#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#পর্ব৩

অরণী আর রিদম যখন চন্দ্রিমা উদ্যানে পৌঁছায়, ঘড়িতে তখন প্রায় নয়টা বাজে। শুরুতে ক্লাস মিস করবে কী করবে না সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও এখন অরণীর ভালো লাগতে শুরু করেছে। তার আর রিদমের সম্পর্কের সাত মাস হতে চললো, কিন্তু সেভাবে ডেটিং এ যাওয়ার সুযোগ হয় না। মায়ের অসুস্থতার জন্য ক্লাসের পর পর বাসায় ফেরার তাড়া থাকে। অরণীর ক্লাস শেষ হয় দুইটায়, বাসায় আসতে আর একঘন্টা হিসেব করে মা ফোন দিতে থাকে। অরণীর বাবাও ক্লাস টাইমের বাইরে মেয়ের বাইরে থাকা পছন্দ করেন না। বাবা বাসায় ফেরার বেশ আগেই বাসায় ঢুকে অরণী। না হলে দাদী তো আছেই, নাতনির দেরি হয়েছে বাসায় আসতে, ছেলেকে এই তথ্য দিতে ওনার দেরি হবে না। বাবা মায়ের এত সতর্ক চোখ এড়িয়ে প্রেম করা সহজ না। বাসায় থাকলে পারতপক্ষে রিদমের ফোন ধরে না অরণী। আর ধরবেই বা কিভাবে, দাদী অরণীর সাথে একই রুমে থাকে, কান এত সজাগ, রাতেও ফিসফিস করে কথা বলা যায় না। অরণী বারান্দায় গিয়ে কথা বললেও বলবেন,”কার সাথে কথা বলিসরে অরণী?”

“অরণী, চন্দ্রিমা উদ্যানে আগে এসেছ?”

“হুম, তবে ইদানীং আসা হয় নি। অমিয় যখন ছোট ছিল, তখন বিকেলে মাঝেমাঝে আমরা বেড়াতে আসতাম, লেকের পাশে সিঁড়িতে বসে চানাচুর মাখানো সহ আরও হাবিজাবি খেতাম। তখন আম্মু এত অসুস্থ ছিল না। বাসায় অনেক সুন্দর পরিবেশ ছিল। দাদী টুকটাক অশান্তি করতেন আম্মুর সাথে, কিন্তু সেটা এত বড় কিছু ছিল না। এখন কতদিন হয়ে গেলো, সেই সুন্দর দিনগুলো যেন হারিয়ে গিয়েছে।”

“আহ্, কী কথা থেকে কই চলে গেলে। মন খারাপ করো না তো। অবশেষে তোমাকে নিয়ে প্রোপার ডেটিং এ আসতে পেরেছি, এই আনন্দে আমি আত্মহারা।”

“আমিও অনেক খুশি। কিন্তু ভয় লাগছে পরিচিত কারও চোখে পড়লে বাসায় খবর চলে যাবে। আমার পরিবার কেমন কনজার্ভেটিভ তুমি জানো না। আচ্ছা তুমি যে হঠাৎ চলে এলে, তোমার প্লেসমেন্টে সমস্যা হবে না?”

“কিছু হবে না, ম্যানেজ করে নেব। ইন্টার্নিই তো চাকরি তো না। আচ্ছা চলো ভেতরে বাগানের দিকে গিয়ে বসি। ওখানে নিরিবিলি, একটা বড় গাছের নিচে বসলে কেউ হঠাৎ দেখবে না বিরক্তও করবে না।”

“আচ্ছা মাঝেমাঝে ফেসবুকে পোস্ট দেখি যে উদ্যানের পরিবেশ ভালো না, বখাটে আছে। অনেকদিন আসি না, কী অবস্থা এখন কে জানে। ভেতরের দিকে যাব না। লেকের দিকে বসি, রাস্তার উল্টো দিকে মুখ করে। তাহলে পেছন থেকে দেখে হঠাৎ কেউ চিনবে না।”

“ওটা বোটানিক্যাল গার্ডেন। এখানে এমন না, ভেতরে আনসার আছে, পুলিশ আছে। সমাধির কাছে সিসি ক্যামেরা আছে। আর আমি তো আছিই তোমার সাথে। তামিল হিরোদের চেয়ে কম নাকি আমি।”

চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে ততক্ষণে প্রাতভ্রমণ শেষে করে সকালে হাঁটতে আসা লোকজন বের হয়ে যাচ্ছে। ভোরের আলো ফুটতেই একদল স্বাস্থ্য সচেতন লোক ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের পার্কগুলোতে হাঁটতে চলে আসেন, এছাড়া ইট কাঠের শহরে সবুজ কই। চন্দ্রিমা উদ্যানও তাই এর ব্যতিক্রম নয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, ওজন কমানো, সৌন্দর্য বর্ধন একেকজনের হাঁটার উদ্দেশ্য একেক রকম। কেউ আবার পার্কে হাঁটতে এসে বন্ধু জুটিয়ে ফেলেন, হয়ে যান বিভিন্ন ক্লাবের সদস্য। কোথাও একদল লোক হাত উপরে তুলে হাসে, হাসলে হার্ট ভালো থাকে, কোথাও হাঁটা শেষে সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা দেয়, খাওয়াদাওয়া করে, তবে এসব গ্রুপে অবসর প্রাপ্ত মানুষেরাই বেশি। তরুণ আর অফিসগামীদের এত সময় কই, তারা হাঁটা শেষে দ্রুত বেড়িয়ে পড়েন।

শেরে বাংলা নগরে, চুয়াত্তর একর জমিতে গড়ে উঠেছে এই উদ্যান, আগে জিয়া উদ্যান নামে পরিচিত হলেও এখন চন্দ্রিমা উদ্যান নামেই সবাই চেনে। উদ্যানের ভেতর রয়েছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধি। উদ্যানের সামনে বাঁকা চাঁদের মতো ক্রিসেন্ট লেক, তার মাঝে ঝুলন্ত সেতু।।সেতুর দু’দিকে পানির ফোয়ারা আছে। মাঝেমাঝে রাতে পানির ফোয়ারা দুটো চালু করলে ভীষণ সুন্দর লাগে। পরিবার নিয়ে আসা লোকজন মূলত এই ঝুলন্ত ব্রীজ, লেকের আশেপাশে শান বাঁধানো অংশ, আর দক্ষিণ দিকের সারিবাঁধা সিঁড়িতেই বসে। রাস্তার অপর পাশেই লুই কানের ডিজাইন বানানো নয়নাভিরাম পার্লামেন্ট হাউস।

রিদম আর অরণী হাঁটতে হাঁটতে সমাধির পূর্ব দিকের পুকুর পাড়ে চলে আসে, কিন্তু এখানে পুকুরপাড়ে বেশ কয়েকটি জুটি বসে আছে বলে রিদম বসতে রাজি হয় না। আবার হাঁটতে শুরু করে তারা, কথা বলতে বলতে উদ্যানের বেশ ভেতর দিকেই চলে এসেছে রিদম আর অরণী, এইদিকটায় বাগান। বড় বড় গাছের ছায়ায় কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। এমনিতেই আকাশে মেঘ করেছে, তাই আরও অন্ধকার লাগছে।

“অরণী, ঐ গাছটার নিচে বসি চলো। পেপার বিছিয়ে নিচ্ছি।”

ব্রীজের কাছে পেপার কিনেছিল রিদম, অরণী কপট রাগও দেখিয়েছিল, ঘুরতে এসে রিদম পেপার কিনছে বলে।

“পেপার এই জন্য কিনেছিলে! তবে এখানে বসবো না। কেমন গা ছমছমে। পুলিশ, আনসার কেউ নেই এদিকে। গাছে কোন সিসি ক্যামেরাও নেই। আর যা মেঘ করেছে, হঠাৎ বৃষ্টি নামলে দৌঁড়ে যে কোন ছাউনিতে যাব, সেই অবস্থাও নেই।”

“ধ্যুত অরণী, ডেটিং এ আসলে এত কিছু চিন্তা করলে হয়। প্রেমিকের সাথে হতে হয় উদ্দাম, বাঁধনহারা, বেপরোয়া। ইংরেজিতে যাকে বলে রেকলেস। আর তুমি যা করছো মনে হচ্ছে প্রেমিকা নিয়ে না, মাকে নিয়ে এসেছি। এই করবে না, ঐ করবে না, হাত ধরে হাঁটা যাবে না। এমনিতেও তোমার সাথে রাতে মন ভরে কথা বলতে পারি না, যখন তখন মন চাইলে ঘুরতে যেতে পারি না। ছুটি নিয়ে, কতকিছু ম্যানেজ করে আজ এখানে আসলাম, তারপরও তুমি আমার সাথে এমন করছো।”

রাগ দেখিয়ে নিজের বিছানো পেপারে বসে পড়ে রিদম।
অরণী বুঝতে পারে আজ এখানে ঘুরতে আসা হঠাৎ করে নয়, রিদম পরিকল্পনা করেই ছুটি নিয়ে এসেছে। আগে থেকে প্ল্যান করলে হয়তো অরণী মানা করে দিত। আজ সকালে মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল, রিদম বলতে তাই মানা করতে পারেনি। এই সাত মাসের সম্পর্কে রিদম কখনো একটু কড়া কথা বলেনি, আজ তার এমন উঁচু গলার কথা শুনে কান্না পেয়ে যায় অরণীর। কত খুশি মনে সেও এসেছে রিদমের সাথে। কিন্তু অরণী এতটা খোলামেলা ভাবে মিশতে পারে না। হয়তো কনজার্ভেটিভ পরিবারে বড় হয়েছে বলে। এই হাতে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে হাঁটা, সময়ে অসময়ে রিকশার হুড তুলে ঘুরতে বের হলে সবার চোখ এড়িয়ে চুমু খাওয়া, ফোনে ঘনিষ্ঠ কথা বলা, প্রেমিকের বন্ধুর খালি মেসে যাওয়া। এগুলো অরণী কোনদিন পারবে না। এই কথাগুলো রিদমকে সম্পর্কের শুরুতেই বলে দিয়েছিল, সীমা অতিক্রম করা কখনোই ওর পক্ষে সম্ভব না। যদিও অরণীর বান্ধবীরা বলেছিল শুরুতে সবাই এগুলো বলে, এরপর বেশিদিন সামলে চলতে পারে না। প্রেমের সাথে নাকি শরীর চলেই আসে। কারও চুমু আর হাত ধরাধরিতে থাকে, কারও এরও বেশিদূর চলে যায়। কিন্তু নাচতে নেমে ঘোমটা দিয়ে থাকা, তা হয় না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here