#সময়ের_পালাবদল
শামসুল ইসলাম
পর্বঃ- ৫
.
হাসুর মাথা নষ্ট!
দিনদিন বাড়ছে বুকে চাঁপা কষ্ট!
সম্পদের লোভে হাসুর জীবন অতিষ্ঠ!
হাসু আর স্থির থাকতে পারলো না, দিন ঘনিয়ে আসছে। সামনের মাসে তালহা আর তাহেরার আকদ সম্পন্ন হবে, সেই সব ব্যস্ততায় আব্দুল মজিদ তাঁর সাংসারিক কাজকর্ম ও মাঠের চাষাবাদ সব কিছু দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করে হাসুর উপরে।
হাসু আব্দুল মজিদের শত্রুপক্ষের সাথে গোপনে নীলনকশা আঁকে, যা বাস্তবায়নের জন্য কিছু অর্থকড়ি গচ্ছা যাবে। হাসু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনি মটেই! কারন, তাঁর কিছু সম্পদ দিয়েছে আব্দুল মজিদ মানবতার খাতিরে। সেটা থেকে টুকটাক চাষাবাদ যা করে তা থেকে সে ফসল বিক্রি করে অর্থ সঞ্চয় করে। মোটামুটি বাৎসরিক অনেক অর্থ হাতে আসে হাসুর।
হাসু সেদিন রাতে কফিল মিয়া ও লালমিয়ার সাথে একটা চুক্তি করে আব্দুল মজিদের জীবন নাশের, তাঁর জন্য বেশ অনেক অর্থকড়ি খরচা হবে।
হাসু তাঁদের প্রতিশ্রুতি দেই, এসব নিয়ে ভাবতে হবে না! তোমরা কাজে বাস্তবায়ন করো আর্থিক দিকটা আমি দেখছি।
হাসু কালসাপের রুপ ধারন করেছে, মনের ভিতরে সম্পদের লোভে তাকে ক্রমাগত চিবোচ্ছে। প্রথমদিকে তাহেরার রুপ লাবণ্যে বিমোহিত ছিলো, এখন সেটা হাসুর মনে উবে গেছে। এখন একটাই নিশানা! আব্দুল মজিদের সম্পদ, মনের ভীতরে এসব ইচ্ছা জাগ্রত হওয়ার সবথেকে বড়ো কারন হচ্ছে আব্দুল মজিদের শত্রুপক্ষের দেওয়া কুমন্ত্রণা কানভাঙানি।
হাসু কফিল মিয়া ও লালমিয়ার সাথে তাঁর সমস্ত চুক্তি সম্পন্ন করে, অতিদ্রুত তাঁকে হত্যা করে জাল দলিল করে তাঁর সমস্ত সম্পদ হস্তগত করবে।
জাল দলিল এখন নাই কিন্তু গত দশ পনেরো বছর পূর্বে জাল দলিলের ছড়াছড়ি ছিলো যা গ্রামের মানুষ খুব পরিচিত আছে। আবার আরেকটি বিষয় ছিলো! তা হচ্ছে রেজিস্ট্রি বন্ধক, এই বন্ধকের মাধ্যমে জমিজমা আদান প্রদান হতো। জমির মালিক রেজিস্ট্রি বন্ধক দিত, পরে যে টাকার বিনিময়ে নিতো সে পরে আর ফিরিয়ে দিতে চাইতো না।
এভাবে আব্দুল মজিদ রেজিস্ট্রি বন্ধকের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে, বর্তমানে একটু ধর্মের পথে ফিরে আসলেও মনের ভিতরে সম্পদের লোভ লালসা এখানো বাসা বেঁধে আছে। যারকারনে যাদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রি বন্ধকের জমি নিয়েছিল তা এখনো ফিরিয়ে দিতে অরাজি।

কফিল মিয়া ও লালমিয়া তাঁরা চাচাতো ভাই, তাঁদের সাথে আব্দুল মজিদের শত্রুতা হচ্ছে এই রেজিস্ট্রি বন্ধকি জমিজমা নিয়ে।
হাসুকে এমন পামপট্রি দিয়েছে যারজন্য সে তাঁদের সাথে আব্দুল মজিদের দ্বিধাবিভক্ত হওয়া!
হাসুকে তাঁরা লোভ দেখিয়েছে আব্দুল মজিদের সমস্তরকম সম্পদের মালিক করে দিবে, সাথে তাঁর একমাত্র মেয়ে তাহেরাকে বিয়ে দিবে। এসব লোভ আর না সামলাতে পেরে অকপটে রাজি হয়ে যায় হাসু।
কফিল মিয়া আর লালমিয়া হাসুকে বললো-
« হাসু তুমি গোপনে কিছু কথা বলার নাম করে আজ রাতে আব্দুল মজিদকে পুকুরপাড়ে নিয়ে আসবে।
« এখানে নিয়ে যাবো কেন?
« ওখানে আমার লোকজন ঠিক করে রাখবো, তুমি তাঁকে বলবা চাচা দাড়ান এখানে আমি এখুনি বাড়ি থেকে দুইটি চেয়ার আনি বসার জন্য। সেই সুযোগে আমাদের লোকজন আব্দুল মজিদকে ধরে নাদীর পাঁড়ে নিয়ে যাবে, সেখানে আমরা আমরা থাকবো। তুমি অতি সংগোপনে এসে হাজির হবে, আর আব্দুল মজিদের সম্পদগুলো সব টিপশই দিয়ে তোমার নামে করে দিব।
হাসু একটু গভীর চিন্তাই মগ্ন হলো, কিছুক্ষণ পর বললো-
« আমার কেনজানি ভয় হচ্ছে যদি ধরা পড়ে যায়?
কফিল মিয়া বললো-
« আরে ধুর!! তোমার কোনো সমস্যা হবে না, এলাকার মোড়ল মাতব্বর সব আমরা দেখবো। তুমি শুধু এতোটুকু সাহায্য করো বাকিটা আমরা দেখবো।
হাসু কথা না বাড়িয়ে তাঁদের কথায় রাজি হলো।
লালমিয়া বললো-
« দেরি না করে আব্দুল মজিদকে এখুনি জানিয়ে দিয়ে এসো রাতে তাঁরসাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
হাসু তাঁদের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকো রওনা করলো।
হাসুর মনে দ্বিধান্বিত হচ্ছে কি করবে সে! সম্পদের জন্য যে পালছে তাকে হত্যা করবে?
এসব ভেবেভেবে কুল কিনারা পাইনা সে, অবশেষে ইবলিশের কুমন্ত্রণায় সিদ্ধান্তগ্রহণ করলো সে কফিল ও লাল মিয়ার সাথেই তাঁদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করে অটোল সম্পদের অধিকারী হবে। এই ধারনা চিন্তা তাঁর মাথায় যেকে বসে।
হাসু বিকালে অপেক্ষা করছে কখনো সে আসরের সালাত পড়ে বাড়িতে আসবে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো, দেখতে পেলো তালহা আর আব্দুল মজিদ মসজিদ থেকে ফিরছে।
একটু কাছে যেয়ে বললো-
« চাচা কিছু কথা ছিলো!
« বলো বাবা কি কথা?
« এখন না রাতে বলবো।
« আচ্ছা।
তালহা তাঁদের কথাটা শুনলো, ইদানীংকাল হাসুকে তালহা বেশি সন্দেহ করছে, ব্যাপারটা হাসুর কাছে ভালো ঠেকছে না! তবুও সামাজিকতা রক্ষার্থে তাঁর সাথে কথার লেনদেন হচ্ছে।

সন্ধ্যার পর মাগরিবের সালাত শেষ করে আব্দুল মজিদ তালহাকে জানালো-‘ দেখতে দেখতে প্রায় মাস চলে যাবার উপক্রম, তোমার পরিবারের সাথে কথা হয়েছে। বিয়ে নিয়ে আর দেরি করতে চাইনা, ইনশাআল্লাহ্‌ আগামী শুক্রবারে তোমাদের বিয়েটা করিয়ে দিব। তুমি মানসিকভাবে তৈরি থাকো, আর্থিক বিষয়টা ভাববেনা আমি দেখবো ইনশাআল্লাহ্‌।’
এসব কথা সহ আরো অনেক কথাবার্তা হলো, একপর্যায় এশার ওয়াক্ত হলো। মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আযানের ধ্বনি ভেসে আসলো। দুইজনে সালাতের উদ্দেশ্যে মসজিদের দিকে ছুটলো।
এশার সালাত আদায় করে তালহার ঘরের পাশ দিয়েই হাসুর ঘরের দিকে প্রস্থান করলো আব্দুল মজিদ। হাসুকে ডাক দিলো, হাসু জানালো চলুন নিরিবিলি পুকুরপাড়ে বসে দুজনে গল্প করবো।
আব্দুল মজিদ বিনাবাক্যে তাকে অনুসরণ করলো, হাসু বললো-
« চাচা একটু অপেক্ষা করুন! বসার জন্য দুইটি চেয়ারের ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখি।
কথাটি বলে হাসু দ্রুতপায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো, এভাবে বসে আছে আব্দুল মজিদ।
হঠাৎ পিছন থেকে তাকে আটদশ জন অপরিচিত মানুষ এসে ধরে ফেললো। প্রথমে এসেই চোখ বেঁধে ফেললো, পরে দুইহাত পিছনে করে বাঁধলো, এভাব গলাই বড়ো একটি ধারালো দা ধরে বললো-
« কোনো শব্দ করার চেষ্টা করবি না! দ্রুতপায়ে নদীর দিকে হাট, তাছাড়া এখানেই শেষ করে ফেলবো।
আব্দুল মজিদ অনেক ভীতু প্রকৃতির মানুষ, যারজন্য কথা না বাড়িয়ে তাঁদের কথার অনুসরন করতে লাগলো।
হাটিহাটি পায়েপায়ে নদীর তীরে পৌঁছে যায় তাঁরা আব্দুল মজিদকে নিয়ে, কেউ একজন তাঁর চোখের বাঁধন খুলে দিচ্ছে। বাঁধনটা খুলে দেওয়ার সাথেসাথে আব্দুল মজিদ স্তম্ভিত হয়ে পড়লো! একি এতো তাঁর চিরচেনা চিরজানা শত্রু কফিল আর লালমিয়া!
আব্দুল মজিদের ভয়ে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো! গা হাতপা ঘামতে শুরু করলো।
কফিল মিয়া বললো-
« আজ তোকে কেউ রক্ষা করতে পারবেনা, আজ আমরা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবো। তুই আমাদের সম্পদ সব হজম করেছিস, সাথে আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছিস, আজ সুদেআসলে সব উসুল করে নিবো। তুই কল্পনাও করতে পারবিনা এসব চক্রান্ত কাকে দিয়ে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছি।
আব্দুল মজিদ হতচকিত হয়ে প্রশ্ন করলো-
« কাকে দিয়ে এই নীলনকশা এঁকেছিস?
« তোর বাড়ির চাকর হাসুকে দিয়ে।
হাসুর কথাটি শুনে আব্দুল মজিদের মাথার ভিতরে চক্কর দিয়ে উঠলো, কি হাসু!!

হাসু আব্দুল মজিদের গলাই বড়ো একটা দা ধরে বললো-
« তোর বাড়িতে গোলামের মতো খাটছি! কতো কষ্টকরে তোর জমির চাষাবাদ করেছি, তোর মেয়ের সাথে সংসার করার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু তুই আমাকে অল্পকিছু সম্পদ দিয়েছিস যা আমার তাতে হবেনা, আমার তোর সমস্ত সম্পদ চাই চাই!
এসব কথা বলে আব্দুল মজিদের পায়ে দার উল্টো পিঠ দিয়ে জোরে একটা আঘাত করলো।
আব্দুল মজিদ ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো, চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো-
« হাসু বাবা আমার! আমাকে ছেড়ে দে, আমার সমস্ত সম্পদ তোকে ফিরিয়ে দিবো। আর কফিল লালমিয়াসহ সকলের সম্পদ বুঝিয়ে দিবো।
« হাহাহা তোকে ছেড়ে দেওয়ার মতো বোকামি আমি করবোনা! কারন তুই নেমকহারাম, বাড়ি গেলে সব ভুলে যাবি। তখন আমি সমাজের চোখে ফেসে যাবো।
« হাসু! আমাকে ছেড়ে দে, আমি তোর বাবা হয়।
হাসুর মাথার ভিতরে চক্কোর দিয়ে উঠালো, কিহ্ আব্দুল মজিদ তাঁর বাবা!!
জিজ্ঞেস করলো-
« বাবা! কিভাবে বাবা! আমার তো জন্মেরই ঠিক নেই।
« আমাকে ক্ষমা করে দে বাবা, আমার কুকর্মের ফসল তুই। তোর কোনো দোষ নেই তোর মায়ের কোনো দোষ ছিলো না, এইতো কিছুদিন হলো জানতে পেরেছি তুই আমার সেই সন্তান।
হাসুর মাথায় বিগাড় চেপে বসলো! রাগান্বিত স্বরে বললো-
« ছেড়ে দিব! অসম্ভব ! আমার পাগলী মা তোরজন্য সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে, সাথে তোরমতো অমানুষের লালসার স্বীকার হয়ে। আমি পিতৃপরিচয়হীনভাবে বড়ো হয়েছি, মানুষের গালি শুনতে শুনতে আজ এতোবড়। তোর আসল পরিচয় পেয়ে কিভাবে তোকে ছেড়ে দিই বল?
আব্দুল মজিদ একদম চুপচাপ কোনো কথা বলার শক্তিটুকু তাঁর যবানীতে নেই।
পাশ থেকে কফিল ও লালমিয়া বললো-
« ওর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই, হাসু তুই নিজে হাতে মৃত মা সহ তোর জীবনে কষ্টে কাটনো দিনগুলির প্রতিশোধ নে।
হাসু আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলোনা, রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে হাতের দা আব্দুল মজিদের গলার ওপর চালিয়ে দিল। রক্ত ফিনকী দিয়ে এসে হাসুর চোখমুখ সয়লাব করে দেই। আব্দুল মজিদ দুনিয়া ছেড়ে চিরতরে বিদায় নেই।
এ যেন “ সময়ের পালাবদল” !!
যে কুকর্মের মাধ্যমে নিজের জৈবিক চাহিদা চরিতার্থ করেছিল এক অবুঝ অবলা নারীর প্রতি, তাঁর পেটে জন্ম নেওয়া সন্তানের হাতেই আজ আব্দুল মজিদকে দুনিয়া ছাড়তে হলো। আব্দুল মজিদের অবৈধ পথে কামায় করা সম্পদেও তাঁকে আজ রক্ষা করতে পারলোনা।
হাসু রাগে বশবর্তী হয়ে আব্দুল মজিদকে খতম করে ভীত বিহ্বল অবস্থা। কফিল মিয়া পকেট থেকে একটা জাল দলিল বের করে, আব্দুল মজিদের হাত থেকে টিপসাক্ষর নিয়ে হাসুর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো-
« এই নে! আজ থেকে সব সম্পত্তির মালিক তুই। আমাদের সম্পদ লাগবেনা, একে খতম করতে পেরেছি তাতেই খুশি।

আব্দুল মজিদকে দাফনকাফন করালো নিজ হাতে তালহা, সেও শোকে দুমড়ে মুচড়ে গেছে। তাঁর পরিণয় হওয়ার পূর্বেই কেমন যেন একটা দমকা হাওয়া এসে সব ভস্মিভুত করে দিয়েছে।
তাহেরা অজ্ঞান! তাঁর বাবার মৃত্যুর খবর মেনে নিতে পারিনি। সাথে তাহেরার দুই মা অভিভাবক ছাড়া হয়ে গেলো, সেই দুঃখকষ্টে তাঁরা দগ্ধ।
হাসু সমাজ দেখানোর মত বিলাপ করে কান্নাকাটি করেছে, কেউ যানে না যে হাসুই খুন করেছে। কারন তাঁরা হত্যার পর নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল, পরে সেখান থেকেই লাশ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে কফিল আর লালমিয়া হাসুকে দিয়ে নীলনকশা বাস্তবায়ন প্রায় সম্পন্ন, কিন্তু অল্প একটু বাকি আছে। তা হচ্ছে আব্দুল মজিদের বংশ নির্বংশ করে দেওয়া। সেই লক্ষ্যে তাহেরাকে হত্যা বা তাঁকে নিরাবাস করতে হবে।
এই পরিকল্পনাটা হাসুকে না জানিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলো তাঁরা, হাসুকে জানালে এইটা বাস্তবায়ন হবেনা। কারন হাসু তাহেরাকে চাই, আর তাঁদের চিন্তু কফিল মিয়ার মেয়ে হাসির সাথে হাসুর বিয়ে দিয়ে সমস্তরকম সম্পদ হস্তগত করা।
এই লক্ষ্যে সেদিনই রাতে জাহেরাকে ক্ষতি করার সিদ্ধান্ত নেই কফিল ও লালমিয়া…………
চলবে।………..
.
[বিঃ দ্রঃ- কমেন্ট করে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here