গল্প :- সঙ্কোচ
পর্ব :- ০৪
Writer :- Kabbo Ahammad
.
.
-:”এদিকে চোখ খুলে মিরা দেখলো তার সামনে একজন অচেনা বুড়ো লোক দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে জাগতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
–“এখন কেমন লাগছে?
–“ঘাড়ে খুব ব্যাথা। মনে হচ্ছে ছিঁড়ে যাবে। (মিরা)
–“হ্যাঁ, প্রেশার হাই তো। এরকম ব্যাথা করবেই একটু।
লোকটার গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো। মিরা দেখেই বুঝতে পেরেছিলো উনি ডাক্তার। ও চারপাশে তাকালো, দেখলো কাব্য জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে জাগতে দেখে ওর সামনে চলে এলো কাব্য। মিরা তখন ওকে জিজ্ঞেস করলো।
–“আশাকে কি পাওয়া গেছে?
–“হ্যাঁ। কালকে রাতেই পাওয়া গেছে, তুমি যখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে তার কিছুক্ষণ পর।
–“কোথায় গিয়েছিলো ও?
–“বাইরে চলে গেছিলো রাগ করে। ওর বড় ভাই-ই ওকে খুঁজে নিয়ে আসে। এখন ওদের বাসাতেই আছে আশা।
–“ওহ, আচ্ছা।
মিরা আর কিছু বললো না। তখন ডাক্তার বললেন।
–“মা, তুমি রেস্ট নাও। আর কিছু নিয়ে টেনশন কোরো না। তোমার প্রেশার আবার বেড়ে গেলে তোমার বেবির কিন্তু প্রবলেম হবে।
তারপর মিরাকে ঘরে একা রেখেই বাইরে বেরিয়ে গেলেন ওরা। ডাক্তার ড্রয়িংরুমে গিয়ে কাব্যকে বললো।
–“আশা কে?
–“আমার রিলেটিভ। কালকে ওর হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনেই মিরা কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায়।
–“ওকে কি আসলেই পাওয়া গেছে?
–“নাহ। মিরাকে মিথ্যা বলেছি আমি।
–“হুম, ভালো করেছেন। মিরাকে সত্যিটা বলবেন না এখন। ওর প্রেশার বেড়ে যাওয়া বেবির ক্ষতির কারণ হবে। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আজকে যাই।
কাব্য তখন ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে দরজা খুলেই দেখলো আশার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখ শুকনো, চোখদুটো ভাবলেশহীন, পাথরের মতো। তাকে দেখে একই সাথে ভয় আর দুঃখ মেশানো এক অনুভূতি হলো কাব্যর। তার মেয়ের বিপদের জন্য তো আসলে সেই দায়ী। তারপরেও কাব্য জিজ্ঞেস করলো।
–“মামা, কেমন আছেন?
আশার সাথে বিয়ের পরেও এই পুরনো সম্বোধনটুকু ছাড়তে পারেনি সে।
–“মিরা নাকি অসুস্থ। ওকে দেখতে এলাম।
মামা যদি মিরার কাছে যায়, তবে মিরা হয়তো জেনে যাবে আশাকে পাওয়া যায়নি। এই ভয়েই কাব্য বললো,
–“মামা মিরা তো ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার বলেছেন কেউ যাতে ওকে ডিস্টার্ব না করে।
–“আচ্ছা। কাব্য তোমাকে একটা কথা বলবো।
মামার হাতে একটা ফাইল। ফাইলে কি আছে কাব্য তা জানে না। কোর্ট অর্ডার নাকি? মামা তো ওদের বিরুদ্ধে মামলাও করতে পারেন, এ অসম্ভব কিছু নয়। কাব্যর মামা তখন সোফায় বসে বললেন।
–“জানো কাব্য আশার সাথে তোমার এ বিয়েতে আমি কেন মত দিয়েছিলাম?’
–“না মামা।
–“মিরার জন্য। এই বিয়েটার আগে যখন ও আমাদের বাসায় যেতো, তখন দেখতাম, আশার ভাবিরা যখনই কোনো খারাপ ব্যবহার করতো আশার সাথে, তখন সাথে সাথেই প্রতিবাদ করতো ও। আমি তখন মনে করেছিলাম, মেয়েটা অন্যরকম, ওর মধ্যে আশার জন্য অনেক মায়া আছে। তাই যখনই মিরা তোমার আর আশার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলো আমার কাছে, আমি রাজি হয়ে যাই। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এটা কত বড় ভুল ধারণা ছিলো আমার।
–“মামা আপনি ভুল বুঝছেন মিরাকে। ওর কোনো দোষ নেই। ওই চাইছিলো আশা থাকুক এখানে। আমিই জোর করে আশাকে পাঠিয়ে দেই।
–“থাক, তোমাকে আর কোনো ফিরিস্তি দিতে হবে না। তুমি যে বউয়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া এক পাও চলতে পারো না, এটা খুব ভালো করেই জানি আমি। এখন বলো, তুমি কি আশার ভাইদের বলেছিলে, যতদিন আশা আমাদের বাসায় থাকবে ততদিন ওর ভরণপোষণের সব খরচ তুমি দিবে?’
–“জ্বী বলেছিলাম।
–“হুম আর এই কথাটি আমি আজ সকালে জানতে পারি। কাল ওর ভাইরা এ কথাটা লুকিয়েছিলো আমার কাছ থেকে। ওরা আশাকে খুব অপমানও করে এই বলে যে, এখন আশার সব খরচ ওদেরই বইতে হবে। ওরা কেন এমন করলো, জানো?
–“না মামা।
–“গ্রামে আমার দশ বিঘা জমি আছে। ওরা দুভাই জমিটা পুরো নিজেদের মধ্যেই ভাগ করে নিতে চায়, আশাকে এর কোনো অংশ দেয়ার ইচ্ছে নেই ওদের। তাই ওরা চাইছিলো, আশার ভরণপোষণের বিনিময়ে জমিটা যেন পুরোপুরি ওদের নামে লিখে দেই আমি। আমার নিজের ছেলেরাই বেইমানি করছে আমার সাথে। ওরা যে এতো নিচ হতে পারে, আমি ভাবতেও পারি নি। আশাকেও ওরাই সরিয়ে ফেলেছে। কাল রাতে আশার রুম থেকে আমি চিৎকারের শব্দ শুনেছিলাম। তখন যদি একবার খোঁজ নিতে যেতাম, মেয়েটাকে আজ হারাতে হতো না। (বলেই মামা কেঁদে ফেললেন)
তারপরেও নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মামা আবার বললেন।
–“যাইহোক, এই ফাইলে আমার ঐ জমির সব কাগজপত্র আছে। আশার নামে পুরো জমি আমি উইল করে দিচ্ছি। আশা যদি ফিরে না আসে, তবে এই জমি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের সম্পত্তি হয়ে যাবে। ওর ভাইয়েরা এর এক কানাকড়িও পাবে না। ওর ভাইয়েরা এখনও এর কিছুই জানে না। আমার বিশ্বাস, জানলে আশার মতো আমাকেও সরিয়ে ফেলবে, তাই লুকিয়েই করছি কাজটা। ফাইলটাও আর আমার বাসায় রাখবো না, আমার এক পরিচিতের বাসায় রাখবো। তোমাকে এ কথাগুলো কেন বলছি, জানো?
–“না।
–“বলছি,কারণ তোমাকে জানাতে চাই, যদি আশা ফিরে আসে, তবে ও কিন্তু আগের মতো অসহায় মেয়ে থাকবে না। তখন ও হবে বিরাট সম্পত্তির মালিক। আর তখন ওর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
এসব বলেই মামা চলে গেলেন।
কাব্য তখন ভাবতে লাগলো, তার মামা আগে থেকেই প্রচন্ড রাগী আর জেদি মানুষ। রিটায়ার্ডের পর ছেলেদের সংসারে থাকতে থাকতে তিনি কেমন যেন মিইয়ে গিয়েছিলেন। আজ সে তার পুরনো মামাকে দেখতে পেল।
কিন্তু এখন কাব্যর একমাত্র কাজ মিরার খেয়াল রাখা। আশাকে যে পাওয়া যায়নি, এটা মিরা জানতে পারলে মিরা আবার অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তখন বেবির ক্ষতি হবে। আর বেবির কিছু হলে মিরাকে বাঁচানো যাবে না।
ওদিকে আশার বড় ভাই গিয়াস ঘরে বসে সিগারেট টানতে টানতে টিভিতে সিনেমা দেখছিলেন। ঘরে বসে সিগারেট খেতে খুব ভালো লাগে তার, কিন্তু বাচ্চাদের জন্য খেতে পারেন না। আজ বাচ্চারা বন্ধুর বাসায় গেছে, তাই আজ কোনো বাঁধা নেই। আবার একটা টান দিতে যাবেন তিনি, এসময়ই তার বউ জবা ঘরে ঢুকে রেগে মেগে বললো।
–“তুমি এখানে বসে সিগারেট খাচ্ছো?
–“উফ, আজকে ঝামেলা করো না তো। ছেলেমেয়েরা বাসায় নেই।
–“ধুর, তোমার সিগারেট নিয়ে কে কথা বলছে। তোমার বাবা, সকাল সকাল ফাইল নিয়ে বাইরে গেছেন। মতির মা দেখেছে। দেখো তোমাদের জমি আবার বিলিয়ে দিয়ে আসেন কিনা।
কথাটা শুনে গিয়াস তাড়াতাড়ি আজমলকে ফোন দিলো। আর দেরি করা যাবে না, হাত নোংরা করতেই হবে। তখন আজমল ফোন ধরেই বললো।
–“বস, এতোদিন পর মনে পড়লো আমারে?
–“শুনো আজমল, একটা কাজ করতে হবে।
তারপর কি করতে হবে আজমলকে বুঝিয়ে দিলো গিয়াস।
–“টেনশন নিবেন না বস। এমনভাবে কাজটা করবো, আপনার বাবা কিছু টের পাবে না। (আজমল বললো)
তারপর ফোন রেখে গিয়াস সিগারেটে লম্বা এক টান দিয়ে বিছানায় বসে পা নাচাতে লাগলো। আজমলের উপর তার পুরো বিশ্বাস আছে, ও কাজে কোনো খুঁত রাখবে না।
ঠিক সেসময়ই সেখান থেকে বেশ দূরের এক শহরের এক বাড়িতে হুলস্থূল কাণ্ড ঘটছে। বাড়ির গৃহকর্ত্রী তার ছেলের উপর চেঁচাতে চেঁচাতে বললেন।
–“মেয়েটাতো এখনো ঘুমাচ্ছে। তোর কি কখনো আক্কেল হবে না আলিফ? এভাবে অচেনা একটা মেয়েকে কেউ বাড়ি নিয়ে আসে?
–“আমি কি করবো? তোমাকে তো বলেছি ওকে কিভাবে পেয়েছি, ওকে কি ফেলে আসতে পারতাম ওখানে?
–“মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর ভাইয়া। দেখ ঘুম ভেঙে আবার ‘মাই হিরোওওও’ বলে তোর গলা জড়ায় ধরে কিনা। (গৃহকর্ত্রীর মেয়ে হাসতে হাসতে বললো)
–“মাইশা তুই অনেক ফাজিল হয়েছিস। চড় দিয়ে তোর দাঁত ফেলে দেয়া উচিত।
–“দে না। বাম পাটির একটা দাঁত ব্যাথা করছে। তুই ফেলে দিলে ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া লাগবে না।
ভাই-বোনের এ ঝগড়া মায়ের কানে ঢুকছিলো না। তিনি ভাবছিলেন কালকে খুঁজে পাওয়া মেয়েটার কথা। উপরে উপরে রাগ দেখালেও মেয়েটাকে দেখে খুব মায়া হয় তার। মেয়েটা এমন ভাবে ঘুমাচ্ছে যেন কয়েকরাত ঘুমায়নি সে। মেয়েটা কে, কেন বাড়ির বাইরে ছিলো কাল রাতে কিছুই জানতে পারেন নি। শুধু জানেন কাল রাতে কি এক ভয়ঙকর ঘটনা ঘটেছিলো মেয়েটার সাথে।
.
.
চলবে…………..