#সময়ের_পালাবদল
শামসুল ইসলাম
পর্বঃ- ৬
.
তাহেরাকে ক্ষতি করার জন্য কফিল ও লালমিয়া গোপনে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আঁকে।
আব্দুল মজিদ মারা গেছে গত দুদিন হলো! গ্রামের অনেকে জানালো তাঁরজন্য দুপাঁচ জন লোকজন ডেকে একটু খাচ মিলাদ পড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
তালহা অকপটে নিষেধ করলো, এসব করা বিদাআত। এককথায় মৃত ব্যক্তির জন্য মিলাদ কিয়াম, চল্লিশে ইত্যাদি এসব বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ তৈরি করে গেছে। বিশ্বের অনেক দেশে এসব নেই, আর মিলাদ সর্বপ্রথম তৈরি হয় ইরাক থেকে। রাসুল সাঃ মৃত্যুর ৬০০ বছর পর এর আবিস্কার, আর কিয়াম রাসুল সাঃ মৃত্যুর ১০০০ বছর পর্যন্ত কিয়াম সম্পর্কে কেউ কিছু যানতেন না।
এসব কুপ্রথা কুসংস্কার আমাদের মাঝে ইহুদি খৃষ্টান ও ভিন্ন ধর্ম থেকে এসেছে, আমরা বাঙ্গালী আবেগী যা পায় যাচাই ছাড়া গ্রহন করি।
তো যাইহোক, তালহা একদম নিষেধ করে দিল এসব কিছু করা যাবেনা।
এদিকে হাসু কফিল ও লালমিয়ার মাথায় শইতানি বুদ্ধি গিজগিজ করছে কিভাবে তাহেরার ক্ষতি করা যায়! কিন্তু তালহা থাকতে মনে হচ্ছে তাহেরাকে ঘায়েল করা অসম্ভব হয়ে যাবে।
হাসু কফিল মিয়াকে বললো-
« আপনার কথামত আব্দুল মজিদকে খুন করলাম, তাঁর সম্পদ পেলাম কিন্তু মেয়ে তো পেলাম না। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করুন আমার সাথে বিয়ে দেওয়ার।
কফিল মিয়া হাসুর পিঠে হালকা থাপ্পড় মেরে বললো-
« এতো অধৈর্য হলে হবে! আব্দুল মজিদ মারা গেলো দুদিন হলো। এখনি এসব করতে গেলে ফেঁসে যাবে, সাথে আমরা সমাজের চোখেও ধরা খেয়ে যাবো। কয়েকটি দিন যাক তখন সব দখল করে দিব।
এভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো তাঁদের, আব্দুল মজিদের হত্যাকারীদের সনাক্ত করা সম্ভভ হলো না।

আব্দুল মজিদ মারা গেছেন আজ ১৫ দিন হলো! এর ভিতরে তাহেরা বাবা হারানোর শোকে দুমড়ে মুচড়ে গেছে।
তালহা তাঁদের সমস্তরকম খোঁজখবর নেই, এবং বাজারঘাট সহ অন্যান্য কাজকাম করে দেই।
হাসু গরুছাগল ও মাঠের দিকে খেয়াল রাখে, কিন্তু তাঁর মনের ভীতরে সবসময় ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। একদিকে আব্দুল মজিদের খুন ধামাচাপা ! অন্যদিকে তাহেরাকে পাওয়ার চিন্তাই তাঁর মাথা নষ্ট।
ইদানীংকাল তালহা হাসুর দিকে ভালো দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না, হাসু এটা লক্ষ্যকরে।
হঠাৎ একদিন তালহা হাসুকে জিজ্ঞেস করলো-
« আচ্ছা হাসু! আমার মনের ভিতরে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, আশা করি তুমি উত্তর দিতে পারবে।
হাসু একটু অবাক হয়ে!
« কি প্রশ্ন?
« চাচাজান যেদিন মারা যান সেদিন এশার সালাত পড়ে তোমার সাথে দেখা করতে যায়, কিন্তু তাঁর পরে থেকে চাচাকে আর পাওয়া যায়নি। বলো সেদিন তোমাদের মাঝে কি কথা হয়েছিল?
তালহার মুখে এমন কথা শুনে হাসুর গলার পানি শুকিয়ে যায়! ভীত বিহ্বল হয়ে বললো-
« না-আ, সেদিন কথা বলার পর চাচাজান পুকুরপাড়ের দিকে যায়, আমি ঘরেই ছিলাম। আমি কিছু যানিনা, চাচাজান কিভাবে মারা গেলো।
« হাসু নিজেকে চালাক ভেবনা! আমার পরিস্কার মনে পড়ছে, তুমি চাচাকে ডেকে পুকুরপাড়ের দিকে নিয়ে গেছিলে।
হাসু কোনো কথা না বলে দ্রুতপায়ে চলে যেতেযেতে বললো-
« যায়! চরে গরু বাঁধা আছে, তাঁদের পানি খাওয়াতে হবে। যে রৌদ্রতেজ তাতে গরুর নাজেহাল অবস্থা।
তালহা হাসুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো-
« যাইহোক হাসু! তুমি কিন্তু পরিস্কার ভাবে বললে না ব্যাপারটা, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকলাম যখন বাড়ি ফিরবে তখন আবার জিজ্ঞেস করবো। যতোক্ষন না জানতে পারছি ততক্ষণ না শান্তি পাচ্ছি।আর তোমাকে সন্দেহ মুক্ত করতে পারছিনা।

হাসু গ্রামের অন্যদিক দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কফিল মিয়ার বাড়িতে পৌঁছাল। তাঁর বাড়ির পাশে যেয়ে দৌড়ানোর গতি স্বাভাবিক করে তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করলো।
প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো কালো একটা যুবতী কুমারী মেয়ে! মেয়েটির গাঁয়ের রং কালো হলেও গঠন আকৃতি অনেক সুন্দর। চোখদুটিতে মায়াবী যাদু করা, যে কোনো পুরুষ দেখে চোখের মায়াজালে আটকে যাবে।
কফিল মিয়ার বাড়িতে ইতিপূর্বে হাসু কখনোই আশার প্রয়োজন পড়েনি, কারন হাসু তাঁর চিরশত্রু আব্দুল মজিদের লোক।
অনেকক্ষণ দাড়িয়ে ভাবলো হাসু কাকে ডাকবে! বাড়ির সবায় অপরিচিত মনে হয়।
হাসু সাহস করে মেয়েটিকে বললো-
« এটা কফিল চাচার বাড়ি না?
মেয়েটা রাগান্বিত স্বরে বললো-
« কফিল মিয়ার বাড়িতে প্রবেশ করে আবার নাম জিজ্ঞেস করেন! ভারি বেখাপ্পা লোক যে আপনি?
« আসলে দুঃখিত ইতিপূর্বে কখনো আশা হয়নি তাই চিনতে পারছিনা। যাইহোক চাচা কোথায়?
« বাবা দক্ষিণ মাঠে গেছে।
« ওহ্ আচ্ছা আশি তাহলে।
কথাটি শেষ করে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যাবে এমন সময় মনের ভীতরে কি উদয় হলো হাসুই ভালো জানে। ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
« আসলে আপনার নামটি কি?
মেয়েটির রাগ হচ্ছে হাসুর ওপর! তা পরিস্ফুট বুঝা যায়, তবুও শান্তমনে অশান্ত ভঙ্গিতে বললো-
« হাসি!
হাসু মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো-
« যাগগা! আপনার সাথে আমার নামের খুব মিল আমার নাম হাসু।
নামটি বলেই হাসু আপন উদ্দেশ্যে দ্রুতপায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।

কফিল মিয়িকে দক্ষিণ মাঠে পাওয়া গেলো, হাসু হাঁফাতে হাঁফাতে বললো-
« আমাদের জন্য চরম দুঃসংবাদ!
« কিহ্, কিসের দুঃসংবাদ!
« তালহা মনে হয় ব্যাপারটা বুঝেগেছে, হত্যাকারী আমি। নানান রকম উদ্ভট প্রশ্ন করেছে, নিরুপায় হয়ে ছলচাতুরী করে সেখান থেকে এসে মনে হচ্ছে প্রাণে বাঁচছি।
কফিল মিয়া বেশ খানিক চুপকরে থেকে বললো-
« আজ রাতে তালহাকে গ্রাম ছাড়া করবো প্রস্তুত থেকে।
দুজনে তাঁদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় শলাপরামর্শ করে নিল, দুজন দুদিকে চলে গেলো।
সন্ধ্যা হলো তালহা মাগরিবের সালাত পড়িয়ে বাড়িতে ফিরলো, খেয়াল করলো আজ কিছু অপরিচিত লোকের আনাগোনা পাচ্ছে।
এভাবে এশার সালাত পড়িয়ে তাঁর ঘরে এসে বসলো, খাবার খাবে এমন সময় রুবি হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বললো-
« বাবা তালহা, আজ কেন যেন আমার ভয় হচ্ছে, দ্রুতবেগে খেয়ে বাড়ির দিকে এসো।
« আচ্ছা এখনি আসছি ইনশাআল্লাহ্‌।
তালহা রাতের খাবার না খেয়েই তাহেরাদের ঘরের দিকে পা বাড়ালো, সেখানে যাওয়ার পথে কয়েকজন মানুষের অন্ধকারে ছায়া দেখতে পেলো। তাঁর মনের ভীতরে সন্দেহ ও ভীতি সঞ্চার হলো, না জানি কি হয়। আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে হাটা শুরু করলো।
বাড়িতে পৌঁছে রুবিকে ডাক দিলো-
« চাচিমা কোথায় আছেন?
« এইতো বাবা তাহেরার ঘরে, তুমি ভিতরে আসো।
« না থাক আমি বারান্দায় বসে থাকছি।
« বাবা কিছু মনে করনা, আমার ভয় হচ্ছে খুব। তুমি সংশয় না করে ঘরের ভিতরে এসে বসো আমরা সবায় আছি।
নিরুপায় হয়ে তালহা ঘরে প্রবেশ করলো, ঘরে প্রবেশ করে অবাক হলো! সবার মুখে ভীতির ছাপ।
রুবি বললো-
« বাবা তালহা যুবতী মেয়ে ঘরে আমার, সাথে গত ঘটনায় সব উলটপালট হয়ে গেলো। আগামী কালই তোমাদের বিয়ে দিব, আমার খুব ভয় হচ্ছে শত্রদের প্রতি।
বিয়ের কথা শুনে তাহেরা লজ্জাই মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললো, তালহাও বেশ লজ্জা পেলো তবুও বললো-
« জ্বি চাচিমা, কোনো আপত্তি নেই। যা ভালো মনে করবেন সেটাই গ্রহন করবো ইনশাআল্লাহ্‌।
« ঠিকআছে বাবা একটু অপেক্ষা করো আমি সরিষার তেল আর কাচা মরিচ পিয়াজ দিয়ে মুড়ি মুখিয়ে আনি, তুমি না খেয়েই চলে এসেছো।
দুজনের একই ঘরে বসে থাকার কথা শুনে তালহার বুকের ভীতরে ধুকধুক করে উঠালো। রুবিকে বললো-
« না না চাচিমা সমস্যা নেই আপনি থাকুন বসে।
রুবি একরকম জোরজবরদস্তি করে বাইরে চলে গেলো।
তালহা তাহেরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
« কেমন আছো?
তাহেরা লাজুক বন্দুকের মত উত্তর দিলো-
« জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
কথাটি বলে মাথা নিচু করলো।
দীর্ঘক্ষণ চুপ তাহেরা কথা বলেনা, তালহা তাহেরাকে বললো-
« আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না?
তাহেরা লজ্জামাখা কণ্ঠে বললো-
« আপনি কেমন আছেন তা আমি জানি! তো এতো শুকিয়ে গেছেন কেন?
তালহা উত্তর দিতে যাবে এমন সময় বাইরে থেকে শব্দ এলো-
« তালহা বাইরে এসে, ডাকাত দল এসেছে মনেহচ্ছে ?
তালহা দ্রুতপায়ে দরজার দিকে ছুটলো! কিন্তু হঠাৎ তাঁদের ঘরের দরজা বন্ধ।

কফিল মিয়া লালমিয়াসহ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গগন এক বিচারের সভা ডেকেছে, এখানে তালহা ও তাহেরাকে বদ্ধ ঘরে কুকর্মের দায়ে তাঁদের বিয়ে দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয় মাতব্বর বর্গরা।
সাথে তালহাকে জুতার মালা পরানো হয় গলাই, ইমামতি থেকে বাদদেওয়া হয়।
এসব হলো কফিল মিয়ার কুপরামর্শে, রুবি যখন মুড়ি আনতে বের হয় তখন কফিল মিয়া তাকে ধারালো দা দ্বারা জীবননাশের হুমকি দিয়ে জিম্মি করে, ওদিকে তালহা তাহেরার ঘরে তালা দিয়ে আটকে ফেলে।
হাসু আপত্তি করলে কফিল মিয়া তাঁর মেয়ে হাসির সাথে বিয়ের ও সম্পদ ভোগের প্রলোভন দিয়ে তাঁকে দমিয়ে রাখে।
গ্রামের সকলকে হাসু জাল দলিল দেখায়, আব্দুল মজিদ সমস্তরকম সম্পদ হাসুর নামে লিখে গেছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত হওয়ার জন্য অকপটে সবায় মেনে নেই, আর যারা গ্রামের মোড়ল মাতব্বর তাঁদের অর্থকড়ি দিয়ে পকেট ভরে দেই।
এভাবে অপমান অপদস্থ করে তাহেরা আর তালহাকে, তাঁদের সাথে আব্দুল মজিদের দুই স্ত্রীকে গ্রাম থেকে নির্বাসন করে দেই……
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here