‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ৪.
তাবিনা মাহনূর
__________
– আম্মা, আইজ এইহানে ঢুকতে পারবেন না।
আজিমপুর কবরস্থানে প্রবেশ নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। দাফন কাজ চলছে কিন্তু কবর জিয়ারত কিংবা প্রিয়জনের কবরের কাছে একটুখানি বসে থাকার অনুমতি নেই। লাশ এলে মসজিদে জানাজা পড়িয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেই সবাইকে বের করে দেয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনে কাউকে ঢুকতে নিষেধ করা হয়েছে। এমন অবস্থায় রিশতা রুদ্রর কবরের কাছে যেতে পারলো না। গেট থেকেই দারোয়ান তাকে মানা করে দিলো।
রিশতা দারোয়ানকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো, ‘মামা, আমি প্রতি শুক্রবার এখানে আসি। আপনি চাইলে আক্কাস চাচাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।’
– আপনি যে এইহানে আহেন তা তো আমি নিজেও জানি আম্মা। কিন্তু পুলিশের নিয়ম না মানলে আবার জেলে ঢুকাইয়া দিব।
রিশতার মনটা ভার হয়ে এলো। এমন নিয়মের কারণ জানতে চাইলে দারোয়ান বললো, ‘আমি জানি না আম্মা। তয় এইহানে খুন-খারাবী বাড়তাছে। এই জইন্য হতে পারে।’
রিশতা দাঁড়িয়ে থাকলো। তার ধারণা, পুলিশ আসবে এখানে। সে অনুরোধ করবে অন্তত তাকে যেন ঢুকতে দেয়া হয়। কিন্তু এখন জুম্মার সালাতের সময়। কেউ অন্যান্য দিন সালাত আদায় করুক আর না করুক, জুম্মার সালাত আদায় করে অনেকেই। তাই এসময় পুলিশের আসার কথা নয়। দারোয়ান কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনে যান আম্মা। আমি নামাজে যামু।’
– আপনি নামাজ পড়তে যান মামা। আমি পুলিশ আসার অপেক্ষায় থাকবো।
– পাগলামি কইরেন না। একদিন কবরের কাছে না গেলে কিছু হইবো না।
এসময় পাঞ্জাবি পায়জামা পরা এক ভদ্র লোক ভেতরে ঢুকতে চাইলে তাকে ঢুকতে দেয়া হলো। রিশতা স্বর উঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য! উনাকে কেন ঢুকতে দিলেন?’
দারোয়ান খুব বিরক্ত হয়ে আছে রিশতার উপর। তার কণ্ঠেও সেই রাগটা প্রকাশ পেলো, ‘আরে উনি ইমাম। আজিমপুর গোরস্থান শাহী মসজিদ চিনেন? ঐখানকার ইমাম। না জাইন্যা খ্যাক কইরা উঠতাছেন। যান তো!’
তরুণ ইমাম পেছন ফিরে তাকালেন। দারোয়ানকে বললেন, ‘এমন ব্যবহার করা মুমিনের কাজ নয়। আপনি সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে পারতেন আকিজ চাচা।’
আকিজ কৈফিয়তের সুরে বললো, ‘এই মাইয়া কখুন থেইক্যা জ্বালাইতেছে জানেন? বলতেছি ভিতরে ঢুকতে দেওন যাইবো না।’
ইমাম বললেন, ‘জুম্মার সালাত শুরু হয়ে যাবে। আপনাকে আর এখানকার শ্রমিকদের নিয়ে যেতে এসেছি। তর্ক না করে তৈরি হয়ে নিন। ওযু করে আসুন।’
তিনি একবারও রিশতার দিকে তাকাননি। অন্যদিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘আপনি চাইলে ভেতরে আসতে পারেন। আমি পুলিশের সাথে কথা বলে নিব।’
রিশতার ইমামকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। তবু মনের গহীনে সতর্ক বাণী বারবার কড়া নাড়ছে। আল্লাহর নাম নিয়ে সে ভেতরে ঢুকলো। রুদ্রর কবরটা আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানে। নতুন কবরস্থানে হলে সে অনায়াসে যেতে পারতো। সেখানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। কবরটা কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে গিয়ে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে সে চলে যাওয়ার জন্য দ্রুত অগ্রসর হলো। গেটের কাছাকাছি আসতেই ইমামের ডাক পড়লো।
– শুনুন!
পেছন ফিরলো রিশতা। ইমাম এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি বললেন, ‘এরপর থেকে আপনি আসতে পারেন। আপনাকে সন্দেহের অধীনে রাখা হবে না।’
ইমামের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে মুচকি হাসলো সে, ‘অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনার সহায় হন।’
হঠাৎ ইমাম তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে সে বিব্রত বোধ করলো। ইমাম বলে উঠলেন, ‘হয়েছে আপনার?’
রিশতা অবাক হয়ে পেছনে তাকালো। দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। সে মনে মনে ইমামকে নিয়ে বাজে ধারণা পোষণ করায় নিজেকে শাসন করলো। ইমাম তার দিকে তাকাননি, বেশ ভদ্র স্বভাবের মানুষ তিনি।
_____
কবরস্থানের কেসটা খুব জটিল নয়। তারপরও জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ইশার সালাত আদায় করে খাওয়া দাওয়া শেষে আরশ তার ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। ম্যাপে আজিমপুর কবরস্থানের আশেপাশের জায়গা খুঁজে দেখছে, কোথায় কেমন নিরাপত্তা দিলে তার জন্য তদন্ত করতে সুবিধা হবে।
মনে পড়ছে তার রাশেদ স্যারের কথাগুলো। সেসময় স্যার তাকে নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেছিলেন। সবটাই ভালো ছিল, কিন্তু শেষের অংশ নিয়ে আরশ বেশ চিন্তিত। রাশেদ বলেছেন…
– যেহেতু আফজাল হক কিংবা লাবিব মোর্শেদ, কেউই এখনো আমাদের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছায়নি এই ব্যাপারে, তাই আমাদেরকে নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
– বুঝতে পারলাম না স্যার।
রাশেদ বুঝিয়ে বললেন, ‘শোনো, কবরস্থানের বিষয়টা নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হচ্ছে স্থানীয় মানুষের অভিযোগের কারণে। কিছুদিন আগে সেখানে দুজনকে খুন করা হয়েছে। লাশ কেউ রেখে গিয়েছে নাকি খুন তা নিয়ে দ্বিধায় ছিল সবাই। পোস্টমর্টেম করে দুটি লাশের একটিতে ইফেক্টিভ মাদক দ্রব্য ব্যবহারের আলামত পাওয়া গিয়েছে। আরেকটি লাশ শনাক্ত করে জানা যায়, তিনি কবরস্থানের মাটি কাটার শ্রমিক ছিলেন। সুতরাং এটা খুন। ধারণা করা হয়, নেশাদ্রব্য নিয়ে দুজনের কথা কাটাকাটি হওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। তারপর জানা গেল, যেই লোকটা উচ্চমাত্রার ড্রাগ এডিক্টেড ছিল, সে আফজালের বাসার কাজের ছেলে। আর এটা শুধু আমরা জানি। জনগণকে কিংবা যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টা জানানো হয়নি।’
চিন্তিত ভঙ্গিতে আরশের প্রশ্ন থাকে, ‘তাহলে তো বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে আফজাল সাহেবের বিজয় অনিশ্চিত। তাই না?’
– নির্বাচন এমন একটা খেলা যেটা সম্পর্কে ধারণা করা মুশকিল। কাজের ছেলেটা যে লাবিবের গুপ্তচর না, এটারও গ্যারান্টি কি বলো?
– তা ঠিক।
– সমস্যা হলো আফজাল আর লাবিব, দুজনই ঘাপটি মেরে বসে আছেন। অনুমান করেও কুল পাচ্ছি না কে অপরাধী। তাই আমার পরিকল্পনা শোনো।
রাশেদ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আমরা ঠিক করেছি, প্রথমে সিআইডির সাহায্যে আসল অপরাধীকে শনাক্ত করবো। আর তাই এখান থেকে এই দায়িত্বে তোমাকে পাঠানো হচ্ছে।’
– জি। আমি তৈরি আছি।
– এরপর যিনি আসল অপরাধী, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এটা নির্বাচনের আগ দিয়ে হলে খুব ভালো হয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব অপরাধী বের করার চেষ্টা করতে হবে।
– নির্বাচন এখনো প্রায় তিন মাস বাকি। আল্লাহ চাইলে এর মাঝেই সত্য বের করা সম্ভব।
– হুম, ধরলাম অপরাধী ‘এক্স’। এই ‘এক্স’কে গোপনে আমাদের তথ্যগুলো জানানো হবে। ভুলেও সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করা যাবে না।
– তারপর?
– তারপর সে যদি আমাদেরকে খুশি করতে পারে, তাহলে ‘বিষয়টা সমাধান হয়নি, তদন্ত চলছে’ বলে যুগ যুগ পার করে দিব।
এমন প্রস্তাব শুনে আরশের মুখ শক্ত হয়ে এসেছিল। কিন্তু রাশেদ তার লালসার কথা বলেই যাচ্ছিলেন।
– আর যদি তিনি উল্টো হুমকি দেন তবে তার বিপরীতে থাকা মানুষটার সাহায্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়, সংবাদ মাধ্যমে, সব জায়গায় উনার কুকীর্তি প্রকাশ করে দিব। এই দিক থেকে আমরা দুইভাবেই লাভবান। কি বলো আরশ?
আরশ মুখ নামিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বলেছিল, ‘স্যার, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সিআইডির দায়িত্বটা দেয়ার জন্য। আমার কাজ হবে আসল অপরাধী খুঁজে বের করা, তাই তো?’
– শুধু তোমার কাজ না। পুরো ডিপার্টমেন্টের কাজ এটা। ওখানে তোমার চেয়েও অভিজ্ঞ আর দক্ষ সিআইডি আছে। তোমাকে পাঠানোর কারণ তুমি যুবক, দৌড়াদৌড়ির কাজটা তোমাকে দিয়ে বেশি ভালো হবে। আর এতে তোমারও ভালো অভিজ্ঞতা তৈরি হয়ে যাবে। আমার প্রতি তুমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। এটা আমি লিখে দিতে পারি!
রাশেদের দাম্ভিক উত্তরের পৃষ্ঠে আরশ বলেছিল, ‘অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমরা শুধু আসল অপরাধীকে বের করে আপনাকে জানিয়ে দেব। এরপরের কাজগুলো সম্পূর্ণ পুলিশ ও উকিলের। সিআইডির কাজ শুধু অপরাধী শনাক্ত করা। তাই আমার অনুরোধ থাকবে, দোষী বের করে দেয়ার পর এই কেসের সাথে আমার সব কিছু মিটমাট হয়ে যাবে। এরপর আপনারা কাকে কী করবেন, এসব আমার ব্যাপার নয়। আপনি বুঝতেই পারছেন আমি কি বলছি!’
রাশেদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি। তুমি সাধু ছেলে, ঘুষ কিংবা টাকা পয়সা দিয়ে পকেট ভারী করার কাজে যাবে না। আমিও এমন নই। তবে চাকরির খাতিরে এরকম করতে বাধ্য হই। নাহলে জীবন নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া শুরু হয়ে যায়। তুমি তোমার কাজ শেষ করে শুধু অপরাধীর খবর গোপন রাখবে। এরপর তোমাকে আমরা আর কোনো কাজ দেব না।’
_____
রাশেদের কথাগুলো ভাবতে গিয়ে আনমনা হয়ে গিয়েছিল আরশ। আসল অপরাধী ধরা পড়লেও চোখের সামনে অন্যায় দেখে চুপ করে থাকাটা কাপুরুষের মতো মনে হচ্ছে তার কাছে। সরাসরি অন্যায়ে তাকে জড়াতে হচ্ছে না, এর জন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া জানিয়েছে সে। কিন্তু মনের মাঝে অন্যায় নিয়ে ভাবনাচিন্তার বিচরণ কমছে না। এই ভাবনা থেকে মুক্তি পেতে সে ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়ালো। বোনের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো।
সেদিন রুদ্রর মৃত্যুর কারণ, রিশতার সাথে আনিকার সম্পর্ক- এসব ব্যাপারে কথা বলার সময় পায়নি আরশ। এসব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করতে হবে বলে সেদিন আর কথা বাড়ায়নি সে। আজ আনিকার কাছে জানতে হবে।
আনিকা ভেতর থেকে বললো, ‘কে?’
– আমি আপু।
– ভেতরে আয়।
আনিকা ক্বুরআন পড়ছিল। আরশকে দেখে মুচকি হেসে বললো, ‘গল্প করতে এসেছিস? আমি জানি তুই আমার গল্প শুনতে খুব ভালোবাসিস। সামনে বস। আমি ক্বুরআন রেখে আসি।’
আনিকার হাত থেকে ক্বুরআন নিয়ে আরশ নিজেই রেখে দিলো। বিছানার এক কোণে বসে বললো, ‘আজ খাবার খেতে অসুবিধা হয়নি তো?’
– না রে। আজ বমি হয়নি। নরম খিচুড়ি খেতে ভালোই লেগেছে। তোকে কেমন যেন বিমর্ষ দেখাচ্ছে। কিছু হয়েছে?
আরশ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললো, ‘নতুন কেস। বাদ দাও আপু। তুমি গল্প বলো।’
– কি গল্প শুনবি?
– যা বলবে তাই।
আনিকা উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো, ‘এই, বিয়ে করবি?’
বিরক্ত হলো আরশ, ‘আবার সেই একই কথা!’
– তুই কিন্তু আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলার অনুমতি দিয়েছিস!
আরশ অনাগ্রহী হয়ে আনিকার বকবক শুনছে। বোনের কাছে এলে এদিক থেকে খুব শান্তি লাগে তার। চিন্তামুক্ত একটা সময় পার করা যায় তার সাথে।
– তোর ভাইয়ার বন্ধুর বোন। খুবই সুন্দরী মা শা আল্লাহ! আর সুন্দরীর চেয়েও বড় কথা, মেয়েটা দ্বীনদার। তোর ভাইয়ের সামনে একটুও যায়নি। ভালো ইলম আছে। পরিবারের অবস্থাও সচ্ছল। কুফু মিলে গিয়েছে, এখন তুই দেখে রাজি হলেই কথা আগানো যাবে।
– লুতুপুতু মেয়ে না তো?
– এটা আবার কেমন কথা!
আরশ উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘আমার যে জীবন, তাতে কোনো আবেগী মেয়েকে আনলে সংসারে অশান্তি থাকবে।’
আরশের পিছে পিছে আনিকা গেল বারান্দায়। ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আবেগী না হলে সংসার টিকবে কীভাবে? রোবট বিয়ে করে আনলে সংসার যন্ত্রের মতো চলবে, এটা কি ভালো হবে তখন?’
– এমন কাউকে চাই যে ধুঁকে ধুঁকে জগৎ চিনেছে। খারাপ পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে জানে।
– এমন হলে ডিভোর্সি, বিধবা মেয়েরা পারফেক্ট হবে। পরিবার সহ কুমারী মেয়েরা একটু কম বোঝা ধরণের হয়ে থাকে। তুই যেমন চাইছিস, এমন কুমারী আর পরিবারসহ মেয়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন। মেয়ে এতিম কুমারী হলেও বাস্তব জ্ঞান থাকবে তার। কিন্তু পরিবার থাকা মেয়েরা বাবা মায়ের ছায়ায় বড় হয়, বাস্তবতা চিনতে দেরি করে।
আরশ চুপ করে আছে। আনিকা মনে মনে অন্য চিন্তায় ব্যস্ত। তার চিন্তা আরো বাড়িয়ে তাকে অবাক করে দিয়ে আরশ বললো, ‘রুদ্র কবে মারা গিয়েছে?’
আনিকা চোখ দুটো সরু করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘তুই কি বলতে চাইছিস? রুদ্র কবে মারা গিয়েছে নাকি রিশতা কবে বিধবা হয়েছে?’
আরশ চমকে উঠলো। বিব্রত ভঙ্গিতে বললো, ‘সবকিছুর উল্টো অর্থ বের না করলে পেটের ভাত হজম হয় না তোমার।’
আনিকা জোরে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো, ‘রূপসী মেয়ে দেখলে ভদ্র ছেলেরও রূপ বদলে যায়। বুঝলাম বুঝলাম!’
চুপ করে আছে আরশ। এখানে এসে মেজাজ আরো বেশি গরম হয়ে যাচ্ছে। আনিকা বললো, ‘মেয়েটা হিজাব পরে মা শা আল্লাহ। কিন্তু তাকে বোঝাতে হবে হিজাব দিয়েই পর্দা হয় না। মুখ ঢাকা অনেকটাই আবশ্যক। এইযে ওর সুন্দর চেহারা কত পুরুষ দেখছে, এতে বাকিটা এমনিতেই কল্পনা করে নিতে পারবে নোংরা মনের পুরুষগুলো। শুধু চুল ঢেকে কোনো লাভ নেই।’
– তুমি কি আমাকে নোংরা বলতে চাইছো আপু?
– তুইও কথার উল্টো অর্থ বের করিস। এখন বল, রুদ্রকে নিয়ে তোর মাথা ব্যথা কেন? কে হয় সে?
আরশ আনিকার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘রুদ্র আমার ব্যাচমেট ছিল। আমি ক্রিমিনলোজি বিভাগের ছাত্র, আর সে অর্থনীতির ছাত্র। তারপরও আমাদের পরিচয় হয়েছিল একটা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। অনুষ্ঠানে আমি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ছিলাম। সেবার দ্রব্যমূল্য নিয়ে আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বিতর্কে আমাদের দল জিতে গিয়েছিল। এর একমাত্র কারণ রুদ্র। সে তার নিখুঁত দক্ষতার পরিচয় দেয়।’
– তুইও কম নাকি!
– আমি অসুস্থ ছিলাম, দ্রুত কথা বলার শক্তি ছিল না। তাছাড়া রুদ্র এমনিতেও আমার চেয়ে বেশি ভালো বিতর্ক জানে। এরপর থেকে প্রায়ই কথা হতো, তবে সেটা পরিচিত বন্ধু হিসেবে। ঘনিষ্ঠ ছিলাম না আমরা, এমনকি সাধারণ বন্ধুদের মতোও ছিলাম না। দেখা হলে, সালাম আর মুচকি হাসি বিনিময় হতো শুধু। ভার্সিটি লাইফ শেষে আর যোগাযোগ হয়নি, বন্ধুরা ওর খোঁজ খবর জানতো না। আমিও জানতে চাইনি।
আনিকা বললো, ‘আমাদের বাড়িওয়ালার ছোট ছেলে রুদ্র। তোকে বলেছিলাম না আমাদের বাড়িওয়ালার ছোট ছেলে মারা গিয়েছে? উনার জানাজায় গিয়েছিল তোর ভাইয়া।’
– হুম। আমি তো বুঝিনি এই ছেলেই রুদ্র।
– মাত্র এক বছরের সংসার ওদের। বাইক এক্সিডেন্ট করে ছেলেটা মারা গেল। জানিস, রিশতার অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। মেয়েটা এমনিতেই শান্ত, তারপর আরও বেশি গুটিয়ে গেল। বলা উচিত না, দুজনই ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন ছিল। কেমন যেন না-স্তিক না-স্তিক লাগতো দেখে। জানিস, রুদ্র নাকি ড্রিংক্স করতো অনেক। রিশতা কিছুই বলতো না! অথচ সে নিজে কিন্তু খায় না এগুলো। আবার রুদ্র…
আনিকাকে থামিয়ে আরশ বললো, ‘আপু, মানুষ সম্পর্কে ভালো কথা বলো। আর ভালো বলতে না পারলে চুপ করে থাকো।’
– আচ্ছা বলছি না। আমি কি নিন্দা করছি নাকি! যা সত্যি তাই বলছি।
– বোকার মতো কথা বলছো কেন আপু? তুমি নিজেও জানো মানুষের সত্য যে দোষ আছে তা বলে বেড়ানো গীবত। আর মিথ্যে বানিয়ে বলা অপবাদ। আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয় থেকেই সাবধান করেছেন আমাদেরকে।
মুচকি হাসলো আনিকা, ‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম রে। জাঝাকাল্লাহ খইরন।’
– ওয়া ইয়্যাকি। এখন বলো, রিশতার পরিবর্তন হলো কি করে?
– জানি না। দুই মাস নিজেকে ঘরবন্দি রেখেছিল মেয়েটা। তারপর একদিন মাথায় ওড়না দিয়ে লিফটে দেখেছিলাম। কিছুদিন পর দেখি বড় হাতার লম্বা ঘের দেওয়া জামা আর একটা হিজাব জড়িয়ে নামছে। আমাকে দেখে চিনে ফেললো কীভাবে জানি না, মুচকি হেসে সালাম দিলো। কোনোদিন ওর মুখে সালাম শুনিনি। পরে আল্লাহর কাছে ওর আরো হিদায়াহ চেয়ে দুআ করলাম।
অবচেতন মনে আরশও দুআ করে দিলো রিশতার জন্য। তার দিকে তাকিয়ে আনিকা মায়া কণ্ঠে বললো, ‘ছোট্ট ভাই আমার। তোর যেই কাজ, তাতে একজন মানুষের সহযোগিতা খুব প্রয়োজন। এইযে তুই নতুন কেস নিয়ে চিন্তায় আছিস, এখন একজন মনের মানুষ থাকলে তোর সমস্যা সমাধান করতে না পারলেও মানসিক প্রশান্তির কারণ হতে পারতো। তার মুখ দেখলেই অর্ধেক ভার নেমে যেতো।’
– সালাত আদায় করলে এমনিই শান্তি লাগে। আর কাউকে লাগে না।
– সালাত মানুষের অন্তরের সঙ্গী। আল্লাহর সান্নিধ্যে আসার একটা মাধ্যম সালাত। আর আল্লাহর সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয় না, তিনি অতুলনীয়। এই শান্তির ধরণ ভিন্ন রে। যে আল্লাহর মাঝে শান্তি খুঁজে নিয়েছে, তার সত্যিই কিছুর প্রয়োজন নেই।
আরশ চুপ করে আছে। আনিকা আবার বললো, ‘কিন্তু তাই বলে জীবনসঙ্গী কি শুধু বংশ বৃদ্ধির জন্য? এমনটা হলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা ডিভোর্সকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হালাল হিসেবে অবগত করতেন না। মানুষ বাচ্চা জন্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে ফেলতো। জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রিয় বিবি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার জন্য দিনরাত অশ্রু বিসর্জন দিতেন না। তার স্মৃতি মনে করে চোখ ভিজিয়ে ফেলতেন না।’
আনিকার কথাগুলো শুনলে মন ভরে যায়। আরশের মনেও এখন অদ্ভুত প্রশান্তি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বললো, ‘ভাইয়ার বন্ধুর বোনের নাম কী?’
_____
(চলবে ইন শা আল্লাহ)