#হঠাৎ_দেখা
#পর্ব_২১
শীতকালের হিমেল ঠান্ডা বাতাসে চারদিক শীতল হয়ে আছে।তার সাথে শীতল হয়ে আছে আসাদ রাবেয়ার দৃষ্টি।কোন কাঙ্কিত জিনিস অনাকাঙ্কিত সময়ে পেয়ে গেল বা সামনে চলে আসলে ঠিক যেমন বিস্ময়ের সাথে খুশি অনুভূত হয় এখন ঠিক তেমন অনুভূত হচ্ছে রাবেয়া আসাদের।ছাদের চিলকোঠার ঘরে দাড়িয়ে আছে সাফা আর তুলি। রাবেয়া ও আসাদকে একে অপরের দিকে এইভাবে চেয়ে থাকতে দেখে সাফা তুলিকে বলল,”কিরে ওরা এইভাবে একে অপরকে দেখে আছে কেন?”
“আই থিংক,তাদের লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয়ছে!”
“কিহ!! তুই আসলেই পাগল?”
“আর তুই পাগলের বান্ধবী ছাগল।”
আর এইদিকে কি যেন মনে পড়তে চোখ নামিয়ে নিল রাবেয়া।হঠাৎ কেন জানি খুব লজ্জা লাগছিলো তার।আসাদ তখনও একমনে রাবেয়াকে দেখে যাচ্ছিলো আর রাবেয়ার সম্পর্কে মায়ের কথাগুলো মনে করছিলো।তার মানে রাবেয়ার সেদিন বিয়ে হয়নি।আসাদের চেয়ে থাকার কারনে খুব লজ্জা করছিলো রাবেয়ার।মনে মনে সেও ভাবলো, “তাহলে তখন কি আমি ভুল শুনেছিলাম যে ওনার বিয়ে হয়ে গেছে!”
“কেমন আছেন রাবেয়া?” আসাদের মুখে তার নাম শুনে ভিতরটা কেঁপে উঠলো রাবেয়ার।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সেও জবাব দিলো,”আলহামদুলিল্লাহ আর আপনি ডাক্তারসাহেব?”এতবছর পর রাবেয়ার মুখে ডাক্তারসাহেব কথাটা শুনে খুব ভাল লাগলো আসাদের।মনেই হচ্ছেনা তাদের মাঝে এতো বছরের দূরত্ব ছিলো।এই তো সেদিন দেখা হয়েছিল তাদের হঠাৎ করে।ভালোবাসা মানুষগুলো হঠাৎ করে এসে হৃদয়ে তাদের জন্য পাকাপোক্ত জায়গা করে নেই।আবারো নিরবতা ছেয়ে গেল তাদের মাঝে।কোথা থেকে কি শুরু করবে দুইজনের কেউ বুঝে উঠতে পারছিলোনা।এইবার আসাদ বলা শুরু করল।
“আজকে এইদিনে আপনাকে এখানে আর গতকাল হাসপাতালে দেখবো বলে কখনো ভাবিনি আমি।”
“আমিও।” ছোট করে জবাব দিলো রাবেয়া।
” আপনার অতীত নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাইছিনা আমি।মা আমাকে সব কিছু বলেছেন।আর এটা জেনে খুশি হলাম যে আপনি নিজের লড়াই নিজে একা লড়েছেন।তার ফলাফল স্বরুপ আজ আপনি নিজের একটা পরিচয় বানিয়েছেন।”
“আপনার বলা কথাগুলো আমাকে সাহস জুগিয়েছে সেদিন।আর সেই সাহস থেকে আমি উঠে দাড়িয়েছি।আপনার আমার থেকে একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য রয়েছে।অনেক খুঁজেছিলাম আপনাকে আমি।”
“শুধুমাত্র একটা ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য?” প্রশ্নটি করার সময় আসাদের ঠোঁটের কোণে হাসি ছিল আর মনে ছিল আরো কিছু একটা শুনার অাশা।
রাবেয়া চুপ থাকায় আবার বলল আসাদ,”কি হলো বললেন না যে শুধুমাত্র ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য আমাকে খুঁজে ছিলেন আপনি?”
“জানি না।” লজ্জায় নুতো মুখে জবাব দিল রাবেয়া।
রাবেয়ার লজ্জা পাওয়া দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো আসাদ।
“আমি তো মনে করেছিলাম আপনি হয়তো আমাকে চিনবেন না।” রাবেয়ার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো আসাদ।এমন প্রশ্ন শুনে রাবেয়ার দিকে সামান্য এগিয়ে আসলো সে।আসাদকে এগিয়ে আসতে দেখে দু’কদম পিছনে গেল রাবেয়া।বুকের ধুকধুকানিটা হঠাৎ বেড়ে গেল তার।
“ছয় বছর ধরে যে চোখগুলোকে মনের গভীরে সযত্নে এঁকে রেখেছিলাম সেগুলোকে কেমন করে না চেনে থাকি বলুন তো।”আসাদের এমন কথায় রাবেয়া যেন নিজ জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারছিলো না।অজানা খুশির সাথে,উত্তেজনা আর একরাশ লজ্জা তাকে ঘিরে ধরলো।পৃথিবীতে হয়তো এর চেয়ে খুশির মুহূর্ত আর হতে পারেনা যখন আপনি জানবেন যার জন্য আপনার ভালোলাগা,ভালোবাসা আর অপেক্ষার মতো অনুভূতি আছে তারও আপনার জন্য সেই অনুভূতি আছে।
_____________________________
আজ সাফার খুশির ঠিকানা নেই।তার খুব ইচ্ছে ছিল মিষ্টি আপুকে ভাবি করে আনার।আর তার সেই ইচ্ছেটা পূরন হবে ভেবেই বাসায় এসে খুশিতে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে সে।তার লাফালাফি দেখে একবার সেলিনা বেগম তো বলেই দিয়েছেন,”যার বিয়ে তার খবর নাই আর পাড়াপড়শির ঘুম নাই।”
“মা আমার খবর আছে বলেই বিয়ে ঠিক হয়েছে আর সেই খুশিতে সাফা এমন করছে।”সাফার মাথায় টুকা দিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে মুচকি হেসে চলে গেল আসাদ।আজ সেও অনেক খুশি।ভালোবাসার মানুষকে হালাল ভাবে পাবে সে। ভাই বোনের এমন কান্ড দেখে সেলিনা বেগমও চলে গেলেন নিজ কাজে।পরশু আকদের জন্য অনেক কাজ বাকি।সব কাজ তাকেই সামাল দিতে হবে।কি হতো এনগেজমেন্ট টা এখন করে পরে একবারে বিয়ে করে বউ ঘরে তুলতে।কিন্তু আসাদ সাফ মানা করে দিল।আর বলল,” হলে এখন আকদ হবে তারপর ওয়ালিমা হবে। বর্তমানে এনগেজমেন্টের নাম করে মা বাবারা যে ছেলে মেয়েদের নিজ থেকে জিনা করার সুযোগ করে দেই তা সে চাইনা।” মিনহাজ সাহেব ও শামীম সাহেব এই বিষয়ে সম্মতি দেয়ায় এই সিদ্ধান্ত হলো যে পরশু একবারে ঘরোয়া পরিবেশে আকদ হবে তাদের আর তার দুইসপ্তাহ পর ওয়ালিমা।তাই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সময় আছে মাত্র কালকের একদিন।
আসাদের বিয়ের কথা শুনে দুই বন্ধুর আবাকের সীমানা রইলো না।জরুরি কথা আছে বলে সাব্বিরকে ডেকে এনেছে আসাদ। জিহান হাসপাতালেই ছিলো।হসপিটাল ক্যান্টিনে বসে আছে তারা।সাব্বিরর মুখ হা করে তাকিয়ে আছে আসাদের দিকে।
“গতকাল ম্যারিড না আনম্যারিড জানতে চাইলি আর আজকে শুনতেছি বিয়ের কথা পাঁকা করে আসলি।কেমন রে?কি জাদু করলি তুই?” বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলো জিহান।তাদের এমন চেহারা দেখে সশব্দে হেসে উঠলো আসাদ আর গতকালের পাত্রী দেখতে গিয়ে রাবেয়াকে আচমকা দেখার সব ঘটনা খুলে বলল তাদের।
সাব্বির বলল,”তুই যা বলিস না কেন তোদের ভাগ্যে তোরা একে অপরের জন্য ছিলি বলে এমনটা হয়েছে।যাইহোক দোস্ত আমি তোর জন্য খুব খুশি।সবাই তাদের ভালোবাসার মানুষকে পাইনা।কেউ কেউ চরম বাস্তবতার আড়ালে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলে।”
রাবেয়ার আজ হাসপাতালে আসতে খুব লজ্জা করছিলো।কেননা আজ থেকে আসাদকে এসিস্ট করতে হবে তাকে।আগের কথা হলে হয়তো লজ্জা করতোনা তার।কিন্তু যতবার গতকাল সন্ধ্যায় আসাদের বলা কথাগুলো আর তাদের বিয়ের হবে এই কথা মনে পড়ছে ততো লজ্জা বাড়ছে তার।সাথে যোগ হচ্ছে টেনশেন।কেমন করে আজকে সারাটা দিন কাটাবে সে।কেননা আসাদ কাছে আসলেই অনবরত কাঁপাকাপি শুরু হয়ে যায় তার।কাঁপাকাঁপি যদি ছোঁয়াছে রোগ হতো তাহলে তার আশেপাশের সবাই এই রোগে আক্রান্ত রোগী হতো।কথাগুলো মনে মনে ভাবছে আর হাসছে সে।তার এমন হাবভাব দেখে ডা.রুমিতো জিজ্ঞেসাও করে ফেলল,”আজ এতো খুশি খুশি লাগছে?বিয়ে টিয়ে নাকি?”প্রতিউত্তরে রাবেয়ার হ্যা সূচক জবাবে আবাক ডা.রুমি।এর মধ্যে পিয়ন এসে রাবেয়াকে ডা.এনামের কেবিনে যেতে বলল। ডা.এনামের কেবিনে ঢুকে আসাদকে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলো সে।এখন না আবার কাঁপাকাপি শুরু হয়ে যায় তার। আসাদ তাকে একবার দেখে পুনরায় ডা.এনামের সাথে কথা বলে ফাইলটা হাতে নিয়ে উঠে দাড়ালো।
“ডা.সাবিহা আজ থেকে আসাদকে ওটিতে আপনি এসিস্ট করবেন।আর পেশেন্ট রাউন্ডেও ওর সাথে থাকবেন।সার্জারির বিষয়ক সবকিছু ওর সাথে আলোচনা করে নিবেন।” ডা.এনামের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো রাবেয়া কিন্তু ভয়ে গলা তার শুকিয়ে কাঠ।এখনি এক গ্লাস পানি চায় তার।
আসাদ সামনে হাটছে এক হাত পকেটে রেখে অন্যহাতে ফাইল নিয়ে আর তার পিছু পিছু হাঁটছে রাবেয়া।হঠাৎ আসাদ কি মনে করে থেমে গেল।আরেকটুর জন্য আসাদের সাথে ধাক্কা লেগে যেতো রাবেয়ার।
“পিছন পিছন হাঁটছো কেন তুমি।এখন তো পাশাপাশি হাঁটার সময়।” আসাদের মুখে তুমি ডাক শুনে কিছুটা আবাক হলো রাবেয়া।
“বয়সে ছোট তুমি আর কর্মস্থানে সিনিয়র আমি তাছাড়া কালকে থেকে নতুন সম্পর্কে হবে আমাদের তাই ভাবলাম এখন থেকে তুমি ডাকা শুরু করি।কি ঠিক করছি তো?”
“হুম।” ছোট করে জবাব দিলো রাবেয়া।
আসাদ আরো কয়েক কদম সামনে এসে রাবেয়ার দিকে একটু ঝুঁকে বলল,”সবার সাথে কম কথা বলো বলে আমার সাথেও কম কথা বলবে এমনটা চলবেনা।
কি বুঝা গেছে?”
আসাদের এইভাবে ঝুঁকে আসার কারনে রাবেয়ার কাঁপাকাপি আবার শুরু হলো।মানুষটা এমন কেন? হুটহাট এইভাবে কাছে চলে আসে।রাবেয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে সেখান থেকে সরে দাঁড়ালো আসাদ।অপরদিকে ঘুরে বলল,”তোমার এই নতুন রোগের চিকিৎসা খুব জলদি করবো আমি।”প্রথমে আসাদের কথা বুঝতে না পারলেও পরে এই কথার অর্থ বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল হতে লাগলো রাবেয়া।আর মনে মনে বলল,”মানুষটাকে যত গম্ভীর ভেবেছিলাম ততটা নয় তিনি।এইরকম লজ্জা দিতে হয়।ইয়া আল্লাহ আর কি কি দেখার বাকি আছে।”
চলবে….
©নওশিন সালসাবিল
ছবিয়াল: Nowshin Salsabil-নওশিন সালসাবিল ♥