#হঠাৎ_দেখা
#পর্ব_২২
আজ চৌধুরি ম্যানশনকে অন্যরুপে সাজানো হয়েছে।সবথেকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে সামনের বসার রুম আর ছাদকে। কারন সামনের বসার রুমে পড়ানো হবে আকদ আর ছাদ সাজানোর আইডিয়া তুলি আর সাফার।আকদের পর তারা রাবেয়া ও আসাদের জন্য ফটোশুট এর আয়োজন করেছে।ক্যামেরাম্যান হবে তুলির আপন খালাতো বোন শাওন।বিয়ের মেহমান বলতে শুধুমাত্র নিকটস্থ আত্নীয়রা।রাবেয়ার মা-বাবা কেউ জানেনা আজ তাদের মেয়ের বিয়ে।আসলে তাদেরকে ইচ্ছে করেই জানানো হয়নি।এই বিষয় নিয়ে দুই একবার কথা কাটাকাটিও হয়ে গেল মিনহাজ সাহেব ও স্বপ্না চৌদধুরি।তবুও নিজ সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন মিনহাজ সাহেব।তার একটাই কথা রাবেয়া এখন তার মেয়ে।ঐ পরিবারের কারো সাথে কোন সম্পর্ক নেই তাদের।পরে আর না পেরে হার মানলেন স্বপ্না চৌধুরি।
সাব্বির আর জিহান সকাল থেকে মীর ভিলায় আছে।বলতে গেলে সব আয়োজন তারা দুইজনই সামাল দিচ্ছে।আর রান্নাঘরে টুকটাক নাস্তার আয়োজন করছেন সেলিনা বেগম ও সাফা।তাদেরকে সাহায্য করছে জিহানের স্ত্রী শাহিনা। নয় মাসের ভরা পেট নিয়ে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে তার তাই সেলিনা বেগম তাকে চেয়ারে বসিয়ে ডালা সাজানোর কাজ দিয়েছেন।
রান্নাঘরের কাজ সেরে রেড়ি হওয়ার জন্য উপরে উঠার সময় সাফা খেয়াল করল সাব্বিরকে।জিহান আর আসাদের সাথে কথা বলছে আর হাসছে।কি সুন্দর লাগে এই মানুষটাকে হাসলে সেটা কি উনি জানেন?সবার সাথে কতো সুন্দর করে কথা বলে আর আমার সাথে কথা বলতে গেলেই মুখটা গোমড়া করে রাখবে।
মনে মনে ভাবলো সাফা।
রাবেয়াকে আজ কি রঙের শাড়ি পড়ানো হবে সেটা নিয়ে দুই এক রাউন্ড ঝগড়া হয়ে গেল স্বপ্না বেগম আর তুলির মধ্যে।স্বপ্না চৌধুরী বললেন,”আজ তো ওকে বিদায় দিবো না তাই লাল বেনারসি পড়ার দরকার নেই।এই কলাপাত রঙের বেনারসিটা পড়া।ওয়ালিমার দিন
লাল বেনারসি পড়বে।”কিন্তু তুলি মানতে নারাজ।অবশেষে শত বাকবিতণ্ডার পর কলাপাত রঙের বেনারসিটার জয় হলো।রাবেয়াকে শাড়ি পড়াতে সাহায্য করলেন স্বপ্না চৌধুরী।কলাপাতা আর কমলা রঙের মিশেল বেনারসিতে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে রাবেয়াকে।সাথে পড়েছে শাড়ির আচঁলের সাথে মিলিয়ে কমলা রঙের হিজাব।অলংকার বলতে কঁপালে টিকলি,নাকে ছোট পাথরের নোজপিন,হাতে দুইটা সোনার বালা।যা তাকে সলিনা মীর দিয়েছিলেন।এতো সুন্দর লাগছে রাবেয়াকে কিন্তু মেয়েটার মুখে হাসি নেই।এর কারনও জানেন স্বপ্না চৌধুরী।কিন্তু উনার করার কিছু নেই।একটা মেয়ের জীবনে বিয়ের দিনটা খুব বিশেষ হয়। সেই বিশেষ দিনে মেয়েটা তার কাছের মানুষদের পাশে চাই।যারা তার হাত শক্ত করে ধরে বলবে,”আমরা ছিলাম,আছি আর থাকবো।একদম ভয় পাবি না।”রাবেয়ার কাছেও এখন আপনজনরা রয়েছে।কিন্তু তার তো মাকে চায়।আজ বড্ড মনে পড়ছে মাকে।মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে ইচ্ছা করছে তার।কতবছর মাকে দেখে না সে।অনেক কষ্টে কান্নাকে চেপে রেখেছে রাবেয়া।কিন্তু যখন স্বপ্না চৌধুরী তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তখন সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি।স্বপ্না চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে কেঁদে উঠলো রাবেয়া।আজ স্বপ্না চৌধুরীও কাঁদছেন রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে তাদের এমন কান্না দেখে তুলিও নিজের চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারেনি।ঠিক তখনই ফোন দিলো সাফা।ফোন রিসিভ করার বাহানায় রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে।তুলির কান্না ভেজা কন্ঠ শুনে সাফা বলল,”কিরে কাঁদছিস কেন?”আসাদ তখন সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলো সাফার প্রশ্ন তার কানে আসাতে সে সাফার রুমে প্রবেশ করল।
কাজী সাহেব এসে বসে আছেন প্রায়য় আধ ঘন্টা হলো।বরপক্ষও চলে এসেছে ঠিক সময়ে কিন্তু বর এখনো আসেনি যার দরুন বিয়ে পড়ানে এখনো শুরু হয়নি।মিনহাজ সাহেব কাজী সাহেবের অস্থিরতা দেখে শামীম সাহেবকে বললেন,”ভাইসাহেব এখনো যে আসাদ এলো না।”
“আমি ফোন দিয়েছিলাম।সে বলল আর কয়েকমিনিটে সে এসে যাবে।ভাই টেনশেন নিয়েন না।চলে আসবে।আর ওর সাথে ওর বন্ধু জিহান আছে।” তারপর শামীম সাহেব সাব্বিরকে ডাক দিয়ে বললেন,”সাব্বির কাজী সাহেবকে এক গ্লাস শরবত দাও তো।শরবত শেষ হতে
হতে বরও এসে পড়বে।”
এদিকে এখনো আসাদ আসেনি শুনে খুব টেনশেন হতে লাগলো রাবেয়ার।সাফা রাবেয়ার পাশেই বসে ছিলো।রাবেয়ার টেনশেন দেখে সে মুচকি হেসে বলল,”ভাবী তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আনতে গেছে ভাইয়া।এতো টেনশেন নিয়ো না তো।”সাফার কথা শুনে অবাক হলো রাবেয়া আর বলল,”কি সারপ্রাইজ?”
“বললে তো আর সারপ্রাইজ থাকবেনা তাইনা।”
শামীম সাহেবের বলা ঠিক পাঁচ মিনিট পর হাজির হলো আসাদ আর জিহান।কিন্তু তারা একা আসেননি।তাদের সাথে রয়েছেন বোরকা পড়া এক মহিলা।আসদকে দেখে এগিয়ে এলো সবাই এবং তার সাথের মহিলার পরিচয় ও জানতে চাইল।মহিলার পরিচয় জানতে পেরে সবচেয়ে আবাক হয়েছেন মিনহাজ চৌধুরি।কারন ভদ্র মহিলা আর কেউ নন রাবেয়ার জন্মদাত্রী মা নিলুফা বেগম।রাবেয়া তখন সাফা আর তুলির সাথে নিজের রুমে বসা ছিলো।তখনই দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলেন স্বপ্না চৌধুরী।সেদিকে তাকিয়ে আবাক চোখে চেয়ে রইল রাবেয়া কারন মামীর পাশে তার মা দাঁড়ানো।
“কেমন আছিস মা?”মায়ের কন্ঠ শুনে আর দাড়িয়ে থাকতে পারলোনা রাবেয়া।দৌড়ে গিয়ে নিলুফা বেগমকে জাপটে ধরলো সে।মা মেয়ের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না।স্বপ্না চৌধুরী বাকী সবাইকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন কারন মা মেয়ের কিছু একাকী সময় প্রয়োজন।রাবেয়াকে পাশে বসিয়ে সযত্নে চোখের পানি মুছে দিলেন নিলুফা বেগম।তারপর কঁপালে,গালে সবজায়গায় আদর করে বললেন,”ভাগ্য করে এমন একটা ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাচ্ছিস তুই। আমি খুব খুশি তোর জন্য।আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আসাদকে তোর জীবনে পাঠানোর জন্য।আজ সে না গেলে আমিতো জানতামও না যে আজ তোর বিয়ে।তোর মামা আমকে কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধও করেনি।এখনো সে রাগ করে আছে আমার উপর।তার রাগ করাটাও ঠিক।মা হয়ে আজ পর্যন্ত কিছুই করতে পারিনি তোর জন্য।”
“মামা তোমাকে নিয়ে আসেননি?তাহলে কিভাবে আসলে তুমি আর বাবা?” বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো রাবেয়া।
“তোর বাবা ঢাকার বাহিরে গেছেন। বাসায় কেউ ছিলোনা।তখন মাত্র আছরের নামাজ পড়ে উঠেছি।দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ পয়ে দরজা খুলে দুইটা ছেলেকে দেখলাম।তারা কে জিজ্ঞেস করাই আসাদ নিজেদের পরিচয় দিয়ে সব খুলে বলল তারপর তোর মামীর সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিলো।তখন এক মুহূর্ত দেরি না করে তোর কাছে চলো আসলাম। “মায়ের কথা শুনে আবার মাকে জড়িয়ে ধরল রাবেয়া।নিলুফা বেগম রাবেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,”আসাদ তোকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে।সেটা আমি তোর জন্য ওর চিন্তা দেখে বুঝেছি।”মায়ের এমন কথা শুনে খুশিতে শিহরণ দিয়ে উঠলো রাবেয়ার।এখন সে অনেক খুশি।তার আপনজন সব তার আশেপাশে রয়েছে।আর সেই ব্যবস্থা করেছে তার আত্নার আত্নীয় আসাদ।
সুন্দরভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেল।সবার মুখে হাসি হাসি ভাব।শুধুমাত্র মিনহাজ সাহেব, স্বপ্না চৌধুরী আর নিলুফা বেগমের চোখে জল তো ঠোঁটে হাসি অবস্থা।কবুল বলার সময়তো রাবেয়া আরেকদফা কান্না করল।তখন বাধ্য হয়ে রাবেয়াকে ধরে মিনহাজ সাহেবকে একদিকে নিলুফা বেগম আর স্বপ্না চৌধুরকে আরেকদিকে বসতে হলো।আসাদের মনে আজ অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করছে।তাই মনে মনে মহান স্রষ্টার শুকরিয়া আদায় করলো সে। বিয়ে পড়ানোর পর পর সাফা আর তুলি সবাইকে বলল,”এখন আমরা বর কনে কে নিয়ে ছাদে যাবো।কেউ সেখানে উঁকি ঝুঁকি মারতে আসবেন না।শাওন ক্যামেরা নিয়ে উপরে আয়।”
ওদের কথা শুনে জিহান ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,”একি শুধু বর কনের ছবি তুললে হবে।আমরা কি দোষ করলাম।”
“ভাইয়া আপনি কোন দোষ করেননি।আচ্ছা ঠিক আছে আপনাকে নিয়ে যাবো যদি শাহিনা ভাবিও যেতে রাজি হয়।”
“না বাবা আমি পারবোনা উঠতে।আর তুমি কি শুরু করলে হ্যা, নিজের বিয়েতে এতো ছবি তুলে মন ভরেনি তোমার যে বন্ধুর বিয়েতেও তুলতে হবে।” জিহানকে ঝারি মেরে বলল শাহিনা।
অবশেষে দেখা হলো রাবেয়া আসাদের।আজ তারা এক নতুন সুন্দর হালাল সম্পর্কে আবদ্ধ।আজ আসাদ সিদ্ধান্ত নিলো যে রাবেয়া লজ্জাপাক আর তার কাঁপাকাঁপি শুরু হোক আজ সে শুধু তার প্রিয়তমাকে সারাক্ষন চেয়ে থাকবে।যতক্ষন না তার চোখের তৃষ্ণা মিটে।ছবি তুলার জন্য রাবেয়া পাশে এসে দাড়াতেই আসাদ তার কানে কানে এসে বলল,”কেমন আছো প্রিয়তমা?” আসাদের এমন কথায় লজ্জায় কোন জবাব দিতে পারলো না রাবেয়া।আর ঐদিকে রাবেয়ার লজ্জা দেখে মিটমিট হাসছে আসাদ।কারন সে জানে তার প্রিয়তমার এই লজ্জা শুধুমাত্র তার জন্য।তাদের এই সুন্দর মুহূর্তগুলো নিমিষে ক্যামেরাবন্দি করতে লাগলো শাওন।
রাতে চলে যাওয়ার আগে আসাদ একবার রাবেয়ার সাথে দেখা করতে চাইল।তাই স্বপ্না চৌধুরি তুলিকে বলল আসাদকে রাবেয়ার রুমে নিয়ে যেতে।রাবেয়া বিছানার এক কোণে বসে ছিল। আসাদকে তার রুমে ঢুকতে দেখে দাড়িয়ে গেল সে।তুলি চলে যাওয়ার সাথে সাথে আসাদ রুমের দরজার খিল লাগিয়ে দিল।সেটা দেখে রাবেয়া বলল,”একি দরজা বন্ধ করছেন কেন!সবাই দেখলে কি ভাববে বলুন তো?”
“মুখের বুলি ফুটলো তাহলে।”রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল আসাদ।রাবেয়ার দৃষ্টি নত করে দাড়িয়ে রইল।আসাদ তার সামনাসামনি এসে বলল,”তাকাও তো আমার দিকে।”রাবেয়া তাকালো না।আসাদের এতটা কাছাকাছি আসার কারনে রাবেয়া কাঁপাকাপি আবার শুরু হয়ে গেল।আসাদ আবার বলল,”তাকাও বলছি।স্বামীর কথা কিন্তু শুনতে হয়।”এইবার রাবেয়া আসাদের দিকে তাকালো।
“জানো কতটা ইচ্ছে ছিল আমার তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে।শুধুমাত্র কোন বৈধ সম্পর্ক ছিলোনা বলে পারিনি।কিন্তু আজ আর কোন বাঁধা নেই।”
লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল রাবেয়া।চোখের পাতা অনবরত কাঁপছে রাবেয়ার তা বুঝতে পারলো আসাদ।আর থাকতে না পেরে আসাদকে যখন পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলো রাবেয়া তখন পিছন থেকে রাবেয়ার হাতটা ধরে ফেলল আসাদ।রাবেয়া যখন সেদিকে তাকালো তখন আসাদ বলল,”ছয়বছর আগে সেদিন তোমার হাতটা ধরে আটকানোর কোন অধিকার ছিলোনা বলে আটকায়নি।আজ তোমাকে আটকানোর সব অধিকার আমার আছে।”
চলবে….
®নওশিন সালাবিল