#শৈবলিনী—৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★স্পোর্টস সু্জ এর অ্যাড করছে আদিত্য। ক্যাম্পাসের একপাশে শুটিংয়ের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। একেক সময় একেক জোরা সুজ পরে নানান ভঙ্গিতে শুট করছে সে। উৎসুক জনতা চারিদিক ঘিরে রেখেছে তাকে দেখার জন্য। গার্ডসরা দুই হাত ছড়িয়ে অনেক কষ্টে তাদের আঁটকে রেখেছে। আদিত্য, আদিত্য করে চিল্লাচ্ছে সবাই। শুট শেষ করে চেয়ারে এসে বসলো আদিত্য। একজন স্পট বয় এসে আদিত্যের সামনে জুসের গ্লাস এগিয়ে দিলো। আদিত্য জুসটা হাতে নিয়ে এক চুমুক মুখে দিয়ে এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘোড়াতে লাগলো। নজরের সীমানায় আকাঙ্খা জাগছে কাউকে দেখার। হয়তো প্রত্যাশা করছে নূরকে আবারও দেখতে পাবে। তবে এতো মানুষের ভীড়ে সেই কাঙ্খিত মুখটা নেই ।থাকবে কী করে, ওতো ভুলেই গিয়েছিল নূর বাকিদের মতো না। কোনো সেলিব্রিটিকে দেখার জন্য ভীড়ের পেছনে ছুটবে এমন মেয়ে সে নয়। যে মেয়ে ওকে চেনেই না সেই মেয়েটার ব্যাপারে এতটুকু তো সে বুঝেই গেছে। মেয়েটার এই অনুপম চরিত্রটাই আদিত্যকে না চাইতেও বারবার নাড়িয়ে দেয়।
ভক্তদের খুশি করতে তাদের কাছে এগিয়ে গেল আদিত্য। হাত বাড়িয়ে সবার হাত ছুঁয়ে দিলো। অটোগ্রাফ, সেলফি যে যেমন পারলো লুফে নিলো। শিখাও ছিলো ভীড়ের মাঝে। আদিত্যকে দেখে সেও এক্সাইটেড হয়ে অটোগ্রাফ চাইলো। আদিত্য অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য নাম জিজ্ঞেস করলে শিখা তার নাম বলল। শিখার নাম শুনে আদিত্যর মনে পড়লো নূর তখন তাহলে এই মেয়েটার কথাই বলছিল। তারমানে এই শিখা মেয়েটাই নূরের বান্ধবী। আদিত্য কিছু একটা ভেবে শিখার উদ্দেশ্যে বলল,
–তুমি আমার অনেক বড়ো ফ্যান তাইনা?
শিখা উৎসাহিত কন্ঠে বলল,
–ইয়েস আদিত্য, অ্যাম ইউর বিগেস্ট ফ্যান। শুধু ফ্যান না, একেবারে এয়ারকন্ডিশন।
–ওয়েল,তাহলে তো তোমাকে শুধু অটোগ্রাফ দিলে চলবেনা। আমার এতবড় ফ্যান কম এসির জন্য আরও কিছু করা উচিত তাইনা? একটা কফি ট্রিট তো দিতেই পারি।
শিখার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। সে অবাক কন্ঠে বলল,
–সত্যিই? আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে। এটা তো ড্রিম কাম ট্রু হয়ে গেল।
–হুম, আমার প্রিয় ফ্যানদের জন্য এটুকু তো করতেই পারি। তুমি এখানেই দাঁড়াও আমি কাওকে পাঠাচ্ছি।
–ওকে।
আদিত্য ওখান থেকে সরে এসে একজন স্পট বয়কে সব বুঝিয়ে দিলো। স্পট শিখাকে সাথে নিয়ে আদিত্যের পার্সোনাল ভ্যানিটির (চলমান ঘর যাকে বলে, সেলিব্রিটিদের সবার জন্য আলাদা আলাদা ভ্যান থাকে) দিকে নিয়ে গেল। শিখারতো খুশিতে র,ক্ত,কনা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। দ্যা সুপারস্টার আদিত্য ওর সাথে পার্সোনালী দেখা করবে।তাও আবার নিজে থেকে বলেছে। নিশ্চয় পূর্বের জনমের কোনো ভালো কর্মের ফল হিসেবে এই বরদান পেয়েছে ও, এমনটাই ধারণা শিখার। বাকি মেয়েরা এই কথা শুনলে জ্বলে পুড়ে শিক কাবাব হয়ে যাবে। অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ শিখা। তোর মাঝে নিশ্চয় কোনো ব্যাপার আছে। আমি জানতাম একদিন তুই মা বাবার নাম উজ্জ্বল করবি। আর আজকে সেই দিন এসে গেছে। এমন গর্বিত মনোভাব নিয়েই এগিয়ে গেল সে। স্পট বয় শিখাকে আদিত্যর ভ্যানিটির দরজা খুলে ভেতর পৌঁছে দিলো। ওদিকে নূর যে ওকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে চলে এসেছে সেই খেয়াল ওর নেই। ওতো দিনদুনিয়ার সব কিছু ভুলে খেয়ে ফেলেছে। তখন শিখা ওখানে না থাকায় নূরের ভীষণ রাগ হয়েছিল। আর সেই রাগের প্রতিফলন হিসেবে শিখার মোরব্বা বানানোর উদ্দেশ্যেই খুঁজছিল শিখাকে। জানতো এখানেই পাবে ওকে। কিন্তু শিখাকে ওই ভ্যানিটির ভেতর ঢুকতে দেখে ভ্রু জোরা কুঞ্চিত হয়ে আসে তার। ভ্যানিটির দেয়ালে আদিত্যের নাম দেখে বুঝতে বাকি রইলো না এটা আদিত্যর ভ্যান। তারমানে ওই লোকটা শিখাকে নিজের ভ্যানিটিতে একা দেখা করতে ডেকেছে। কী লুইচ্চা ব্যাটা। নিজের ভক্তদের সাথেও চাঞ্চ মারছে। আবার আমাকে বলে আমার চিন্তাধারার নাকি সংশোধনের দরকার। আরে সংশোধন দরকার তার চরিত্রের । লুইচ্চা ব্যাটা আমার সহজসরল গাঁধিটারে আবার নিজের জালে না ফেলে দেয়। যতই রেগে থাকি কিন্তু শিখার কোনো ক্ষতিতো হতে দিতে পারি না আমি। ওকে বাঁচাতে হবে আমার।
আদিত্য শিখার সাথে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলছে। স্পট বয় কফি দিয়ে গেছে ওদের। শিখা কফি খাবে কী! সে কোন জগতে আছে সেটাই ঠাওর করতে পারছে না। শরীরের সব লোমকূপ গুলো যেন লুঙ্গিড্যান্স করছে। মুখের হা এর ভেতর দিয়ে একটা ফুটবল আরামছে ভেতর বাহির হতে পারবে। কথাবার্তার একপর্যায়ে আদিত্য বলে উঠলো।
–তা তোমার কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই?
–হ্যাঁ আছে তো। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমার জানু হলো নূর। আর গিয়াসও আমার ভালো বন্ধু।
–ও আচ্ছা, তা তোমার বন্ধুদের সম্পর্কে কিছু বলো। আসলে আমি বর্তমানে যে ফিল্মটা করছি সেটাতে আমি ভার্সিটির ছাত্রের চরিত্রে অভিনয় করছি।আমার স্টাডি তো বিদেশে হয়েছে। তাই দেশের ভার্সিটি লাইফ সম্পর্কে আমি বেশি বেশি ধারণা নিচ্ছি। বিশেষ করে বন্ধুমহল নিয়ে। যাতে আমার চরিত্র আরও ভালো করে ফুটিয়ে তুলতে পারি। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছিলাম।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই বলবো। আমাদের বন্ধুমহল টা ছোট হলেও অনেক অটুট। আমরা একজন আরেকজনের মনের কথা না বলতেই বুঝে যাই। মুখে মুখে একজন আরেকজনকে যতোই পচাই তবে আমাদের বন্ডিং টা অনেক ভালো।
শিখা বেচারি তো আর জানে না যে,এসব মিত্র প্রীতির গল্প শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আদিত্যর। সেতো শুধু কোনভাবে নূরের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছে। কিন্তু সরাসরি সেটা বলতেও পারছে না। আর শিখাতো বন্ধুত্বের ওপর রিতীমত তিন পৃষ্ঠার রচনা শেষ করে ফেলেছে এতক্ষণে। আদিত্য কথার মোড় ঘুড়িয়ে নূরের ওপর ট্রান্সফার করার চেষ্টায় নিয়োজিত। মাথা আর গলা খানিকটা ঝেড়ে নিয়ে বলল,
–তা নূর নামের মেয়েটার কথা যে বললে,সেকি তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু? কবে থেকে চেনো তাকে? তার সম্বন্ধে কিছু বলো।
ব্যাস এতটুকুই দরকার ছিলো শিখা নামক মোটরকে স্টার্ট দেওয়ার জন্য। এরপর সে নিজেই গরগর সব উগলে দিতে লাগলো।
–হ্যাঁ ওতো আমার জান। আমরা ইন্টারমিডিয়েট থেকেই একজন আরেকজনের বন্ধু। ভাগ্যবশত আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে চাঞ্চও পেয়ে যাই। অনেক মেধাবী, অনেক ভালো, আত্মমর্যাদাপূর্ণ, সাহসী আর বাস্তবমুখী একটা মেয়ে নূর। যাকে বলে একেবারে সর্বগুণ সম্পূর্ণা। নূরকে অনায়াসে এই ট্যাগটা দেওয়া যায়। তবে মেয়েটার জীবনে অনেক চড়াই উৎরাই দেখতে হয়েছে। এমনকি এখনো দেখতে হচ্ছে। জীবন অনেক কঠোর পরিক্ষা নিচ্ছে ওর কাছথেকে।
শিখার কথা মন দিয়ে শুনছিলো আদিত্য। মেয়েটার সম্পর্কে শুনতেও যেন রাজ্যের ভালোলাগা কাজ করছে। মনে হচ্ছে কোনো রুপকথার রাজকন্যার কাহিনি শুনছে সে। তবে শিখার শেষের দিকে বলা কথাগুলো বিরিয়ানি খাওয়ার সময় দাঁতের নিচে এলাচ পড়ার মতো মনে হলো। আদিত্য নড়েচড়ে বসলো। গাম্ভীর্যের সহিত শুধালো,
–কেন কী হয়েছে এমন?
–আসলে নূরের পরিবার মধ্যবিত্ত। নূরের বাবা নুরুজ্জামান আঙ্কেল নিজের গ্যারেজের উপার্জন দিয়েই সংসার চালাতো। তবুও হাসিখুশিই থাকতো সবাই। তবে একদিন নুরুজ্জামান আঙ্কেল হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। নূর তখন মাত্র প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নূরের পরিবার ভেঙে পড়ে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি মারা যাওয়ায় পুরো পরিবার অকুল পাথারে পরে যায়। তখন নূর নিজের কাঁধে সব দায়িত্ব তুলে নেই। সংসারের খরচ আর ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব পালন করতে নূর ওর বাবার গ্যারেজ চালু করে। কিছুদিন কাজ শিখে নিজেই চালায় সেই গ্যারেজ। গ্যারেজের কাজ করে, পরিবারের সব ঝায়ঝামেলা সামলে আবার পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে হয় ওকে। ওর বাবার স্বপ্ন ছিল নূরকে অনেক বড়ো ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। তাইতো এতো কষ্টের মাঝেও নূর পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এতকিছুর পরও ওর মুখে কখনো কোনো অভিযোগ নেই। সি ইজ আ রিয়েল ফাইটার।
এতক্ষণ সব শুনে গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল আদিত্যর। আবেশে বুজে নিলো আদিত্য। চোখের সামনের অন্ধকার চিড়ে ভোরের কিরণের মতো ভেসে উঠলো নূরের অবয়ব। শুভ্র সাদা মেঘের ন্যায় শুভ্রতায় ঘেরা এক অনন্যা সে। বুকের বা পাশের খাঁচায় বন্দী হৃদপিণ্ডটা হঠাৎ করে বিদ্রোহ শুরু করলো। খাঁচা ভাঙার জোর দাবিতে দাপাদাপি করছে যেন। আনমনেই বিড়বিড় করে আদিত্যর মুখ থেকে বের হলো,
–শৈবলিনী।
শিখাকে বিপদের মুখ থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে আদিত্যর ভ্যানের দিকে অগ্রসর হলো নূর। শিখার সাথে খারাপ কিছু করলে ব্যাটা নায়ককে সে মেরে মেরে ফাটা পোস্টার বানিয়ে দেবে। এমনই মনোবল নিয়ে হিংস্র বাঘিনীর মতো এগুলো সে। ভ্যানের বাইরে দরজার পাশে চেয়ারে বসা ছিলো জিদান। আদিত্যর ভ্যানের বাইরে থেকে সে খেয়াল রাখে কেউ যেন বিনা অনুমতিতে ভেতরে ঢুকতে না পারে। সামনে থেকে নূরকে ওভাবে আসতে দেখে জিদান চকিত নজরে তাকালো। এই কুমিরের সরদারনী এখানে কী করছে? স্যারকে আবার কিছু করতে আসেনি তো? এই মেয়ের কোনো ভরসা নেই। নূর যতো কাছে আসছে জিদানের হাঁটুর নিচের শক্তি ততই কমে যাচ্ছে। ঠকঠক করে কেঁপে কেঁপে এক হাটু আরেক হাঁটুর সাথে বারি খাওয়ার উপক্রম। তবুও নিজেকে সাহসী রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। স্যারকে যে ওকেই এই কুমিরের সরদারনীর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। নূর এসে ভ্যানের দরজার সামনে যেতে নিলেই জিদান নূর আর দরজার মাঝে দাঁড়িয়ে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলল,
–এক মিনিট! কোথায় যাচ্ছেন আপনি? ভেতরে যাওয়া নিষেধ।
–এই ব্যাটা পাতিহাঁস, সর এখান থেকে। আমি ভেতরে যাবোই। কোনো মায়ের লাল ঠেকাতে পারবেনা আমাকে। তোর স্যারকে তো আজ ঘেঁচুখেত দেখিয়েই ছাড়বো। সর বলছি।
–না না কক্ষনো না। আমার দেহে একবিন্দু র,ক্ত থাকতে আমি আমার স্যারকে কিছু হতে দেবো না। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যাবো। আপনাকে যেতে হলে আমার লা,শের ওপর দিয়ে যেতে হবে।
হিমালয় পর্বত সমান বিরক্তিতে নূরের মাথা আরও গরম হয়ে গেল।ওই নায়কের আগে এই নমুনাটাকেই শায়েস্তা করতে ইচ্ছে করছে। নূর কিছু একটা ভেবে হঠাৎ উপর দিকে এক হাত উঠিয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
–আরেহ,ওটা কী??
জিদানও নূরের ইশারা বরাবর সেদিকে তাকালো। সেই সুযোগে নূর জিদানের হাতের নিচ দিয়ে সুরুৎ করে পেছনে চলে গেল। জিদানকে হালকা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। তারপর দরজায় আক্রমণ শুরু করলো। ভ্যানিটির দরজায় করাঘাতের তীব্র শব্দে আদিত্যের ধ্যান ভঙ্গ হলো। চোখ মেলে তাকালো সে।এভাবে কে দরজায় নক করছে? মনে হচ্ছে দরজা ভেঙেই ফেলবে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো আদিত্য। বাঁধের গেট খুলে দিলে যেমন পানির প্রলয় উপচে পড়ে, তেমনই দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকলো নূর। এতটাই হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো যে সামনে কী ছিলো না ছিলো সেটা দেখারও টাইম ছিলোনা তার। আর হঠাৎ নূরের এভাবে হুমড়ে পড়ায় আদিত্যও নিজের ব্যালেন্স রাখতে পারলোনা।ফলস্বরূপ চোখ দুটো বড়সড় করে দুই হাত ঝাপটাতে ঝাপটাতে পেছনের বেডের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে গেল সে। তবে একা পড়লোনা সঙ্গে নূরকে নিয়েই পড়লো। নূরও কার্পেটের সাথে পা বেজে আদিত্যকে নিয়ে পড়ে গেল। আদিত্যর বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো নূর। ঘটনায় আকস্মিকতায় থমকে গেল আদিত্য।নূরের এলোকেশী কেশগুচ্ছ আদিত্যর মুখমন্ডলে চাদরের ন্যায় ছেয়ে গেল। নজরের সীমানার সামনে এলো নূরের ওই দুই জোরা ডাগরআঁখি। ওই চোখের গভীরতা বোধহয় কোনো সাগরের থেকেও বেশি। নাকে এসে লাগলো নূরের চুলের মনমাতানো সুবাস।নূরের শরীর থেকেও মিষ্টি একটা সুবাস পাচ্ছে। মারাত্মক নেশা ধরানো সেই ঘ্রাণ। আদিত্যর চারপাশের সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে কেমন। সে যেন হারাচ্ছে কোথাও। বুকের বাম পাশের যন্ত্রটা তার বিদ্রোহ আরও জোরদার করছে। সমানে গোলা বারুদ ছুড়ছে বক্ষপিঞ্জরে। সেতো ভাবতো শুধু ফিল্মেই বুঝি এমন হয়। ওর ফিল্মেও এমন সিন অনেকবার হয়েছে। তবে এই অনুভূতি গুলো তখন তো একেবারেই শূন্য ছিলো। আজ কেন এমন লাগছে? এতটা ভালো লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে এই মুহূর্ত টা যেন কখনো শেষ না হয়?
নূর ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেল এমন একটা অবস্থায় পড়ে। সে আদিত্যর দুই পাশে বিছানায় ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো। ঠিক তখনই জিদান ভেতরে এসেই একুল,ওকুল না দেখে গগনবিদারী এক আর্তনাদ করে উঠলো।
–স্যারররররররর….. নাআআআআআ…..আমি আপনাকে বাঁচাতে পারলাম না….. স্যাররর… এই জীবন রেখে এখন কী করবো আমি…
জামাই মরে যাওয়া মহিলাদের মতো ফ্লোর চাপড়ে চাপড়ে আর্তনাদ করতে লাগলো জিদান।
জিদানের চিৎকারে ঘোর কাটলো আদিত্যর। নূরও তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লো। আদিত্যর চরম পরিমান রাগ হলো এই জিদানের ওপর। ওর কী সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করে দিলো ইডিয়ট টা।আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–শাট আপ ইডিয়ট, কী আবোলতাবোল বলছ?
আদিত্যকে সহিসালামত দেখে জিদান বিধাতাকে লাখ লাখ শুকরিয়া জানিয়ে বলে উঠলো।
–স্যার আপনি বেঁচে আছেন। আমারযে কী খুশি লাগতাছে।
–বেঁচে আছেন মানে কী? আমার আবার কী হবে?
–কেন এই মেয়েটা কিছু করেনি আপনাকে? আমিতো ভেবেছি আপনার শত্রুরা বুঝি এই গুন্ডি মেয়েটাকে হায়ার করেছে আপনাকে মারার জন্য।
আদিত্য নূরের পানে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
–সত্যি নাকি মিস নূর? আপনি কী আমাকে মারার চুক্তি নিয়েছেন? তা বললেই হতো। আমি স্বেচ্ছায় আমার ধর আপনার হাতে দিয়ে দিতাম।
নূর দম্ভীকতার সহিত বলল,
–নূর কখনো কারোর আন্ডারে বা কারোর আদেশে কাজ করে না মিঃ নায়ক। আপনাকে মারার হলে আমি আমার নিজের দরকারে মারবো। অন্য কারোর জন্য নয়। তার আগে আপনি বলুন, আপনি আমার বান্ধবীকে এখানে একা ডেকেছেন কেন? কী মতলব আপনার? দেখুন আপনি যা খুশি তাই করেন তাতে আমার নিক (উকুনের ডিম) পরিমানও যায় আসে না। কিন্তু আমার বান্ধবীকে নিজের ট্র্যাপে ফেলানোর চেষ্টা করলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
আদিত্যর সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
–জাস্ট ফিনিস করে দেব আপনাকে। এন্ড আই মিন ইট।
আদিত্য শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূরের পানে। নূরের এতগুলো কথার প্রতিত্তোরে কেবল কিঞ্চিত রহস্যময় হাসলো। শিখা এতক্ষণ ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে সব দেখে যাচ্ছিল। এখানে আসলে হচ্ছে টা কী সেটাই তার বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে নূরের কথায় বুঝলো নূর হয়তো ওদের ভুল বুঝছে। তাই সে নূরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আরে নূর, তুই ভুল বুঝছিস। এমন কিছুই না। আদিত্য তো আমাকে শুধু ক…
–তুই চুপ কর। একটা কথাও বলবিনা। তোকে তো পরে দেখে নিচ্ছি। তোর সাথে আমার অনেক বোঝাপড়া আছে। চল এখান থেকে।
শিখাকে বলার সুযোগ না দিয়ে শিখার হাত ধরে একবার আদিত্যর তাকিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে গেল নূর।
জিদান আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
–স্যার, এখন আমাদেরও যাওয়া উচিত।
–হুম চলো।
আদিত্য বেডের ওপর থেকে ফোনটা নিতে গেলেই কিছু একটা চোখে পড়লো ওর। ভালো করে খেয়াল করে দেখলো ছোট্ট একটা কানের দুল। হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরলো আদিত্য। এটা নিশ্চয় নূরের হবে। তখন কান থেকে পড়ে গেছে হয়তো। দুলটা হাতের তালুতে নিয়ে নাকের ডগায় ধরতেই আবারও নূরের চুল আর শরীরের লোমহর্ষক ঘ্রাণটা পেল। আবেশে নেত্রপল্লব বন্ধ করে নিলো সে। কিছুক্ষণ পর আঁখি যুগল খুলে দুলটার দিকে তাকিয়ে থেকে আদিত্য জিদানের উদ্দেশ্যে বলল,
–আমার নতুন ফিল্মের আর্ট ডাইরেক্টরকে বলবে। আমার এই লোকেশনটা অনেক পছন্দ হয়েছে। কাল থেকে এখানে শুটিংয়ের ব্যাবস্থা করতে।
আদিত্য দুলটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বেড়িয়ে গেল। জিদানের মাথায় হাত। ওর স্যার জেনেশুনে কুমিরের সরদারনীর সামনে কেন থাকতে চাচ্ছে এটাই খুঁজে পাচ্ছে না সে।
চলবে….
(