#শৈবলিনী—৪৫
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★রাতভর নূর দরজার সাথেই হেলান দিয়ে বসে থাকলো। ক্লান্ত হয়ে একসময় ওখানেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। সকালে আদিত্য দরজা খুলে দিতেই নূর হেলে গিয়ে নিচে পড়ে গেল। ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে। আদিত্যকে দেখে দ্রুত উঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিত্য বেড়িয়ে গেল। নূর আদিত্যকে ডাকতে ডাকতে তার পেছন পেছন গেল। আদিত্য নূরের ডাকে সারা না দিয়ে নিজের মতো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে বাইরে বেড়িয়ে গেল। নূরও আদিত্যকে ডাকতে ডাকতে নিচে এসে মেইন ডোর পর্যন্ত এসে থেমে গেল। কারণ ততক্ষণে আদিত্য চলে গেছে। আদিত্যর এই উপেক্ষা ধারালো ছু,রির মতো নূরকে এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে। কান্নারা তীব্র বেগে উপচে পড়ছে। নূর ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল লিভিং রুমের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নূর নিজের কান্না আঁটকে দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল। পরিবারের সবাই বুঝতে পারলো এদের দুজনের মাঝে বড়ো কোনো সমস্যা হয়েছে। কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মাঝের কথা এভাবে জিজ্ঞেসও করা যায়না। তাছাড়া এমনিতেও নূর একঘেয়ে স্বভাবের। যত কষ্টই হোক কাউকে কিছু বলতে চায়না। বড়ো বোনের এমন হতাশাগ্রস্ত অবস্থা দেখে নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাচ্ছে অমালিয়া। আজ ওর অবাধ্য স্বভাবের কারণেই দুই বোনের জীবনেই দূর্দশা নেমে এলো। আমার সাথে যা হয় হোক। আল্লাহ যেন আমার বোনটাকে এবার একটু সুখী করে। জীবনে কম কষ্ট করেনি। এবার অন্তত একটু সুখের দাবীদার সে।

নূর রুমে এসে আবার কাঁদতে লাগলো। এখন যে এই কান্নায় ওর নিত্যসঙ্গী। কাঁদতে কাঁদতে চোখের সব পানি ফুরিয়ে গেলেও ওর অপরাধ মার্জনা হবেনা। ও কাজই এমন করেছে। সুখকে দূরে ঠেলে নিজেই দুঃখকে আপন করে নিয়েছে।এখন কান্না ছাড়া আর কি-বা পাবে ও। নূরের কান্নার মাঝেই ওর ফোন বেজে উঠল। শিখা ফোন করেছে। নূর ফোন রিসিভ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–শিখা, মিঃ নায়ক মাফ করেনি আমাকে। সে আমাকে ঘৃণা করে। কথা বলছেনা, আমার দিকে একবার তাকাচ্ছেও না। এখন আমি কী করবো শিখা? আমিযে ওকে হারিয়ে ফেললাম।

শিখা ওপাশ থেকে ধমকের সুরে বলল,
–এই তুই আগে চুপ করতো। কি টিভি সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো কেঁদে যাচ্ছিস। তুই কবে থেকে এমন ফ্যাসফ্যাস করে কথায় কথায় কাঁদতে শুরু করা মেয়েদের মতো হয়ে গেলি! দেখ ভাইয়া অনেক কষ্ট পেয়েছে। সেটা সারতে তো একটু সময় লাগবেই। যেখানে তুই তাকে প্রায় একটা বছর কষ্টে রেখেছিস। সেখানে তুই মাত্র একদিনেই সব জয় করতে চাচ্ছিস! একটা কথা মনে রাখিস, যার ভালোবাসা যতো মারাত্মক, তার রাগও ততই মারাত্মক। তাই এতো সহজে সব ঠিক হবে না। তোকে মেহনত করতে হবে। একবার না হলে, হার না মেনে বারবার চেষ্টা করতে হবে। দেখবি একসময় ঠিকই ভাইয়া তার রাগ ভুলতে বাধ্য হবে। কতক্ষণই তোকে অবজ্ঞা করে থাকতে পারবে।

–সত্যিই বলছিস! উনার রাগ ভাঙবে তো?

–আরে হ্যাঁ অবশ্যই ভাঙবে। তুই শুধু চেষ্টা করে যা। আর এমন টিভি সিরিয়াল টাইপ দুঃখিনী ভাব ছেড়ে একটু রোমান্টিক হ। ভাইয়ার সামনে নিজেকে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে পেশ কর।তারপর দেখবি ভাইয়া না গলে থাকতেই পারবেনা। এক কাজ কর,আজকে ভাইয়ার জন্য একটা রোমান্টিক সারপ্রাইজ প্ল্যান কর।

নূর একটু লজ্জা পেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
–কিন্তু কীভাবে করবো? আমিতো এসব সারপ্রাইজ টারপ্রাইজ কখনো করিনি। কীভাবে কি করবো?

–উফফ,এখন এটাও আমাকে বলে দিতে হবে? জিদান ঠিকই বলে, তুই আসলেই একটা কুমিরের সরদারনী। রোমান্টিক কীভাবে হতে হয় তাই এখনো জানিস না! আচ্ছা ঠিক আছে শোন, আমি সব বুঝিয়ে দিচ্ছি তোকে।
শিখা নূরকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলো কীভাবে কী করতে হবে। কথা শেষে নূর নিজের চোখের পানি মুছে মনে মনে বলল,”শিখা ঠিকই বলেছে। এভাবে বসে বসে কাঁদলে কাজ হবে না। আমাকে চেষ্টা করতে হবে। একবার হেরে গেলে বারবার করতে হবে। যেখানে জখমের মাত্রা এতো গভীর সেখানে সারতেও তো সময় লাগবেই। আঘাত জখন আমি দিয়েছি তা সারানোর দায়িত্বও আমার। আজ মিঃ নায়ককে আমার সব অনুভূতি উজাড় করে দিবো। আজকে তাকে তার সেই কাঙ্খিত বাক্যটি বলবো যা শোনার জন্য সে এতদিন অপেক্ষা করেছে। একবার আসুন মিঃ নায়ক। আজকে আপনার রাগ আমি ভাঙিয়েই ছাড়বো।
___

আহানা ফোনে কিছু ফানি ভিডিও দেখে একা একাই হাসছিল। ভাইয়া ভাবির মাঝে সমস্যা চলছে। ভাবির মন খারাপ, তাই আর তাকে আজ বিরক্ত করেনি আহানা৷ সময় কাটানোর জন্য তাই মোবাইলেই এসব দেখছিলো। হঠাৎ দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার মতো ধাক্কা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে তার ঘরে ঢুকলো আবির। তার মুখমণ্ডল কেমন র,ক্তি,ম লাল হয়ে আছে। চেহারা বিধ্বস্ত লাগছে।আচমকা আবিরকে দেখে আহানা ভড়কে উঠে বলল,
–এসব কী অভদ্রতা আবির ভাই? একজন মেয়ে মানুষের ঘরে ঢোকার আগে যে নক করতে হয় এতটুকু ম্যানারিজম নেই আপনার?অবশ্য আমিও কাকে কী বলছি! যার জীবন টাই পুরো ম্যানারলেস, সে আবার ভদ্রতা কীভাবে জানবে!

আবির তেড়ে গিয়ে আহানার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে নিজের মুখোমুখি এনে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–ম্যানারস শেখাচ্ছিস তুই আমাকে,হ্যাঁ ম্যানারস? তা তুই তো ভদ্রতার ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর তাইনা? তাহলে এই কী তোর ভদ্রতার নমুনা?
আবির ওর ফোন বের করে স্ক্রিনে থাকা আহানার ছবি দেখালো। যেখানে সে একটা ছেলের সাথে ক্লোজ হয়ে ছবি উঠেছে। আহানা ছবিটার দিকে তাকালো। ছেলেটা ওর বান্ধবীর ভাই। আহানাকেও নিজের বোনের মতোই স্নেহ করে। কাল বান্ধবীদের সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে উনার সাথে দেখা হয়। উনিই সবাইকে খাওয়ান৷আড্ডা দেওয়ার পর সবার সাথে ছবি তুলেন। আহানাও তার সাথে ছবি ওঠে। আর পরে সেটা ফেসবুকে আপলোড করে। আবির সেই ছবিটার কথাই বলছে। আবির আবার রাগী কন্ঠে বলল,
–কীরে বল, এটাই তোর ভদ্রতা? ছেলেদের সাথে বাইরে বাইরে আড্ডা দেওয়া? কে এই ছেলে? এটাই কী তোর সেই সো কল্ড বয়ফ্রেন্ড?

আহানা মিথ্যে করে বলে উঠলো,
–হ্যাঁ এটাই আমার বয়ফ্রেন্ড? সুন্দর না? দেখুন কত সুন্দর মানিয়েছে আমাদের। আমাকে না অনেক ভালোবাসে।

আবিরের ক্রোধ এবার সপ্তমে। সে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–টু হেল উইথ ইয়োর ভালোবাসা? কীসের ভালোবাসা? তোর মাথায় এসব ফালতু জিনিস কে ঢুকিয়েছে? ভালোবাসা টালোবাসা সব ফালতু জিনিস। খবরদার আজকের পর এসব ফালতু জিনিসে নিজেকে ইনভলভ করবিনা।

–কেন? কেন করবোনা? আমার জীবন, আমার ইচ্ছে। আমার যা মন চায় তাই করবো। আপনি বলার কে?

আবির চোখ বন্ধ করে নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
–দেখ আহানা ভালোবাসা অনেক খারাপ জিনিস। এসবে পড়তে নেই। তুই এসব মাথা থেকে বের করে দে। আর ওই ছেলের সাথেও যেন আর কখনে না দেখি তোকে।

আহানা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–আপনি বললেন আর আমি যেন শুনলাম। আমার মন যা চায় আমি তাই করবো। আমার ভালোবাসতে মন চাইছে, আমি বাসবে। আপনার কথা কেন মানতে যাবো আমি?

আবির আবার ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। সে আবারও আহানার বাহু চেপে ধরে বলল,
–কি ভালোবাসা ভালোবাসা লাগিয়ে রেখেছিস? কেন দরকার তোর ওসব ভালোবাসার? তুই তো আমাকে ঘৃণা করিস তাইনা? তো এই অনুভূতিতেই থাক। আমাদের কত সুন্দর একটা ঘৃণার সম্পর্ক। তা রেখে তোর ওসব ফালতু
ভালোবাসার কেন দরকার পড়লো।

আহানা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–হ্যাঁ দরকার আমার ভালোবাসার। আমি ঘৃণার সম্পর্ক চাইনা। আমি ভালোবাসার সম্পর্ক চাই।

আবির অতিরিক্ত রাগের বশবর্তী হয়ে বলে উঠলো,
–কেন? কী এতো দরকার পড়লো তোর ভালোবাসার? শারীরিক প্রয়োজন মেটাতে?

তীব্র ঘৃণায় সারা শরীর টগবগিয়ে উঠলো আহানার। আজ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা। ঠাসস করে আবিরের গালে চড় লাগিয়ে দিলো আহানা। চড় মেরে ঘৃণিত কন্ঠে বলল,
–ছিহহ্, আজ আপনাকে ঘৃণা করতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।

আবির দুই হাতে আহানার মুখটা আগলে ধরে বলল,
–হ্যাঁ তো করনা ঘৃণা। যতো খুশি কর। সারাজীবন ঘৃণা কর। ওসব ভালোবাসা টালোবাসা বাদ দিয়ে আমাকে শুধু ঘৃণা কর। মন প্রাণ উজাড় করে ঘৃণা কর। আমাদের এই ঘৃণার সম্পর্কটাই বেস্ট।

আহানা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তিক্ত সুরে বলল,
–ইউ আর আ সিক। মেন্টালী ডিস্টার্ব আপনি। আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন। যান গিয়ে ডাক্তার দেখান। আপনার মতো পাগলের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে। আর রইলো আপনাকে ঘৃণা করার কথা। সেটাতো এমনিতেও করবো। আপনাকে আমি সারাজীবন ঘৃণা করে যাবো। আর এই ঘৃণা বাড়বে বৈ কমবে না।

আবির স্মিথ হেঁসে বলল,
–প্রমিজ!

–প্রমিজ।

–ব্যাস তাহলে তো হয়েই গেল। তুই যাকে খুশি ভালোবাস আর যাই কর। শুধু আমাকে ঘৃণা করলেই হলো। এটাতে কোনো কমতি যেন হয়না।
বলেই বেড়িয়ে গেল আবির। আহানার কান্না আর তার চোখে পড়লোনা।
__

নিজেকে আজ নারীতে রুপান্তর করার চেষ্টা করেছে নূর। শাশুড়ীর একটা শাড়ী পড়েছে সে। রেহনুমাই পড়িয়ে দিয়েছে। ছেলের জন্য নূরের এফার্ট দেখে তিনিও খুশি। এখন এদের সব ঠিক ঠাক হয়ে যেন যায় সেই দোয়া করছেন তিনি। নূর ছাঁদের ওপর আদিত্যর জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে। ছাঁদ টা সুন্দর করে সাজিয়েছে সে। এখন শুধু অপেক্ষা আদিত্যর আসার। আজকে সে আদিত্যর মান ভাঙিয়েই ছাড়বে। তাকে বলবে সকল মনের না বলা কথা। বলবে সে কতটা ভালোবাসে আদিত্যকে। আদিত্য বিনা যে সে এখন শুধুই নিঃশ্ব মরুভূমি। সবই বলবে আদিত্যকে। আদিত্যর সকল অভিযোগ আজ দূর করে দেবে সে। ভালোবাসা সঁপে দিবে তার চরণে। আজ মুখ ফিরিয়ে নিতে দিবেনা। বাহুডোরে বেঁধে রাখবে তাকে। ভালোবাসায় মুড়িয়ে নিবে ওর প্রিয়তমকে। এসব ভেবে ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে নূর। ঠোঁটে ভাসছে অনাগত খুশির ঝিলিক। প্রতিক্ষা কেবল সেই পুরুষের আগমনের। যার জন্য আজ মনের দুয়ার খুলে অধীর আগ্রহে তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানানোর অপেক্ষায় বসে আছে। নাজানি সেই পুরুষ কখন আসবে।

প্রতিক্ষার ক্ষণ দীর্ঘ হচ্ছে। রাত প্রায় বারোটা। আদিত্যর আসার নাম নেই।দশটার দিকে একবার জিদানের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল আদিত্য এখনে শুট করছে। তাই কতো দেরিতে আসবে ঠিক নেই। কিন্তু নূরও হার মানবেনা। যতো রাতই হোক সে অপেক্ষা করবে। কিন্তু নূরের এই অপেক্ষা ধীরে ধীরে শুধু বাড়লো বৈ কমলো না। রাত একটাও একসময় পার হয়ে গেল তবুও আদিত্যর খবর নেই। নূরের হাসিমাখা মুখটা ধীরে ধীরে চুপসে যাচ্ছে। আশা রাখতে চেয়েও আবারও নিরাশা হানা দিচ্ছে। চোখের পাতা পাঁচ মন ওজন সমান ভারী হয়ে যাচ্ছে। ছাঁদের ফ্লোরে বসে বসেই ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছে বারবার। কতবার উঠে চোখে পানি মেরে আসছে। তবুও কাজ হচ্ছে না। একসময় চোখে আর পানি দিতে হলোনা। নোনাজলে এমনি এমনিই দুচোখ ভরে গেল। তবুও আশা ছাড়ছেনা নূর। আদিত্য আসবে। সে অপেক্ষা করবে। যতো রাতই হোকনা কেন। মনের এই দৃঢ়তা সময়ের সাথে দূর্বল হয়ে পড়লো। ঘুমের প্রখরতার কাছে হেরে গেল নূর। ছাঁদের দেয়ালে হেলান দিয়ে একসময় চোখ দুটো বুজতে বাধ্য হলো সে। চোখের পাতা নামতেই জমে থাকা নোনাজল গাল বেয়ে গড়ে পড়লো।

রাত দুটোর পর ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত আর বিষন্ন মনে,নেশায় মাতাল হয়ে ঢুলতে ঢুলতে বাসায় এলো আদিত্য। গেস্ট রুমে ঢুকে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়লো সে। হঠাৎ হাতের কাছে কিছু বাঝলো ওর। আদিত্য হাতড়িয়ে সামনে এনে দেখলো একটা চিরকুট। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে চিরকুট খুলে দেখলো সেখানে লেখা আছে,
“জানি অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনাকে। অনেক আঘাত করেছি। ক্ষমা চাইবোনা। শুধু আপনার একটু সময় চাই। প্লিজ শুধু দুই মিনিটের জন্য ছাঁদে আসুন। এরপর আর কিছু চাইবোনা আপনার কাছে। আপনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে আপনার দোষী। শুধু একবার আসুন”

আদিত্য ঠোঁট বাকিয়ে তাচ্ছিল্যকর হাসলো। চিরকুট টায় আঙুল বুলিয়ে মাতাল সুরে বলল,
♬ তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়
♬ দুঃখের দোহনে, করুন রোদনে
♬ তিলে তিলে তার ক্ষয়, তিলে তিলে তার ক্ষয়…
গানের লাইনগুলো বলতে বলতে চোখ মুখ কঠিন বিষাক্ত করে চিরকুট টা হাতের মাঝে দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

সকালের কিরণ চোখে পড়তেই কপাল কুঁচকে চোখ মেলে তাকালো নূর। মাথা আর চোখের পাতা দুটোই ভীষণ ভারী, ব্যাথা হয়ে আছে। হেলান দিয়ে থাকায় ঘাড়টাও ভীষণ ব্যাথা করছে। পুরোপুরি চৈতন্য পেতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে। রাতভর এখানেই ছিলাম? তবে আদিত্য আসেনি? নাকি বাসায়ই ফেরেনি সে? নূর দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এলো। নিচে এসে নিজের রুমে আদিত্যকে পেলনা। গেস্ট রুমেও চেক করতে গেল। সেখানেও নেই আদিত্য। নূর ভাবলো হয়তো আদিত্য রাতে ফেরেইনি। নূর হতাশ হয়ে চলে যেতে নিলেই মেঝেতে পড়ে থাকা ওর চিরকুট টা দেখতে পেল। নূর চিরকুট হাতে নিয়ে দেখলো এটা ওরই সেই চিরকুট। তারমানে আদিত্য এসেছিল রাতে। আর ওর চিরকুটও পেয়েছিল। তবুও সে আসেনি ওর ডাকে। ধপ করে বসে পড়লো নূর। আর পারলোনা নিজের কান্না থামাতে। আরও একবার অপারগ হয়ে গেল সে। আদিত্য কী কখনই আর ওকে মেনে নিবে না? এতটাই ঘৃণা করে ফেলেছে আমাকে?

কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে চোখের পানি মুছে মনে মনে বলল,”আমাকে হার মানলে চলবেনা। আঘাত যখন এতো গভীর দিয়েছি তা সারাতেও আমাকেই হবে। বারবার চেষ্টা করতে হবে। আদিত্যর উপেক্ষা সইতে হবে।আমার দেওয়া আঘাতের সামনে এসব কিছুই না। আমার এতো উপেক্ষার পরও যখন আদিত্য হার না মেনে আমার মন জয় করতে পেরেছে তখন আমি পারবোনা কেন! হ্যাঁ আমাকেও পারতেই হবে। আদিত্য কতক্ষণ আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে। একসময় মন গলবেই তার। নূর ভাবলো আদিত্য বাসায় ঠিকমতো থাকছেনা। পালিয়ে বেড়াচ্ছে ওর কাছ থেকে। তাই আজ নাহয় নূর নিজেই ওর কাছে যাবে। শুটিংয়ের ওখানে গিয়ে সারপ্রাইজ দিবে আদিত্যকে। তখন আর কোথাও পালাতে পারবেনা। যেই ভাবা সেই কাজ। নূর উঠে রুমে এসে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিলো।শাড়ি বদলে একটা লং গোল ড্রেস পড়লো। তারপর রেডি হয়ে নিচে এসে আদিত্যর জন্য কিছু খাবার প্যাক করলো। এতো সকাল সকাল যে আদিত্য না খেয়েই বেড়িয়ে গেছে সেটা বুঝতে বাকি নেই তার। তাই ব্রেকফাস্ট টিফিন বক্সে ভরে নিয়ে রওয়ানা হলো সে। জিদানের কাছ থেকে ফোনে শুটিং স্পটের জায়গার নাম জেনে নিলো। আজ নাকি এফডিসিতেই শুটিং করছে সে। নূর সেখানেই এসে পৌঁছাল। আদিত্য শুটিংয়ে ব্যস্ত। তাই জিদান নূরকে আদিত্যর ভ্যানিটিতে অপেক্ষা করতে বলল। নূর ভ্যানিটিতে ঢুকে অপেক্ষা করতে লাগলো আদিত্যর। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে এখানে কাটানো পুরান স্মৃতিগুলো মনে করে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো নূরের। এই ভ্যানিটিতেই প্রেম কাহিনির শুরু হয়েছিল। কতো খুনসুটির চিহ্ন আছে এখানে। আজ আবারও এখানে আদিত্যর সাথে নতুন এক খুনসুটির চিহ্ন আঁকবে সে। ওকে এখানে দেখে আদিত্য আর উপেক্ষা করতে পারবেনা। আজ তার মান ভাঙবেই। এমনটাই আশা করছে নূর।

ঘন্টাখানিক অপেক্ষার পর আদিত্য ভ্যানিটিতে ঢুকলো। হঠাৎ নূরকে দেখে কিছুক্ষণ থমকে গেল সে। নূরও আদিত্যকে দেখে সুন্দর করে হাসিমুখে বলল,
–আপনি এসেছেন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি। নিশ্চয় খেয়ে আসেন নি সকালে। আমি ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছি। আসুন খেয়ে নিন।
বলেই নূর টিফিন বক্স খুলে খাবার বের করতে নিলো। ঠিক তখনই আদিত্য হুংকার দিয়ে জিদানের নাম ধরে ডাকলো। যে হুংকারে নূরও কেঁপে উঠে চমকে তাকালো আদিত্যর দিকে। ডাক শুনে দৌড়ে এলো জিদান৷ হন্তদন্ত হয়ে বলল,
–জি স্যার, কি হয়েছে?

আদিত্য জিদানের উদ্দেশ্যে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–তোমাকে কতবার বলেছি আমার বিনা অনুমতিতে ভ্যানিটিতে কাউকে ঢুকতে দিবে না! বলো বলেছি কিনা? তাহলে আমার বিনা অনুমতিতে ভ্যানিটিতে লোকজন ঢুকতে দিয়েছ কেন? এটাকে কী পাবলিক গার্ডেন বানিয়ে দিয়েছ? আন্সার মি ড্যাম ইট!

জিদান হঠাৎ তার স্যারের এমন বিহেভিয়ারের কারণ বুঝতে অক্ষম হচ্ছে। জিদান থতমত স্বরে বলল,
–কিন্তু স্যার উনিতো ম্যাম..

–হোয়াট ম্যাম? তুমি কি আমার চাকুরী করো নাকি অন্য কারোর? মনে হচ্ছে চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এসেছে তোমার। কাজে মন নেই এমন লোকের দরকার নেই আমার।

জিদান ভীতিগ্রস্ত কন্ঠে বলল,
–না না , কি বলছেন স্যার। প্লিজ আমাকে চাকরি থেকে বাদ দেবেন না।

–সেটা কথা অমান্য করার আগে ভাবা দরকার ছিল।

আদিত্যর এই বিষে ভরা কথার ছু,রি নূরের হৃদপিণ্ড ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। আজ সে আদিত্যর কাছে বাইরের লোক হয়ে গেল! শুধুমাত্র ওর আসার জন্য জিদানকে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছে! এতটা ঘৃণিত হয়ে গেলাম আমি! হয়তো এটাই ডিজার্ভ করি আমি। নূর অনেক কষ্টে নিজেকে ধরে রেখে গলার কান্নাগুলো ঢোক গিলে নিয়ে ধরা গলায় বলল,
–ভুল আমার, আমার জন্য কাউকে চাকরি থেকে বাদ দেবেন না প্লিজ। আমি চলে যাচ্ছি এখুনি। তবুও জিদানকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েন না।

বলেই চলে যেতে লাগলো নূর।দরজার কাছে আসতেই তখনই হঠাৎ দরজা দিয়ে এক সুন্দরী মেয়ে প্রবেশ করলো। সিনেমার নায়িকা হয়তো। সে ঢুকে নূরকে দেখে বলল,
–আমি কি ভুল সময়ে চলে এলাম আদিত্য? না মানে আমি একটু সীনগুলো শেষবার তোমার সাথে রিহার্সেল করার জন্য এসেছিলাম। তুমি ব্যাস্ত থাকলে তাহলে আমি পরে আসছি।

আদিত্য বলে উঠলো,
–আরে না না, আমি একদম ব্যাস্ত নেই।এখানে ইম্পর্ট্যান্ট কিছুই চলছে না। তুমি এসো।
আদিত্য জিদানের উদ্দেশ্যে বলল,
–জিদান,আমি এখন কোনো ডিস্টার্বেন্স চাইনা। বুঝতে পেরেছ?

জিদান অপরাধী চোখে একবার নূরের দিকে তাকালো। নূর খুব বুঝতে পারছে ডিস্টার্বেন্স বলতে আদিত্য ওকেই বুঝাচ্ছে। আজ নূরের চাইতে অন্য মেয়ে আদিত্যর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল! ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে নূর। নূর এক মুহুর্তও না দাড়িয়ে দ্রুত বেড়িয়ে গেল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here