#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২২
#Saji_Afroz
আলিয়া খাতুন নিহিরের ব্যাপারে সবটা জানার পর থেকে ভীষণ খুশি। মনেহচ্ছে তিনি যেন আকাশের চাঁদ পেতে চলেছেন। এতদিন কত কেউ কত কথাই না বলল। সবার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।
তায়শার কাছে নিহিরের ছবি দেখে তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, সত্যি এই ছেলে তোরে পাত্তা দিছে? একদম রাজপুত্রের মতন।
তায়শা হেসে বলেছিল, আমার কাছে পাত্তা পাওয়ার জন্য ঘুরঘুর করছে।
.
আজ ছেলের চাচী এবং চাচাতো ভাই এই বাড়িতে আসবে তায়শাকে দেখতে। তাই তাদের জন্য আয়োজনের কোনো কমতি রাখছেন না আলিয়া খাতুন। দোকান থেকে হরেক রকমের মিষ্টি, নাস্তা, ফল তো এনেছেনই; নিজেও
পিঠে বানাতে ব্যস্ত। কোনোমতেই তিনি এত ভালো প্রস্তাব হাত ছাড়া করতে চান না।
এদিকে নিহির তাদের সাথে আসবে না শুনে তায়শার মন কিছুটা খারাপ হয়। কিন্তু নিহির বলেছে, তার চাচীর যদি তাকে ভালো লাগে পরেরবার সে নিশ্চয় আসবে কথা পাকাপোক্ত করার জন্য।
এটা শুনে তায়শার মন কিছুটা হলেও ভালো হয়। তবে নিহির থাকলে বিষয়টা তার জন্য অনেক সহজ হত। এর আগে কখনো নিহিরের চাচী বা ভাই এর সাথে তার দেখা হয়নি বলে কিছুটা নার্ভাস লাগছে।
তায়শা তৈরী হয়ে নেয়। হালকা গোলাপি রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে সে। নাফিশার কথাতে মাথায় ওড়না দিয়েছে। পাত্রের চাচী আসছে বলে কথা!
তৈরী হয়ে সেলফি তুলে নিহিরকে পাঠায় তায়শা। নিহিরের ইচ্ছে করছে তাকে সামনে থেকে দেখতে। চোখ জুড়ে, মন ভরে দেখতে! কিন্তু চাচী কি না কি মনে করেন! এই ভেবে সে যাওয়ার কথা আর বলতে পারলো না। কেনো যে চাচী তাকে সাথে নিচ্ছেন না। হয়তো এটা কোনো নিয়ম বা তার ইচ্ছে।
তায়শার ফোনে আশিকের কল আসে।
মেজাজটায় তার খারাপ হয়ে যায়। সে বিরক্ত হয়ে তার নাম্বারটি ব্লক লিস্টে রেখে দেয়। যদি অন্য নাম্বার থেকে বিরক্ত করে তবে সিমটায় খুলে ফেলবে সিদ্ধান্ত নেয়। এমনিতেও নিহিরের কাছে তার অন্য একটি নাম্বার আছে। তাই এটা বন্ধ রাখলেও সমস্যা নেই। এই ভেবে মোবাইলের দিকে বিরক্তভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তায়শা।
.
.
সেনোয়ারা বেগম গাড়ি ভর্তি নাস্তা আনিয়েছেন। তা দেখে নিখিল হেসে বলল, পুরা মিষ্টি আর ফলের দোকান তুলে আনলে না কি?
-পারলে সেটাই করতাম।
.
তারা বেরুনোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেনোয়ারা বেগমের শাড়ির কুচি অগোছালো হয়ে আছে। বুশরা তা খেয়াল করে বলল, আপনার শাড়ির কুচি অগোছালো। যদি কিছু মনে না করেন আমি ঠিক করে দিই?
.
তিনি নিচে তাকিয়ে দেখলেন বুশরা ঠিক বলছে। নিজ থেকে যেহেতু ঠিক করে দিতে চায়ছে দিক। এই ভেবে বলল, হুম।
.
বুশরা খুব গুছিয়ে তার কাজটা সম্পন্ন করলো। তাকে ধন্যবাদ জানায় সেনোয়ারা বেগম। নিখিল বলল, তুমি তো আমাদের সাথে যেতে পারো।
-এখন বেরুনোর সময় নেই আমার। তৈরী হতেই অনেক সময় লেগে যাবে।
-তোমাকে নরমালেই ভালো মানায়।
.
সেনোয়ারা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন, দেরী হয়ে যাচ্ছে। বেরুনো উচিত আমাদের।
.
নিহির এসে নিখিল কে বলল, ড্রাইভার কে এড্রেস আমি দিয়েছি। তোকেও বলছি। যাতে পৌঁছতে অসুবিধে না হয়।
.
নিখিল ঠিকানা নিতে যাবে ঠিক তখনি তার ফোন কল এলো। সে বলল, ভাইয়া একটু অপেক্ষা করো।
.
সে ফোন রিসিভ করেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকে কী হয়েছে তার জানার জন্য। নিখিল বলল, আমি এখুনি আসছি।
.
সে ফোন রেখে সবার উদ্দেশ্য বলল, সরি ভাইয়া আমি যেতে পারব না। আমার বন্ধু এক্সিডেন্ট করেছে। তার অবস্থা খুবই খারাপ। আমার ওখানে যাওয়া লাগবে।
-কোন বন্ধু?
-আমার বেস্ট ফ্রেন্ড শাকিল।
-ও আচ্ছা! তুই এখুনি চলে যা। বাইকে যাস না। গাড়ি নিয়ে যা।
-আচ্ছা।
.
এই বলে নিখিল ছুটে চলে যায়। নিহির সেনোয়ারা বেগমকে বলল, তোমাকে একা যেতে হবে এখন।
.
তার একা যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই মুহুর্তে বুশরাকে বলে নিজেকে ছোট করতেও মন চায়ছে না। তিনি বললেন, সমস্যা নেই। আমি সবটা ম্যানেজ করে নেব।
.
.
তায়শার বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই সেনোয়ারা বেগমের মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই এলাকায় অবশ্য এমন বাড়িই তিনি আশা করেছিলেন। বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের বাড়ির চারটে রুমের সমান হবে এই পুরো বাড়িটা৷ নিহির বলে তিনি এই বিষয়ে কিছু বলবেন না। কিন্তু নিখিলের জন্য যেনতেন ঘরের মেয়ে বউ করে তিনি আনবেন না।
মনে মনে এসব আওড়াতে আওড়াতে ভেতরে প্রবেশ করেন তিনি। তাকে দেখে আলিয়া খাতুন সালাম জানিয়ে সাদরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলেন। সেনোয়ারা বেগম কাউকে পাঠিয়ে গাড়ি থেকে বাক্স গুলো নামাতে বললেন। আলিয়া খাতুন এতই অধৈর্য ছিলেন যে, তিনি নিজেই গাড়ির দিকে ছুটে গেলেন সেনোয়ারা কী এনেছেন তা দেখার জন্য। সেনোয়ারা কে একা রেখে তিনি বাক্স গুলো এনে তা খুলে দেখতে লাগলেন। এসব দেখে তার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। তার সাথে যোগ দেয় তায়শাও। সে এত দামী মিষ্টি দেখে লোভ সামলাতে পারলো না। খেতে শুরু করলো। নাফিশা এসে মা বোনের এসব কাণ্ড দেখে ধমকের সুরে বলল, মেহমানকে বসিয়ে রেখে তোমরা এসব নিয়ে পড়ে আছ? কী ভাববেন উনি!
.
এতক্ষণে আলিয়া খাতুনের হুশ হলো। তিনি নাফিশাকে নাস্তা রেডি করতে বলে ছুটে গেলেন। এসেই বললেন, দুঃখিত৷ আসলে আমি একা মানুষ তো৷ সবটা সামলাতে হয় নিজেকেই।
-মেয়েরা কী করে?
.
এই প্রশ্ন শুনে মিথ্যে হাসি দিয়ে আলিয়া খাতুন বললেন, ওরা করতে চায়। আমিই দিইনা৷ বড় আদরে রেখেছি ওদের। কোনো কাজই পারে না। এই বিষয়ে যে বোন আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। অবশ্য এত বড় ঘরের মানুষ আপনারা। নিশ্চয় কাজের লোক আছে?
-বেশ কয়েকজন আছে। তবুও আমি নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করি। প্রত্যেকেরই এটা উচিত বলে আমি মনে করি।
-কাজের লোক না থাকলে অন্য কথা! এত টাকা দিয়ে ওদের রেখে আবার নিজে করার দরকার কী?
-সেটা আমার ভালো লাগা থেকেই করি।
.
আলিয়া খাতুন এই বিষয়ে আর এগুলো না। বুঝতে পারলেন, ছেলের মা অসুস্থ হওয়াই চাচী বাড়ির মালকিন হয়ে বসে আছে।
একবার বিয়েটা হয়ে যাক, তায়শা হবে সেই বাড়ির মালকিন। তার কথাতেই এই চাচীকেও উঠা বসা করতে হবে। কোনোমতে বিয়েটা করিয়ে দিতে পারলেই হয়।
সেনোয়ারা বেগম বললেন, মেয়ের বাবা কোথায়?
-দোকানে আছে। আসলে কিছু সময় দোকানে না থাকলেও লোকসান হয়৷ আর তিনি একেবারেই অলস হয়ে থাকতে পছন্দ করেন না।
-দোকান বলতে?
-তার মুদি দোকান আছে। ওখানেই আছে।
.
শেষমেশ মুদি দোকানদারের মেয়েকে পছন্দ করলো নিহির! তার চেয়ে ঢের ভালো তো ওই বুশরা ছিল।
সেনোয়ারা বেগম খানিকটা বিরক্তি নিয়েই বললেন, মেয়েকে ডাকুন।
.
নাফিশা এসে নাস্তা গুলো রেখে যায়। আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি আলিয়া খাতুন। কিন্তু সেনোয়ারা বেগম কিছুই মুখে তুলছেন না। তার মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। একটু বাদে নাফিশার সাথে তায়শা আসে। তায়শা কে দেখে তার মন কিছুটা হলেও ভালো হয়। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘মাশাআল্লাহ’ শব্দটি।
এখন বুঝতে পারছে, কেনো নিহির এমন একটা পরিবেশের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।
তিনি শুনেছেন, ছেলেরা পড়াশোনা করে টাকা কামাই করে একটা সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করার জন্যে।
নিহির হয়তো সেই নীতিটায় অনুসরণ করেছে।
তায়শার সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগলো সেনোয়ারার। তিনি তায়শার জন্যে আনা চেইনটা তার গলায় পরিয়ে দেন। এরপর আলিয়া খাতুনকে বললেন, নিহির যেহেতু আগেই ওকে পছন্দ করেছে এর উপরে কোনো কথা থাকতে পারে না। আপনাদের সাথে হয়তো নিহিরের দেখা হয়নি?
-জি না! বাবাজিকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে।
-তবে কাল ওদের এনগেজমেন্ট করিয়ে দিই?
.
কালই এনগেজমেন্ট এর কথা শুনে আলিয়ার চোখেমুখে অন্ধকার নেমে আসে। এত কম সময়ে এত আয়োজন কীভাবে করবে?
সেনোয়ারা বেগম তার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, বড় কোনো আয়োজন নয়। পারিবারিক ভাবে এনগেজমেন্ট টা হবে। সেই আয়োজনটা আমিই করব। আপনারা শুধু উপস্থিত থাকবেন। আমাদের ঘরের সদস্য আর আপনাদের, এছাড়া আর কেউ নয়।
.
এই বলে তিনি উঠে পড়লেন। তায়শার কাছ থেকে তার আঙুলের সাইজ জিজ্ঞাসা করে বললেন, আজ আসি। কাল দেখা হবে।
.
তাকে বাড়িয়ে দিতে যায় নাফিশা। আলিয়া খাতুন তায়শাকে বললেন, বড়লোকের বড়লোকি কারবার আরকি। আবার এনগেজমেন্ট এর কী দরকার? বিয়েটায় এভাবে করিয়ে নিয়ে গেলে হত না?
.
তায়শা বিরক্ত হয়ে বলল, উফফ মা! কালকের জন্য সব গুছিয়ে রাখো এত কথা না বলে।
.
.
আজ নিহির অফিসে যায়নি। সেনোয়ারা বেগম বাড়ি ফিরতেই সে তার পাশে এসে বসলো।
মায়ার কাছ থেকে এক গ্লাস পানি পান করে তিনি বললেন, মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে।
-সত্যি?
-হু। কিন্তু…
-কি?
-মেয়ের পারিবারিক অবস্থা ভালো না। তাছাড়া আমাদের সাথে ওরা মেলেনা। এই বিষয়টা মাথায় রেখেই তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
-তাহরিমা তো আমায় এতকিছু বলেনি। অবশ্য আমি জিজ্ঞাসাও করিনি।
-ওর বাবা মুদি দোকানদার। জানোনা তুমি?
.
নিহির অবাক হয়ে বলল, তাই?
-হ্যাঁ।
.
তাহরিমা যেভাবে চলে, তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাদের অবস্থা এত ভালো না। তাহরিমার কথাবার্তায় এসব মনেও হয়নি। তাহরিমা নিজেকে অন্যভাবে প্রেজেন্ট করে কেনো? এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে নিহির।
সেনোয়ারা বেগম বললেন, মেয়ের মাকেও এতটা ভালো আমার লাগেনি। তার মেয়ে না কি কোনো কাজই করতে পারবে না। আমরা যেন তাকে কাজ করতে আনছি!
.
নিহির বলল, মেয়েকে ভালোবেসে বলে ফেলেছেন হয়তো।
-কি জানি। যাই হোক, তুমি যখন এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। আমি আর কিছু বলব না৷ আজ সুন্দর থেকে একটা রিং নিয়ে এসো। কাল তোমাদের আন্টি বদল হবে।
.
নিহির মুখে হাসিয়ে ফুটিয়ে বলল, তাই!
-হু। দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত থাকব আমরা। এতটুকুই। আসলে আমি চাচ্ছিলাম নিখিলের জন্মদিনটা ধুমধাম করে করব। সেদিন তোমাদের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করব।
.
নিহির এতেই খুশি হয়ে যায়। কিন্তু দূর থেকে এসব শুনে ভালো লাগলো না বুশরার। নিখিলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ধুমধুমভাবে হতে পারলে, নিহিরের এনগেজমেন্ট কেনো নয়? সেনোয়ারা যে দু’জনের মাঝে তফাত করে, এটা নিহির বোঝে না?
.
চলবে
.