#সন্ধ্যাতারা
#ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৩
আলভির এ নাটক আমি আর নিতে পারছি না। চোখ মুছে ছাঁদের দিকে হাঁটা ধরলাম। গতকাল কয়েকটা শাড়ি আর বোরকা হিজাব ধুয়ে ছাঁদে শুকাতে দিয়েছিলাম। সেখান থেকে বোরকা হিজাব পরে চিরতরে এ বাড়ি থেকে চলে যাবো। আলভির দুই রকম ব্যবহার আমি নিতে পারছি না। একটা কষ্ট হয়তো বুকে চেপে বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু দুই রকমের ব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না। কখনো মনে হয় আলভি আমারই আছে, কাউকে বিয়ে করেনি ও, কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। কখনো বা মনে হয় নীলিমা আলভিকে জয় করে নিয়েছে। আলভির নতুন বিয়ের বয়স এখনো একদিন পার হয়নি। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে কয়েক যুগ ধরে আমি এই কষ্ট সহ্য করছি।
এই ছাঁদের প্রতিটি জায়গায় আমার আর আলভির স্পর্শ লেগে আছে। কত রাত দুইজন মিলে তারা গুনেছি, চাঁদ দেখেছি। জীবনে ভালোবাসার অভাব ছিলো না।
‘ প্রিয় ভালোবাসা দিন শেষে তুইও আমার সন্ধ্যাতারা হয়ে গেলি’
নীল আকাশ যখন কালচে লাল হয়ে যায় তখন তোর দেখা মেলে, তারপর নীল আলোয় আলোকিত আকাশ কালো বর্ণ ধারণ করে, আস্তে আস্তে সেই অন্ধকারে যেন ঢেকে ফেলে সম্পূর্ণ আকাশকে। নিকষ কালো আকাশে আশার প্রদীপ হয়ে ফুটে ওঠে হাজার তারা। ঠিক যেন আমার জীবনের মতো। আলভির কেয়ার গুলো যেন আমার কাছে আশার প্রদীপ!
সকালের দিকে হয়তো বৃষ্টি হয়েছে। বোরকা হিজাব ভিজে গেছে। ভেজা বোরকা হিজাবই পরে নিলাম। কি আর হবে আমার! মরে যেতে পারলেই তো সব থেকে ভালো হয়। আসলেই কি তাই! মরার পর কি জবাব দিবো আল্লাহর কাছে, কবরের আযাব মাফ হবে তো?
কাজ শেষ করে নিচে নামতেই দেখলাম আলভি আর নীলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। ওদের সামনে পড়তে ইচ্ছে করলো না, তাই চুপচাপ সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। আলভি শাশুড়ি মা’য়ের কাছে জিজ্ঞেস করলো, ” মা তানিয়া কোথায় গেছে?”
-‘ আমি কি জানি তোর নবাবজাদি বউ কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে! আমাকে ও-র বডিগার্ড রেখেছিস নাকি? কি ছেলে জন্ম দিলাম আল্লাহ!”
–” মা আপনি বড্ড সিরিয়াল দেখেন, এসব না করে একটু কুরআন হাদিস তো পড়তে পারেন নাকি?”
নীলিমা মুখে মা ডাক শুনে আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। তাহলে সত্যি নীলিমা আলভির বউ? না হলে কেন শাশুড়ি মাকে মা বলে ডাকবে? আলভি নীলিমার কথায় মুখ চেপে হাসছে। শাশুড়ি মা মুখ বেঁকিয়ে ঘরে চলে গেলেন। অবাধ্য আঁখি থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বেইমানগুলোকেই কেন আমরা এতো ভালোবাসি!
–” ভেজা বোরকা পড়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
আলভির গলা শুনে চমকে উঠলাম। ভালো করে আসে পাশে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও সে নেই। হয়তো আমার কান ভুল শুনেছে, মস্তিষ্ক আমাকে ভুল সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। আর এক মুহুর্ত দেরী না করে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এই দরজাটা পেরিয়ে গেলে হয়তো জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবো। কিন্তু আসলেই কি তাই দুনিয়ার কোনো কষ্টই জাহান্নামের আযাবের সমান হতে পারে না। জাহান্নাম যে চিরশাস্তির স্থান।
দরজা পার হতে গেলেই আলভি আমার হাত টেনে ধরলো। তারপর রাগী গলায় বললো, ” কোথায় যাচ্ছো তুমি? তোমার শরীর এতো গরম। অসুস্থ অবস্থায় কোথাও যেতে পারবে না তুমি। ঘরে আসো। ”
কথাগুলো বলে আমার হাত ধরে টানতে লাগলো। অনেক সহ্য করেছি, আমার পক্ষে আর
এসব সহ্য করা সম্ভব নয়। এক ঝটকায় আলভির হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। আলভি একপলক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও আমার হাত ধরতে গেলো। আমি আলভির গালে একটা থাপ্পড় দিলাম। আলভি হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, ” কি নাটক শুরু করেছেন আমার সাথে? এমন লুকোচুরি খেলে কি সুখ পাচ্ছেন আপনি? দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ ঘরে এনে প্রথম বউয়ের সাথে এতো নাটক না করলেও পারতেন আপনি। আমার প্রতি এতো দরদ দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চান? আপনি ভালোবাসেন আমাকে? আসলেই? আপনি যদি আমাকে ভালোই বাসবেন তাহলে কেন আমাকে ঠকালেন? কি হলো চুপ করে আছেন কেন?”
আলভি খুব শান্ত গলায় বললো, ” আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবো। দয়া করে তুমি এই ভেজা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না। তোমার শরীর অনেক খারাপ হবে। ”
আমি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, ” বেইমান, বিশ্বাসঘাতক লোকেদের মুখে এসব কথায় মানায় না। আপনার এই আলগা দরদ আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন প্লিজ।”
–” তুমি আমাকে একটু তো সময় দেও কিছু বলার। আমি সব বলবো তো তোমাকে। ”
–” কি বলবেন আপনি? নিজের প্রেম কাহিনী শোনাবেন আমাকে? কি করে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন ব্যাখ্যা করবেন? আমি আপনার মুখটাও দেখতে চাই না। বিয়ে করেছেন নতুন বউ নিয়ে সুখে থাকেন। আমাকে নিয়ে এমন লুকোচুরি করবেন না। ”
আলভি আমার কথার কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলো। আমি কি একটু বেশি বলে ফেললাম ও-কে? তেষ্টায় গলা বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। শরীর মনে হয় জলন্ত উনুনে পরিনত হয়েছে। ভিজা বোরকা পরে থাকার জন্য হয়তো জ্বর কিছুটা বেড়ে গেছে। দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। তবুও তেষ্টা মিটছে না। আরো এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। শরীরটা হঠাৎ অনেক খারাপ লাগছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এক পা-ও চলার শক্তি নেই। মাথা ঘুরে পড়ে যাবো হয়তো। কোনো রকম ঘরে গিয়ে বোরকা খুলে শুয়ে পড়লাম। শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। আচ্ছা আমার কি বড় কোনো রোগ হয়েছে! এমন কিছু যাতে আমি তাড়াতাড়ি মরে যাবো। এই মিথ্যা দুনিয়ার মায়া থেকে মুক্তি পাব। জ্বর ক্রমশ বাড়তে লাগলো। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বিছানার পাশে একটা বোতলে পানি রাখা থাকে, সেখান থেকে বারবার পানি খেতে লাগলাম। কিছুতেই তেষ্টা মিটছে না। মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। কখন যে অজ্ঞান হয়ে গেলাম নিজেও জানি না।
।
।
চোখ খুলে দেখলাম নীলিমা আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। মেয়েটা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি কে জানে! নিজের সতীনের সেবা করছে। আমি চাইলেও কেন নীলিমাকে ভালো মনে করতে পারলাম না জানি না। হয়তো আমার জিনিসে ভাগ বসিয়েছে তার জন্য। কোনো মেয়েই তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে চায় না। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়।
আমি চোখ মেলেছি দেখে নীলিমা বললো,” আপনার এখন কেমন লাগছে? আপনি তো জ্বরের কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছেন দেখে আমি মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিলাম। ”
–” আপনার এতো কষ্ট করার কি দরকার ছিলো? আমি মরে গেলেই ভালো হয় ”
–” হায়াত থাকতে তো আপনি মরবেন না। শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কি আছে?”
নীলিমা কথাগুলো আমার কেন জানি ভালো লাগছে না। আসলে মন থেকে ভালো না লাগে যাকে অপছন্দ তার কোনো কিছুই ভালো লাগে না। নীলিমার ব্যাপারটাও ঠিক তেমন। আমার সব থেকে বড় জিনিস আমার থেকে কেড়ে নিয়ে এখন এসব দরদ দেখিয়ে কি লাভ! ইচ্ছে করছিলো ও-কে অনেক কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু চুপ করে রইলাম।
শাশুড়ি মা হয়তো নীলিমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। নীলিমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আমার ঘরে আসলেন। নীলিমাকে আমার কপালে জলপট্টি দিতে দেখে বললেন, ” দুই সতিনের এমন মিল তো সিরিয়ালেও দেখা যায় না। ”
নীলিমা মুচকি হেসে বললো, ” আপনি মনে হয় সারাক্ষণ সিরিয়াল নিয়ে বসে থাকেন। একটা মানুষ অসুস্থ কষ্ট পাচ্ছে, তার সেবা না করে আমি চুপচাপ বসে থাকবো এতোটা ব্যক্তিত্বহীন আমি না। আপনি তো উনার শাশুড়ি, মায়ের মতো, এসব করার দায়িত্ব তো আপনার তাই না?”
শাশুড়ি মা কিছু না বলে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেলো। আমি নীলিমাকে প্রশ্ন করলাম, ” আচ্ছা নীলিমা, তোমার সাথে আলভির কি করে বিয়ে হয়েছে? ”
নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ” দুইজন বিবাহিত মানুষকে ধরে একটা কাগজে সই করে দিলেই কি বিয়ে হয়ে যায় বলো?”
নীলিমার কথায় আমি বেশ অবাক হলাম। হতবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ” দুইজন বিবাহিত মানুষ মানে কি?”
–” আমিও বিবাহিত তানিয়া। আলভির যেমন আপনি আছেন আমার তেমন স্বামী আছে। আলভির সাথে আমার গতকালই দেখা হয়েছে।”
–” কিসব বলছো তুমি নীলিমা? আলভির সাথে তোমার কেনো সম্পর্ক নেই?”
–” নাহ্, আলভির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি আমি উনাকে চিনতামও না। ”
–” কিসব বলছো তুমি নীলিমা? আমাকে সবকিছু খুলে বলো প্লিজ।”
নীলিমা কিছু বলতে যাবে এর আগে আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। ফোনের স্কিনে আলভির নম্বরটা জ্বলজ্বল করছে। দেরী না করে কল রিসিভ করলাম।
–” তানিয়া,’
–” হ্যাঁ বলো, ”
–” এতো বছরের বিবাহিত জীবনে আমি একটা মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি। আজ নিজের কাছেই আমি হেরে গেছি। আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে বেইমান বলেছে, সে আমার মুখও দেখতে চায় না। তাহলে আমি আর আমার মুখ তোমাকে দেখাবো না। একটা শেষ অনুরোধ তোমার কাছে আমার মা’কে একটু দেখে রেখো প্লিজ। ভালো থেকো, নিজের খেয়াল রেখো।”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আলভি কল কেটে দিলো। আমি আবার কল দিলাম কিন্তু ফোন বন্ধ। আল্লাহ এ কোন পরীক্ষায় ফেললেন আমাকে! চোখ বন্ধ করে আল্লাহ কাছে সাহায্য চাইতে লাগলাম। চোখের সামনে কুরআনের একটি আয়াত ভেসে উঠলো।
–” জেনে রেখো, আল্লাহর সাহায্যে অতি নিকটে! ( সূরা আল-বাকারা, আয়াত ঃ ২১৪)
চলবে