#সভ্যতার_সভ্য
#ত্রয়োদশাংশ
#NishchupSpriha
==============
আমার প্রেগন্যান্সির চারমাস রানিং। আর সভ্যর সঙ্গে কথা না বলার প্রায় দুই মাস। সেদিনের পর আমি আর ওর সঙ্গে কোন কথা বলিনি। কিভাবে ও এসব বলতে পারলো?

অবাক করা বিষয় হচ্ছে মাম্মাম আর ছোটমাও সভ্যর গান গাওয়া শুরু করেছিল। আমি ভাবতে পারি না তারা কিভাবে আমাকে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে বলে?

আমি শুধু মাম্মাম আর ছোটমাকে বলেছি,
— ‘ঠিক আছে.. আমি তোমাদের কথা শুনবো.. কিন্তু তার আগে তোমাদেরও কথা দিতে হবে যে, তোমরাও নিজের সন্তানকে নিজের হাতে খুন করবে। আমাকে তোমরা নিজের হাতে মেরে ফেলবে।’
এরপর তারা আর কিছুই বলতে পারেনি। অবশেষে তারা আমার জেদের কাছে হার মেনেছে।

মাম্মাম আর ছোটমা দুজনেই এখন আমার সঙ্গে থাকছে। বাপি আর ছোটবাবা মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখে যায়।

আমার প্রেগন্যান্সিতে নানা ধরণের কমপ্লিকেশন। এরজন্য আমাকে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট দাওয়া হয়েছে। একটু অসাবধান হলেই অনেক বড় অঘটন ঘটে যেতে পারে। এর জন্য আমি স্কুলের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছি।

এই দুই মাসে আমি সভ্যর কোন ফোনকল রিসিভ করিনি। ওর সাথে কোন কন্টাক্ট রাখিনি। ও দেশে আসতে চেয়েছিল কিন্তু আমি মাম্মাম আর ছোটমাকে বলেছি যে,
— ‘ও যদি দেশে আসে, তাহলে আমি দূরে কোথাও চলে যাবো। তখন খুঁজলেও তোমরা আর আমাকে পাবে না।’

আমার মনে হচ্ছিলো সভ্য দেশে এলেই আমার থেকে আমার বাবুদের কেড়ে নিবে।

প্রেগন্যান্সির পর আমার ছোটবেলার সেই পুরনো জেদটা আবার ফিরে এসেছে। আমার এই জেদকে বাসার সবাই অনেক বেশি ভয় পায়। যার ফলে এখন আমি যা বলি তারা তাই করে।

সভ্যর বলা শেষ কথাগুলো ছিল,
— ‘প্রেগন্যান্সির জন্য তোমার বডি এখনো স্টেব্যাল নয়, জান। প্লিজ আমার কথাটা শোনো… তোমার কিছু হয়ে যাওয়ার চান্স অনেক বেশি… অনেক বিদঘুটে সিচুয়েশন আসতে পারে.. আমাকে হয়তো তোমাকে আর আমার বাচ্চাদের মধ্যে একজনকে চুজ করতে হবে.. অথবা তোমাদের তিনজকেই আমাকে হারাতে হবে…’

তখন আমি বলেছিলাম,
— ‘এমন সিচুয়েশন এলে তো কোন সমস্যা নেই.. তুমি তো আমাদের কাউকেই চাও না।’

ও তখন আহত স্বরে বলেছিল,
— ‘তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলে? তোমার কিছু হলে আমার সব শেষ হয়ে যাবে.. তখন আমি আমার বাচ্চাদের দিয়ে কি করবো? ওদের দিকে তাকালে মনে হবে, আজ ওরা আছে বলে তুমি আমার কাছে নেই.. তখন আমার কি হবে? তুমি না থাকলে আমার সম্পূর্ণ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে… আমি তোমাকে হারাতে পারবো না…. আমার তুমি ছাড়া আর কিচ্ছু চাই না… প্লিজ আমার কথাটা শোনো।’

— ‘তুমি এতটা সেলফিস কিভাবে হতে পারো সভ্য? নিজের জন্য তুমি আমার সন্তানদের মেরে ফেলতে বলছো?’

— ‘তোমার জন্য আমি সব কিছুই করতে পারি..’

— ‘আই উইশ আল্লাহ্‌ যেন ওদের সাথে আমাকেও তার কাছে নিয়ে নেয়।’
বলেই আমি ফোন অফ করে দিয়েছিলাম।

আচ্ছা আমি খুশি হবো নাকি কষ্ট পাবো? কেউ একজনকে কতটা ভালোবাসলে এমনটা করতে পারে? যে নিজের সন্তানকেও চায় না স্ত্রীর ক্ষতি হবে জন্য!! কিন্তু আমার ভিতরে কোন আনন্দই কাজ করছিল না। আমার সকল চিন্তা যেয়ে আটকেছে আমার বাবুদের উপরে।

এরপর সভ্য আমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি।

আজ অনলাইনে ঢুকতেই সভ্যর একের পর এক ম্যাসেজ আসতেই থাকলো.. হোয়াট’স অ্যাপ থেকে ইনস্টা… সব জায়গায় সভ্যর ম্যাসেজ.. এত দিন আমি একটিভ ছিলাম না।

আমি ম্যাসেজ না পড়ে রিপ্লাই করলাম,
— ‘Tumi ar amake knock korbe na. Even amar sathe kono prokar contact korbe na.’

সাথে সাথে রিপ্লাই এলো,
— ‘Tumi ki cao ami tomar sathe kotha na boli?’

আমি রিপ্লাই দিলাম,
— ‘Yes, Exactly. You got the right point.’

রিপ্লাই এলো,
— ‘But, Why don’t you?’

— ‘I won’t account to you for it.’

— ‘Ami toh tomake sob kichu bolechi. Kotobar sorry bolechi. Kintu tumi kono response koroni. Even ami deshe obodi jete ceyechi. Tumi amake jete daoni.’

— ‘Tumi amar kache asbe na.’

— ‘Ami dure thakle tumi happy thakbe?’

আমি একটু দেরি করে লিখলাম,
— ‘Humm…….’

— ‘Okay ami durei thakbo. Kintu tumi nijer proti obohela keno korcho? Tumi time to time khaccho na, tension korcho.. esob ki? Tumi to jano tomar pregnancy te onek complication. Tahole je? Please sweetheart, ar emon ta koro na, Nijer & amader baccader kono khoti koro na. Tomar kichu hole ami just shesh hoye jabo. Please nijer jotno nao.’

— ‘Tomar kotha shunte ami baddho noi.’

— ‘Obossoi tumi baddho..’

সভ্যর এই ম্যাসেজ দেখে আমি রিপ্লাই দিলাম,
— ‘Are you forcing me?’

রিপ্লাই এলো,
— ‘You can suppose.. ‘

আমি রিপ্লাই দিলাম,
— ‘No use. However, Never try to contact me. Bye.’
সেন্ড করেই অফলাইনে চলে এলাম। সাথে সাথে সভ্যর কল এলো। কল কেটে দিয়ে, আমি ফোনও বন্ধ করে ফেললাম।

যত দিন যাচ্ছে আমার শরীরের তত অবনতি হচ্ছে। টুয়েন্টি সিক্স উইক’স রানিং… আমি আমার বাবুদের নড়াচড়া অনুভব করতে পারি।

আমার দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে ওদের সাথে গল্প করে। ওরা যখন নড়াচড়া করে, আমি যখন ওদের অনুভব করি, তখন আমার শুধু সভ্যর কথা মনে পড়ে। খুব করে মন চায় দুজনে এক সাথে আমাদের বাবুদের অস্তিত্ব অনুভব করি। কিন্তু সেটা কখনো সম্ভব নয়।

কাল ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়ন্টমেন্ট ছিল, কাল কনফার্ম হলাম আমার দুজন মেয়ে বাবু হবে। ডাক্তার কাল আল্ট্রাসনোগ্রাফি করেছে। বাবুদের হৃদস্পন্দন ঠিক আছে কি না, ঠিক মতো বাড়ছে কিনা, বাচ্চাদের কোন শারীরিক ক্রটি আছে কিনা, আরো অনেক কিছু জানার জন্য।

কিন্তু আমাকে আরো হতাশ হতে হয়েছে.. বাবুদের পজিশন ভালো না.. বয়স হিসেবে বাচ্চার গ্রোথ অনেক কম। আমাকে টেনশন ফ্রি থাকতে বলা হয়েছে, টাইম টু টাইম খেতে বলা হয়েছে এবং সম্পূর্ণ বেড রেস্ট..
অথচ আমার ঘুম বলতেই নেই। সব সময় মাথায় আজেবাজে চিন্তা আসে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি হয়তো মারা যাবো..

আচ্ছা, আমি না থাকলে আমার বাবুদের কে দেখবে?

সভ্য? হাহ্! একজন মেয়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে তার গর্ভকালীন অবস্থা। সব মেয়ে চায় এই সময়টায় তার স্বামী যেন তার পাশে থাকে। তেমনই আমিও সেটা চাইতাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। সভ্যর সাথে আমার লাস্ট ম্যাসেজিংয়ের দুই মাস হয়েছে। এরপর ওর সাথে আর কোন কথা হয়নি।

খুব করে মন চায় সভ্যর সাথে কথা বলতে। মন চায় আগের মতো ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে থাকি, পৃথিবীর সকল শান্তি যেখানে রয়েছে। ওর আদর গুলো পেতে খুব করে মন চায়। কতদিন থেকে ওর মাতাল করা ঘ্রাণ নিতে পারি না…!

কিন্তু অহং..! অহং বলে যে জিনিসটা আছে সেটা আমাকে সভ্যর কাছে যেতে দেয় না। প্রতি রাতে আমি সভ্যর ব্যবহার করা শার্ট, টি-শার্ট নিয়ে ঘুমোই। রাতের অন্ধকারে সভ্যর কথা ভাবলেই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়া শুরু হয়। কষ্ট হয়.. অনেক কষ্ট হয়.. কিন্তু কাউকে বলতে পারি না।

আমার অসুস্থতা যেন বেড়েই চলেছে… হাই ব্লাড প্রেশার.. রক্তশূন্যতা.. প্রবল বমির ভাব ও বমি যেন যত দিন যাচ্ছে ততই বেড়ে যাচ্ছে.. তলপেটে চিনচিন একটা ব্যথা হয়। ডাক্তার বলেছে এটা ভালো লক্ষণ নয়।

আমার সাত মাস গর্ভকালীন অবস্থায়, নানুবাসায় আমার ‘‘ঐতিহ্যবাহি সাতসা’’ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

অসুস্থতার কারণে সাত মাসে সেটা করা সম্ভব না হলেও , মাম্মাম আর ছোটমার কারণে থার্টি সিক্স উইকে সেটার বিশার আয়োজন করা হল। বাড়িতে নতুন অতিথি আসার খুশিতে তারা পাগল প্রায়.. তার উপর আবার ডাবল অতিথি..! অথচ তারাও এক সময় সভ্যর সাথে একই গান গাওয়া শুরু করেছিল।

সন্ধ্যায় আমার জন্য যে বড় রকমের ঝাটকা অপেক্ষা করছিল..! সেটা কি আমি জানতাম..!

বাসা ভর্তি মানুষ… একমাত্র বোনের একমাত্র মেয়ের সাতসা! মামা-মামিরা সবাই ব্যস্ত.. কাজিনদের মধ্যে দুই তিনজন সব সময় আমার পেছনে লেগেই আছে। আমার কিছু লাগবে কিনা… খারাপ লাগছে কিনা… কিছু খাবো নাকি… কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা… আরো অনেক কথা তাদের।

এত সব কিছুর মধ্যে আমি সভ্যকে মিস করছিলাম ভীষণ! এত এত আনন্দের কিছুই আমাকে স্পর্শ করতে পারছিল না।

অনুষ্ঠান শুরুর পর আমি প্রথম যে ঝাটকাটা খেলাম সেটা হল রুশাপু! রুশাপু, ফাইয়াজ ভাইয়া, রাজপুত্র ফারিস আর ছোট্ট পুতুল রায়না এসেছে…!

রায়নাকে আপু-ভাইয়া এডোপ্ট করেছে। রায়না দেখতে একদম পুতুলের মতো। ওকে দেখলে মনেহয় কোন পুতুলের মধ্যে জীবন দেয়া হয়েছে। গোলগাল মুখ, মাথা ভর্তি স্বর্ণকেশ, বড় বড় বাদামি চোখ আর লাল-ফর্সা গায়ের রং! কোন পুতুলের থেকে কম নয়..!

ওদের দেখে আমি থ! আমার এতক্ষণের খারাপ লাগাটা অনেকটাই কেটে গেলো।

রুশাপু আসার পরে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি এত করে বললাম,
— ‘তুমি রেস্ট করো… জেট ল্যাগের কারণে সমস্যা হবে…’
কিন্তু কে শুনে কার কথা? সে তার মতোই চলবে..

অবশেষে বললো, ‘তারা পরশু দেশে এসেছে… তাদের জেট ল্যাগও চলে গেছে। বাসার সবাই জানে ওদের কথা, শুধু আমি বাদে.. কারণ আমাকে আপু সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল।’

তারপরেও আমি যখন বললাম,
— ‘আমাকে নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে, ভাইয়া, ফারিস, রায়নাকে দেখো। ওদের কিছু লাগবে কিনা? আমার জন্য সবাই আছে।’

তখন রুশাপু হেসে বলেছে,
— ‘ওদের জন্যও সবাই আছে.. এখন আমাকে তোর যত্ন নিতে দে.. আমার পুতুলটা..! কত দিন তোকে কাছে পাই না..! এতদিন তো তোর ভাইয়ের পিছনেই ছিলাম.. আর ফারিস, রায়নাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। ওদের কিছু লাগলে ফাইয়াজ আছে.. ছেলেমেয়ে দুটোই বাপ ভক্ত হয়েছে.. যত আবদার সব ওদের বাপের কাছে.. আর আমার কাছে ওদের বাপের যত আবদার।’
বলেই রুশাপু হেসে ফেললো।

বাবা ভক্ত শুনেই আমার হাসি চলে গেল, কথাটা যেন একদম আমার বুকে যেয়ে লাগলো..! আচ্ছা! আমার বাবু গুলোও কি বাবা ভক্ত হবে? সভ্য কি ওদের আদর করবে?

আমার দিকে তাকিয়ে রুশাপু আমার মাথায় চুমু খেয়ে বললো,
— ‘চিন্তা করিস না সোনা.. সব ঠিক হয়ে যাবে.. কথা বল ওর সাথে.. ছেলেটাও তো অনেক কষ্টে আছে.. দেখ সবাইকে ছেড়ে ওই দূর দেশে পড়ে আছে.. সব কিছু ছেড়ে অনেক আগেই চলে আসতো.. কিন্তু তুই নাকি আবার কি উল্টাপাল্টা কথা বলেছিস? দেখ ও কিন্তু তোর ভালোর জন্যই এমন পাগলামি করেছে। জানিস তো ছেলেটা তোকে কত ভালোবাসে? লক্ষী আপু আমার, আর পাগলামি করিস না.. ছেলেটার সাথে কথা বল… খুব কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা.. আর কষ্ট তো তুইও কম পাচ্ছিস না.. পাগলটা নিজের কি হাল করেছে তুই ভাবতেই পারবি না… শুধু শুধু কেনো নিজেদের কষ্ট দিচ্ছিস লক্ষী আমার?’

আমি কিছু না বলে চুপ করে আপুর কোলে মুখ গুঁজে ছিলাম। ভেতরটা তীব্র একটা কষ্টে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিলো। বারবার চোখ ভিজে উঠছিল। মন চাচ্ছিলো ছুটে চলে যাই পাগলটার কাছে… কিন্তু সেটা সম্ভব না.. মন চাইলেই মানুষ সবকিছু করতে পারে না..

আমি অসুস্থ থাকায়, আমাকে ঔষধ খাইয়ে সবার আগে ঘুমোতে পাঠানো হল। অবশ্য আমারো খারাপ লাগছিল সাথে অস্বস্তি… তল পেটের চিনচিনে ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে। অনুষ্ঠানের ধকলে শরীর অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কখন ঘুমিয়েছি টেরই পাইনি।
………………………..
(চলব)

[ বিঃদ্রঃ যারা আগে পড়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, ‘‘নো স্পয়লার প্লিজ…’’ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here