#স্বপ্নের_চেয়ে_মধুর❤️
লেখাঃ সুমাইয়া ইসলাম মিম
পর্ব-বারো
.
চট্টগ্রাম স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে রাফাত এবং হুমায়রা। এখান থেকে আপাতত একটা হোটেলে উঠবে তারা। হুমায়রা সারারাস্তা চুপ করে থেকেছে একদম। রাফাত এর সাথে কথা বলার চেষ্টাও করে নি। রাফাতের কাছে বিষয় টা আজব লাগলেও তেমন ঘাটায় নি হুমায়রাকে। সে নিজেও কিছু সময় চায়। হুমায়রার চেহারায় একটা অদ্ভুত ভয় লুকিয়ে আছে যেন। কিসের ভয় পাচ্ছে মেয়েটা? রাফাত বেশি কিছু ভাবতে পারলো না। হুমায়রা কে বগলদাবা করে হোটেলের উদ্দেশ্যে চলল।
এখানে রাফাতের দুইদিন কাজেই ব্যস্ত থাকতে হবে। এবং পরবর্তীতে ঠিক করেছে সপ্তাহ খানেক সে হুমায়রাকে সময় দিবে। তাকে নিয়ে ঘুরাফিরা করবে। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে হুমায়রা কেমন যেন গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। রাফাতের এবার বেশ চিন্তা হচ্ছে তারজন্য। গতকালকের কথা রাফাত কাজ সেরে হোটেলে আসতেই দেখলো হুমায়রা পেটে হাত দিয়ে বিড়বিড় করছে। আর জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। রাফাত রুমে প্রবেশ করতেই যেন ধ্যান ভাঙলো তার। এরপর থেকেই সে হাঁপাচ্ছে। রাফাত এতো শান্ত হতে বলছে সে পারছে না শান্ত হতে। এর পর্যায়ে রাফাত হুমায়রাকে জড়িয়ে ধরতেই একদম শান্ত হয়ে গেলো সে। কাঁপুনিটাও কমে এসেছে। রাফাত ভাবলো ঢাকায় গিয়েই সে হুমায়রাকে ভালো একটা ডাক্তার দেখাবে৷ প্রাণবন্ত মেয়েটা হুট করেই যেন মূর্ছা গেলো। অবশ্য এরজন্য সেই তো দায়ী।
.
পাঁচতারা হোটেলে মুখোমুখি বসে আছে শুদ্ধ এবং বেলা। বেলাকে স্কুল থেকে আজ প্রায় অপহরণ করে এনেছে শুদ্ধ। সেদিনকার দাওয়াতে বেলা আর কোন উত্তর না করায় হতাশ হয়েছিল সে। পরে নিজেই চলে গেছে বেলার স্কুলে। শুদ্ধ টেবিলে বসে পাক্কা পাঁচ মিনিট সে বেলার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল। কি খুঁজছিল বা দেখছিল বেলার জানা নেই। বারবার যখন প্রশ্ন করে আশাহত হয়েছে পরে নিজেই চুপ হয়ে গেছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে এবার শুদ্ধই বলল,
-“বেলা কি খাবেন মেন্যু দেখে অর্ডার দিন প্লিজ!”
বেলা কথা বাড়ালো না। মেন্যু দেখে সাদা ভাত, সরষে ইলিশ আর মেজবানি গরুর গোশত অর্ডার দিলো। শুদ্ধকে বেশ অবাক দেখা গেলো। তবে তার মুখশ্রীর ভাব এমন যেন সে আগে থেকেই জানতো বেলা ঠিক কি অর্ডার করতে পারে। বেলার দিক সামান্য ঝুঁকে বলল,
-“আপনি জানেন সরষে ইলিশ আমার প্রিয় খাবার।”
বেলা অসম্ভব শান্ত গলায় বলল,
-“জানি।”
শুদ্ধ অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
-“কিভাবে?”
বেলা চমকালো। বুঝতে পারলো নিজের ভুল। কথা ঘুরাতে সময় নিলো না সে।
-“এই তো মাত্রই বললেন।”
শুদ্ধ চোখের পাতা কুঞ্চিত করলো। সে স্পষ্টত বুঝেছে বেলা কথা ঘুরিয়েছে। সে কথা না ঘাটিয়ে খাবারে ধ্যান দিলো।
-“তা আপনার কি পছন্দ বেলা?”
-“স্বপ্নপুরুষ এর প্রিয় খাবারটাই।”
শুদ্ধ হাসলো। তবে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-“স্বপ্নপুরুষ কে? স্পেশাল কেউ?”
বেলা হাসলো, সেই সাথে তার চোখের হাসি। মারাত্মক আকর্ষণ অনুভব করলো শুদ্ধ। এই বুঝি হৃদমাঝারে ঘন্টা বেজে গেলো। বেলার ইচ্ছে করলো তার সামনে থাকা স্বপ্নপুরুষটিকে সবটা বলা উচিত। পরক্ষণেই ভাবলো এসব কি আদোতেও কাকতালীয় নাকি পূর্বপরিকল্পিত? বেশ কিছুটা সময় নিয়ে সে বলল,
-“জানাবো কোন এক সময়।”
.
আজ সপ্তাহ খানেক ধরে পূণ্য অফিস যাচ্ছে না। জ্বরে সে কুপোকাত। সেইদিন রাগের বশে প্রায় দু’ঘন্টা পানিতে ভিজে ছিল বাসায় এসে। ব্যস! জ্বরও এসে হাজির। আজ সে আবার স্পর্শর সামনে যাবে। যে মানুষ তার মন বোঝে না তাকে সে জোর করেই বোঝাবে তার মনের কথা। দরকার হলে জোর করেই বোঝাবে। সেই ভার্সিটি লাইফ থেকেই মানুষটা তাকে হৃদদহনে পুড়িয়ে আসছে। হুট করেই খবর পেলো সে অন্য কারো প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করেছে? কেন? পূণ্য তো সেই ছয় বছর আগেই তার মনের কথা তাকে জানিয়েছিল এরপরও সে সময় চেয়ে কিভাবে পারলো তন্নির প্রেমে পড়তে? যখন খোঁজ নিলো স্পর্শের সম্পর্কে। সে কিছুটা ভেঙেই পড়েছিল এটা ভেবে যে এভাবে স্পর্শ তার অনুভূতিকে অপমান করলো? তবে এবার একটা শেষ চেষ্টা সে করবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্মিত হাসলো। বাম হাতের কাপড়টা উচিয়ে দেখলো স্পর্শ নামটা। হৃদয়ে হঠাৎই চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলো সে। খালি গলায় সুর তুলে এক লাইন আওড়ালো,
“বোঝেনা সে বোঝেনা!”
আজ তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়েছে সে। অফিস থেকে বেরিয়ে দ্রুত স্পর্শের অফিসে গেলো সে। অনুমতি নিয়ে সে স্পর্শের কাছে গিয়ে বলল,
-“স্পর্শ আহমেদ। আপনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। যদি সময় দিতেন।”
স্পর্শ অবাক হয়ে আশপাশ তাকালো। সবার সামনে নাকচ করে দেওয়াটা বোধহয় ভালো দেখাবে না। সে আবার পূণ্যর দিকে তাকালো। তার চেহারা দেখে বিস্মিত হলো সে। পূণ্যকে হ্যাঁ বলে সেও ছুটি নিলো। দুজনে কাছেই এক রেস্তোরাঁয় গেল। ধোঁয়া ওঠা কফি, মুখোমুখি দুজনে। পূণ্য ভাবলেশহীন ভাবে বসে। গরম কাপটাকে সে দুহাত দিতে চেপে ধরে বসেছে। মনের উত্তাপের কাছে এই উত্তাপ যেন অতি ক্ষীণ তার কাছে। স্পর্শ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার হাতের দিক। নিরবতা ভুলে সেই এবার বলল,
-“কি জরুরী কথা?”
পূণ্য একই ভাবে বসে। বেশ ধীরে সময় নিয়ে উত্তর দিলো,
-“আজ ছয়টা বছর তোমার পিছনে আমি পড়ে আছি। তুমি জানো আমি অন্যসব ছ্যাচড়া মেয়েদের মতো নই। সেই ভার্সিটি জীবনের, আমার জীবনের প্রথম ও শেষ প্রেম তুমি। জানতে না স্পর্শ? জানতে। তুমি খুব ভালো করে জানতে। জানো। কিন্তু তবুও তুমি আমার অনুভূতিকে অপমান করলে। কারণটা আমার অজানা। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম স্পর্শ। অথচ তুমি আমাকে ভেঙেচুরে আমারই চাচাতো বোনের সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে গেলে? কেন স্পর্শ? আর কত ব্যাথা তুমি আমায় দিতে চাও? কেন করলে এমন টা?”
স্পর্শ যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। সে জানতো এমন একটা সময় ঠিক আসবে। তাকে জবাবদিহি করতে হবে।
-“এই তোমার জরুরী কথা?”
-“হ্যাঁ। আমার জীবনে জড়িয়ে থাকা প্রতিটা বিষয়ই খুব জরুরী৷ সেটা তুমি হলে গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য। ”
স্পর্শ হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করলো।
-“আমি তন্নিকে ভালোবাসি। ও আমার মন জয় করেছে তাই ওর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক। তন্নিও আমাকে খুব ভালোবাসে। চার বছরের প্রেম আমাদের।”
পূণ্য হাসলো। তার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। মনে যেন পাথর চাপিয়ে দিয়েছে কেউ।
-“এই চার বছরেও তুমি তন্নিকে চিনতে পারলে না স্পর্শ? তোমার জন্য কষ্ট হচ্ছে। ”
স্পর্শ বেশ রাগী স্বরেই বলল,
-“আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দেও। তুমি কেমন তা তো চিনেছি তাতেই হবে। ”
পূণ্য তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-“তন্নি চেনালো বুঝি?”
-“যেই চেনাক। চিনেছি তো আমিই। ”
পূণ্য জোরেই হেসে দিলো। যেন স্পর্শ তার সঙ্গে মশকরা করেছে।
-“স্পর্শ আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
-“আমি বাসি না।”
পূণ্য কফির মগ থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিতেই স্পর্শ ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বলল,
-“সহ্যক্ষমতা শেষ? ”
পূণ্য এবার সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালো। গরম কফিটা স্পর্শের সামনেই নিজের হাতে ঢেলে দিলো সে। ঠোঁটে হাসি। ভয়ংকর এক হাসি। প্রেমিক হৃদয় ঘায়েল হওয়ার মতো হাসি। কিন্তু স্পর্শ ভয় পেলো। হুট করে নজর গেল পূণ্যর হাতের দিকে। অস্পষ্ট ‘র্শ’ অক্ষর। পূণ্য পরক্ষণেই হাতা ঠিক করে নিলো। স্পর্শ দেখলো তার হাত লালাভ রঙ ধারণ করেছে। এমন পাগলামি করবে সে কল্পনাতেও ভাবে নি। তন্নি ঠিক বলে পূণ্য পাগল। নয়তো কি এমন কাজ কেউ করতে পারে? স্পর্শ পূণ্যর হাত টেনে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলো। স্পর্শের কাজ দেখে পূণ্য আবার হাসলো।
-“বাহ্যিক ক্ষত সাড়াতে পারবে তবে অন্তরের ক্ষত কি করবে স্পর্শ?”
(চলবে)..