#শৈবলিনী—-৪৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে আছে নূর। সব হারিয়ে যেন নিঃশ্ব মনে হচ্ছে নিজেকে। নিজের করা ভুলের জন্য আজ এতবড় শাস্তি পেতে চলেছে সে। আদিত্য ওকে ছেড়ে চলে যাবে। কীভাবে বাঁচবে ও আদিত্যকে ছাড়া। এরচেয়ে তো ওকে মৃ,ত্যুর শাস্তি দিলে তাও হয়তো সহজ ছিলো। এখন এই নিঃশ্ব জীবনের বোঝা কীভাবে বয়ে বেড়াবে সে। অতিরিক্ত বেদনায় আজ যেন কান্নাও আঁটকে গেছে নূরের। কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটু ধাতস্থ করে মনোবল শক্ত করার চেষ্টা করলো। আদিত্যকে সে যেতে দিবেনা। কিছুতেই না। আজ একবার শুধু বাসায় আসুক। যে করেই হোক সে আজ আদিত্যর রাগ ভাঙিয়েই ছাড়বে। যাতে আদিত্য ওকে ছেড়ে না যায়।নূর অস্থির হয়ে বসে বসে আদিত্যর অপেক্ষা করতে লাগলো। রাত বারোটার পরও যখন আদিত্য ফিরলো না। নূর তখন জিদানকে ফোন করলো। জানতে চাইলো আদিত্য কোথায়, বাসায় কখন ফিরবে। জিদান জানাল,”ম্যাম, স্যার-তো বলল সে আজ বাসায় ফিরবে না। আজ থেকে উনি ফার্মহাউসেই নাকি থাকবেন। বাসায় নাকি আপনি তাকে অনেক বিরক্ত করেন তাই তিনি আর বাসায় যাবেন না। এমনটাই বললেন উনি। আমি একটু আগেই স্যারকে ফার্মহাউসে রেখে এলাম”

ফোন কেটে দিলো নূর। হঠাৎ তার প্রচুর রাগ উঠলো। চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়াল সে। ব্যস,অনেক হয়েছে। কান্না কাটি অনেক হয়েছে। মনে হচ্ছে এবার নূরকে তার আসল রুপেই ফিরতে হবে। এই মিঃ নায়কের নাটক এবার একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। আমি বিরক্ত করি তাকে! আমার জন্য সে বাসায় ফিরবে না! আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে! যাওয়াচ্ছি তাকে। ঘুঘু দেখেছ তার ফাঁদ দেখোনি মিঃ নায়ক। এবার বোঝাব নূর কি জিনিস। নিজেকে সেই আগের রুপে এনে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো নূর। লিভিং রুমে দেয়ালের সাথে ঝুলিয়ে রাখা গাড়ির চাবিগুলোর ভেতর থেকে একটা চাবি নিয়ে মেইন ডোর খুলে বেড়িয়ে এলো সে। নির্দিষ্ট গাড়িটিতে বসে তার গন্তব্যে রওয়ানা হলো। ফার্মহাউসের ঠিকানা সে জানে। অমালিয়ার ওই ঘটনার সময় এটার সম্বন্ধে জেনেছিল সে। তাই সেখানে পৌঁছাতে আর কোনো সমস্যা হলোনা তার।

প্রায় ঘন্টাখানিক পর সে এসে পৌঁছাল ফার্মহাউসে। গাড়ি থেকে নেমে রাগী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেল মেইনডোরের দিকে। কলিং বেল টা পরপর কয়েকবার চাপলো। কিছুক্ষণ পরেই দরজা খুলে গেল। দরজা খুলতেই সামনে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখতে পেল নূর। তার মুখ দর্শন হতেই যেন ভেতরের বেদনা গুলো রাগের বহিঃপ্রকাশ হয়ে বেড়িয়ে এলো। নূর তেড়ে আদিত্যর সামনে গিয়ে দুই হাতে আদিত্যর বুকে ধাক্কা দিলো। ধাক্কা খেয়ে আদিত্য এক কদম পিছিয়ে এলো। তবে সে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া করলোনা। নূর ধাক্কা দিয়েই ক্ষিপ্ত স্বরে বলতে লাগলো,
–কী নাটক শুরু করেছেন আপনি হ্যাঁ? যা মন চায় তাই করবেন?

নূর আবারও ধাক্কা দিলো। আদিত্য আরও এক কদম পিছিয়ে গেল। এবারও সে নির্বিকার ভঙ্গিতে নূরের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। নূর ধাক্কা দিয়ে বলল,
–আমি বিরক্ত করি আপনাকে? তাই বাসায় যাবেন না? এতো পঁচে গেছি আমি?

নূর আবারও ধাক্কা বলল,
–কী বলছিলেন সেদিন? আমাকে বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিবেন? মানে কি আপনার? আপনার সাহস কি করে এই কথা বলার?

নূর আবারও ধাক্কা দিলো। আদিত্য আরও এক কদম পেছালো। নূর বলতে লাগলো,
–আমার চাইতে আপনার ওই ফালতু নায়িকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে? আমাকে বের করে দিয়ে ওই ডাইনির সাথে থাকতে চাচ্ছিলেন আপনি?

নূর আবারও ধাক্কা দিয়ে বলল,
–মানছি ভুল করেছি। অনেক বড় ভুল করেছি। তারজন্য তো কতোবার মাফ চাচ্ছি। কিন্তু আপনিতো ঘাড় তেড়া ঘোড়ার মতো বাঁকা হয়ে বসেই আছেন।

এভাবে নূর বারবার করে ধাক্কা দিচ্ছে আর আদিত্য পেছাচ্ছে। তবে আদিত্য কোনো প্রতিক্রিয়া করছেনা। শুধু একদৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। এতে করে নূর যেন আরও ক্ষেপে গেল। ভেতরের কষ্ট এবার তার কন্ঠে আর চোখেও বিদ্যমান হলো। আবারও ধাক্কা দিয়ে কষ্ট আর রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
–মাফ নাহয় নাই করলেন। তাই বলে আমাকে ছেড়ে যাবেন আপনি? নিউইয়র্ক চলে যাওয়ার প্ল্যান করছেন? টিকেটও করে ফেলেছেন? আমাকে ছেড়ে যাওয়ার এতো সাহস কে দিলো আপনাকে? বলুন কে দিলো? একবারও বুক কাঁপল না আপনার?
বলতে বলতে নূর কেঁদে উঠল। কান্নারত কন্ঠে আদিত্যর বুকে দুই হাতে কিল মারতে মারতে পাগলের মতো বলতে লাগলো,
–কীভাবে পারলেন আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে? বলুন কীভাবে পারলেন? কীভাবে? কীভাবে? কীভাবে?……..

এই পর্যায়ে এসে প্রতিক্রিয়া করলো আদিত্য। আর এমন প্রতিক্রিয়া করলো যে নূরকে মুহুর্তেই স্থির মানবে পরিণত করে দিলো। অশান্ত ঢেউকে এক মুহুর্তেই থামিয়ে দিলো। থামিয়ে দিলো সব কোলাহল। যখন নূরের আক্রমণের মাঝেই আচমকা আদিত্য নূরের ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের ওষ্ঠদ্বয় মিলিত করলো। থমকে গেল নূর।থেমে গেল আক্রমনাত্মক হাত দুটো। জমে গেল তার আপাদমস্তক। হৃৎস্পন্দনের আলোড়নও থেমে গেল মুহুর্তেই। দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে অধরযুগল মেলালো আদিত্য। মিলিত অবস্থাতেই নূরকে ঠেলে নিয়ে পেছনের দেয়ালের সাথে আঁটকে ধরলো। আরও নিবিড় ভাবে মেলালো ওষ্ঠদ্বয়। আহরণ শুরু হলো পুষ্পমধুর। সারা অঙ্গ শিহরণে কেঁপে উঠল নূরের। নিঃশ্বাস দশ মন ওজন সমান ভারী হচ্ছে। অসার হয়ে এলো শরীর। শক্তিহীন হয়ে লুটিয়ে পড়বে বুঝি এখুনি। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সে অবলম্বন হিসেবে দুই হাতে খামচে ধরলো আদিত্যর বুকের ওপরের শার্টের অংশ। আদিত্য এবার এক হাতে নূরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের সাথে একেবারে মিশিয়ে ফেললো। এতক্ষণ ক্রিয়াবিহীন থাকলেও এখন আর থাকতে পারলোনা নূর। আদিত্যর লোমহর্ষক ক্রিয়ায় এবার নূরও প্রতিক্রিয়া দেখালো। প্রিয়র সান্নিধ্যে সারা দিতে বাধ্য হলো সে। একপাক্ষিক কার্য এবার দ্বিপাক্ষিক হলো। লেনদেন শুরু হলো দুজনের সকল অনুভূতির। দুজন দুজনার মাঝের জমে থাকা সব বিষ টেনে নিলো। নূরের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো প্রাপ্তির সুখ।

দুজনের এই লেনদেন কতক্ষণ চলল তার হুঁশ নেই কারোরই। একপর্যায়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো নূরের। আদিত্য সমাপ্তি ঘটালো ক্রিয়ার।কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দুজনেই হাঁপাতে লাগলো। আদিত্য সরে আসতে নিলেই নূর, আদিত্যর ধরে রাখা শার্ট টা আরও শক্ত করে খামচে ধরে আদিত্যকে নিজের দিকে টেনে ধরলো।কপাল ঠেকানো অবস্থায় নজর নিচের দিকে রেখে, নূর আবেগ ভরা আকুল কন্ঠে বলল,
–প্লিজ আর দূরে সরিয়ে দিবেন না আমাকে । কাছে টেনে নিন আমাকে।সামিল করে নিন নিজের মাঝে। আপনাতে মিলিয়ে যেতে চাই আমি। আপনার শৈবলিনী আপনি নামক সাগরে মিলিত হতে চায়।

আদিত্য মাথা তুলে নূরের হাত ছাড়িয়ে হালকা সরে এলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে জিহ্বা দিয়ে মুখের মাঝে চ এর মতো উচ্চারণ করে বলল,
–উহুম, এইভাবে না। আমাতে মিশতে হলে আগে তোমাকে পুরোপুরি শৈবলিনী হতে হবে। শৈবলিনীর আসল রুপে নিজেকে তৈরি করতে হবে।

নূর কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলো আদিত্যর দিকে। আদিত্য নেশাময় হাসির রেখা ঝুলিয়ে নূরের হাত ধরে সামনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। নূরও বিনাবাক্যে আদিত্যর সাথে চলল। আদিত্য নূরকে একটা রুমে নিয়ে এলো। রুমে এসে নূরের হাত ছেড়ে কাবার্ড খুলে সেখান থেকে বিশাল একটা প্যাকেট বের করে আনলো। সেটা এনে নূরের সামনে ধরে বলল,
–এসব তোমার জন্য। এগুলো পড়ে নিজেকে শৈবলিনী রুপে সাজাও।

নূর দেখলো সেখানে বিয়ের শাড়ির মতো লাল কারুকাজ করা শাড়ি। আর তার ওপর কিছু গহনা। নূর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–এগুলো কোথাথেকে আসলো।

আদিত্য বলল,
–সেসব পড়ে জানবে। আগে এগুলো পড়ে নাও। আর হ্যাঁ শাড়ি পড়া নিয়ে চিন্তা করোনা। এটা অটোমেটিক কুঁচি করা শাড়ি। তোমাকে শুধু পড়তে হবে। আর বাড়তি কিছুই করতে হবে না। তোমার জন্য স্পেশাল ভাবে ডিজাইন করিয়েছি এটা। শাড়িতো আমিও পড়িয়ে দিতে পারতাম। তবে আমি তোমাকে পুরো সাজে একবারে দেখতে চাই। নাও এখন পড়ে নাও। আমি বাইরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

নূর লজ্জা মিশ্রিত হেঁসে মাথা নেড়ে আদিত্যর হাত থেকে প্যাকেট টা নিলো। আদিত্য বেড়িয়ে যেতে নিয়ে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
–শোনো, বেশি অপেক্ষা করিও না। এমনিতেই অনেক অপেক্ষা করিয়েছ। জলদি এসো।

নূর লজ্জায় মাথা নিচু করে নাড়াল। আদিত্য মুচকি হেঁসে বেড়িয়ে গেল। বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো নূরের। অধীর আগ্রহে অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগলো। হার্টবিট অস্বাভাবিক গতিতে চলছে। মিনিট দশেক পর আদিত্যর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো নূর। লাল শাড়ি আর গহনায় নববধূবেশে সজ্জিত হয়েছে সে। মাথার উপরের লম্বা বঁধুর ওড়নাটা ঝুলে মাটি পর্যন্ত লুটিয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসার সময় ওড়নার দুই ধার ফ্লোরে লেপ্টে আসছে। নূরের পানে দৃষ্টি মেলতেই থমকিত হলো আদিত্যর সর্বস্ব। হৃৎস্পন্দন তার গতি হারালো, মস্তিষ্ক তার ক্রিয়া ভুলে গেল,নিঃশ্বাস তার আনাগোনা ভুলে গেল,আঁখি তার পলক ফেলা ভুলে গেল। এ কি দেখলো সে! এযে ম,র,ণঘাতী রমনী। এখুনি বুঝি হৃদপিণ্ড টা ছুটে বেড়িয়ে লুটিয়ে পড়বে এই রমণীর চরণে। এই সৌন্দর্য যে অসামান্য, অলৌকিক। ভাষায় ব্যক্ত করা কেবলই ব্যার্থতা। এই অপূর্ব, মহীয়সী রমণী টি শুধু আদিত্যর। আদিত্যর শৈবলিনী। ভাবতেই যেন নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যবান পুরুষ মনে হচ্ছে।
আদিত্যকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো নূর। আজ যেন সব লজ্জারা ওর ঠিকানাতেই এসেছে ভীড়। এতো কেন লজ্জা লাগছে ওর? আদিত্য যা-ও একটু সবল ছিলো, নূরের এই লাজে রাঙা মুখ যেন আরও ঘায়েল করে দিলো তাকে। মেয়েটা কি আজ একেবারেই মেরে ফেলতে চাইছে তাকে! একেতো নূরের এই নববধূ রুপ, তারওপর এই লাজে রাঙা মুখ যেন নূরকে পুরোপুরি শৈবলিনীর রুপ দিয়েছে। যে রুপে আদিত্যর দেখার অদম্য আকাঙ্ক্ষা ছিলো। আজ ফাইনালি সেই স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নিয়েছে আদিত্যর। তীব্র নেশাপ্রবণ নজরে তাকিয়ে নূরের কাছে এগিয়ে গেল আদিত্য। কাছে এসে একটু ঝুঁকে সযত্নে কোলে তুলে নিলো নূরকে। নূর প্রথমে হালকা একটু চমকালো, তারপর আবারও লজ্জার চাদরে মুড়ে গেল। লজ্জা লুকাতে মাথাটা আদিত্যর কাঁধের মাঝে লুকিয়ে ফেললো সে। আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে ছাঁদে চলে এলো। ছাঁদে আসতেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল নূর। অতিব আশ্চর্যান্বিত হয়ে চারিদিকে চোখ বোলাতে লাগলো সে। পুরো ছাঁদ বাহারি রঙবেরঙের ফুল, বেলুন আর কার্টেইনস দিয়ে সাজানো। নূর অবাক চোখে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
–এসব? কীভাবে? কখন করলেন আপনি?

আদিত্য মুচকি হেঁসে বলল,
–বলছি জানেমন, আগে একটু বসতে তো দিবে।
ছাঁদের মাঝ বরাবর একটা দোলনা আছে। যেটাকেও ফুল দিয়ে সুন্দর সাজানো হয়েছে। যেন কোনো ফেইরি টেলের দেশ মনে হচ্ছে। আদিত্য নূরকে কোলে নিয়েই সেই দোলনায় গিয়ে বসলো। নূরের চোখে চোখ রেখেই পা দিয়ে ফ্লোরে ঠেলা দিয়ে দোলনায় দোল দিলো আদিত্য। দুলতে লাগলো দুজন। আদিত্যর নজর স্থির নূরেতে। আর কোনোকিছুতে নজর যাওয়ার সাধ্য কোথায় তার। নূর আবারও জিজ্ঞেস করলো,
–বলুন না এসব কীভাবে কখন করলেন? আপনি তো জানতেন না যে আমি আসবো। তাহলে এসব কীভাবে করলেন?

আদিত্য নূরের কপাল আর গালে আলতো করে আঙুল বুলিয়ে বলতে লাগলো,
–আমি জানতাম তুমি আসবে। তাইতো তোমার স্বাগতমের জন্যই এতো কসরত করলাম আমি?

–কীভাবে জানলেন আমি আসবো? যদি না আসতাম আমি?

–আসতে তো তোমাকে হতোই। না এসে কোথায় যাবে তুমি?

–তারমানে জিদানকে ওসব বলার জন্য আপনিই বলেছেন? আপনি জানতেন ওসব শুনে আমি রেগে যাবো আর এখানে চলে আসবো?

–হুম জানতাম। তোমার নড় নক্ষত্র সবই যে আমার জানা। তোমাকে আমার চেয়ে ভালো আর কে চেনে।

নূর এবার মলিন মুখ করে অভিমানী সুরে বলল,
–এতোই যখন জানেন তাহলে এতদিন কেন এতো কঠোর ছিলেন? কেন এতো অবজ্ঞা করছিলেন? আমার প্রতি সত্যিই এতো ঘৃণা জন্মে গেছে আপনার?

আদিত্য নূরের ঠোঁটের ওপর তর্জনী আঙুল রেখে বলল,
–হুঁশশ, একথা ভুলেও ভাববে না। তোমাকে ঘিরে আমার হাজার রকমের অনুভূতি হতে পারে। তবে ঘৃণা, সেটা আজীবনেও সম্ভব না। আমি চেয়েও পারবোনা।সে যতোই তুমি আমাকে আঘাত দাওনা কেন,যতোই কষ্ট দাওনা কেন। আমার জানই বা নিয়ে নাওনা কেন। তবুও তোমাকে ঘৃণা করা আমার দ্বারা অসম্ভব। আমি নিজেকে ঘৃণা করতে পারি কিন্তু তোমাকে কখনোই না। হ্যাঁ তোমার সেদিনের কথায় রাগতো প্রচুর হয়েছিল আমার। অনেক অভিমান জন্মেছিল তোমার ওপর। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা। যা কখনোই কমার নয়। বরং সর্বদা আরও বাড়তেই থাকে তা। আমি চাইছিলাম এবার তুমিও একটু ভালোবাসার পীড়ন অনুভব করো। ভালোবাসা নাকি পুড়ে পুড়ে খাটি হয়। আমার ভালোবাসা তো অনেক খাটি হয়েছে। তাই এবার তোমারটাকেও খাটি করছিলাম। যাতে তুমি তোমার ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারো। জানো সেদিন রাতে যে তোমাকে পদ্মফুল এনে দিয়েছিলাম। তুমি সেদিন বলেছিলে তুমি কোনো কিছুতে ভয় পাওনা। আমি সেদিন মনে মনে বলেছিলাম, তুমি একদিন ভয় পাবে। আর সেই ভয়ের কারণ হবো আমি। এই আমিকে হারানোর ভয়ে মরিয়া হয়ে যাবে তুমি। আর আজ সেই দিনটাই এসেছে নূর। আজ আমাকে হারানোর ভয় তোমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছে। তাইতো এতো রাতে পাগলের মতো ছুটে এসেছ আমার কাছে।

নূর ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,
–কিন্তু আপনিতো আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমার ভয়কে সত্যি করে দিতে চাইছেন। আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব কি করে? আপনি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?

আদিত্য একটু বাঁকা হেঁসে বলল,
–হ্যাঁ যাবোই তো। যাবো নাতো কী করবো? এমন বউয়ের কাছে কে থাকবে যে,তার স্বামীকে এখনো পর্যন্ত ভালোবাসিই বললো না।

নূর মায়াবী কন্ঠে বলল,
–সবসময় কি মুখে বলতে হয়? আমার মনের কথা কি বুঝতে পারেন না আপনি?

–হ্যাঁ পারি, তবে সেই কথাটাই ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে শোনার মাঝে যে খুশি আছে তা অতুলনীয়। শুধু একবার বলোনা। নাকি আজও আমাকে তৃষ্ণার্তই রাখবে?

নূর লজ্জায় পড়ে গেল। সে চাইছে বলতে। কিন্তু কন্ঠনালী কেন যেন বন্ধ হয়ে আসছে তার। এই সামান্য কথাটা বলতে এতো কেন নার্ভাস হচ্ছে ও? নূরের চুপ থাকা দেখে আদিত্য মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,
–ঠিক আছে আমি বরং নিউইয়র্কই চলে যাই।এখানে তো কেউ আমাকে ভালোই বাসেনা। এখুনি চলে যাবো আমি। আর এক মুহুর্তও থাকবোনা এখানে।

নূর আৎকে উঠে হঠাৎ আদিত্যর গলা জাপটে ধরে দ্রুত বলে উঠলো,
–ভালোবাসি,ভালোবাসি, ভালোবাসি। অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি। সবথেকে বেশি, নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না৷ প্লিজ প্লিজ প্লিজ, পায়ে পড়ছি আপনার।

বলতে বলতেই কেঁদে দিলো নূর। আদিত্যর ঠোঁটে ভাসলো প্রাপ্তির খুশি। আজ সে সার্থক। সে পেরেছে, পেরেছে তার নূরের মন জয় করতে। এমনিতেতো নূরের চোখের পানি সহ্য করতে পারে না আদিত্য। তবে আজ নূরের চোখের এই পানিও তার কাছে ভালো লাগছে। এই পানিই যে তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। কতটা চায় নূর আদিত্যকে সেটাই বয়ান করছে এই পানি।তবে বেশিক্ষণ নূরকে কাঁদতে দিলোনা আদিত্য। নূরের চোখের পানি মুছে বলল,
–হুঁশশ, এই পাগলী কে বললো আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি? তোমাকে ছেড়ে গিয়ে কি আমার দেহে প্রাণ থাকবে।

–তাহলে ওই টিকেট কীসের?

–এমনিতেতো অনেক বুদ্ধিমান দেখাও। আর টিকেট দেখলে অথচ ডেট চোখে পড়লেনা? আরে ওটাতো আমার গতবছরের টিকেট। শুটিংয়ের জন্য নিউইয়র্কে যাওয়ার কথা ছিলো। তাই টিকেট কেটে রেখেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু প্রবলেম আসায় আর যাওয়া হয়নি। আর সেই টিকেট দেখেই তুমি আসমান জমিন ভেবে নিয়ে আসো। তবে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। ওটার জন্যই তো আজ তুমি এখানে আসলে।

নূর অশ্রুসজল চোখে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–সত্যিই? তারমানে আপনি কোথাও যাচ্ছেন না?

আদিত্য নূরের নাকের সাথে নাক ঘষে বলল,
–উহুম, কোথাও যাচ্ছিনা আমি। এই আদিত্যর থেকে তোমার কোনোদিনও নিস্তার নেই বুঝেছ।

নূরও খুশিমনে বলে উঠলো,
–চাইও না নিস্তার। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনাকে পাশে চাই।

আদিত্য দুষ্টু হেঁসে নূরকে নিজের সাথে আরেকটু চেপে ধরে বলল,
–আচ্ছা? তা আর কি কি চাই শুনি তোমার? নিচে কি যেন বলছিলে তুমি? আবার বলোনা।

নূর লজ্জায় আদিত্যর বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
–জানি না, যান।

আদিত্য হেঁসে উঠে নূরকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো। প্রশান্তির সুখময় খুশি আবেশিত হলো দুজনের মন। কিছুক্ষণ পর নূর আদিত্যর বুকে মাথা রেখেই বলে উঠলো,
–একটা গান শুনান না?

–বাব্বাহ, নূর রানী আবার গানও শোনে নাকি!

নূর বুঝতে পারছে আদিত্য ওকে পিন্চ করছে। তাই সে মুচকি হেঁসে শান্ত সুরে বলল,
–হ্যাঁ শোনে। এখন যে এই নূর আর সেই নূর নেই। এই নূরের এখন সবই ভালো লাগে। বিশেষ করে আপনার গলায় গাওয়া গান। গান না একটু?

–ওকে মহারানী, আপনার আদেশ শিরোধার্য। তবে এই অধমের একটা শর্ত আছে। তোমাকে এই আপনি আপনি বলা ছেড়ে দিতে হবে। কেমন আঙ্কেল আঙ্কেল ফিলিং হয়।

নূর আদিত্যর বুকের মাঝে হেঁসে দিলো। আদিত্য মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,
–হাসছ যে বড়ো! ফটাফট এক্ষুণি তুমি করে বলবে। বলো আদিত্য আমার জন্য গান গাও। তবেই গাইবো। নাহলে কিন্তু কথা বলবোনা।

আদিত্যর বাচ্চামো দেখে ভীষণ হাসি পেল নূরের। সে আদিত্যর আবদার রাখতে বুকে মাথা রেখেই লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
–গান শোনাও না মিঃ নায়ক।

আদিত্য হাসিমুখে বলল,
–এখুনি শোনাচ্ছি।
আদিত্য নূরের থুতনির নিচে আঙুল দিয়ে মুখটা উঁচু করে নূরের মুখের দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থেকে গেয়ে উঠলো,
♬তোমার জন্য সিন্ধুর নীল আরো হবে স্বপ্নীল
♬উদাস দুপুরে রাগ বসন্ত গাইবে সোনালী চিল
♬তোমার যত ভুল সব নিমিষে হবে ফুল
♬তবু ভালবাসি শুধু তোমায় নিশিদিন সারা বেলা

♬তোমার জন্য মরুর বুকে আবেশ ছড়াবে সবুজ
♬তোমার জন্য শান্ত নদীটা হয়ে যাবে আরো অবুঝ
♬তোমার জন্য রাতের মহাকাল হাজার তারা ঝিকমিক
♬দস্যু ছেলেটা পথ হারিয়ে হাটবে দ্বিকবিদ্বিক

♬ তোমার যত ভুল সব নিমিষে হবে ফুল
♬ তবু ভালবাসি শুধু তোমায় নিশিদিন বেলা।

নূরের দিকে নেশাময় চোখে তাকিয়ে গালে আঙুল বোলাতে বোলাতে গান গাইছে আদিত্য। নেশা তীব্র হচ্ছে তার। মাতাল হয়ে যাচ্ছে কেমন। মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে নূরের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে আদিত্য। নিঃশ্বাস আবারও ভারী হয়ে আসছে নূরের। কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে ভেতর বাহিরে। তাকাতে পারছেনা আদিত্যর ওই নেশাময় চোখে। নিজেকে বাঁচাতে আদিত্যর বুকটাই বেছে নিলো সে। শার্ট খামচে ধরে লুকিয়ে পড়লো সেখানে। আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে আবার উঠে দাঁড়াল। ছাঁদের অন্যপাশে এলো। যেখানে আরেকটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে নূরের জন্য। নূর মাথা তুলে সামনে আরও একবার চমকিত হলো। এখানে ছোট্ট ঘরের মতো চৌকোনা করে সাজানো হয়েছে। সাদা রঙের পর্দা দিয়ে চারপাশ ঘেরাও করা। কতোইনা অপূর্ব লাগছে দেখতে। আদিত্য নূরকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। গদি বিছানো সাদা বিছানায় নূরকে বসিয়ে দিলো আদিত্য। লজ্জায় নতজানু হয়ে বসে রইলো নূর। বুকের মাঝে তার ভীষণ ধুকপুক করছে। হার্টটা বুঝি আজ ব্লাস্টই হয়ে যাবে। আদিত্য প্রথমে নূরের মাথার ওড়নাটা আস্তে করে নামিয়ে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে শরীর থেকে গহনা গুলো আলাদা করলো।মুখটা এগিয়ে নিয়ে অধর ছোঁয়াল নূরের ললাটে। অধরের স্পর্শ ছড়ালো সারা মুখ জুড়ে। নূরের সারা অঙ্গে মরণঘাতী কম্পনের বিস্তার ঘটলো। নিঃশ্বাসের ভারীর মাত্রা হলো তীব্র। দুই হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরলো সে। আদিত্যর দৃষ্টি পড়লো নূরের কম্পিত ওষ্ঠদ্বয়ে। যেথায় সে কিছুক্ষণ পূর্বেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সুধাপান করেছিল।নেশা তীব্র হলো তার। হাজার জনমের তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে রইলো সেই পানে। এক হাত নূরের কানের নিচে দিয়ে অন্য হাতে নূরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আবারও বশীভূত হলো নূরের ওষ্ঠদ্বয়ের গভীরে। সারা দিলো নূরও। ওইভাবেই নূরকে নিয়ে শুয়ে পড়লো আদিত্য। দ্রবীভূত হলো দুজন দুজনার মাঝে। শৈবলিনী মিলিত হলো তার সমুদ্রে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here