বিয়ের দশ বছর পরেও কোনো বেবি নেই কাব্য আর মিরার সংসারে। সমস্যাটা অবশ্য মিরার।
ছোটবেলায় এক ছোট অপারেশন করতে গিয়ে মিরার ওভারির একটা নালি কেটে যায়। এরপর থেকে মিরা সন্তান নিতে অক্ষম। অথচ কথাটি সে জানতে পারে বিয়ের তিনবছর পর, যখন ও আর কাব্য পাগলের মতো এক ডাক্তার থেকে আরেক ডাক্তারের কাছে ছুটে বেড়াচ্ছে বেবির আশায়।
সে রাতে মিরা উন্মাদের মতো কেঁদেছিলো। নিজের চাইতেও ওর বেশি কষ্ট হচ্ছিলো কাব্যর জন্য। ওর তো কোনো দোষ নেই। কেবল মিরার জন্যই সারাজীবন বাবা ডাকটি শুনতে পাবে না সে। মিরার কেবল মনে হচ্ছিলো সে কাব্যকে ঠকিয়েছে।
অথচ কাব্য না থাকলে মিরা হয়তো সে রাতে মারাই যেত।
এতো ভয়ঙকর কথাটি জানবার পরেও সে রাতে কাব্য ছিল একদম শান্ত। মিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে ওর কানে কানে বলেছিলো।
–“পাগল। এমন কেউ করে? কত জনেরই তো বাচ্চা হয় না, তারা কি বেঁচে থাকে না? আমরা দুজনই টোনাটুনির মতো রয়ে যাবো সারাজীবন। আমাদের আর কিছুর দরকার নেই।
কাব্যর এই কথাটুকুই মিরার অন্তরে সে রাতে শীতল পরশ বুলিয়ে দিয়েছিলো। কাব্যকে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার বুকে শেষ আশ্রয় খুঁজেছিলো সে।
সেই কাব্যর আজ বিয়ে। মিরা নিজেই বিয়ে দিচ্ছে কাব্যর।
আসলে মিরার কিছুই করার ছিলো না। ওরা যতোই ভালো থাকতে চাক, সমাজ ওদের ভালো থাকতে দিলো না। ওদের দিকে আঙুল তুলে তুলে বারবার দেখালো, ‘দেখ দেখ, ঐ অভাগা অলুক্ষুণেদের কোনো বাচ্চা নেই।’ কোনো অনুষ্ঠানে ওরা দুজন গেলে ওদের ঘিরে কানাকানি ফিসফাস শুরু হয়ে যেত। কারো নতুন বেবি হলে ওদের কাছে দেয়া হতো না, যদি বাচ্চার অমঙ্গল হয়? কাব্যর মা ‘নাতি নাতি’ করে আফসোস করতেন মিরার সামনে, উঠতে বসতে খোঁটা দিতেন। মিরা আর নিতে পারছিলো না।
কাব্য অবশ্য মুখে কিছু বলতো না, কিন্তু মিরা বুঝতো, ওরও একই অবস্থা।
এভাবে আর চলা যায় না। মিরা নিজের মনের উপর ছুরি মেরেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলো, বিয়ে দিতে হবে কাব্যর। কাব্যকে বোঝাতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হলো সে। মেয়েও ঠিক করে ফেলল মিরা, কাব্যর মামাতো বোন আশা। এর আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো ওর, কিন্তু বছর না ঘুরতেই স্বামী মরে বিধবা হয় মেয়েটা। এরপর থেকে বাবার ঘরে বোঝা হয়েছিলো। কাব্যর সাথে বিয়ে হলে হয়তো কিছুটা কষ্ট কমবে মেয়েটার।
তারপর ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল কাব্য আর আশার। মিরা ওর আর কাব্যর রুমটা ছেড়ে দিলো নবদম্পতির জন্য, নিজের হাতে ওদের বাসরঘরে রেখে এলো। তারপর পাশের গেস্টরুমটা, যেটা ও আজ থেকে নিজে থাকবার জন্য গোছগাছ করে রেখেছে, সেখানে গিয়ে দরজায় খিল দিলো। এতক্ষণ নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলো সে, এখন আর পারলো না। বিছানায় পরে আকুল হয়ে কাঁদলো। কে যেন তার অন্তরটা তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করছে, এতো যন্ত্রণা হচ্ছে তার। কাঁদতে কাঁদতে হাঁপাতে লাগলো মিরা, মাথা ঘুরছে,বমি বমি লাগছে ওর। রুমের সাথে অ্যাটাচড বাথরুম ছিলো, সেখানে দৌড়ে গিয়ে বেসিনে হড়হড় করে বমি করে দিলো সে।
তখন হঠাৎ এক সন্দেহ উঁকি দিলো ওর মনে। ওর পিরিয়ড মিস হয়েছে গত মাসে। অ্যান্টি ডিপ্রেশনাল মেডিসিন নিচ্ছিলো ও কয়েকমাস ধরে, এটাকে সেই মেডিসিনের সাউড ইফেক্ট মনে করে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি ব্যাপারটাকে। কিন্তু যদি এটা অন্য কিছু হয়?
মিরার ব্যাগে ওর বোন শিলা ওর নিজের জন্য কেনা প্রেগনেন্সি কিট রেখেছিলো আজকে, এতো ব্যস্ততায় ওটা দেয়ার কথা আর মনে ছিলো না। সেই কিটটাই বের করলো মিরা, টেস্ট করে দেখবে। দেখলো। খুব সুন্দর রিং ফুটে উঠলো টেস্ট কিটে। রেজাল্ট পজিটিভ।
ভিজে বাথরুমের মেঝেতেই বসে পড়লো মিরা, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এ কি করে সম্ভব? কিভাবে ও কনসিভ করলো?
সেই অন্ধকার বাথরুমে একা বসে রইল মিরা, সারারাত।
.
.
চলবে…………..
.
গল্প :- সঙ্কোচ
পর্ব :- ০১
লেখা :- কাব্য আহম্মেদ