#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#পর্ব৯

আজ সকালে অরণী যখন কলেজের জন্য বের হয়, আকাশে তখন ঝকঝকে রোদ। চিন্তাও করতে পারেনি বারোটা বাজতে না বাজতে এমন ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে যাবে। চারদিকে শীতল বাতাস বইছে, যখন তখন বৃষ্টি নামবে। কালবৈশাখীর বৈশিষ্ট্যই বোধহয় এমন, হঠাৎ করে আসে, আর সব লন্ড ভন্ড হয়ে যায়। আজ প্লেসমেন্টে কারও মন নেই, মাতাল করা আবহাওয়ায় স্যার ম্যামরাও যেন গা ছেড়ে দিয়েছেন। আউটডোরে রোগী নেই, রিদম অরণীকে নিয়ে ক্যাম্পাসের লনে দাঁড়িয়ে আছে। আরও অনেকেই ভীড় করেছে বাইরে, উদ্দেশ্য বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজবে। কেমন একটা উত্সব উত্সব আমেজ।

“রিদম, তুমি ফোন দিলে না কেন রাতে? কী পরিমাণ চিন্তা করেছি জানো? সকালে এসে দেখি তুমি নাই। আমার চিন্তা আরও বেড়ে গেলো।”

“বিশ্বাস করো ফোন আব্বু নিয়ে গিয়েছিল। আরে এত দেরিতে বাসায় গিয়েছি এমনিই দুনিয়ার বকা খেলাম। সকালেও আরেক দফা বকে তারপর ফোন দিয়েছে আব্বু।”

আসলে রাতে দেরিতে ঘুমানোয় সকালে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। চার্জ না দেওয়ায় ফোনও বন্ধ হয়ে যায়। মোবাইল চার্জ দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ডিউটতে আসতে আসতে লেট। এর মাঝে অরণীকে আর জানানোর সময় সুযোগ হয়নি। মেডিকেল অফিসারের কাছে এক দফা বকা খেয়েছে লেট করার জন্য। এখন অরণীর সাথে আর কথা পেঁচাতে ইচ্ছে করছে না। অবলীলায় তাই একটু সত্য মিথ্যা বলে ওকে ম্যানেজ করে নিয়েছে, অরণী এত ইমোশনাল, ওকে ম্যানেজ করা সহজ। রিদমের কথা সহজেই মেনে নেয় অরণী। নিজের বাবার সাথে মিলিয়ে কথাগুলো অবিশ্বাস করার কারণ খুঁজে পায় না।

“রিদম, বৃষ্টি নেমেছে। চলো ভিজি।”

“আরেহ না। কত মানুষ দেখেছ। দরকার নাই ভেজার।”

“ইসস আমাকে না প্রথম এমন বৃষ্টিভেজা দিনেই দেখেছিলে। কত আবেগ নিয়ে সেই দিনের কথা বলো।”

“তাই তো তোমাকে ভিজতে নিষেধ করছি। কত কত চোখ এখানে সবাই তোমাকে ঐ একই রকম মুগ্ধতা নিয়ে দেখুক, তা আমি চাই না। সেটা শুধু আমার জন্য।”

“হুম, এটাকে পজেসিভ আচরণ বলে জানো তো?”

“হলাম একটু পজেসিভ। তুমি কনজার্ভেটিভ নও? এই যে প্রেমের মাঝে এত এত বিধিনিষেধের দেয়াল তুলে রেখেছ। আমি না হয় একটু পজেসিভ হলাম। আমি তোমারটা মানতে পারলে তুমিও মানো।”

“আচ্ছা যাও ভিজবো না। ওকে।”

বলতে বলতেই বৃষ্টি শুরু। ছেলেমেয়েরা সব হইচই করতে করতে ক্যাম্পাসের মাঠে নেমে গেলো। রিদম ক্যান্টিন থেকে গরম চা নিয়ে এসেছে, সিঁড়িতে বসে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে আর গরম চায়ে চুমুক দিয়ে অরণীর মনে হয়, জীবনটা খারাপ না, বরং অনেক সুন্দর। আচ্ছা তার বাবা মা এমন হয় না কেন! তেমন কিছু তো লাগে না, একটু ঝগড়ার পর মান ভাঙানো, দুটো মিষ্টি কথা, একসাথে বসে বৃষ্টির পানি মেশানো চা খাওয়া, আর ভালোবাসার অনুভূতি। সুখী হতে আর কী লাগে। সে আর রিদম একদম অন্য রকম যুগল হবে। মান অভিমানের পালা রাত বা পোহাতে শেষ করে ফেলবে, আসলে ঝগড়াই করবে না। মনের ভেতর শত-শত কথার কাটিকুটি খেলে রিদমের হাতটা জড়িয়ে ধরে অরণী। রিদম অবাক হলেও খুশি হয়, অরণী নিজ থেকে কাছে আসে না, আজ এই হাতটুকু ধরাই তাই বিশাল কিছু।

সময় কেটে যায় আরও কয়েক সপ্তাহ। রিদমের ইন্টার্নি শেষের দিকে, অরণীর পড়ার চাপও বেড়েছে বহুগুণ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যস্ততা আর প্রেম। যতকিছুই হোক রিদম অরণীকে রোজ বাসার কাছে এগিয়ে দিয়ে তারপর লাইব্রেরিতে যায়। বাসায় বলেছে চেম্বার করে। দশ পনেরো হাজার টাকার জন্য চেম্বারে না গিয়ে রোজ লাইব্রেরিতে বসে পড়বে ঠিক করেছে রিদম।চ্যালেঞ্জটাই নিতেই হতো, বের হওয়ার সাথে সাথে পোস্ট গ্রাজুয়েশনে চান্স পেলে এগিয়ে যাওয়া যাবে। এফসিপিএস পরীক্ষার দেরি নেই, তাই এখন অন্য কিছু ভাবার সনয় নেই রিদমের। ভাগ্য ভালো অরণী বিষয়গুলো বোঝে, তাই এখন রিদমকে খরচের কোন চাপ দেয় না, রিদমের ভবিষ্যত ভালো হওয়া মানে তো তাদের ভবিষ্যত ভালো হওয়া।

অরণী আজ বাসায় পৌঁছে দেখে তার দুই ফুপু সাথে কিছু লোকজন নিয়ে বসার ঘরে গল্প করছেন।

“অরণী, আয় আয়, সালম দে। কে চিনতে পারছিস না? আরে আমার মেঝো ননদের জা, তোর সালমা আন্টি।”

শিলু ফুপু এমন ভাবে “তোর সালমা আন্টি” বললেন, যেন অরণী কত চেনে। ফুপুর ননদের জাকে অরণী জীবনে এই প্রথম দেখলো।

“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

“ওয়ালাইকুম সালাম মা। ভার্সিটি থেকে আসলে?”

“না, কলেজ থেকে।”

“ঐ সেটাই। তুমি তো দাঁতের ডাক্তারি পড়ছো তাই না? ভালোই হলো আমাদের।”

অরণী কী বলবে বুঝতে না পেরে হ্যাঁ হ্যাঁ করে। আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কোন রকমে ফুপুর হাত থেকে ছাড়া পায়।

“আম্মু, ফুপু হঠাৎ কাদের নিয়ে আসলেন?”

“মেহমান, শুনলি তো। কিন্তু তোর আজ পাঁচটা কেন বাজলো?”

“বৃষ্টির জন্য রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। আমি ড্রেস পাল্টে আসি, তোমাকে হেল্প করবো।”

“লাগবে না, জরিনা আছে। তুই ভালো একটা জামা পরিস, যা।”

রাত হতে হতে অমিয়র কাছে মেহমান আসার কারণ জানতে পারে অরণী। প্রাথমিক ভাবে পাত্রী দেখতে এসেছে। অরণীকে ওদের ভালোও লেগেছে। ছেলে ভালো চাকরি করে, পরিবার, আর্থিক অবস্থা সবই ভালো। এখন সব ঠিক থাকলে ছেলেকে সাথে নিয়ে কোন একটা রেস্টুরেন্টে বসতে চান ওনারা, মুরুব্বিরা কথা বলবে, আর ছেলে মেয়ে একে ওপরকে দেখবে।

“আম্মু, হঠাৎ আমার বিয়ের কথা আসলো কেন? সামনে পরীক্ষা।”

“হঠাৎ এর কী আছে। ফাইনাল ইয়ারে আছিস, কয়দিন পর পাশ করে ফেলবি। এই সময় পাত্র দেখার জন্য ভালো। আর বললেই কী বিয়ে হচ্ছে নাকি। ওনারা হঠাৎ আসলো, মেহমানের সামনে না করা যায় নাকি। তুই পড়ালেখা কর, বাকিটা বড়রা দেখবে।”

মা পড়ালেখা করতে বললেও, অরণীর সব মাথায় ওঠে। রিদম যে ক্ষ্যাপাটে, এসব শুনলে একটা পাগলামিই করবে। বলবে কী বলবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারে না অরণী।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here