‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ৫.
তাবিনা মাহনূর

__________

জামিলের বন্ধু শিহাবের বাসায় আজ রান্নার বড় আয়োজন চলছে। জামিল শিহাবকে বলেছিল সে, তার স্ত্রী, মা নাজিফা বেগম আর আরশ যাবে বিকেল বেলা। কিন্তু শিহাব সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে একপ্রকার জোর করেই। যেহেতু জামিলের খুব ভালো বন্ধু সে, সেই হিসেবে দুপুরের খাবারের দাওয়াত দিয়েছে। পাত্রী পছন্দ হওয়া, না হওয়া পরের ব্যাপার।

বাড়ির পুরুষ মানুষগুলো একসাথে জামায়াতে সালাত আদায় করলো মসজিদে। শিহাব অত্যন্ত আন্তরিক স্বভাবের মানুষ। ইতিমধ্যে আরশের মতো ভদ্র ছেলেকে তার বোনের জন্য বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছে। প্রফুল্ল মনের শিহাব আরশকে ছোট ভাই বলে ডাকছে। আরশেরও ভালো লাগছে তার এমন বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ।

খাওয়ার পর্ব শেষে জামিল আরশকে ধীর স্বরে বললো, ‘দেখাদেখির কাজটা সেরে ফেলো ভাই। তোমার আপু ডাকছে ওই ঘরে।’

আরশ সামনে তাকিয়ে দেখলো, হাত দিয়ে ইশারায় আনিকা তার কাছে যেতে বলছে। একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। আরশ সেদিকে এগিয়ে গেলে সে বললো, ‘আমিও তোর সাথে ভেতরে যাচ্ছি। শিহাব ভাই নীচে গিয়েছেন, নাহলে উনিই থাকতেন। একজন মাহরাম থাকা প্রয়োজন ছিল। এতক্ষণ আমরা শিমুলের সাথেই ছিলাম। এবার তোর সাথে আলাদা করে কথা বলানোর জন্য এ ঘরে নিয়ে এসেছি। আমি বারান্দায় থাকবো। শুধু চেহারা দেখে বেরিয়ে আসিস না।’

আরশ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘মানে?’

– মানে মেয়ে বিশ্ব সুন্দরী। কথাবার্তা না বলে বেরিয়ে এসেই কবুল কবুল করিস না।

বোনের কথা শুনে রাগ হওয়ার বদলে হেসে ফেললো আরশ। তার হাসি দেখে অবাক হয়ে আনিকা বললো, ‘আজকে দেখি খুব খুশি আপনি! মেয়ে দেখার কথা বললেই আগ্নেয়গিরির লাভা বেরিয়ে আসে। দেখতে নিয়ে গেলে মেয়ে দেখে এসেই বলেন পছন্দ হয়নি। আর আজ না দেখতেই খিলখিলানি!’

মুচকি হাসি ধরে রেখেই আরশ বললো, ‘আল্লাহ মেয়েদের তৈরি করেছেন আকর্ষণীয়ভাবে। তাই সব মেয়েই সুন্দর। তুলনা করলে হয়তো চেহারার দিক থেকে কেউ কম রূপবতী, কেউ একটু বেশি। কিন্তু সব মেয়েই পুরুষদের ঘায়েল করতে জানে। সেটা রূপ দিয়ে হোক কিংবা ব্যক্তিত্ব। একটা চরম সত্য কথা হলো, নারীর ব্যক্তিত্ব ও আচরণটাই পুরুষকে ধরে রাখতে পারে স্থায়ীভাবে। সৌন্দর্য নয়। কিন্তু আফসোসের বিষয়, পুরুষরা সেটা ভুলে গিয়ে রূপ খুঁজে বেড়ায়। আর নারীরাও তাদের রূপকে সঠিক জায়গায় ব্যবহার করে না।’

আনিকা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। আজ তার ভাই একটু বেশিই খুশি মনে হচ্ছে। তা নাহলে এত কথা বলার লোক আরশ নয়। আরশের মুচকি হাসিটা এখনো মুছে যায়নি। আনিকা বললো, ‘তুই আজ সত্যিই খুব খুশি! তাই না?’

– জানি না আপু। কেন যেন মনটা এমনিতেই ফুরফুরে লাগছে।

কথা বাড়ালো না আনিকা। দুজন ভেতরে ঢুকতেই সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শিমুল। আরশ এখনো শিমুলের দিকে তাকায়নি। আনিকা শিমুলকে কিছু কথা বলে বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়ালো। আরশ সোফায় বসলে শিমুল বিছানায় তার সামনাসামনি বসলো। আরশ এবার তাকালো মেয়েটার দিকে। আনিকার ভাষ্যমতে মেয়েটা রূপসী, এই কথা মিথ্যে মনে হলো না আরশের। আরশ তাকিয়ে থেকেই বললো, ‘আপনি আমার সম্পর্কে কিছু জানেন?’

ভালো-মন্দ কোনো কথা না বলে সরাসরি আলাপে যাওয়ায় শিমুল একটু বিব্রত বোধ করলো। সংকুচিত হয়ে বললো, ‘জি, জানি।’

– কি জানেন?
– আপনি ইফতিখার আরশ। এএসপি এবং আনিকা ভাবীর ভাই।
– আর কিছু জানেন না?

এবার শিমুলও আরশের দিকে তাকালো। তাকিয়েই তার কথার মালা ছিঁড়ে গেল। এদিক ওদিক পুঁথি গড়িয়ে পড়ায় কোনো কথাই মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো না। আরশ ভ্রু উঁচিয়ে বললো, ‘কোনো সমস্যা?’

কথা জড়িয়ে আসছে শিমুলের, ‘না, সমস্যা, মানে… পানি! পানি খাবো।’

পানি খাবে বলে শিমুলকে বিছানায় বসে থাকতে দেখে আরশ উঠে দাঁড়ালো। টেবিল থেকে পানি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলো। শিমুল প্রচন্ড লজ্জিত বোধ করে গ্লাসের পানি সবটা খেয়ে নিলো। আরশ তাকে শান্ত হওয়ার সুযোগ দিয়ে নিজের কথা গুলো গুছিয়ে বললো।

– বুঝতে পারছি আপনি একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে গিয়েছেন। তাই আমি আর প্রশ্নে না জড়িয়ে আমার কথাগুলো নিজ থেকে বলছি। প্রথমত, আমি একজন দ্বীনদার সঙ্গী চাই। এর সাথে নো কম্প্রোমাইজ! দ্বিতীয়ত, আমার চাকরিটা সুবিধার না। যেহেতু আমি দ্বীন মেনে চলার চেষ্টা করি। আমার স্ত্রীকে তেমনই দৃঢ় মনের হতে হবে। তার মাইন্ড সেট করতে হবে এই ভেবে যে, আমাদের জীবন অনিশ্চিত।

মনে মনে ভয় হলেও প্রকাশ করলো না শিমুল। সামনের যুবকটিকে তার পছন্দ হয়েছে। তাই কথাগুলো ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না সে। তার মনে একটাই কথার বিচরণ, ‘যা ইচ্ছে বলুন। আমার কিছু বোঝা লাগবে না। বিয়ে হলে বুঝে নিব।’

_____

আলাপন শেষে শিহাবদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো সবাই। গাড়িতে বসে নাজিফা বললেন, ‘আমি জানতাম আমার দুআ কবুল হবে। এই ছেলেটার মতিগতি ভালো ছিল না। বিয়ের কথা শুনতেই পারতো না! উমরায় গিয়ে আল্লাহর কাছে কত করে চেয়েছি যেন ছেলেটার সুবুদ্ধি হয়।’

জামিল হেসে বললো, ‘আব্বা চাননি?’

আরশের বাবা লুকমান গুরুগম্ভীর স্বভাবের। আরশ কিছুটা বাবার মতো হয়েছে। তিনি জামিলের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘আমি ওর ব্যাপারে কিছু চাওয়ার অধিকার রাখি নাকি?’

এ কথাটা অভিমান থেকে বলেছেন লুকমান। আরশকে আইন বিভাগে জড়াতে অনেকবার নিষেধ করেছেন তিনি। ছেলেটা কথা শোনেনি। তাই এরপর থেকে তিনি ছেলের যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এমন একটা বাক্য বলবেনই। বলা যায়, আরশকে একটু খুঁচিয়ে দেয়া!

আরশ চুপ করে আছে। আমান বিষয়টা স্বাভাবিক করতে বললো, ‘জামিল ভাই, আমাদের ছোট ভাইটার যে বিয়ের শখ হয়েছে এটাই অনেক। তবে আম্মু, তুমি কীভাবে দুআ করলে বলো তো? আল্লাহ যেহেতু কবুল করে নিয়েছেন, তোমার মতো আমরাও দুআ করা শিখে নিই।’

নাজিফা খুশি হয়ে বললেন, ‘আমি বলেছি, হে আল্লাহ! আমার পরিবারে সুখের কমতি নেই তোমার অশেষ দয়ায়। তুমি এই রহমত অটুট রেখো আল্লাহ। যেকোনো বিপদে যেন তাওয়াক্কুল রাখতে পারি এই সাহস দৃঢ় রেখো আল্লাহ। আমার সুন্দর পরিবারে আমি খুব শান্তিতে আছি আল্লাহ, গফুরুর রহিম। আমার কোনো অভাব নেই, শুধু আমার ছোট ছেলেটাকে একটু বুদ্ধি দিও আল্লাহ। তার জীবনটা রঙিন করে দিও। আমার ছোট ছেলের জন্য যেমন চক্ষু শীতলকারিণী প্রয়োজন, তেমনই এনে দিও আল্লাহ। বেশি চাই না, শুধু ওর সুখটা থাকলেই হলো।’

সবাই খুব খুশি হলো এমন দুআ শুনে। আমানের স্ত্রী ফাতিহা জামিল থাকায় তেমন একটা কথা বলছে না। এবার সে একটু হেসে আমানের কানে কানে বললো, ‘আম্মা খুব সুন্দর দুআ করতে জানেন।’

জামিল দুষ্টুমি করে বললো, ‘তবে আম্মা, আপনি যে কুমারী মেয়ে চাননি? দেখা গেল কোনো এক বুড়ো জুটে যাচ্ছে আমার শ্যালকের কপালে। হাইরে!’

সবাই হেসে ফেললে নাজিফা চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘তাই তো! কুমারী চাওয়া হয়নি। আমার যা ছেলে, যদি বুড়ো বিয়ে করে আনে?’

জামিল বললো, ‘ডিভোর্সি কিংবা বিধবা পঞ্চাশ বছরের যুবতী?’

জামিল বেশ রসিক মনের মানুষ। তার কথাকে সবাই মজা হিসেবে নিলেও আরশ মোটেও মজা পাচ্ছে না। এবার আরশ বলে উঠলো, ‘বিধবা কিংবা ডিভোর্সড হলে সমস্যা কোথায় আম্মু?’

সবাই চুপ হয়ে গেল। নাজিফা মুচকি হেসে বললেন, ‘সমস্যা আবার কিসের? আল্লাহ যা চাইবেন তাই হবে। তবে তুই যেমন কুমার, বউ কুমারী হোক। এটা চাওয়া তো দোষের না।’

– কুমারী বউ ধরো পরের হাত ধরে পালিয়ে গেল। তার চেয়ে দ্বীনদার বিধবা কিংবা ডিভোর্সি কি ভালো নয়?
– ওমা! আমরা কি না জেনেশুনে বিয়ে দিব তোকে? পরের হাত ধরে পালাবে কেন? এরকম হলে তো বিধবা মেয়েও পালাতে পারে।

ঘটনা অন্যদিকে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আরশ আর কথা বাড়ালো না। জামিল আনিকার স্বাস্থ্যের কথা বলে প্রসঙ্গ বদলে ফেললো। গাড়িতে থাকা সবাই এখন আনিকাকে নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। তবে এখানে দুজনের মন অন্যদিকে। আরশ ভাবছে তার মামলার কথা। শিমুলকে নিয়ে আপাতত তার চিন্তা নেই। আর আনিকা ভাইয়ের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। ডিভোর্স কিংবা বিধবা নিয়ে এত বেশি প্রতিক্রিয়া দেখানোর কি কোনো অর্থ থাকতে পারে?

_____

আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানের আশেপাশে সিআইডির সমাগম। এখানকার শ্রমিকদের সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখানে কাউকে সাধারণত ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। ক্ষেত্র বিশেষে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে এসে তারপর ঢুকতে হচ্ছে। কিন্তু দারোয়ান আকিজের কথায় অবাক হলেন সিআইডি কার্তিক।

– প্রতি শুক্রবার আসে মেয়েটা?
– জে স্যার। মাইয়ারে কইছিলাম এইহানে ঢুকতে দেওন যাইবো না। পড়ে ইমাম আইসা কইলো হ্যারে যেন ঢুকতে দিই। হ্যায় নাকি খারাপ না।

বিরক্ত হলেন কার্তিক, ‘এই অনুমতি ইমামকে কে দিয়েছে? আমরা নিজে চোখে না দেখা পর্যন্ত কাউকে প্রবেশ করতে মানা করেছি। অথচ ইমাম আগ বাড়িয়ে… তোমার ইমামকে ডেকে আনো।’

আকিজ চলে গেলে কার্তিক ভ্রু কুঁচকে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মিলন সাহেব খুন হওয়ার জায়গাটা পর্যবেক্ষণে করছেন। কার্তিককে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি বললেন, ‘তোমার চেহারা এমন হয়ে আছে কেন?’

কার্তিক ইমামের হস্তক্ষেপের বিষয়টা প্রকাশ করলেন। মিলন অবশ্য তেমন একটা গুরুত্ব দিলেন না।
– হতে পারে মেয়েটা ইমামের পরিচিত।
– তা হলেও কেন আমাদের কথা না শুনে যে কাউকেই ঢুকতে দেবে?
– আপনার এটাকে গুরুতর সমস্যা মনে হলে আপনি শুক্রবারে এসে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যাবেন। এখন এসব বিষয় মাথায় না নিয়ে আসল ঘটনা দেখুন। জায়গাটায় খুনের কোনো আলামত পেয়েছিলেন?

স্বাভাবিক হলেন কার্তিক, ‘জি। মাটিতে আর ড্রাগসে দুই ধরণের রক্ত পাওয়া গিয়েছিল। দুটিই ভিন্ন গ্রুপের রক্ত হওয়ায় শনাক্ত করতে সুবিধা হয়েছে। কিন্তু ইনজেকশনে পাওয়া ডিএনএর সাথে ওই দুই রক্ত থেকে পাওয়া ডিএনএ ম্যাচ হয়নি।’
– কিন্তু খুন হয়েছে দুজন?
– জি স্যার।

মিলন চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘এমন কি হতে পারে এখানে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ছিল? কি মনে হয় তোমার?’

– স্যার, যারা মাদক দ্রব্য সেবন করে তারা একটা ইনজেকশন সবাই মিলে ব্যবহার করে। এজন্য এটা নিয়ে সন্দেহ দূর হচ্ছে না। মাটিতে বিভিন্ন জায়গায় রক্ত লেগে ছিল। তিন জায়গার মাটি নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্টে সেখানে খুন হওয়া দুজনের রক্ত পাওয়া গিয়েছে। আর রক্ত মাখা ইয়া-বার প্যাকেটে আফজাল সাহেবের কাজের ছেলেটার রক্ত ছিল। মাটি কাটার শ্রমিকের রক্ত শুধু মাটিতে পেয়েছি। ইনজেকশনে এই দুজনের কারো ডিএনএ ম্যাচ করেনি। তাই আমরা দুটো বিষয় ধারণা করছি।
– কি কি?
– প্রথমটা হলো, হয়তো তারা তখনো ইনজেকশন ব্যবহার করা শুরু করেছিল না। তাই একই ইনজেকশন আগে যে ব্যবহার করেছে তার আঙুলের ছাপটাই লেগে আছে। ওটা একটা প্যাকেটে থাকায় অন্যদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেখানে নেই। দ্বিতীয় যেই ধারণাটা করছি তা হলো, এখানে তৃতীয় কেউ ছিল। যে আগে ইনজেকশন ব্যবহার করেছে। এবং সে-ই খুনটা করেছে।

মিলন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘খুন হওয়া দুজনের নাম কি?’

– কাজের ছেলেটার নাম আতিক। আর মাটি কাটার ছেলেটার নাম ভুবন।

_____

বাসায় ফিরে অবাক হয়ে দেখলো রিশতা, সোফায় আজমেরীর সামনে বসে আছেন একজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ। রান্নাঘরের দরজা ধরে মর্জিনা খালা সেদিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আজমেরী রিশতাকে দেখে অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ‘কিরে? তোর তো এই সময় স্কুলে থাকার কথা!’

রিশতা ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে বললো, ‘সামনে একটা অনুষ্ঠান আছে স্কুলে। মেয়েগুলো নাচ রিহার্সেল করতে গিয়েছে বলে আজ অর্ধেক দিন ক্লাস হলো।’

রিশতাকে দেখে লোকটা স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু লোকটার মুখে চোর ধরা পড়ে যাওয়ার মতো অভিব্যক্তি ছড়িয়ে আছে। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘কেমন আছো রিশতা?’

রিশতা লোকটাকে চেনে না। তবু ভদ্রতার খাতিরে হেসে বললো, ‘ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?’

– আমিও ভালো আছি। তুমি করেই বলছি তোমাকে, যেহেতু বয়সে আমার মেয়ের মতো। আমাকে চেনোনি বুঝতে পারছি। আমি জুয়েল, আজমেরীর কলিগ ছিলাম।

আজমেরী পূর্বে মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ছিলেন। রুদ্রর স্কুল শুরু হওয়ার পর সেটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে তিনি বাসাতেই আছেন। জুয়েলের পরিচয় জানার পর রিশতার মুখে স্বস্তি ফিরে এলো। সে হেসে বললো, ‘ওহ আচ্ছা, আর আমি রুদ্রর স্ত্রী রিশতা। রিশতা জাহান। আপনারা গল্প করুন, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।’

জুয়েল আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘না না, অনেক গল্প হয়েছে আমাদের। এরপর একদিন এসে তোমার সাথে গল্প করবো।’

রিশতা ‘ইন শা আল্লাহ’ বলে ঘরে ঢুকে গেল। তবে ঘরে ঢুকে দরজা আটকাতে গেলে বাধা পেলো সে। মর্জিনা খালা হাত ঢুকিয়ে রেখেছেন। তার দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকালে তিনি মৃদু স্বরে বললেন, ‘আজকে তোমাকে সব বলতেই হবে আমার। তুমি সময় পাইলে জানাবা।’

এই বলে তিনি চলে গেলেন। রিশতার মনে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জমেছে। সেগুলোকে এক পাশে রেখে সে জামা বদলে নিলো। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার ছাড়া বাকি দিনগুলো সে সকাল সকাল গোসল সেরে ফেলে। তাই আজ আর গোসলের ঝামেলায় যেতে হলো না। ঘরের বাইরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে মিষ্টির বাটি বের করে ডাকলো সে, ‘মা! আপনি সকালে মিষ্টি খেয়েছেন? আপনার তো ডায়াবেটিস মা। মেনে না চললে কিভাবে হবে!’

মর্জিনা তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এসেই ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বললেন, ‘কাকে খুঁজছো?’

রিশতা মিষ্টির বাটিটা দেখিয়ে বললো, ‘মাকে। দেখেছেন? মা মিষ্টির লোভ সামলাতে পারেনি।’

– জি না বোকা মেয়ে। তোমার মাকে যৌবনের স্বাদ ধরছে।
– ছি ছি! এসব কি কথা মর্জিনা খালা? এভাবে না বলে সরাসরি বলুন কি হয়েছে।
– দাঁড়াও বলতেছি। আগে ভাইজানকে ওষুধ দিয়ে আসি।
– এখনো ঔষধ দেননি! এত দেরি কেন করলেন খালা? কি আশ্চর্য! এগারোটা বেজে গিয়েছে।

মর্জিনা খালাকে বকতে বকতে নিজেই ঔষধ নিয়ে হিশামের কাছে গেল রিশতা। হিশামকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে তার গায়ে চাদর টেনে দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। মর্জিনা খালা এলে সে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘খালা, বাবা ঘুমিয়ে যাক। এরপর কথা বলবেন।’

হিশাম ঘুমিয়ে পড়েছেন। মর্জিনা রিশতার সামনে মেঝের উপর বসে তার হাত ধরে বললেন, ‘আল্লাহর কসম বলো কাউকে বলবা না?’

– কি সম্পর্কে খালা?

এরপর মর্জিনা যা বললেন, রিশতার পুরো পৃথিবী থমকে গেল। মনে হলো, আশ্রয়ের যেই অবশিষ্ট অংশ ছিল তা-ও হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। ঝাপসা চোখে সামনের দিনগুলোর পরিণতি ভাবছে সে। ঘোর কাটলো মর্জিনার আর্তনাদে। মর্জিনা উচ্চস্বরে বলছেন, ‘ভাইজান! ভাইজান! কি হইলো ভাইজান?’

রিশতা দ্রুত পেছন ফিরে দেখলো, হিশামের মুখ দিয়ে অনবরত সাদা ফ্যানা পড়ছে। চোখ উল্টে গিয়েছে। হাত পা কাঁপছে অতি দ্রুত!

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here