কিভাবে বলি আপনাকে! আপনি এতো ভালো,আমরা আপনাকে এতো ভালোবাসি,তাও আপনার বাসায় অনেকদিন যাইনা।”

জোহরার হাত পা কাঁপতে থাকে। তবু খুব স্বাভাবিক গলায় বলেন,”কি হয়েছে মা? তুমি আমার আরেক মেয়ে। মায়ের সামনে সংকোচ কি?বলো মা।”

“আন্টি, কলেজে সবাই আরিশার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে।খুব বাজে কথা। ম্যাডামরাও কয়েকবার ওকে ডেকে ওয়ার্নিং দিয়েছেন। ”

মিষ্টি কথায় অনেক চাপাচাপির পরে জানা গেল,আরিশা একদমই ক্লাস করেনা, দুই দিন পরপর
বয়ফ্রেন্ড পাল্টায়, অনেকে বলাবলি করে, ও নাকি টাকার বিনিময়ে হোটেলে সময় কাটায়।কলেজে আন্টির ডাক পড়বে শিগগিরই।

জোহরা বেগমের হাত-পা কাঁপছিলো। তবু স্থির গলায় বললেন,”আরিশা বেশি সুন্দর তো। অনেক মেয়ে হিংসা
করে। বিয়ের দুশ্চিন্তায়, মাস্তানদের ভয়ে মেয়ের মন খারাপ থাকে। বাসায় চলে আসে,নইলে অশ্রু -আনিলার বাসায় যায়,কখনো মামা-খালার বাসায় যায়। মানুষের মন এতো ছোট! কালকেই আমি টিচারের সাথে কথা বলবো।”

ফোন রেখে জোহরা বেগম ভাবতে বসলেন। কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবেনা। অন্তত এই রাতটা অপেক্ষা করতে হবে,তার আগে কাকপক্ষীটিও যেন কিছু না জানে। সামাদ সাহেব বা আনিলাকেও জানানো যাবে না। কাল কলেজে যেতে হবে। টিচারদের যাহোক কিছু বুঝাতে হবে। কি বুঝানো যায়?

টিচারঃ আপনার মেয়ে দিনের পর দিন ক্লাস করেনা।আমরা তাকে পরীক্ষা দিতে পারমিট করবো না।

জোহরাঃ আমার মেয়ে যে পরিস্থিতিতে আছে,তাতে ও
বেঁচে থাকলেই আমি খুশি। পরীক্ষা তো অনেক দূরের কথা। আমি অল্প কটা কথা বলে চলে যাবো ম্যাডাম। আমার সোনার টুকরো মেয়েটা এই নিয়ে দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হয়। সাদেক গ্যাঙের নাম শুনেছেন? সেই সাদেক আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পাগল। একমাস সময় দিয়েছে আমাদের ভাবার জন্য। এর মধ্যে বিয়েতে রাজী না হলে মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে। কলেজে আসতে নিষেধ করলেও মেয়ে শোনে না। সে লেখাপড়া করতে চায়। কিন্তু এখন মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছে। কলেজে আসে,তারপরে ভয়ে কাঁপতে থাকে।কলেজের গেটে আমার বোনের বা ভাই এর ছেলেকে রাখি। আরিশা পাগলের মতো বের হয়ে ভাইএর সাথে বাসায় চলে আসে,কখনো ওর ভাই বোনদের বাসায় চলে যায়।আবার কলেজে ফিরে আসে।ক্লাস করতে চায়,পারে না,লেখাপড়া করতে চায়,পারেনা। মেয়েটা আমার পাগল হয়ে যাচ্ছে। (এই পর্যায়ে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠবেন।)সাদেক বলেছে পুলিশকে জানালে বা অন্য কোথাও পাঠানোর চেষ্টা করলে মেয়েকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমি কি করবো আপা আমাকে বলে দিন। মাঝে মাঝে মনে হয়,গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ি।”

হবে,এভাবে বললেই কলেজের কেলেংকারী কাটানো যাবে।কিন্তু এখন? কার সাথে কোথায় পালালো মেয়েটা?নিরাপদে আছে না যার সাথে পালিয়েছে,সে সব গয়না,টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে আরিশাকে….
উহ্,আর ভাবা যাচ্ছে না।

এর মধ্যে ফোন।

” আম্মা”,
“আরিশা,কোথায় তুই? ”
“আমি বিয়ে করেছি। এখন ওদের বাসায় আছি।”
“কি বলছিস?কাকে বিয়ে করেছিস? কোথায় বাসা?ঠিকানা বল,আমি এখুনি আসছি।”

“নো আম্মাজান,আজ এখানে আসা যাবে না। ইনফ্যাক্ট,এই বাড়িতে আমি আর ও ছাড়া কেউ নেই। ওর বাবা-মা আজ জাপান গিয়েছেন। দুইজন সার্ভেন্ট আছে অবশ্য। শূন্য বাড়িতে হানিমুন করছি।”

“আমাকে কেন বললি না? আমি নিজে বিয়ের ব্যবস্থা করতাম।”

“ও নিষেধ করেছিল। ”

“বাসার ঠিকানা বল, আমি যাই আর না যাই।”

“বলা নিষেধ।”

” পাগল নাকি?”জোহরা বেগম উন্মাদের মতো চিৎকার করতে লাগলেন।
“কেন ঠিকানা বলা নিষেধ? এতো লুকোচুরি কিসের?ওই বদমাশ যদি টাকা,গয়না সব কেড়েকুড়ে তোকে খুন করে গুম করে ফেলে,তাহলে? এতো গোপনীয়তা কেন,তা তোর মোটা মাথায় ঢুকছে না?”

“হাসালে আম্মা। আমি যে গয়না,টাকা এনেছি, ওদের কাজের লোকেরও এর চেয়ে বেশি আছে।”

জোহরা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,”তাই? তাহলে তোকে ওগুলো নিয়ে যেতে বললো কেন? বাসায় নরমাল ভাবে প্রস্তাব পাঠালো না কেন?”

ওপাশ চুপচাপ। তারপরে প্রায় ফিসফিস করে আরিশা নাম-পরিচয় দিল,” বাহার, সেগুনবাগিচা, এতো নং বাড়ি”…

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here