#শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
#৪র্থ_পর্ব
হেনা বেগম নিজ রুমে ঢুকতেই যাবেন তখন শান্তকে ডাক দিয়ে বলেন,
“আমার রুমে আসো।“
মায়ের কথামতো শান্ত ও তার পিছু পিছু রুমে যায়। হেনা বেগম হিজার খুলতে খুলতে বলেন,
“আজ এই অপমানের কারণটা তুমি। তোমার জন্য আমি এতো অপমানিত হয়েছি। রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আমার ছেলেকে কি না ওই মেয়েটা রিজেক্ট করে, আমার শিক্ষা নিয়ে সে কথা বলে। কতো বড় স্পর্ধা! আমি অবাক হয়েছি।“
“সরি মা, আমি জানতাম না ভাবী এই মেয়েটাকে আমার জন্য বাছবে।“
“আমি কিছু জানি না। আমার বাড়ির বউ হিসেবে আমি এই মেয়েকেই দেখতে চাই শান্ত। যেদিন ওই মেয়েটা মাথা নিচু আমার ঘরে ঢুকবে সেদিন আমার এই অপমানের ক্ষোভ মিটবে।“
মায়ের এমন অদ্ভুত কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় শান্ত। তার মায়ের মাথায় কি চলছে? এতো মেয়ে থাকতে সেই বেয়াদব, উদ্ধত মেয়েটাই কেনো? মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
“সরি মা, আমি ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারবো না। শুধু তোমার কথা তাখতেই ওখানে আমি গিয়েছিলাম। হয়তো অন্য কোনো মেয়ে থাকলে আমার আপত্তি ও থাকতো না। কিন্তু নবনীতা, অসম্ভব। আমি ওই মেয়েকে কখনোই বিয়ে করতে পারবো না।“
“যদি বলি আমার ওকেই পছন্দ, তাহলে?”
ঝাঁঝালো কন্ঠে কথাটা বলেন হেনা বেগম। শান্ত তার মার কথাগুলোকে প্রচন্ড অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। যে মেয়ে তার ছেলেকে এতো অপমান করেছে তাকেই কিনা নিজের বাড়ির বউ করতে চাচ্ছেন। এটা লজিক্যালি অসম্ভব। হেনা বেগমের স্বভাব এতোটাও দিল দরীয়া নয়, তার মতো সাহসী, কড়া এবং স্ট্রিক্ট মহিলা খুব কম ই আছেন। নিজের মাকে ভালো করেই চিনে শান্ত। স্বাধীনতার সময় হেনা বেগমের বাড়ি পাক বাহিনীর এক দল এসেছিলো। তখন হেনা বেগমের বয়স ছিলো মাত্র সাত বছর। তিন বোনের সবচেয়ে ছোট হওয়ায় ডানপিটে পনা যেনো রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিলো তার। পাক বাহিনী যখন ঘর তল্লাশিতে এসেছিলো তখন হেনা বেগমের বাবা হাসান মির্জা স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাড়ির পেছনের পুকুরের ঝাড়ে লুকিয়ে থাকেন। পাক বাহিনীর বর্বরতা থেকে নিজের মেয়েদের বাচাতে সারা রাত সেই ঠান্ডা পানির ভেতর অর্ধনিমজ্জিত হয়ে লুকিয়ে থাকেন তারা। হেনা বেগম এতো ছোট হবার পর ও সারারাত শুধু নাক উঠিয়ে সেই ঠান্ডা পুকুরে ডুবে থাকেন। পাক বাহিনী যখন প্রস্থান করে, তখন তারা সেই পানি থেকে উঠে। পানি থেকে উঠতেই হাসান মির্জা খেয়াল করে তার ছোট সাত বছরের কন্যার পায়ে একটা লম্বা গেছো সাপ আটকে আছে। হয়তো ঝোপ ঝাড় থেকে এসেছে। সাপটা তার পায়ে জড়িয়ে আছে অথচ এতোগুলো ঘন্টা বিনা শব্দে তার মেয়ে পানিতে নাক উচিয়ে অর্ধনিমজ্জিত ছিলো। তার সাহসিকতা এবং নির্ভীক স্বভাবের এছাড়া অনেক কিচ্ছা আছে। নয়তো আটান্ন বছরে নারী একটা গার্মেন্টস এর চেয়ারপারসন কখনোই হতে পারতো না। মাত্র আঠাশ বছর বয়সে স্বামীকে হারান তিনি। একা হাতে স্বামীর ব্যাবসা, পরিবার এবং বাচ্চাদের সামলেছিলেন এই নারী। শান্ত তখন মাত্র তিনমাস। শুধু এই মহিলার বুদ্ধিমত্তা, সাহস এবং কড়া ডিসিপ্লিনের জন্যই পাঁচটা মেশিনের ছোট্ট গার্মেন্ট এখন একটা বিশাল রুপ ধারণ করেছে। ৫০ জন কর্মী থেকে সেখানে আজ হাজার হাজার কর্মী। অথচ আজ সেই হেনা বেগম কি না নবনীতার মতো মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ বানাতে চাচ্ছেন।
হেনা বেগম সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে। শান্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে অস্থিরতা। মায়ের কথা অমান্য করার ইচ্ছে নেই। কিন্তু মা যা চাইছে সেটা দেবার ইচ্ছে বা ক্ষমতা তার নেই। কি উত্তর দিবে তার জানা নেই। মা এমন অনৈতিক জিনিস তার কাছে কেনো চাইছে সেটাই বুজতে পারছে না সে। খানিকটা অস্থির হয়ে বলে,
“মা, পৃথিবীতে তো মেয়ের অভাব নেই। তবে নবনীতাই কেনো? আর ওই মেয়েকে দেখলেই আমার রক্ত টগবগ করতে থাকে। আমি তার সাথে সারাটাজীবন কখনোই কাটাতে পারবো না।“
“কিন্তু তুমি ওর থেকে যোগ্য মেয়ে কাউকে খুজেই পাবে না। যে মেয়ে নির্ভীক হয়ে প্রতিবাদ করতে পারে, যে মেয়ে নির্ভীক হয়ে পুরুষের চোখে চোখ রেখে নিজের ইচ্ছের কথা বলতে পারে সেই মেয়েকেই আমি আমার ঘরের বউ হিসেবে চাই। তুমি সময় নাও। দরকার হলে ওর সামনে প্রমান করো তুমি নির্দোষ। আমি দুটা কারণে মেয়েটিকে আমার ঘরের বউ করতে চাই। প্রথমত মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছে। দ্বিতীয়ত মেয়েটি আমার ছেলেকে রিজেক্ট করেছে। আমি চাই ওই মেয়ে নিজে তোমাকে পছন্দ করবে। এবং আমি যখন তোমার সাথে তার বিয়ের কথা বলবো, সে যেনো নিজ থেকে হ্যা বলে।“
“অসম্ভব।“
“সেটা সম্ভব কিভাবে করবে তুমি ভাবো। এখন যাও। আমি রেস্ট করবো। আর সামিয়া বলো আমার জন্য এক কাপ চা পাঠাতে।“
শান্ত আর কথা বাড়ায় না। জানে মায়ের কথা শেষ কথা। এর উপরে কথা বলা মানে শুধু শুধু নিজের কথা নষ্ট করা হবে। তাই সে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
নিজের ঘরে আসতে ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দেয় শান্ত। নবনীতা কম ছিলো এখন মাও নিজের উটকো ইচ্ছে নিয়ে হাজির হয়েছে। নবনীতাকে বিয়ে করতে হবে ভাবলেই গা শিরশির করে উঠে শান্ত। রাগে বিষিয়ে উঠে মন। একটা নারীকে এতোটা অসহ্য হয়তো কখনোই লাগে নি তার। নবনীতা এবং তার গল্পে কোনো হৃদয় প্রসন্নের ঘটনাই ছিলো না। ছিলো শুধু অপ্রীতিকর কিছু স্মৃতি। একটা মেয়ে তাকে ভরা বাসে থাপ্পড় মেরেছে, সেই মেয়েটি তার বাসায় দাঁড়িয়ে তাকে অপমান করেছে, শুধু তাই নয় আজ তো সীমাই পার করে দিয়েছে সে। অথচ এই উদ্ভত অহমীকার ভাণ্ডারের সাথে তার মা তার বিয়ে দিতে চাচ্ছে। ভাবলেই রাগে মাথাটা ধরে আসে। রাগ সামলাতে না পেরে সজোরে লাথি মারে সামনে থাকা চেয়ারটিতে শান্ত। তারপর মাথা ধরে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে সে। কিছু কিছু সম্পর্কের সূচনাটাই হয় ঘৃণা দিয়ে, নবনীতা এবং শান্ত তার ই জীবন্ত প্রমান। এই সম্পর্কের পরিণতি কি হবে সে অনুমান করতেই গা শিউরে উঠে শান্তের। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আছে তার__________________
দেখতে দেখতে ঘটনার দশদিন পেরিয়ে যায়। শারমিন বেগম মেয়ের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছেন। তার নালিশের পিটারা জসীম সাহেবকেই শুনতে হয়। তিনি চান জসীম সাহেব যেনো তার সাথে কথা বলে। জসীম সাহেব স্ত্রীর এতো জেদ সামলাতে না পেরে অবশেষে মেয়ের কাছে সেদিনের ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বিকেলের সময়,
আসরের নামায পড়ে নিজের ছোট বারান্দায় এসে দাঁড়ায় নবনীতা। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে, শ্রাবণের অবিরাম ধারা। ঘোলাটে বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে নবনীতার। বারান্দা থেকে আকাশটা বেশ ভালো করেই দেখা যায়। রোডের উপর বিল্ডিংটি হয়ায় এই সুবিধা। নবনীতার আকাশ দেখতে খুব ভালো লাগে। উজ্জ্বল হোক কিংবা ঘোলাটে আকাশ তো আকাশ। একরাশ অসীম বিস্ময়ের এক অজানা ঠিকানা। নবনীতার ভাবনায় ছেদ পড়ে দরজার টোকায়। পেছনে ফিরে বাবাকে দেখতে পায় সে। শুক্রবার দিন জসীম সাহেবের ছুটি। তাই আজ তিনি বাড়িতেই আছেন। নবনীতা মৃদু হেসে বলে,
“কি বলবে বাবা?”
“কি করছিলি একা একা?”
“আকাশ দেখছিলাম। আসো না”
জসীম সাহেব এগিয়ে মেয়ের কাছে দাঁড়ায়। নবনীতা আবার দৃষ্টি বাহিরে দেয়। তখন ইতস্তত কন্ঠে জসীম সাহেব বলেন,
“তোর মা বলছিলো, তুই নাকি সেদিন পাত্রপক্ষের সাথে দুর্ব্যাবহার করেছিলে?”
“হ্যা, খানিকটা করেছিলাম। এতোটা করা ঠিক হয় নি।“
“তাহলে কেনো এমনটা করেছিলি?”
“কি করবো বলো? ওই লোকটাকে দেখলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।“
জসীম সাহেবের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে নবনীতার কথায়। নবনীতা মেয়েটি সব দিকে গুনী হলেও একটি বদগুন তার আছে। তা হলো তার মেজাজ। মেয়েটি শান্ত মেজাজের নয়। যখন মেজাজ খারাপ হয় তখন বোধজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর যাকে একবার অপছন্দ হয় তাকে পছন্দের কোটায় ফেলতে সে নারাজ। ছোটবেলার একটা ঘটনা। তখন নবনীতা মাত্র পাঁচ বছর। সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সেখানে একটি ছেলে ছিলো তার সুব্রত মন্ডল। নবনীতা তাকে ঘুষি দিয়ে ঠোঁট ফাটিয়ে ফেলেছিলো। কারণ ছেলেটি ভুল ক্রমে তার পায়ে পা বাধিয়ে তাকে কাঁদায় ফেলে দিয়েছিলো। এর পর থেকে কিন্ডারগার্ডেনের চারটি বছর সে সেই ছেলেটির সাথে কথা বলে নি। তাকে হাজার বোঝানোর চেষ্টা করলেও তাক্লে বোঝাতে অক্ষম হন জসীম সাহেব। জেদটা একটু বেশি তার মেয়ের। মাঝেমাঝে এই জেদকে সামলানো সত্যি খুব দুষ্কর। তিনি সন্দীহান কন্ঠে মেয়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন,
“কেনো ছেলেটি কি এমন করেছে?”
বাবার প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ থাকে নবনীতা। তারপর সেদিনের বাসের ঘটনা সম্পূর্ণ খুলে বলে বাবাকে। সব শুনেও নির্বিকার থাকেন জসীম সাহেব। বরং উলটো প্রশ্ন ছুড়েন,
“তুমি শিওর ওই ছেলেটাই তোমার সাথে এমন করেছে?”
“মানে?”
“মানে, বাসের যাত্রীসংখ্যা তো কম ছিলো না তখন। এমনটা নয় কি তোমার মনে হয়েছে এই ছেলেটার মধ্যে গাপলা আছে তাই এই ছেলেটাই দোষী?”
“কিন্তু বাবা, আমার পেছনে সেই দাঁড়িয়ে ছিলো।“
“তো? সে দাঁড়িয়ে ছিলো তাই সে দোষী?”
“……………”
“নবনীতা, তোমার একটা দোষ আছে জানো তো? সেটা হলো তুমি কখনো সিচ্যুয়েশন চিন্তা করতে চাও না। তোমার কাছে যা সঠিক মনে হয় সেটাকেই সঠিক ভাবো। যদিও তুমি ভুল থাকো তুমি সেটা কখনোই মানতে চাও না। শান্ত ছেলেটা যদি সত্যি দোষী হতো, তবে কখনোই সে তোমার চোখে চোখ রাখতে পারতো না। বরং এড়িয়ে যেতো তোমাকে। সে কি তা করেছে?”
“নাহ”
“তাহলে? সবসময় খোলা চোখে যা দেখি তা সত্য হয় না নবনীতা। সত্যকে দেখতে হলে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। নিজের আক্রোশের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হয়। আমি হয়তো তোমাকে বোঝাতে পেরেছি। ভেবে দেখো। সেদিন বাসে ঠিক কি ঘটেছিলো তা একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই তোমার সামনে পরিষ্কার হবে।“
“…………”
“থাকো, আমি তোমার মা কে সামলাই। সে খুব রেগে আছে তোমার সেদিনের কাজে”
নবনীতা মলিন হাসি হাসে। বাবার কথাকে একেবারেই ফেলে দিতে পারছে না সে। সত্যি সেদিন বাসের ঘটনা এতো আকর্ষিক ছিলো যে সে ঠান্ডা মাথায় চিন্তাও করে নি। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে বুঝতে পারতো শান্ত তো মোবাইল স্ক্রল করছিলো। তার বা হাতে ছিলো মোবাইল, আর ডান হাত ছিলো বাসের স্টান্ডিং রডে। নবনীতার মুখের রঙ পালটে যায়। এক অজানা গ্লানি মনের কোনায় জাল বুনে। নিজের এমন বোকামিতে নিজের ই লজ্জা লাগছে। বাবা না বললে হয়তো সেই ব্যাপারটা চিন্তাও করতো না সে। এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠে। চিন্তার স্তরে পড়ে ছেদ। মোবাইল হাতে নিতেই দেখে চারটা মিসকল। এতোক্ষণ মোবাইলটা হুক্কা হুয়া করছিলো অথচ সেদিকে তার খেয়াল ই ছিলো না। ফোনটা ধরতেই নীলয়ের মিহি কন্ঠ কানে আসে,
“কই ছিলা এতোক্ষণ? আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।“
“একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
“সমস্যা বাদে ফোন করা কি মানা?”
“আমি কি সেটা বলেছি নাকি? তিল কে তাল করছো কেনো?”
“আচ্ছা যাও, করলাম না তিল কে তাল। একটা গুড নিউজ আছে।“
“কি শুনি?”
“আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। অবশষে?”
“সত্যি?”
খুশিতে আত্নহারা হয়ে উঠে নবনীতা। শান্তের চিন্তা হুট করেই মাথা থেকে হাওয়া হয়ে যায়। তখন নীলয় বলে,
“হ্যা বাবা সত্যি, শুধু তাই নয়। আগামী পরশু আমার পুরো পরিবার আসবে বিয়ের কথা বলতে……………
চলব