#শৈবলিনী—-৪১
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★শুভ্র ভোরের স্নিগ্ধতায় আলোকিত হলো নূরের স্বর্ণময়ের ন্যায় ঝলমলে মুখমন্ডল। সেই স্নিগ্ধতায় সিক্ত হচ্ছে আদিত্যর হৃদয়, মন। আজকের সকালের ন্যায় সুন্দর বুঝি কখনো কোনো কিছুই হতে পারবেনা। এ যে এক অনাবিল, প্রশান্তিময় সকাল। যা আদিত্যকে এনে দিয়েছে সুখের সাম্রাজ্য। আদিত্যর পাশে নূরের এই ঘুমন্ত মুখটা এক মহাসাগর সমান সুখময় খুশির বার্তা বয়ে এনেছে। রাত থেকে একবারও চোখের পাতা এক করেনি সে। ভয় হচ্ছিল, যাদি চোখ বুজতেই নূর স্বপ্নের মতো হারিয়ে যায় তাহলে! তাইতো রাতভর সে শুধু নূরের পানে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়েছে। এই মুখপানে তাকিয়ে তো আদিত্য শুধু এক রাত কেন, তার পুরো জীবনকালই অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবে। ঘুমন্ত অবস্থায় কতো নিষ্পাপ আর মায়াবী লাগছে নূরকে। যেন সদ্য ফোটা শিশির ভেজা পুষ্প। কে বলবে, এই মেয়ে এখুনি জাগনা পেলেই ডাকুরানী রুপ ধারণ করবে। জিদানের ভাষায় কুমিরের সরদারনী। নিজের মনে কথাটা বলে নিজেই হাসলো আদিত্য। বাম হাতের আঙুল দিয়ে আস্তে করে নূরের কপালে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো। আলতো করে অধর ছুঁইয়ে দিলো নূরের ললাটে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
–গুড মর্নিং ওয়াইফি, আমাদের নতুন জীবনের নতুন সকাল এক নতুন আগমনের বানী বয়ে আনুক। পৃথিবীর সকল খুশির ঠিকানা তোমার হোক। হাসি হোক তোমার নিত্যদিনের সঙ্গী। খুশি হোক তোমার প্রতি কদমের সঙ্গী।

আদিত্যর এই মোহময়, প্রশান্তিময় মুহূর্তের মাঝে হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটলো। যখন বাইরে থেকে কারোর গলা ফাটিয়ে চিল্লানোর আওয়াজ এলো। বিরক্তিতে চোখ বন্ধ করে দাঁত কিড়মিড় করে চিবালো আদিত্য। এই ফাটা বাঁশের আওয়াজটা যে ওই ড্রামাবাজ আবিরের তা বুঝতে পেরেই আদিত্য বিরক্ত হচ্ছে। সকাল সকাল নিশ্চয় চলে এসেছে হাই লেভেলের ড্রামার প্রদর্শন করতে। আদিত্যর আশেপাশের সবগুলো এক একটা নমুনা। একটার ড্রামা শেষ হয়,তো আরেকটার শুরু হয়ে যায়। আদিত্য বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। আবিরের চিল্লানিতে নূরের ঘুমও ভেঙে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সে। চোখের সামনে আদিত্যকে দেখে প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর কালকের কথা মনে পড়লো তার। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বাইরের চিল্লানোর আওয়াজ শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। বাইরে থেকে কেউ চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছে,
–ওই নায়কের বাচ্চা নায়ক, বাইরে আয়। আজ তোর একদিন কি আমার যে কয়দিন লাগে। শালা, হা,রা,মি কোথায় বউয়ের আঁচলের তলে লুকিয়ে আছস। সাহস থাকেতো এক্ষুনি বেড়িয়ে আয়।

নূর কপাল কুঁচকে তাকালো আদিত্যর দিকে। আদিত্য ফিচেল হেঁসে বলল,
–এটা আমার অসভ্য বন্ধু, আবির। সভ্যতা এখনো পর্যন্ত ওকে ছুতে পারেনি। আমি দেখছি ওকে। তুমি টেনশন নিও না। তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও ততক্ষণে।

বলেই বেড়িয়ে গেল আদিত্য।নূরও বিষয় টা দেখার জন্য কৌতুহল বশত এগিয়ে গেল। আদিত্য বাইরে এসে দেখলো আবির লিভিং রুমে তার ড্রামা আরম্ভ করে দিয়েছে।আর দর্শক হিসেবে পুরো পরিবার জড়ো হয়ে গিয়েছে? আদিত্য ওর সামনে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–ওই, সকাল সকাল কি পাগলা কু,কু,রে কামড়েছে তোকে? এমন ফাটা বাঁশের মতো চিল্লাচ্ছিস কেন? নে এসে গেছি আমি। কি বমি করবি, কর।

আবির এবার তার বিশ্ব বিখ্যাত মেলোড্রামা শুরু করলো। নেকি কান্নার সুরে বলল,
–হ্যাঁ, হ্যাঁ আমার কথাতো এখন বমিই মনে হবে। আমি এখন কে তোর! বউ পেয়ে গেছিস এখন এই আবির কোন খেতের মুলা!

বাবলু মিয়া মাঝখান থেকে তার বুদ্ধির প্রদর্শন করে বলে উঠলো,
–কিন্তু স্যার,মুলা তো শীতকালীন সবজি। এইডা এখন কেমনে আইবো? আপনি এই মৌসুমের কোনো সবজির কথা বলুন না। সেটা কোনো খেতে পাওয়া যাবে।

বাবলুর এই বিশেষ টিপ্পনী শুনে বাকিসবার বিরক্তির মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেলেও দ্য গ্রেট আবির বাবলুর কথায় ইমোশনাল হওয়ার ভাব করে বলল,
–থ্যাংক ইউ বাবলু মিয়া, তুমি আজ কতো মহান একটা তথ্য দিলে। তুমি না বললে আজ আমি এতবড় একটা জ্ঞান অর্জন করতে পারতাম না। আমারতো পুরো জীবনটাই বৃথা যেত। ধন্য করলে তুমি আমাকে।

বাবলু বেকুবের মতো বলে উঠলো,
–তাহলে কি এখন থেকে আপনাকে সবাই ধন্য বলে ডাকবে?

আদিত্যর বাবা বাবলুকে ধমক দিয়ে চুপ থাকতে বলে আবিরকে বলল,
–আরে বাবা হয়েছে টা কী, সেটাতো বলবে?

আবির মেলোড্রামার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে দুঃখী মুখ বানিয়ে বলল,
–কী হয়নি তাই বলেন আঙ্কেল। এই আপনার ছেলে। সে আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। বন্ধু নামের কলঙ্ক সে। আমাদের ল্যাং,টা কালের বন্ধুত্বের এই প্রতিদান দিয়েছে! সে নাকি নিজেকে আমার বন্ধু দাবি করে। অথচ এতবড় একটা কথা আমার থেকে লুকিয়েছে।

–কোন কথা?

–কেন, মিডিয়ার সামনে আদি বলল না যে,সে নূর ভাবিকে দুইমাস আগেই বিয়ে করেছিলো? অথচ এই কথা আমাকে বলেনি ও। আমাকে! ওর ল্যাং,টা কালের বন্ধুকে! সেই বন্ধু, যে কলিজা, ফোপড়া ওয়ালা বন্ধু।যে বন্ধুর সাথে খেলাধুলা, খাওয়া,পড়া, হাসিকান্না,সর্দি-কাশি, হাগা-মোতা সব শেয়ার করা হয়। সেই বন্ধুকে ও এতবড় কথা বলেনি! এই দুঃখ কোথায় রাখবো?দুঃখে নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার।

বাবলু বলে উঠলো,
–কিন্তু স্যার দুঃখে নাক কীভাবে বন্ধ হয়? আমারতো দুঃখে আরও নাক খুলে যায়। নাক দিয়ে দুঃখের বন্যা বয়ে যায়।

আবির প্রতিত্তোরে বলল,
–আরে বাবলু, আমার কাল ঠান্ডা লেগেছে তো তাই নাক আঁটকে গেছে।

এদের কান্ডে বিরক্তরাও বুঝি অক্কা পেয়ে যাবে এবার। আদিত্য ধমকের সুরে বলল,
–ড্রামা বন্ধ করবি তুই এবার? আরে ওসব মিথ্যে বলেছিলাম আমি। ওই অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য ওসব মিথ্যে বলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা।

আবির এবার খুশি হয়ে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–আরে আগে বলবিতো।আমি জানতাম, আমার ল্যাং,টা কালের বন্ধু আমার সাথে এমন করতেই পারে না।

এবারে বাকিরাও হেঁসে দিলো। এতদিন পর বাড়িতে যেন প্রাণ ফিরে এসেছে। নূরও উপর থেকে এসব দেখে না চাইতেও মুচকি হেঁসে দিলো। পরিবারের লোকগুলো এতটাও খারাপ না যতটা নূর ভেবেছিল। ড্রামার পর্ব শেষ করে সবাই যার যার কাজে মনোযোগ দিলো।আদিত্য আর সোফায় বসলো। আবির সোফায় বসে এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে আহানাকে খোঁজার চেষ্টা করলো। কিন্তু পেলনা। পাবে কীভাবে! আবিরের কন্ঠ শুনতে পেয়েই যে সে দরজা আঁটকে দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে শুয়ে আছে। এই লোকের সামনে সে আসবেই না, এমনটা পণ করেছে। কিন্তু আহানার ঘৃণাপূর্ণ ওই নজর না দেখা পর্যন্ত শান্তি হয়না আবিরের। বসে অপেক্ষা করতে লাগলো সেই শান্তি পাওয়ার আাশায়। আপাতত লিভিং রুমে আর কেউ নেই। আবির আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–কাজটা কী তুই ঠিক করলি?

আদিত্য জানে আবির ওর কোন কাজের কথা বলছে।আবির ওর সব কথা না বলতেই বুঝে যায়। তাই আর ভনিতা না করে বলল,
–জানি না ঠিক করেছি কিনা, শুধু জানি এটা না করলে নূরকে সত্যি সত্যিই হারিয়ে ফেলতাম। হয়তো সে অন্য কারো হয়ে যেত। যা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। অন্তত নিঃশ্বাস থাকতে না।

–ভাবি যদি কখনো জেনে যায় তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছিস?

–কী আর হবে?রাগ আর ঘৃণার মাত্রা হয়তো আরও বেরে যাবে। সয়ে যাবো। এসবও তো মানুষের অনুভূতির ভেতরেই পড়ে। ভালোবাসার অনুভূতিতে নাহয় নাই থকলাম, তার ঘৃণাতেই নাহয় নিজেকে খুঁজে পেলাম। তবুও তার অনুভূতিতেই রইলাম।

আবির মজা করে বলল,
–ওয়াহ! ওয়াহ! ওয়াহ, তুই তো দেহি মিঞা ভিখারি মার্কা কবি হয়ে গেলি। এক্টিং এর দোকান বন্ধ হয়ে গেলেও এই ধান্দা ভালোই চলবে।

আদিত্য হাসলো। তবে ভেতরে ভেতরে ভয়তো তারও হচ্ছে। যদি কখনো নূর সত্যি টা জেনে যায় নাজানি কী করবে।

রুমে এসে আদিত্য আরেক ঝটকা খেল। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই অপূর্ব এক দৃশ্যের সাক্ষী হলো সে। তার বউটা গোসল সেরে আয়নার সামনে ভেজা চুল ঝাড়ছে। আহ! এরথেকে মোহনীয় দৃশ্য বুঝি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। এই মোহনীয়তায় বিমোহিত হয়ে যাচ্ছে আদিত্য। তীব্র নেশায় ডুবে যাচ্ছে সে। বিদ্রোহ করছে তার সর্বস্ব। এই নারী এখন তার বউ। এই ঘরের সব কিছুতে তার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে।ভাবতেই মন প্রাণ প্রসন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে। এমন একটা দিনইতো চেয়েছিল আদিত্য। আদিত্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো নেশালো চোখে তাকিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো নূরের দিকে। একসময় নূরের একেবারে কাছে এসে গেল সে। নূরের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে মুখ এগিয়ে নাক ডুবিয়ে দিলো নূরের ভেজা চুলের মাঝে। আচমকা এমন হওয়ায় হকচকিয়ে উঠলো নূর। আয়নায় তাকিয়ে আদিত্যকে দেখতে পেল সে। হঠাৎ যেন জমে গেল নূর।মৃদু কম্পন ঘটলো শরীর জুড়ে। আদিত্য নূরের চুলের মনমাতানো ঘ্রাণে নিজেকে নিমগ্ন করতে করতে ডান হাতটা উঠিয়ে নূরের কোমড়ে গলিয়ে দিয়ে, কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নূরের সাথে আরও নিবিড়ভাবে মিশে গেল। কম্পন ছড়িয়ে পড়লো নূরের সর্বাঙ্গে। শক্তি হ্রাস পাচ্ছে নূরের। যার দরুন তার হাতের তোয়ালেটা হাত ফসকে নিচে পড়ে গেল।নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে তার। আবারও বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের ঘাটতি পাচ্ছে সে। এই বাড়িতে নিশ্চয় অক্সিজেনের কমতি আছে। তাইতো এমন হচ্ছে। লোকটা কাছে আসলেই তার অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে। শুধু অক্সিজেন না, এই লোকটা কাছে আসলে তার সবকিছুই দূর্বল হয়ে পড়ে। বোধশক্তি, বলশক্তি সব হ্রাস পায়। এই লোকটা কি কোনো বশীকরণ মন্ত্র জানে! যে মন্ত্র দ্বারা আমার সবকিছু অকেজো করে ফেলে সে! আদিত্যর এই বশীকরণ সফল হতে দিবেনা নূর। তাই অনেক কষ্টে কোনোরকমে বলে উঠলো,
–ক ককি করছেন? ছাড়ুন বলছি।

আদিত্য হঠাৎ নূরকে ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক সুরে বলল,
–কী আবার করছিলাম! আমি চেক করছিলাম যে, তুমি আমার স্পেশাল সিঙ্গাপুর থেকে আনা শ্যাম্পুটা নাওনি তো আবার! না মানে আমার সবকিছুই তো তোমার। চাইলে সব নাও। তবে আমার ওই শ্যাম্পু বাদে। ওটা আমি কারোর সাথে শেয়ার করবোনা। তোমার সাথেও না। এই জন্য আমি চেক করছিলাম যে, তুমি আমার সেই নিয়েছ কিনা।কেন? তুমি কী ভাবছিলে? এক মিনিট, তুমি কি ভাবছিলে আমি তোমার সাথে রোমাঞ্চ করার চেষ্টা করছি? তুমিও না, সকাল সকালই মাথায় শুধু ওসব নিয়ে ঘোরো। আরে মানুষের আর কোনো কাজ নেই নাকি? কি একটা বউ পেয়েছি আমি! সবসময় শুধু বাসর ঘোরে তার মাথায়। নাজানি আমার কী হবে! আমাকে তো পুরো শেষ করে দিবে তুমি দেখছি।

রাগে ফেটে যাচ্ছে নূর।কত্তবড় অসভ্য হলে কেউ এসব কথা বলতে পারে। মনেতো চাচ্ছে এখুনি এই লোকটাকে তার ওই শ্যাম্পুর পুরো বোতল খাইয়ে দিয়ে অজানা গ্রহে ছুঁড়ে মারতে। সকাল সকাল মেজাজ হাই করে দিলো। অসহ্য লোক একটা। নূরের এই রাগী মুখ দেখে ভীষণ মজা পাচ্ছে আদিত্য। রাগে আরও ঘী ঢেলে দিতে আদিত্য বলে উঠলো,
–বাইদা ওয়ে, সকাল সকাল গোসল করলে যে।আমার জানা মতে তো গোসল করার মতো কিছু হয়নি আমাদের মাঝে। তাহলে গোসল করলে কেন? এই এক মিনিট! তুমি আবার ঘুমের মাঝে আমার সাথে কিছু করোনিতো, যা আমি জানি না?

নূরের মাথার ভেতর যেন টগবগে গরম তেলের মতো ভলকে উঠলো। নূর রাগে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–আই সোয়্যার, আর একটা বাজে কথা বললে আপনার এই মুখ আর কথা বলার যোগ্য থাকবেনা। এসব অসভ্য চিন্তা আমার না, আপনার মাথায় ঘোরে। সকাল সকাল গোসল করা আমার অভ্যাস। আর তাছাড়া আমাকে কাজেও যেতে হবে৷ আমার নতুন অফিসের কাজ চলছে। সেটা দেখতে যেতে হবে। তাই গোসল করে রেডি হচ্ছি। এখন আর একটা কথাও যেন না শুনতে পাই আমি।

হুমকি ধামকি শেষ করে নূর রেডি হতে লাগলো সে। বাড়ি থেকে আসার সময় মা একটা ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড় দিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকেই কিছু বের করে পড়ে নিয়েছে। আদিত্য আর জ্বালালো না নূরকে। সেও ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকতে নিবে তখনই হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠল। আদিত্য ফোন নিয়ে রুমের বাইরে এসে রিসিভ করলে ওপাশ থেকে আদিত্যর লোক বলল,
–স্যার, আপনার কথা অনুযায়ী সোহান নামের ওই লোকটাকে ধরে এনেছি। এখন কী করবো? আপনি আসবেন?

আদিত্য বলল,
–না আমি আসবোনা। তোমরাই দুই চার ঘা দিয়ে ছেড়ে দাও। আর শাসিয়ে দাও, আর কখনো যেন নূরের সামনে না আসে। আমি ওর সামনে গেলে ওর মৃ,ত্যু নিশ্চিত। আর তোমরা ভালো করেই জানো, শুধু নিজের ক্ষোভ মেটাতে আমি কাউকে মারি না। আমি শুধু তাদেরই মারি যারা সমাজের কীট।

–ওকে স্যার।

ফোন রেখে দিয়ে বাঁকা হাসলো আদিত্য। তুমি এখন যেখানে খুশি যাও, যা খুশি করো নূরসোনা। আর কোনো ভয় নেই আমার। এখন সারাদেশ জানে তুমি শুধু আমার।

নূর রেডি হয়ে ব্যাগ কাঁধে রুমের বাইরে এসে করিডর দিয়ে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ পাশের রুম থেকে কারোর ঝাঁঝাল কন্ঠ শুনতে পেল। এটাযে তার বোনেরই কন্ঠ তা বুঝতে সময় লাগলোনা নূরের। কিন্তু অমালিয়া এভাবে রুঢ় হয়ে কার সাথে কথা বলছে? আদ্রর সাথে? ওদের মাঝে কী সমস্যা আছে? নূর মাথা ঝাকিয়ে এসব চিন্তা মাথা থেকে বের করতে চাইলো। স্বামী স্ত্রীর মধ্যেকার ব্যক্তিগত বিষয়ে নূর আর ইনভলভ হতে চাইলোনা। এমনিতেও অমালিয়ার ব্যপারে ভাবা সে ছেড়ে দিয়েছে। নূর সামনে অগ্রসর হতে নিলেই হঠাৎ সামনে রুম থেকে আদ্রকে বেড়িয়ে আসতে দেখলো। দুজনের চোখাচোখি হতেই দুজনেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। গত আট মাসে এটাই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। এর আগে অমালিয়া মাঝে মধ্যে বাড়িতে আসলেও আদ্রকে কখনো দেখেনি নূর। তাদের একটা সম্পর্ক থাকলেও সেটা খুবই অযাচিতভাবে হয়েছে। তাই দুজনের মাঝেই কেমন ইতস্তত ভাব কাজ করছে। নূরের চেয়ে আদ্রর অপ্রস্তুত ভাব টা বেশি। তার মাঝে যে আকাশ সমান অপরাধবোধ কাজ করছে সেই কারণেই নূরের সামনে পড়তে তার এতো জড়তা। আজ ওর জন্যই এতোকিছু হয়ে গেল। কোন লজ্জায় তার সামনে দাঁড়াবে সে। আদ্র কোনরকমে জোরপূর্বক হেঁসে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো ওখান থেকে। তবে আদ্রর চোখের মলিনতা আর তীব্র অপরাধবোধের প্রগাঢ়তা একটু হলেও টের পেল নূর। আদ্রর প্রতি তার মনের নেতিবাচক ধারণাটা কেমন পরিবর্তনের দিকে মোড় নিলো। নূরের কেমন যেন মনে হলো আদ্রর চোখে বোধহয় পানি ছিলো।ছেলেটা কি কাঁদছিল? হঠাৎ তখনই অমালিয়া দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এলো। নূরকে দেখে প্রসন্নচিত্তে হেঁসে বলল,
–আপু তোমাকে….

বাকি কথা শেষ করার আগেই নূর পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে গেল। চোখে পানি জমলো অমালিয়ার। তার বোনকে কি আর কোনোদিনও ফিরে পাবেনা?

নূর নিচে নেমে সোজা বেড়িয়ে যেতে নিলেই রেহনুমা তড়িঘড়ি করে তাকে আটকে দিয়ে বললেন,
–আরে আরে নূর, কোথায় যাচ্ছ?

নূর দাঁড়িয়ে গিয়ে নরম সুরে বলল,
–জি আমার কাজ আছে। আপনারা হয়তো জানেনই আমার কাজের ব্যাপারে। আজ আমার নিজস্ব অফিস বানানোর কাজ চলছে। সেখানে যেতে হবে।

–হ্যাঁ তো যাবে। যেখানে খুশি যাবে। তবে আগে ব্রেকফাস্ট করতে হবে। তারপর যাবে। না খেয়ে আমি কাউকে বাড়ি থেকে বের হতে দেইনা। তাই আগে খাবে তারপর যেখানে যাওয়ার যাবে।

–না আন্টি, আমার এখন খিদে নেই। আমি বাইরে কিছু খেয়ে নিবো।

নূরের মুখে আন্টি শুনে রেহনুমার একটু খারাপ লাগলো বৈকি । তবে সে বুঝতে পারছে নূরের জন্য এসব এতো সহজে মেনে নেওয়া সহজ না। সবার সাথে মিশতে, এই পরিবারকে নিজের মানতে সময় লাগবে ওর। এমনিতেও আমরা ওর উপর তেমন ইতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলিনি। আমি নিজেইতো ভুল ধারণা নিয়ে মেয়েটাকে কতো নিচু করে কথা বলেছিলাম। তো সেখানে ওই বা আমাদের আপন কীভাবে ভাববে। তারজন্য আমাদেরই চেষ্টা করতে হবে । সময়ের সাথে একদিন নিশ্চয় সবাইকে আপন করে নিবে। এসব ভেবে রেহনুমা মুচকি হেঁসে নূরের হাত ধরে নূরকে খাবার টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে বলল,
–সকাল বেলা বাসা থেকে না খেয়ে বের হওয়া একদম ঠিক না। আগে নাস্তা করো তারপর যাবে।

নূর আর না করতে পারলোনা। তাহলে বেয়াদবি দেখাবে। তাই অগত্যা নাস্তা করতে রাজি হলো সে। রেহনুমা বাবলুকে ডেকে বলল,
–শোন বাবলু, বৌমার জন্য নাস্তা নিয়ে আয়তো।

বাবলু যথারীতি তার বেকুবের ভান্ডার থেকে প্রশ্ন ছুড়ল,
–কিন্তু কার জন্য আনবো? বৌ, নাকি মায়ের জন্য। আপনি তো বৌ,মা দুইজনের জন্য নাস্তা আনতে কইলেন। কিন্তু আপনের মা তো মইরা গেছে গা। তাইলে কী তার ভুতে আইছে নাস্তা খাইতে? কিন্তু ভুতেরা নাস্তায় কী খায় আমিতো জানি না। তাইলে কী আনুম?

আবির পাশেই বসা ছিলো। সে মজা করে বলল,
–বাবলু, তুমি এককাজ করো টিকটিকি ভাজি নিয়ে এসো। ভূতেদের খুব পছন্দের খাবার। উইথ টমেটো সস।

সোফায় বসে থাকা আদিত্যর বাবা বলে উঠলেন,
–তারও দরকার নেই। তারচেয়ে বরং তুই নিজেই খাবার প্লেটে বসে পড়। শাশুড়ি আম্মা তোকে খেয়েই সবচেয়ে মজা পাবে। আর আমরাও তোর থেকে মুক্তি পেয়ে যাবো। কমছে কম শাশুড়ী দ্বারা একটা উপকার তো হবে।

এদের কথপোকথন শুনে না চাইতেও হেঁসে দিলো নূর। এই পরিবারের কিছু মানুষ মজারও আছে দেখছি। আদিত্য সেই সময়ই সিড়ি বেয়ে নেমে আসছিলো। নূরের হাসি চোখে পড়লো তার। আজ কতদিন পর যেন এক প্রশান্তিময় নিঃশ্বাস নিলো সে। বাবলুর উপর আজ খুব হিংসে হচ্ছে। ওর মতো আমিও যদি নূরকে হাসাতে পারতাম। যাক মেয়েটা হেঁসেছে এটাই বড়ো কথা। নূরের এই হাসিমাখা মুখটাইতো সে সর্বক্ষণ দেখতে চায়। আদিত্য এগিয়ে গিয়ে নূরের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। রেহনুমার চোখের কোন চিকচিক করে উঠলো। আজ তার ছেলে কতদিন পড় এই টেবিলে বসে সবার সাথে খাবার খাবে। মনটা ভরে গেল তার। তিনি নিজে হাতে ছেলে আর ছেলের বৌকে খাবার সার্ভ করলেন। খাওয়া শেষে নূর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–আমার যেতে হবে এখন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

রেহনুমা বলল,
–আচ্ছা ঠিক আছে যাও।গাড়িতে যাও, আদি তোমাকে পৌঁছে দিবে।

–না না, তার দরকার নেই। আমি একাই চলে যেতে পারবো। গাড়ি লাগবেনা আমার।

এইপর্যায়ে আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–আরে মা,বুঝছ না কেন! তোমার বৌমার কাল আমার কোলে চড়ে বদঅভ্যেস হয়ে গেছে। তাই এখন তার অন্য গাড়ি পছন্দ হচ্ছে না।

নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–হোয়াট রাবিশ,কী বলছেন এসব!

–এখুনি বুঝাচ্ছি।
বলেই আদিত্য কোনো পূর্বাভাস ছাড়া ফট করে নূরকে কোলে তুলে নিলো। কোলে নিয়ে বাইরের দিকে রওয়ানা হলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে উঠলো নূর। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত পা চালাতে লাগলো, যা বরাবরের মতোই বিফলে গেল। বাকিরা সব মিটমিট করে হাসতে লাগলো। আবির মুখে দুই আঙুল পুরে শিস বাজিয়ে বলে উঠলো,
–জিও মামা।

এসবের মাঝে বাবলু বেচারা দুঃখিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
–আহারে আমগো আদিত্য সাহেব শেষমেশ ল্যাংড়া বউ বিয়া করলো। তাইতো কোলে তুইলা হাঁটতে হইতাছে। বেচারা! তার দুঃখে শোকাহত আমি।

বাবলুর টপ লেভেলের বেকুব মার্কা কথায় হেঁসে দিলো সবাই।

চলব…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here