#স্বপ্নের_চেয়ে_মধুর ❤️
লেখাঃ সুমাইয়া ইসলাম মিম
পর্ব-তেরো
.
স্পর্শ কিছু না বলে হাঁটা দিতেই পূণ্য পথ আগলে দাঁড়ায়।
-“দাঁড়াও। আগে তোমার প্রেমিকার সুকর্মের কিছু নমুনা তো দেখে যাও। তোমার ফোনে পাঠিয়েছি কিছু। জানি ভাববে তোমাকে ভুল বোঝাতে চাইছি। কিন্তু কোনটা আসল কোনটা নকল সেটা বোঝার ক্ষমতা নিশ্চয়ই হয়েছে। তন্নির জায়গায় অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিলে হয়তো এতোটা পাগল হতাম না। তখন আমার কাছে তোমার ভালো থাকাটাই মূখ্য থাকতো। কিন্তু তন্নির কাছে তুমি কোন সুখই পাবে না। ও একটা মরিচিকা।”
স্পর্শ ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
-“তন্নি খারাপ হলে তুমি কি? নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে এসেছো? শুনে রাখো কেঁদে মরে গেলেও আমি তোমার হবো না।”
পূণ্য হাসলো। প্রাণখোলা হাসি।
-“আমি আর কাঁদবো না স্পর্শ। কাঁদবে তুমি। তবে তখন কিন্তু আমায় আর তোমার নীড়ে পাবে না। হাহা..”
হাসতে হাসতেই পূণ্য স্থানত্যাগ করলো। স্পর্শ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল ওর পানে। হঠাৎই শুনতে পেলো পূণ্যর আওয়াজ,
“যেজন প্রেমের ভাব জানে না..তার সাথে নাই লেনাদেনা..খাটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা..সেজন সোনা চেনে না..”
বিরক্তিতে স্পর্শ ভ্রু কুঁচকে ফেললো,
-“আমি সোনা চিনি না? প্রেমের ভাব জানি না? এহ! উনি বোধহয় বিশ্ব প্রেমিকা! হুহ!”
ফোনে পাঠানো ছবি এবং চলমান ছবিগুলো একটা ফাইলে সংরক্ষণ করে রাখলো। আজ পূণ্য খুব উপকার করেছে তার। পূণ্যর কথা ভাবতেই হাসি ফুটলো ঠোঁটে। পাগল মেয়ে!
.
পাশাপাশি হাঁটছে বেলা এবং শুদ্ধ। শুদ্ধ বেলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আপনার কাজল কালো চোখগুলো মাশা-আল্লাহ খুব সুন্দর। মনে হয় যেন কাজল ছাড়া আপনাকে একদমই মানাতো না।”
বেলা হাসলো। মিষ্টি হাসি।
-“স্বপ্নপুরুষ এর পছন্দ বলে কথা।”
শুদ্ধ কিছুটা ঈর্ষান্বিত অনুভব করলো। কে এই স্বপ্নপূরুষ? যে বেলার মন-মস্তিষ্কে ঝেঁকে বসে আছে?
-“আপনার স্বপ্নপুরুষকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছি।”
-“ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই দেখবেন।”
-“হুম”
বেলা হুট করে হাঁটা থামিয়ে বলল,
-“আমরা এভাবে হাঁটছি কেন?”
শুদ্ধ দুইহাত পকেটে রেখে পা দিয়ে ইট ঠেলতে ঠেলতে উত্তর দিলো,
-“ভালো লাগছে!”
বেলা আড়চোখে তাকালো শুদ্ধের দিকে। লোকটাকে দেখে ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। তা কি লোকটা জানে? দমকা হাওয়ার বেগে বেলার নীল রঙা আঁচলখানা উড়ে গেল শুদ্ধের পানে। শুভ্র শার্ট পরিহিত শুদ্ধকে তার নামের মতোই শুদ্ধ মনে হচ্ছে। গায়ের উপর আঁচলের ঝাপ্টায় বেলার দিকে তাকালো একই সময় বেলার দৃষ্টিও তার চোখেই আবদ্ধ। সময় নিয়ে বেলা নিজেকে ঠিক করে ভাবলো বিদায় জানাবে শুদ্ধকে। কিন্তু প্রকৃতি হয়তো আজ ভিন্ন কিছুই আবদার করছে। বৃষ্টির তেজ বাড়তেই দৌড়াতে শুরু করলো শুদ্ধ বেলা। বেশখানিকটা পথ চলে গেল তারা। আশপাশ প্রায় জনশূন্য। হঠাৎই শুদ্ধ বেলার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো। বেলা থেমে শুদ্ধের দিক তাকাতেই দেখতে পেল তার মুগ্ধ চাহনী। শুদ্ধ অস্থির স্বরে ডাকলো তাকে,
-“বেলাহ!”
বেলা তাকিয়ে থাকতে পারছে না। তবুও সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো শুদ্ধের পানে চাইতে। শুদ্ধ সময় নষ্ট করলো না। হুট করেই বলল,
-“তোমার জন্য আমার মনে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। ভালোবেসে ফেলেছি বোধহয়!”
বেলা অবাক হলো।
-“আমি আপনার জন্য অচেনা। আপনি আমাকে চেনেন কতটুকু? এই ক্ষীন সময় প্রেমে পড়া কি এতোই সহজ?”
-“তুমি আমার জন্য অচেনা নও বেলা। তুমি আমার প্রথম অনুভূতি, প্রেম, ভালোবাসা এবং আমার স্বপ্নকন্যা।”
বেলা চমকালো। কি বললো শুদ্ধ? স্বপ্নকন্যা? একি আদোও সম্ভব? শুদ্ধর চাহনী নির্লিপ্ত, খুব স্বাভাবিক।
-“স্বপ্নকন্যা মানে?”
.
অসময়ের বৃষ্টিতে আজ খুব ভিজতে ইচ্ছে হলো হুমায়রার। রুমে বরাদ্দ বারান্দায় চলে গেলো সে৷ বারান্দাটা খোলা যার দরুন বৃষ্টির ছাঁট আসছে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে চাইলো বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে। ভালো লাগছে হুমায়রার। ভেতরটা হঠাৎই কেমন কেঁদে উঠলো। সাথে ভিজে গেলো তার চোখ। ইচ্ছে হলো প্রাণভরে কাঁদতে। কত বছর যে হাসে না, নিজের ইচ্ছেগুলোও যেন জড় পদার্থে পরিনত হয়েছে। তবে ইদানীং তার ভালো লাগে। বাঁচতে ইচ্ছে হয়। রাফাতের জন্য নয়। রাফাত এবং তার অংশের জন্য। হুমায়রা পেটে হাত বুলিয়ে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। দুই মাসের অন্তসত্বা সে। রাফাতকে কথাটা জানায় নি সে। কিভাবে জানাতো? রাফাত যদি অস্বীকার করে? সেদিন রাতে তো সে হুশে ছিল না। তবে সেদিনের মিলনের মাঝে একবারও বেলার নাম নেয় নি সে। বরং হুমায়রাকেই খুঁজছিল যা হুমায়রাকে অবাক করেছিল সাথে উতলাও।
রাফাত গোসল করে বেরিয়ে হুমায়রাকে বারান্দায় দাঁড়ানো দেখে এগিয়ে গেল। মেয়েটা কাঁপছে কেন? পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই হুমায়রা চোখ খুলে তাকালো। তার চোখ অসম্ভব লালাভ রঙ ধারণ করেছে। রাফাত বুঝতে পারলো মেয়েটা কান্না করেছে। সে মৌন রইলো। ফুপিয়ে কাঁদতে থাকা হুমায়রা আস্তে বলল,
-“আমার ভুলের জন্য বোধহয় শাস্তি আরো বাকি আছে। তাই না রাফাত? আচ্ছা রাফাত আমি এই পৃথিবীর বোঝা বই অন্যকিছু হতে পারলাম না কেন? আচ্ছা আমার কি ভালোভাবে বাঁচার অধিকার নেই? কেন আমার সাথে এমন হলো?”
রাফাত উত্তর দিতে পারলো না। ভাগ্য তো তার সাথেও খেলেছে। সে নিজেও পরিস্থিতির স্বীকার।
-“হুমায়রা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমাদের দুজনেরই হয়তো জীবনটাকে নতুন করে ভাবা উচিত। মানে মুভ অন করা উচিত।”
হুমায়রা চমকালো। বিষন্ন মন বুঝতে পারলো না রাফাতের কথা। হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে পড়লো সে। রাফাত ধরতে না পারায় মেঝেই ঠাই হয়েছে তার। রাফাত দিকবিদিকশুন্য হয়ে পাজকোলা করে তাকে বিছানায় শুয়ে দিলো। একদম ভেজা সে, এভাবে বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরাতে চেষ্টা করলো তবে সে ব্যর্থ। সে বুঝতে পারলো না হুমায়রা হঠাৎ জ্ঞান হারালো কেন? তাড়াতাড়ি জামা পালটে দিয়ে সে হুমায়রাকে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালে।
.
যাত্রী ছাউনির বেঞ্চিতে বসে শুদ্ধ এবং বেলা। তাদের মাঝে বেশ দূরত্ব। দুজনেই চুপ করে আছে। যেন মৌনতায় মনের ভাব প্রকাশ করছে দুজনে। মৌনতা ভাঙলো বেলা।
-“আমি এক পুরুষকে রোজ স্বপ্নে দেখি। শুভ্র জামা পরিহিত এক স্বপ্নপুরুষ। তাকে আমি আগে কখনোই বাস্তবে দেখি নি। না তো বাস্তবে সে আছে তা জানতাম! সে আমাকে স্বপ্নে এসে সময় দিতো। আমরা স্বপ্নে ঘুরি। এই যে কাজল দেই সেটাও তার পছন্দে। আমি জানি স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই হয়। আমরা যা চিন্তা করি তাই স্বপ্নে দেখি। তবে সে আমার হৃদয়ের খুব কাছের কেউ। তাকে আমি অনুভব করতে পারি।”
শুদ্ধ অবাক হলো।
-“পরে?”
বেলা হাসলো শুদ্ধর আগ্রহ দেখে।
-“প্রথম যখন আপনার ভাইকে আমি দেখি আমি অবাক হয়েছিলাম। কেননা সে দেখতে স্বপ্নপুরুষ এর মতো। আমি খুশি হয়েছিলাম। সাথে হতাশও। তার মাঝে স্বপ্নপূরুষ এর কোন বৈশিষ্ট্যই আমি খুঁজে পাই নি। আমি চেষ্টা করলাম স্বপ্নপুরুষকে ভুলে যেতে। তবে ব্যর্থ হলাম। স্বপ্নপুরুষ স্বপ্নে আসা বন্ধ করলো না। তবে আমি অবাক হয়েছিলাম দ্বিতীয় দফায় যখন আমি আপনাকে দেখি। নিশ্চয়ই বলতে হবে না কারণটা।”
-“পৃথিবীতে কত ধরণের আশ্চর্য ঘটে। আজ দেখেও নিলাম। তুমি তোমার স্বপ্নপুরুষকে বাস্তবে আগে না দেখলেও আমি আমার স্বপ্নকন্যাকে ঠিকই দেখছিলাম এক ঝলক। এর পর থেকেই তার আগমন ঘটতো আমার স্বপ্নে। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া কন্যাটি এসেছিল আমার বোনের বাসায়। পাহাড়ের প্রতি তার মুগ্ধ দৃষ্টি আমাকে ঘায়েল করেছিল। কিন্তু ভাগ্য সায় ছিল না। ভার্সিটি থেকে ডাক পড়লে যেতে হয় সেখানে৷ পরে এসে আর খোঁজ পাই নি কন্যাটির। আপাকেও জানাতে পারলাম না কিছু। আগেই বলেছি আপার সাথে অতোটা ক্লোজ নই আমি। কিন্তু কন্যা আমার স্বপ্নে এসে জ্বালাতে লাগলো। এরপরই তার নাম দিয়েছিলাম স্বপ্নকন্যা। মা অবশ্য জানে তার কথা। আর সেই স্বপ্নকন্যাটি তুমি বেলা।”
বেলা বেশ অবাক হলো। তার মানে সেও হয়তো শুদ্ধকে দেখেছিল সেদিন। ভুলে যাওয়ায় মনে হয়েছিল দেখেই নি কখনো। তারমানে অবাস্তব নয়। তার স্বপ্নপুরুষ বাস্তব। শুদ্ধই তার স্বপ্নপুরুষ!!
(চলবে)..