#সাহেব_বাবুর_বউ – [০১]
মাথার উপর শীতল তরল কিছু অনুভব করতেই পাশ ফিরে তাকায় নূরি। সামনে জ্বলজ্বল দুটি চোখ দেখেই দৃষ্টি তার ক্ষুদ্ধ হয়ে যায়। রাগে কটমট করে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি বুঝতে পারলো মাথা থেকে মুখের উপর পড়ছে সেই তরল পদার্থটুকু। হাতটা কপালে রেখে সেটা দেখে বুঝতে পারলো তার মাথায় রং ফেলা হয়েছে। সাদা লাল হলুদ নীল গোলাপী নানা রংয়ের মিশ্রন করে সেটা পানিতে মিশিয়ে নূরির মাথায় ঢেলে দেওয়া হয়েছে। রাগে দুঃখে অপমানে নূরি সামনে থাকা লোকটার কলার চেপে ধরে বলে,
” কেন এত বাড়াবাড়ি করছো আমার সাথে? কি চাই কি তোমার। আমাকে পছন্দ করো না বলে যখন খুশি অপমান করবে! এই কলেজে তোমার এত রোয়াবগিরী চলবে না। আমি সেটা মেনে নিবো না। তোমাকে সহ্য করছি কারন রানিমার জন্যে। আর শুনো রানীমা আর বড় সাহেবকে ছাড়া না তোমার কোন মূল্যই নেই নগরপাড়ায়। ইউ আর নাথিং। তুমি আর তোমার এই গ্যাং, খামখেয়ালি গ্যাং! এই শুনো তোমাদের গ্যাং এর নামটা চেঞ্জ করো। খামখেয়ালি না রেখে ডেঞ্জারাস রাখো ওটাই তোমাদের সাথে যায়। তোমরা প্রত্যেকে এই নগরপাড়ায় টিকে আছো শুধু মাত্র রানীমার জন্যে।” অন্যথায় তুমি আনকালচার, ডেঞ্জারাস ভ্যাগাবন্ড।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করলো নূরি। এতক্ষণে তার খেয়াল হলো সামনে থাকা লোকটার অক্ষিদ্বয় লাল আভায় পরিপূর্ণ। হিংস্র বাঘের মতো ক্ষেপে উঠেছে। পাত্তা দেয়না নূরি। গত একটা বছর যাবৎ ঝালাচ্ছে। সবগুলো পয়সাওয়ালা বাপের বখে যাওয়া ছেলেমেয়ে। তারপর সন্তর্পণে সেখান থেকে প্রন্থান করে। রেগে গেছে যাক। একবারের জন্যেও পিছনে ফিরে তাকায়না সে। নূরির চলে যাওয়ার পর ছেলেটা রংয়ের বালতিতে লাথি মেরে সবটা ফেলে দেয়। রাগে ক্ষোবে পাশে বেঞ্চে বসে পরে। বলতে থাকে,
” আমাকে অপমান, সামান্য ম্যানেজারের মেয়ে হয়ে আমাকে অপমান করে। উঠে দাঁড়ায় সে তারপর বলে, আমাকে রাগিয়ে তুমি ঠিক করলে না নূরি। জমিদার বাড়ির ছোট জমিদার এই আহনাফ চৌধুরী আমি। আমার সাথে উচু গলায় কথা বলার ফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে।”
ভৌগলিক অবস্থানের দিকে থেকে বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ। এই দেশের অভ্যন্তরের ছোট্ট একটি শহর টাংগাইল। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য টাংগাইলকে এক বিশেষ ঐশ্বর্য দান করেছে। উত্তর ও পূর্বে প্রাচীন লালমাটির উঁচু ভূমির ধ্যানমগ্ন পাহাড়। তার মধ্যে নানা উপজাতি লোকের বিচিত্র জীবন যাপন, গজারী, গামার, কড়ি, মেহগনি বৃক্ষরাজির সারি অনন্তকাল যাবত নামাজের জামায়াতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে সমতল ভূমি, তার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ছোট ছোট আঁকা বাঁকা নদী। পশ্চিমদিকে দুরন্ত যৌবনা বিশাল যমুনা নদী। নদীর মধ্যে মধ্যে অসংখ্য নতুন নতুন চর। চর তো নয় যেনো দুধের সর। সেখানে কূলে কূলে শিশুদের খেলা ঘরের মতো নিত্য নতুন নতুন ঘরবাড়ি নতুন জীবন। এ যেনো প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে বিজয়ী মানুষের উড্ডীন রাঙা পতাকা। এই শহরেই অবস্থিত একটা ছোট্গ্রাম নগরপাড়া। এখানেই অবস্থিত একটা জমিদার বাড়ি। সময়ানুক্রমিক ও বংশপরম্পরায় এখনো টিকে আছে এই জমিদার বাড়ি। তবে এতে ছোঁয়া পেয়েছে আধুনিকতার। সেই সাথে পেয়েছে নগরের ছোঁয়া। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই এখানে গড়ে উঠেছে স্কুল কলেজ হসপিটাল মসজিদ মন্দির। এখানকার তাঁতের শাড়ি দেশ বিদেশে সনামধন্য। জমিদার বাড়ির কর্তা সে এখনো গ্রামের মাথা, গ্রামবাসীর কাছে সে বড় সাহেব হিসাবে খ্যাত আর কর্তাগিন্নি রানীমা। বড় সাহেব আর রানীমার কোন পুত্র সন্তান নেই। উনাদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে আহনা আর ছোট মেয়ে মোহনা। বড় সাহেব টাংগাই শহরে একটা নতুন শো-রুম খুলবেন তার জন্যে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইঞ্জিনিয়ার ডেকে পাঠান। তবে তার ডাকে কোন বাঙালি আসে নি। এসেছিলো অক্সফোর্ডের এক ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার স্যামুয়েল। বাংলার মাটিতে পা রেখে স্যামুয়েল প্রেমে পড়ে বড় সাহেবের মেয়ে আহনার। সুদর্শন স্যামুয়েলের প্রেমকে প্রত্যাখ্যাত করেনি আহনা। সাড়া দিয়েছিলো তার প্রেমে। ঘটনাটা বড় সাহেবের কানে আসতেই বড় সাহেব শর্ত দেন, তার মেয়েকে যে বিয়ে করবে তাকেই ঘর জামাই থাকতে হবে। স্যামুয়েল তাতেই রাজি হয়ে যায়। শুভ পরিণয় পায় তাদের সম্পর্ক। আহনা আর ইংরেজ বাবু স্যামুয়েলের সন্তান আহনাফ। বাঙালি মা আর ইংরেজ বাবার সবটুকু গঠনে যেন তৈরী আহনাফ। দুধসাদা গায়ের রংয়ের নীল চোখের মনির ঘন নেত্রপল্লবের চোখদুটি দেখলে মনে হয় এ যেন এক ইংরেজ সাহেব। ছোটবেলায় আহনাফের বন্ধুরা ওকে সাহেব বাবু বলে ডাকতো। আহনার ছেলেবেলার বন্ধু রবিন ছিলো জমিদার হউজের একজন বিশ্বস্ত কর্মচারীর ছেলে। স্কুল পাশ করার পর রবিন শহরে চলে যায় আর সেখানে পড়াশুনা শেষকরে একটা কোম্পানির চাকরি করে। শহরের সনামধন্য এক ব্যবসায়ীর মেয়ে নিতু প্রেমে পড়ে রবিনের। নিতুর পাগলামি, রবিনের প্রতি নিতুর ভালোবাসা বাধ্য করে রবিনকে নিতুর প্রেমে পড়তে।নিতু পরিবারের সকলের অবাধ্য হয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় রবিনকে। রবিন ও নিতু বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। বছর যেতে না যেতেই তাদের কোল আলো করে আসে একটা কন্যা সন্তান। রবিন তার কন্যাকে দেখা মাত্রই তাকে নূর বলে সম্বোধন করে। নূর নামটা নিয়ে নিতুর একটু অভিযোগ ছিলো, ওদের মেয়ের নাম নূর কেন হবে? নূর তো ছেলেদের নাম তাহলে নূরি কেন নয়। নিতুর কথা শুনে রবিন হেসে বলে, “আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার, ঠিক আছে আমার নূর মামনি এখন থেকে না হয় নূরি হবে। তবে হ্যাঁ আমি ওকে নূর বলেই ডাকবো।”
“সে তুমি যা খুশি ডাক। গাল ফুলিয়ে বলে উঠেছিল নিতু।” রবিন একগাল হেসে নিতুর গাল টিপে দিয়ে বলেছিল, ” অভিমানী নিতু আমার।” লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলো নিতু। নূরির বছর ঘুরতে না ঘুরতেই খবর আসে রবিনের বাবা অসুস্থ। খবরটা শুনে রবিন তার মেয়ে ওর বউকে নিয়ে চলে আসে নগরপাড়ায়। সেদিন-ই বড় সাহেব ডেকে পাঠায় রবিনকে। পরেরদিন রবিন স্বপরিবারে জমিদার বাড়িতে যায়। আহনা নূরিকে দেখা মাত্রই নূরির গলার সোনার চেইন পড়িয়ে দেয়। চার বছরের ছোট্ট্ সাহেব দৌড়ে এসে নূরিকে কোলে তুলে নেয়। নূরির গুলোমুলো চেহারা দেখে সাহেব বলে উঠে, ” এই জ্যান্ত পুতুলটা কি আমার মম। আজ থেকে এটা আমার কাছে থাকবে। আমার জ্যান্ত পুতুল।” ছোট্ট সাহেবের কথায় সেদিন সকলে হেসেছিলো। পরে বড় সাহেব রবিনকে তাদের কোম্পানির ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করেন। এরপর থেকেই রবিন থেকে যায় নগরপাড়ায়।
বড় সাহেব আর রানিমা নিজেদের ঘরে বসে কথা বলছেন। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি, কাঁধে বড় চাদর শরীরে মুড়ানো আর গলায় সোনার চেইন। এ যেন সেই পনেরো শতাব্দীর কোন এক জমিদার। রানিমাও কম কিসে, লাল সাদা তাঁতের কাপড়, গায়ে ভারী গহনা আর মাথায় আধো ঘুমটা। দুজনে কথায় ব্যাস্ত আর এমন সময় ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করে নূরি। রানিমার কোলে মুখ গুজে শ-শব্দে কেঁদে উঠে। রানীমা জানেন নূরি কেন কাঁদছে, অসহায় মুখ করে বড় সাহেব আর রানীমা নূরির তাকিয়ে রইলো। রানিমা নূরির মাথায় হাত বুলাচ্ছে তখন নূরি বলে উঠলো,” আমি কি খুব খারাপ রানীমা, কেন সবাই আমাকে ছেড়ে চলে চায়। জানো রানীমা, আজ আমি তোমার সাহেবকে কথা শুনিয়েছি। বলেছি ও এই নগরপাড়ার কিছু নয়। ” নূরির কথা শুনে রানীমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরে।
বাড়ি ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে যায় আহনাফ। মহলে প্রবেশ করার মুখে দিবার সাথে একবার দেখা হয়েছিল আহনাফের। দিবার মুখেই শুনলো আর নূরি এসেছিলো। নানিমার ঘরে বসে নাকি খুব কাঁদছিলো। দিবাকে আর কোন প্রশ্ন করে না আহনাফ। সোজা নিজের ঘরে চলে আসে। দেয়ালে টানানো ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রানীমা বলেছে এটা নাকি আহনাফ আর নূরির ছোটবেলার ছবি। যেখানে স্পষ্ট, আহনাফ নূরির বেনুনী ধরে টানছে আর নূরি কাঁদোকাঁদো মুখ করে চোখ উল্টিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আহনাফ। সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগে ওর কাছে। ছোটবেলা বলতে কিছুই জানে না আহনাফ। সকলের কাছে নূরি পূর্ব পরিচিত আর আহনাফের কাছে এক বছরের পরিচিত নূরি। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর থেকেই নূরিকে চেনে সে। তাহলে কি আহনাফের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। সেটা কেন হবে, ইংরেজ পিতার সন্তান ইংরেজদের মতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধি অসাধারণ মেধা তার। এই নগরপাড়ার উত্তরসূরি আহনাফ চৌধুরী। দরজার টোকা পরতেই ভাবনার ছেদ ঘটে আহনাফের। দিবা এসেছে। দিবা আহনাফের খালা মোহনার মেয়ে। বড় সাহেব মোহনাকে নিজ গ্রামে বিয়ে দেন। দিনের বেশীরভাগ সময় তারা জমিদার বাড়িতেই কাটায়। মোহনার দুই মেয়ে দিপা আর দিবা। দিপা পড়ে ক্লাস এইটে আর দিবা ফোরে। দিবা ঘরে ডুকেই বলল, ” নানি তোমাকে ডাকছে ভাইয়া? ”
” আসছি।” বলে ওয়াশরুমে চলে যায় আহনাফ। দিবা ফটোটার দিকে একপলক তাকিয়ে চলে যায়।
আহনাফ রানীমার ঘরে ডুকতেই দেখে রানীমার বিষণ্ণ মুখ। অব্যক্ত কিছু যন্ত্রনা ছেয়ে আছে রানীমার চোখ মুখে। আহনাফ ব্যাস্ত হয়ে রানীমার পাশে বসে বলে, ” তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে নানী। আমি ডক্টর মামাকে কল করছি।”
” তার কোন প্রয়োজন নেই আহনাফ, আমি ঠিক আছি। আগে বল নূরির মাথায় কেন রং ঢেলে দিয়েছো?”
” নালিশ করতে এসেছিলো তাহলে!”
” নূরিকে আমি ডেকেছিলাম, তোমার নামে নালিশ করতে ও এখানে আসে না কখনো।” দেখো নানুভাই এভাবে সারাদিন ঘুরেফিরে তোমার দিন চলবে না। তোমাকে যে চৌধুরী মহলের দায়িত্ব নিতে হবে। এতগুলো তাঁতের মিল আবার শো-রুম এগুলোর সব দায়িত্ব যে তোমাকেই নিতে হবে।তোমার নানার তো বয়স হচ্ছে তাই না। এখন তুমি আমাদের শেষ ভরসা সেই তুমি যদি এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেফিরে মেয়েদের উত্তেক্ত করো, হেলায় ফেলায় সময় নষ্ট করো তাহলে কে দায়িত্ব নিবে এই মহলের।”
” আমার এসব-ই ভালোলাগে।”
” তাই বললে কি চলবে?”
” কেন চলবে না। তুমি আর নানাভাই তো আছোই তোমরা সামলে নিবে। আমি এলাম বুঝলে।” এই বলে আহনাফ চলে আসে নিজের ঘরে।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।